কাশ্মির টু লাদাখ রোড। সোনমার্গ যেতে হলে এই রোড ধরেই এগোতে হয়। কাশ্মিরের শ্রীনগর থেকে সোনমার্গ প্রায় ৮৩ কিলোমিটার দূরে, গাড়িতে সময় লাগে তিন ঘণ্টা। আমরা দশজনের একটি টিম রিজার্ভ গাড়িতে সকাল ৯টায় রওনা হলাম গন্তব্যস্থল সোনমার্গের উদ্দেশে। আমাদের কাশ্মির ভ্রমণের তৃতীয় দিনের নির্ধারিত স্থান সোনমার্গ। আজকের পরিবেশটা চমৎকার, জার্নিটাও ভালো লাগছিলো। চারিদিকের চোখধাঁধানো সৌন্দর্য মনকে প্রশান্ত করে দিচ্ছিলো। যাত্রাপথের বিশেষ আকর্ষণ ছিলো- এর পাশে দিয়ে বয়ে যাওয়া স্রোতস্বিনী সিন্দ নদী। অসম্ভব সুন্দর একটি নদী। পাথরের গা বেয়ে চলছে ঝিরিঝিরি পানির প্রবাহ। দু’ধারে সবুজ পাহাড়। পাথরের বুকে আছড়ে পড়ছে জল। আহা এমন স্বর্গীয় অনুভূতি- এর আগে কোনো দিন দেখা হয়নি। অসম্ভব ঠাণ্ডা এর পানি। নদীতে নেমে অনেক ছবি তুলে নিলাম। কেউ কেউ ভিডিও করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমি বিভিন্ন রঙের ছোট ছোট কিছু নুড়ি পাথর কুড়িয়ে নিলাম। পাথরগুলো যে কারোর মন কাড়বে! প্রায় ১০৮ কিলোমিটার লম্বা এই নদীটি হলো ঝিলাম নদীর উপনদী। জম্মু-কাশ্মিরের একমাত্র নদী যেখানে তিনটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে। ভয়ঙ্কর স্রোতের পাশে তাল মিলিয়ে গাড়িতে করে ছুটে যেতে যেতে তার শাঁ শাঁ শব্দ একটা মোহ ধরিয়ে দিয়েছিলো। জীবনটাকে অন্যরকম সুন্দর লাগছিলো। এতো ভালো লাগাগুলোকে কোনো মূল্য দিয়েই বিচার করা যায় না।
আমি ভেবেছিলাম পাহাড়ে যাচ্ছি, না জানি রাস্তার মধ্যে কতবার ঝাঁকি খেতে হবে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিলো কাশ্মির। এতো চমৎকার পিচঢালা রাস্তা পাবো এটা আমি কল্পনা করিনি। শহর থেকে মাত্র তিন ঘণ্টার দুর্দান্ত পথ। উত্তর-পূর্বে গন্দারবাল এলাকার হিল স্টেশন হচ্ছে সোনমার্গ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৭৩০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। আকাশের বিপরীতে রয়েছে তুষার ঢাকা পাহাড়। গন্দারবাল, কঙ্কন, গুন্দ বিভিন্ন পাহাড়ি জনপদ পেরিয়ে গাড়ি এগোচ্ছে। এই উপত্যকার কোথাও একটা লেক আছে যার জল থেকে সোনালি রঙ ছড়িয়ে পড়ে। এই জন্য নাম হয়েছে সোনমার্গ অর্থাৎ সোনালি উপত্যকা। সোনমার্গ থেকে পায়ে হেঁটে বা ঘোড়ায় চেপে পৌঁছে যাওয়া যায় হিম পাহাড়ে।
দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে। মাঝপথে একটা রেস্টুরেন্ট দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। হোটেলে বয়গুলো অসাধারণ। ওদের নমনীয় ব্যবহার আমাদের মুগ্ধ করলো। আমরা বাংলাদেশি জানার পর আমাদের প্রতি তাদের ভালোবাসা আরো বেড়ে গেলো। কাশ্মিরিরা বাংলাদেশিদেরকে খুব পছন্দ করে। আমাদের সাথের কয়েকজন খাওয়া শেষ করে পাশের দোকানে কাশ্মিরি শাল কিনতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে আবার ছুটে চললো আমাদের গাড়ি লক্ষ্যপানে। গাড়ির ড্রাইভার বেলাল ভাই। খুবই আন্তরিক মানুষ। কাশ্মিরের চারদিনের সফরের সঙ্গী আমাদের। নরম দিলের মানুষ। কোনো ছলচাতুরী নেই। ভ্রমণের সব কাজে আমাদের যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন তিনি।
দূর থেকে বরফে আবৃত পাহাড়গুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকে। সাদা পাহাড়ের ওপর তখন সোনালি রোদ পড়েছে। কেমন চকচক করে উঠলো পাহাড়গুলো মুহূর্তে। চারপাশে সবুজ আর সাদা পাহাড়ের অসাধারণ মিতালি। সারা জীবন শুধু সবুজ দেখে এসেছি। জীবনে এই প্রথম এতো কাছ থেকে সবুজের মাঝে সাদা পাহাড় দেখছি। এতো সুন্দর! এতো মোহনীয়! এতো নয়নাভিরাম! আমরা তখন কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখি অবস্থা। গাড়ি থেকে অনেকে অপরূপ সৌন্দর্য ক্যামেরায় বন্দি করে নিচ্ছে। এরই মাঝে আমরা সোনমার্গ উপত্যকায় চলে এসেছি। গাড়ি থেকে নেমে দেখি চতুর্দিকে বরফে আচ্ছাদিত বড় বড় পাহাড় মাথা উঁচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয়, শুভ্র বরফের ঘোমটা পরিয়ে নবরূপে সেজেছে পাহাড়গুলো। এমন মনোরম সৌন্দর্য দেখে কবি মতিউর রহমান মল্লিকের সে বিখ্যাত গানটি মনে পড়ে গেলো-
“তোমার সৃষ্টি যদি হয় এত সুন্দর
না জানি তাহলে তুমি কত সুন্দর
সেই কথা ভেবে ভেবে কেটে যায় লগ্ন
ভরে যায় তৃষিত এ অন্তর।”
ঘড়িতে তখন একটা বাজে। গাড়ি থেকে নেমেই দেখলাম আরো অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। বুঝলাম এটাই সেই পয়েন্ট যেখানে গাড়ি থেকে নেমে ঘোড়া নিতে হয়। কাশ্মিরের সবগুলো ট্যুরিস্ট স্পটই এই সিস্টেমের। গাড়ি একটা নির্দিষ্ট পয়েন্টের পরে আর যাবে না, মানে আর গাড়ি চলার রাস্তা নেই। সেখানে থেকে ঘোড়ায় চড়ে যেতে হবে কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। সেই ঘোড়ায় চড়াকেই কাশ্মিরি ভাষায় বলে পনির রাইড। খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি টাইপের অবস্থা। গাড়ি ভাড়া লাগে জনপ্রতি ৩৫০ টাকা আর ঘোড়া ভাড়া লাগে ৭০০-৮০০ টাকা।
অনেককেই দেখলাম পায়ে হেঁটে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরাও স্থির হলাম পায়ে হেঁটে যাবো। এর মধ্যে গামবুট নিয়ে নিলাম। এখানে ভাড়ায় সব পাওয়া যায়। গামবুট, ওয়াটারপ্রুফ জ্যাকেট, ট্্রাউজার ইত্যাদি। গামবুট ব্যতীত বরফের পাহাড়ে হাঁটা মুশকিল। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পায়ে হাঁটারও সুন্দর রাস্তা রয়েছে। ব্যস, পায়ে পায়ে এগোতে শুরু করলাম ফাহিম, জুয়েল, মাসুম ও শারমিন আন্টিসহ আমরা কয়েকজন। বাপ্পি ভাই, রাফসান ও রিফাতসহ বাকিরা অন্য পথে হাঁটতে শুরু করলো। পথে অনেক ঘোড়াওয়ালা খুব করে অনুরোধ করছিলো তাদের ঘোড়ায় চড়ার জন্য। অনেক রকম ছাড় দেয়ার কথা বলছিলো। কাজ না হওয়ায় শেষে ভয় দেখাচ্ছিলো যে অনেক কষ্ট, আমরা পায়ে হেঁটে যেতে পারবো না হাবিজাবি… কে শোনে কার কথা। হেঁটে যেতে আমার ভালোই লাগছিলো। সবুজের গালিচা ধরে টিপটিপ পায়ে হেঁটে চলা, মন্দ কী। হিম পাহাড়ে যতই এগিয়ে চলছি ততই আকর্ষণ বাড়ছে। আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যেখানে ‘বাজরাঙ্গি ভাইজান’ সিনেমার শ্যুটিং হয়েছে সেখানে যাবো; কোনো ভাবেই মিস করা যাবে না। তাই বরফ ঢাকা সাদা পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করলাম। খানিকটা ওঠে হাঁফিয়ে গেলাম। মাঝ পাহাড়ে দেখা মিললো আরো কয়েক পর্যটকের সাথে। ওনারা আসছেন গুজরাট থেকে, আরেক গ্রুপ আসছে উত্তরপ্রদেশ থেকে। তাদের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা হলো, ভাব বিনিময় হলো। প্রায় ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর পাহাড়ের অপর প্রান্তে দেখা মেলে সোনমার্গের পাশে দিয়ে বয়ে চলা সিন্দ নদী। নদীর বয়ে চলার ধ্বনি যে কারো ক্লান্তি দূর করিয়ে দিতে পারে। আমি কিছুক্ষণ নদীর পাড়ে বসে ছিলাম।
ভয় রোমাঞ্চ সব মিলিয়ে হিম পাহাড়ে পৌঁছলাম। পর্যটকেরা খুব মজা করছেন। স্কেডিং করছেন। একে অন্যকে বরফ ছুড়ে মারছেন। মাঝখানে সবুজ সমতল ভূমি থাকলেও চারপাশের পাহাড় কেবলই বরফ দিয়ে ঢাকা। এতো চমৎকার জায়গায় দাঁড়িয়ে কেবল সুন্দর উপভোগ করতে হয়। বরফে গড়াগড়ি দিচ্ছে কেউ। কেউ টানা দিয়ে উঠছে উপরের দিকে। স্থানীয়রা একটি গাড়ি বানিয়েছে; ওতে পর্যটকদের বসিয়ে উপরে ওঠায় রশি দিয়ে টেনে আবার পেছনে বসিয়ে নিচে নেমে আসে দ্রুত। আমরাও ছোট বেলার বরফ পানি খেলায় মেতে উঠলাম। বরফে মজা করতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে আমারও প্যান্ট ময়লা হয়ে গিয়েছে। অবশেষে ময়লা প্যান্ট নিয়েই রুমে ফিরতে হলো।
পাশেই লেকের পানিতে বরফ গলে পড়ছে। সেখানে পা ডোবাতেই এক অদ্ভুত ভালো লাগায় মজে গেলাম। পশ্চিমে সূর্য হেলে পড়ছে তার আভা এসে পাহাড়ের শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। সূর্যের আলোর বিকিরণের সাথে সাথে বরফে ঢাকা পাহাড়েরও রূপের পরিবর্তন ঘটছে। রাতের মধ্যে ফিরতে হবে শহরে, কাশ্মিরি কাওয়া (বিশেষ চা) পান করে রওনা করলাম। পেছনে রেখে এলাম অপরূপ সৌন্দর্যের হাতছানি পাহাড় আর বরফের উপত্যকা সোনমার্গ।
ফেরার পথে শ্রীনগর শহরে ঢুকতে চোখে পড়লো কাশ্মির বিশ^বিদ্যালয়। শুরুতেই বিশাল আকৃতির মাওলানা রুমি নামে গেইট। ভিতরে ঢুকেই একজন অধ্যাপকের সাথে দেখা। তাঁর কাছ থেকে জানা গেলো, ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশ^বিদ্যালয়ের আয়তন ২৬৩ একর। ১১টি অনুষদের অধীনে প্রায় ৫০টি বিভাগ রয়েছে। ২৫টির মতো বিভিন্ন সহশিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে। আল্লামা ইকবাল নামে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগারও রয়েছে এই বিশ^বিদ্যালয়ে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশসহ অন্য দেশ থেকেও এখানে পড়তে আসেন অনেকে। পাশেই অবস্থিত হজরত বাল মসজিদ। এটি কাশ্মিরের দর্শনীয় স্থান হিসেবেও পরিচিত। ধর্মস্থানটির নামকরণ করা হয়েছে উর্দু শব্দ ‘হজরত’ থেকে যার অর্থ ‘শ্রদ্ধেয়’ এবং হিন্দি শব্দ ‘বাল’ এর অর্থ হল ‘চুল’। জানা যায়, একজন সাহাবি ভারতবর্ষে এসে এখানে অবস্থান করেছিলেন। তাঁর সাথে হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর একটি চুল মোবারক ছিলো। সেটি বর্তমানে এই মসজিদেরই একটি সংরক্ষণ কক্ষে রাখা হয়েছে। প্রতি মাসের কোন এক জুমা বার রাসূল (সা.)-এর চুল মোবারক মুসল্লি ও দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। রাসূল (সা.)-এর চুল মোবারক দেখা জন্য কোন কোন জুমা বার লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়ে থাকে।
হযরত বাল মসজিদ কমপ্লেক্সটি ডাল লেকের পাড়ে অবস্থিত। সন্ধ্যায় এখানে ব্যাপক জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়। মসজিদ ও মাজারকে কেন্দ্র করে পসরা বসে হরেক রকম দোকানের। এখানের রুটি ও হালুয়া প্রসিদ্ধ খাবার। বিশাল আকৃতির রুটি তৈরিতে ব্যস্ত কারিগররা। রুটিগুলো কেটে কেটে কেজি হিসেবে বিক্রি করা হয়। সাথে নানা স্বাদের হালুয়া ও মিষ্টান্ন পাওয়া যায়। আমরা সবাই মিলে রুটি আর হালুয়া খেলাম। বেশ মজাদার। মন চাইছে, দেশে আসার সময় কিছু রুটি আর হালুয়া নিয়ে আসি। আশপাশের মার্কেটগুলোতে অনেকে কেনাকেটায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সমজিদ প্রাঙ্গণে স্থানীয়দের খেলাধুলা করতে দেখা গেলো। যারা কাশ্মির ভ্রমণ করবেন, বিশেষ করে সোনমার্গ যাবেন ফেরার পথে সন্ধ্যার পর এই স্থানটি ঘুরে আসতে ভুলবেন না।
Share.