শিকার করতে এসে কি ওরা নিজেরাই শিকার হয়ে গেলো? এ গভীর জঙ্গলে ওদের কোথায় খুঁজবে আমিন ইয়ামিন। এদিকে সূর্য ডুবতে শুরু করেছে।
ভয়ঙ্কর জঙ্গল মাসাইমারা। আফ্রিকার এ জঙ্গলের নাম শুনলে অনেক বড় বড় শিকারির মুখও ফ্যাকাসে হয়ে যায়। কেন যে ওরা এ ভুল করলো। বাংলাদেশ ছেড়েছে শিকারের নেশায় আফ্রিকার কেনিয়ার মৃত্যুকূপ মাসাইমারা আসার কী দরকার ছিল। আমিন ইয়ামিন ভাবতে পারছে না। ওর সব রাগ গিয়ে পড়ছে বিভূতিভূষণ রায়ের ওপর। তার বিখ্যাত কিশোর থ্রিলার ‘চাঁদের পাহাড়’ পড়ার পরই মেহেদী, নাহিদ আর লাবিলের শংকরের মতো হিরো হওয়ার ইচ্ছে হয়। চাঁদের পাহাড়ের নায়কের মতো ওরাও যাবে আফ্রিকার কেনিয়ার মৃত্যুকূপ মাসাইমারা জঙ্গলে। শিকার করবে আর গুপ্ত ধনের সন্ধান করবে। ইচ্ছেঘুড়ির নাটাই ছিঁড়ে সত্যি সত্যি ওরা আজ এ জঙ্গলে। না আমিন ইয়ামিন আর ভাবতে পারছে না। ভয়, রাগ, দুঃখ আর ক্ষোভে তার পাগল হওয়া অবস্থা।
: যত নষ্টের মূলে ‘তাবু অ্যাডভেঞ্চার’-এর সিইও ঐ মুশাহিদ মামা, না মামা বলতে ইচ্ছে করছে না। ওর মামাকে বাবা যা বলে সম্বোধন করে, তাই বলতে ইচ্ছে করছে। আমিন ইয়ামিন চিৎকার করে ওঠে।
: ‘কী ব্যাপার চিৎকার করছ কেন?’ মুশাহিদ দৌড়ে এসে জানতে চায়
: মেহেদী, নাহিদ আর লাবিল কোথায়, ওদের খুঁজে পাচ্ছি না, ওরা কোথায় গেছে?
: শিকারে গেছে
: সন্ধ্যে হয়ে আসছে, ফিরছে না..
: হয় তো শিকার পায়নি
: এ ভিন দেশি জঙ্গলে হারিয়ে যাবে তো..
: ‘অ্যাডভেঞ্চারের ষোলকলা পূর্ণ হবে, তুমি খুঁজতে বের হয়ে যাও।’ মুশাহিদের চোখে মুখে রহস্যের হাসি
আমিন ইয়ামিন মুশাহিদের চোখের দিকে তাকাতে পারে না। তাকে বড় অচেনা মনে হয়। সে ভাবছে, শিকার করতে এই ভয়ঙ্কর জঙ্গলে এসে ওরা নিজেরাই শিকারে পরিণত হয়নি তো। ‘তাবু অ্যাডভেঞ্চার’-এর অনেক সুনাম। মুশাহিদের সাথে তাদের চেনা-জানা অনেক অনেক দিনের। এর আগে দেশের গারোপাহাড়, সুন্দরবন, নিঝুম দ্বীপ ছাড়াও কাশ্মির, নেপাল, মালদ্বীপ আরো কত শত জায়গায় গেছে। তিনি বেশ কেয়ারফুল। রক্তের সম্পর্কের কেউ না হলেও সত্যিকারে মামার মতোই তার ব্যবহার। কিন্তু আজ কেন এত অচেনা লাগছে, আমিন ইয়ামিন বুঝতে পারছে না।
: ‘চলো।’ মুশাহিদের গম্ভীর বাজখাঁই ডাকে আমিন ইয়ামিন চমকে ওঠে।
: কোথায় যাবো?
: তোমার বন্ধুদের খুঁজতে?
ভয়ে আমিন ইয়ামিনের গলা শুকিয়ে গেছে। সে কথা বলতে পারে না। তার মনে ভয়, দ্বীধা-দ্বন্দ্ব। তাকে নিয়ে মুজাহিদ শা.. কোথায় যাবে, এ গভীর বনে?

২.
আফ্রিকা অদ্ভুত সুন্দর এক মহাদেশ। কিন্তু ভয়ঙ্কর। বাবলা বনে ভর্তি বাংলাদেশের মাঠের মতো দেখালেও আসলে মৃত্যুসঙ্কুল। কেনিয়ার মাসাইমারা ভ্রমণের ইচ্ছে শুধু চাঁদের পাহাড় পড়েই ওদের মনে জাগেনি। এ বনের আকর্ষণ অজস্র পশু-পাখি। সাবানা ঘাস আর একেশিয়া গাছে ভরা এই বিশাল অরণ্য দেখলে মনে হয় হারিয়ে যেতে নেই মানা ।
প্রকৃতি এখানে বড় বৈচিত্র্যময়। কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মের ব্যত্যয় নেই। এ বনেরও সঙ্গী অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, ঝড়, দুর্যোগ আর প্রকৃতির আদরভরা অঝর ধারা। তাই তো একসাথে জিরাফ, জেব্রা, বনশুয়োর, আফ্রিকার বিখ্যাত দ্বিশৃঙ্গ গণ্ডার, মহীরুহ দাঁতাল দলে দলে অবাধে বিচরণ। এই ‘বিচরণ’-এর আবার নানা রূপ। কখনও বিচরণ চলছে শান্তভাবে আশপাশে, কখনও দল বেঁধে তারা চলেছে তানজানিয়া থেকে কেনিয়া, সবুজের সন্ধানে। পাসপোর্ট ভিসাহীন পশুপাখিদের এ ‘মাইগ্রেশন’ চলে সারা বছরই। কারণ ওরা কোন সীমার বাঁধনের ধার ধারে না। তবে ‘মাইগ্রেশন’ নামে বিখ্যাত এই বিচরণ সবচেয়ে বেশি হয় জুলাই মাসে। তানজানিয়া আর কেনিয়া দু’টি আলাদা দেশ হলেও পশুদের জন্য কোনও কাঁটাতার নেই। এমনকি ট্যুরিস্টরাও মাসাইমারাতে দাঁড়িয়ে স্পর্শ করতে পারেন তানজানিয়ার মাটি।
আমিন ইয়ামিন এখানে আসার আগে পত্রপত্রিকার আর গুগলে সার্চ করে দেখেছে, মানুষের সৃষ্ট কোনও বাধা না থাকলেও নিরীহদের জন্য এ পরিভ্রমণে প্রকৃতিগত বাধা আছে। আর সেই বাধা বড় ভয়ঙ্কর। মাংসাশী প্রাণী বুনো শুয়োর বা সব জিরাফই যে নিরাপদে পৌঁছতে পারে মাসাইমারায়, তা নয়। পথে থাকে চিতা, নেকড়ে, সিংহের দল। একটু ভুলে মৃত্যুর হাতছানি এখানে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। চিতা তার দুর্দান্ত গতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে কোনও হরিণের ঘাড়ে- এই দৃশ্য বহু পর্যটকের সামনেই ঘটে। পর্যটকদের জিপ আবার খুব কাছে চলে এলে, শিকার করা মৃত হরিণ নিয়ে চিতা চলে যায় গাছের আড়ালে।
তবে বিপদ শুধু স্থলে নয়, মারা নদীতেও আছে। আফ্রিকার বিখ্যাত নাইল ক্রোকোডাইল বা কুমির। পিপাসায় কাতর হয়ে পানি পান করতে আসা জন্তুদের ওপর আক্রমণ করে। তাদের ভোজন পর্ব সম্পন্ন করে। তবুও এত কিছুর পরেও প্রতি বছর প্রায় দশ লক্ষ জন্তু চলে আসে এই বিশাল ৫৮৩ বর্গমাইল মাসাইমারা জঙ্গলে। আর তাদের এই পরিভ্রমণ দেখার আদর্শ স্থল মারা ও তালেক নদীর সঙ্গমস্থল।
মারা নদীর প্রচুর কুমির ও জলহস্তির রোদ পোহানো দেখতে দেখতে নদীর চরে মধ্যাহ্নভোজন করে নিতে পারেন ট্যুরিস্টরা। তবে সবথেকে ভালো লাগে, সাবানা ঘাসের উপরে কোনও একেশিয়া গাছের তলায় গিয়ে নিরাপদে গাড়ি থেকে নামতে পারলে। দূরে হয়তো চোখে পড়বে মাসাই জিরাফদের বিচরণ। এখানেই আছে সুন্দর ঘুমঘুম চাঁদ, ঝিকিমিকি তারা, এই মাধবী রাত!
‘চাঁদের পাহাড়’ এর শঙ্করের কথা মনে পড়তেই আবার অজনা আশঙ্কায় বন্ধুদের জন্য বুকটা কেঁপে ওঠে আমিন ইয়ামিনের। শঙ্কর বলেছে, ‘আফ্রিকা অজানা মৃত্যুসঙ্কুল, তাই জঙ্গলে যত্রতত্র নেমে পড়া বারণ। কারণ চিতা, সিংহ চোখে পড়লেও, বোঝা যায় না ঘাসের তলায় কোথায় লুকিয়ে আছে বিষাক্ত মাম্বা সাপ, তবু স্টারলিং পাখি থেকে শুরু করে বহু পাখি নিয়ে মাসাইমারা অদ্ভুত সুন্দর, যেখানে সব তৃণভোজীরা আমাদের মতোই এসেছে, পরিভ্রমণে।


: ‘চলো।’ মুশাহিদ তাড়া দেয়।
: কোথায়?
: কেন শিকার..
: বন্দুক কোথায়?
: শিকার করতে নয় দেখতে
: ‘মানে?’ ভয়ার্ত কণ্ঠে জানতে চায় আমিন ইয়ামিন
: এত ভয় পাচ্ছো কেন, এ বনে শিকার করা নিষেধ
: তাহলে শিকার দেখবো কিভাবে..
: মানুষের শিকার নয়..
: চিতা, সিংহ, বুনো শুয়োর আর কুমিবরা তাদের ভোজনপর্ব সারতে শিকার করে, সেই শিকার দেখতে..
: কী ভয়ঙ্কর কথা, চিতা সিংহের মুখোমুখি হবো, মেহেদী, নাহিদ আর লাবিলরা কোথায়?
: ওরা তো কত আগে চলে গেছে, আমি তো তোমার জন্য অপেক্ষা..
: কেন? তুমি তো তাঁবুতে এসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলে..
: ওদেরকে আফ্রিকান গাইডের সাথে পাঠিয়ে দিয়ে, আমি তোমার ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় আছি, আর দেরি নয়. মারা ও তালেক নদীর সঙ্গমস্থল মনে হয় এতক্ষণে শিকার জমে উঠেছে…

Share.

মন্তব্য করুন