রোজার ছুটি। স্কুল বন্ধ। ইশিতা মায়ের সাথে গ্রামের বাড়ি যাবে। আরো তিন দিন পর রোজা শুরু হবে। তাই ইশিতা মায়ের সাথে পাকা কথা আদায় করে রেখেছে যে দু’দিনের জন্য হলেও বাড়ি যাবে।
মা কথা দিয়েছেন। অনেকদিন গ্রাম দেখা হয় না। তিন বছর আগে যখন ইশিতা গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলো তখন দাদাভাই জীবিত ছিলেন। দাদাভাই এখানে- সেখানে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। দাদাভাই যে প্রাইমারি বিদ্যালয়ে পড়তেন সেখানেও গিয়েছিলো ইশিতা আর দাদাভাই। পুরনো কেউতো নেই এখন। অনেকেই জজ ব্যারিস্টার সচিব পুলিশের বড় কর্মকর্তা হয়ে গেছেন। অনেকে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাঠিয়ে গ্রামের বিভিন্ন স্থানে দালানকোঠা গড়েছেন। শহরের অনেক কিছুই গ্রামে পাওয়া গেছে। এবার গেলেতো হয়তো আরো অনেক পরিবর্তন দেখা যাবে।
ওরা রওনা হলো। পথের যানজট ঝামেলা কাটিয়ে যখন গ্রামের বাড়ি পৌঁছলো তখনো ইশিতার চোখে ভাসছে পথের পাশে সারিসারি গাছ যা ওদের গাড়ির গতির সাথে প্রতিযোগিতায় নেমেছে যেনো। সাঁই সাঁই করে গাড়ি কিভাবে ছুটে চলেছে তা ইশিতা বেশ ভালোভাবে উপভোগ করেছে।
গাছ আর গাছ, সরিষার হলুদ বিছানা, নারকেল, বাঁশঝাড়, ধান, আলু আর পেঁয়াজের জমিগুলো ইশিতাকে সুখের আবেশে জড়িয়ে রাখে দীর্ঘ সময়। ছোটবেলা থেকেই ইশিতা গ্রামকে ভালোবাসে। তাই আজও সেরকমভাবেই সে নজর রাখে গ্রামের পথঘাট পুকুর জলাশয় তাল নারকেল আম জাম কাঁঠালের গাছে। তার চোখ যায় শিম আলু ফুলকপি মুলার জমিনে। সে দেখে কিভাবে লাউ শক্তভাবে ধরে রেখেছে মাচানের বেত বাঁশের লাঠি।
গেলোবার বিদ্যালয়ের বার্ষিক প্রতিযোগিতায় সে গ্রামের একটি প্রকৃতির ছবি এঁকে প্রথম হয়েছিলো। সেখানে ছিলো একটি তালগাছ, গাছে পাখির বাসা, ছিলো ছোট্ট খাল, খালের ঘাটে নৌকা বাঁধা ছিলো, শুকনো একরত্তি চর চরে হলুদ টিয়া পাখির ঠোঁটে সরিষার ফুল, মৌমাছির মুখে মধুর রোয়া।
এরকম একটি ছবি দেখে বিচারকগণ কি মনে করে যেনো ইশিতাকে প্রথম বানিয়ে দেয়। সবচেয়ে মজার বিষয় ছিলো: সে প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জেলখানায় বসে লেখা সেই রোজনামচা গ্রন্থটি। যা পড়ে ইশিতার চোখে জল এসেছিলো। আর মায়ের সাথে বিকেলে চা খেতে বসে যুদ্ধের গল্প, শেখ মুজিবের জীবনের ত্যাগ নিয়ে কথা বলেছিলো।
ওরা পৌঁছলো তখন বেলা তিনটার বেশি। অনেক দেরি হলো পথে যানজটের কারণে।
ইশিতাকে পেয়ে বাড়ির অনেকেই উপস্থিত। আগের মতো এখন বাড়িতে ছোট্ট ছেলে পুলে নেই। সবাই বড় হয়ে ঢাকা বা অন্যসব শহরে পড়াশোনা করছে। কিন্তু রয়ে গেছে মাসুদ আর হাফিজা আরা বেগম। ওর চাচাতো বোন। ওরা বাড়িতেই থাকে। ইশিতাকে পেয়ে কাছে এসে কুশল বিনিময় করে। সবার চোখে মুখে আজ খুশির ঝিলিক।
ঘরের সবার সাথে কথা বলে ইশিতা আবার এক পলকেই বের হয়ে এলো। কারণ ওর মনে নানা রকমের খেলা আর মজার মজার আড্ডার আইডিয়া জমে আছে।
মার সাথে বের হবার সময়ই ইশিতা একটি প্রোগ্রাম বানিয়ে রেখেছিলো কী কী করবে গ্রামের বাড়িতে। ইশিতার ক্লাস টিচার মাহবুবা ম্যাডামও এ ব্যাপারে একদিন ব্রিফ করেছিলো। ম্যাডাম খুব চমৎকার করে কথা বলেন যেনো চলচ্চিত্রের কোনো নায়িকা। কী অসাধারণ কণ্ঠ ম্যাডামের। তাঁর কথা শুনতেই ভালো লাগে।
মাসুদ ছেলে মানুষ বলে ওর ভেতর পাখি শিকার করা, মাছ ধরা, গাছে ওঠে ডাব পাড়া, শসা এনে বাড়ির উঠোনে রাখা সব কিছুই তার মগজে সেট করা আছে। এখন শুধু হাফিজাকে নিয়ে বের হওয়া।
পাশের বাড়ি থেকেও দু’তিনজন এসেছে। সবাই হুড়মুড় করে বের হয়ে পড়লো।
প্রথমেই পাখির খোঁজ করা। একসাথে ডাবও পাড়া হবে। তারপরই ওরা চলে গেলো পাশের সরিষা ক্ষেতে। ওখান থেকে অনেক সরিষার ফুল ছিঁড়ে আনা হবে। আসার পথে শসা কেটে আনা হবে। ক্ষেতের মধ্যেই শসা খাওয়া আর বেতের ঝুড়িতে করে দাদুমণির সামনে এনে রাখা।
এসব আনন্দ করে বেলা শেষ করে সবাই। বাড়িতে বেশ বড় উঠোন, ছোট খাটো একটা খেলার মাঠ। সন্ধ্যার পর আকাশ ভরা পূর্ণিমার চাঁদ উঠোনের বুক জুড়ে আলোর জাল বিছিয়ে দিয়েছে। ইশিতা কত দিন এমন আলোর মেলা দেখেনি। ওর মন ঘরে থাকে না। দাদাভাই নেই মনটা কেমন বিষাদে ভরে থাকে অনেকক্ষণ। তবু ইশিতা সবার নাম ধরে চিৎকার করে ডেকে ওঠে-সবাই উঠোনে আসো। ক্রিকেট খেলবো।
অমনি সবাই এসে জড়ো হয়। শুরু হয় খেলা। সবাই মানে চারজন। দু’ভাগে ভাগ হয়ে খেলা শুরু করে কিন্তু হাফিজার প্রথম বলেই ইশিতা বোল্ড আউট হয়ে ফিরে যায়। রাগ করে সে খেলাটাকেই বন্ধ করে দেয়।
পরের দিন।
ইশিতার মেজাজ ভালো নেই। গতকালের আউট হওয়া নিয়ে ওকে অনেক কটু কথা শুনিয়েছে হাফিজা। তাই সে এখন আর হাফিজার সামনে যেতে চায় না। কি আর করা। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী আজ ওরা মাছ ধরার জন্যে পুকুরে ব্যস্ত থাকবে।
ইশিতা মাছ ধরবে।
সে মাছের জন্য পুকুর ঘাটের সিঁড়িতে বসে মুড়ি খই ছুড়ে দেয়। মাছের ঝাঁক এসে এক মিনিটে সব সাবাড় করে নেয়। চলতে থাকে মাছের খেলা। এই আনন্দের দৃশ্য ইশিতাকে সত্যি সুখী করে তোলে। সে খেয়াল করেনি কখন পেছনে এসে মাসুদ দাঁড়িয়ে আছে। সে খেয়াল করেনি এই আনন্দের ভেতরও একটা ঘটনা ঘটে যায়।
মাসুদ কাছে এসে বলে-জানো ইশিতা তুমি যে এভাবে খাবার দিচ্ছো মাছ কিন্তু খাবারের জন্য এখন ঝগড়া করবে।
–মাছ কিভাবে ঝগড়া করবে? ওরা কি মানুষ?
-হাঁ ওরাতো সব বুঝে। খাবারের জন্য ওরা উঠে পড়ে লেগে যায়। একজন আরেকজনকে ডিঙ্গিয়ে কাঁটার আঘাত করে নিজেরা সব খাবার নেয়ার জন্য চলে আসে।
– বলো কী, আমাদের শহরেও এরকম দেখেছি। আজকাল মানুষও ট্রাক সেলের খাবার নেয়ার জন্য খুব হৈচৈ করে ঝগড়া করে। আসলেতো দেশে এখন সঙ্কট চলছে। তাই মানুষের অনেক কষ্ট। তবে এসব বেশিদিন থাকবে না। জানো মাসুদ, আমাদের ম্যাডাম বলেছেন কোনো খারাপ সময় নাকি দীর্ঘকাল থাকে না। শুধু একটু সয়ে থাকতে হয়। তাহলে একদিন সুদিন আসবেই।
মাসুদ কী মনে করে যেনো একটু চুপ করে থাকলো।
তারপর সে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দিয়ে বললো, হ্াঁ ঠিকই বলেছো ইশিতা। কোনো মানুষের খারাপ সময় বেশিদিন থাকে না।
দু’জনে আরো ভারি ভারি দু’চার কথা বলেই ঘরে চলে গেলো। খাবারের সময় হয়েছে।
কাল সকালেই ইশিতা ফিরে আসবে শহরে। এসেই সে ম্যাডামকে কল করে গ্রামের এই গল্পগুলো বলবে। তার বিশ^াস ম্যাডাম খুব আন্তরিকভাবে এন্জয় করবে এই গল্প।

Share.

মন্তব্য করুন