আজ আমি তোমাদের আমার জীবনের ঘটে যাওয়া একটি স্মরণীয় গল্প শুনাবো। সময়টা ছিল ঠিক ২০১৯ সাল, তখন আমি মাত্র অষ্টম শ্রেণিতে পড়ালেখা করি। হঠাৎ করে একদিন আম্মু আমরা সবাই মিলে ওমরাহ করতে সৌদি আরব যাবো। আমরা সবাই বলতে আমি আম্মু আর ভাইয়া। আব্বু তখন সৌদি আরব থাকতেন। আব্বুর সাথে সেখানে সাক্ষাৎ হবে আমাদের। একে একে প্রস্তুত হতে থাকলো আমাদের যাওয়ার জন্য কাগজপত্রগুলো। দিন তারিখ ঠিক হয় গেল আমাদের যাওয়ার।
আমাদের ফ্লাইট ছিল ২৩ মে ২০১৯ইং তারিখে সকাল ১০টা হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে। তখন সময়টি ছিল রমজান মাস। আমরা সৌদি আরব যাওয়ার একদিন আগেই ঢাকার পথে রওনা হলাম। ঢাকা যাওয়ার সময়ে ছিল অন্য রকম আরেকটি মজার ঘটনা। আমরা ঢাকায় যাতায়াত করি সাধারণত বাসে করে। কিন্তু তখন আমরা প্রথম লঞ্চে করে ঢাকার পথে রওনা হলাম। আমি আরেক সময়ে আমি লঞ্চে যাওয়ার মজার গল্পটা তোমাদের শুনাবো। ঢাকা যেতে যেতে আমাদের বিকেল হয়ে যায়। যেহেতু রমজান মাস ছিল, রোজা রেখে আমার যেতেও অনেক কষ্ট হয়। আগে থেকে আম্মু খালামণিকে জানিয়ে দিয়েছেন আমরা খালামণিদের বাসায় থাকবো।
আমরা ইফতারের কিছুক্ষণ আগেই তাদের বাসায় গিয়ে পেছাই। আমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে ইফতারের জন্য তাদের ডাইনিং টেবিলে গিয়ে দেখি সব মজার মজার খাবার খালামণি তৈরি করেছে আমাদের জন্য। আমি খেয়েছি অনেক। যাইহোক পরদিন সকাল ১০টায় ছিল আমাদের ফ্লাইট। আমরা সাহরি করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, সকাল ৭টা বাজে সবার থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলাম এয়ারপোর্টে উদ্দেশে। এয়ারপোর্টে যেতে যেতে সকাল ৮টা বেজে যায়। যেহেতু এয়ারপোর্টে আমরা একদমই নতুন ছিলাম তাই কিছুই চিনতে পারছি না। কিছু মানুষকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম ব্যাগগুলো কোথায় কিভাবে দেয়। আমরা আমাদের ব্যাগ জমা দিয়ে রওনা হলাম ইমিগ্রেশন কমপ্লিট করার জন্য। আমাদের এক ঘণ্টা ইমিগ্রেশন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল।
ইমিগ্রেশন শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ৯টা ৩০ মিনিট। আমরাও তাড়াতাড়ি করে যেতে শুরু করি আমাদের বিমানের দিকে। বিমান কর্তৃপক্ষ আমাদের টিকিট দেখে আমাদের বসার স্থান দেখিয়ে দিল। আমার আর আম্মুর আসন পাশাপাশি, ভাইয়ার আসন একটু দূরে পড়ছে। কিছুক্ষণ পরে জানিয়ে দেওয়া হলো বিমানের কিছু সমস্যার কারণে আমাদের বাহারাইনে ল্যান্ড করবে এবং তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। এর ভিতরে বিমানের কেবিনক্রুরা আমাদের খাবার দিয়ে যায়, খাবারে ছিল ভাত মুরগির মাংস আর একটি ৭ঁঢ়। যেহেতু আমরা রোজা ছিলাম তাই খাবারগুলো ব্যাগে রেখে দিয়ে ছিলাম। প্রায় পাঁচ ঘণ্টা বিমানযাত্রার পরে আমরা বাহরাইন এয়ারপোর্টে পৌঁছাই। বাহরাইন এয়ারপোর্টের ভিতর আমরা আসরের নামাজ পড়ে ওমরাহর উদ্দেশে ইহরাম বাঁধা শুরু করি। কিন্তু আমরা পড়তে পারছিলাম না, পরে এক দাদু হাসতে হাসতে এসে আমাকে পরিয়ে দিল।
একটু পরেই এয়ারপোর্টে অ্যানাউন্স করা হলো আমাদের বিমান যাত্রার জন্য তৈরি। আমরা বিমানে উঠতে শুরু করলাম সবাই। বিমানে উঠার কিছুক্ষণ পরেই মাগরিবের আজানের ধ্বনি শুনা গেলো। আমরা বিমানে দেওয়া খাওয়াগুলো খেতে শুরু করি, এর ভিতরে আবার বিমানে নতুন করে খাওয়া দিতে শুরু করে। খাওয়াগুলো অনেক অনেক মজার ছিল। কিন্তু আমি বেশি কিছু খেতে পারি নাই, এর অন্যতম কারণ ছিল অনেক দীর্ঘতম যাত্রা সাথে রোজা অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল প্রায় উনিশ ঘণ্টা রোজা থাকতে হয়েছিল আমাদের। যাইহোক বাহরাইন থেকে প্রায় এক ঘণ্টা ত্রিশ মিনিটের যাত্রা শেষে সৌদি আরব গিয়ে আমরা পেঁৗঁছি।
আমাদের আগে থেকে ঠিক করে রাখা মক্কা নগরীতে আমাদের হোটেলে উঠলাম। আম্মু আব্বুর জন্য একটি রুম আমি আর ভাইয়ার জন্য অন্য আরেকটি রুম। আমরা সবাই মিলে ওমরাহ পালন করব। পরের দিন ইফতার আমরা কাবাঘরের পাশে বসে করেছি। কিছুক্ষণ পরপর মানুষ আমাদের খেজুর দিতে ছিল। এতো এতো খেজুর জমা হয়েছে কী বলবো, খেজুর খেয়েই আমার পেট ভরে গিয়েছে।
মক্কা নগরীতে আমরা ছিলাম সাত দিন। এই সাত দিনে আমরা মহানবী সা. আবু বকর রা. কে সাথে নিয়ে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করে যাওয়ার সময় যে গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই গুহা পরিদর্শন করেছিলাম। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর উপর প্রথম ওহি নাজিল হওয়া সেই বিখ্যাত হেরা গুহা দেখতে গিয়ে আমি উঠতে চেয়েছিলাম কিন্তু আব্বু আম্মু উঠতে দিলেন না। গুহা অনেক উঁচু ছিল বলে উঠতে দেয় নাই। তখন আমার মনের কোণে কষ্ট জমা হতে শুরু করে এই কথা ভেবে যে, আমাদের প্রিয় নবী করিম সা. কত কষ্টই না করেছেন নিজের উম্মতের জন্য, কত কষ্ট করে না এখানে তিনি উঠতেন।
এরপর গেলাম মহানবী সা. যে পাহাড়ে দাঁড়িয়ে বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন সেই পাহাড়ে। আমরা গিয়ে দেখি কিছু মানুষ পাহাড়কে ঘিরে নামাজ পড়ছে এবং সেজদা দিচ্ছেন। দেখে খুবই কষ্ট লাগলো, কিন্তু সেখানে স্পষ্ট নিষেধ ছিল বাংলা ইংরেজি এবং আরবিসহ প্রায় সকল ভাষায় এখানে সেজদা না করার। এরপরও কিছু মানুষ না শুনে কাজগুলো করে যাচ্ছিল।
তারপরে আমরা গেলাম আরাফাতের ময়দানে। আমরা মক্কা নগরীতে যে সাত দিন ছিলাম আমরা চেষ্টা করেছি প্রতি ওয়াক্ত কাবা ঘরে গিয়ে নামাজ আদায় করতে। আট দিনের দিন আমরা মক্কা নগরী থেকে মদিনার পথে রওনা হলাম। আসরের নামাজের একটু পরেই আমরা মদিনায় গিয়ে পৌঁছেছি। সেই দিন আমরা মাগরিব নামাজ পড়তে মদিনা শরিফে চলে গেলাম। মহানবী সা.-এর রওজা দেখে মন শীতল হয়ে গেল। আমরা ইফতার সেখানেই করেছি। কত বাহারি ধরনের খাবার, এর মধ্যে সবচেয়ে কষ্টদায়ক বিষয়টি হলো এখানকার মানুষগুলো কত ধরনের খাবারই না অপচয় করে! কিন্তু কত মানুষ না খেয়ে প্রাণ হারায়। আমরা ছিলাম পাঁচ দিন মদিনায়, এই পাঁচ দিনে সকল ওয়াক্ত নামাজ আমরা মদিনা শরিফে পড়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। তার সাথে সাথে আমাদের জন্য ও পরিবারের সকলের জন্য কিছু কেনাকাটাও করেছি।
আনন্দময় সময়গুলো যেন দ্রুত চলে যায়। বলতে না বলতে এক দিন ফিরার সময় চলে এলো। মহানবী সা.-এর রওজাকে চোখের পানিতে বিদায় দিয়ে চললাম এয়ারপোর্টের দিকে। বাবাও আমাদের বিদায় দিতে এয়ারপোর্টে এসেছিল। বাবাকে আমরা চোখের পানিতে বিদায় দিয়ে চলে আসলাম নিজের জন্মভূমিতে।
এই ছিল আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া সুন্দরতম একটি ঘটনা।
Share.