শৈশবকালের কথা আমি খুব করে বলি। একজন মানুষের জীবনে শৈশবকাল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ ততদিন জীবন্ত থাকে যতদিন তার শৈশব তার সঙ্গে থাকে। আমাদের জীবন আমাদের সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নিয়ে যাচ্ছে চুপেচুপে, খুব গোপনে! কখন যে শৈশব থেকে কৈশোরে, কৈশোর থেকে যৌবনে, যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্বে এবং প্রৌঢ়ত্ব থেকে বার্ধক্যে নিয়ে যাচ্ছে আমরা টেরই পাই না। দুঃখের মধ্য দিয়ে জীবন শেষ হয়। আনন্দের ভেতর দিয়েও শেষ হয়ে যায়। তবে জীবন দুঃখে শেষ হলে কিছুটা বোঝা যায়। কিন্তু আনন্দে শেষ হলে বোঝাও যায় না যে কিভাবে শেষ হলো। এভাবে তিল তিল করে, পায়ে পায়ে, অগোচরে আমাদের জীবন শেষ হয়ে যায়।

মরার আগেও জীবন শেষ হয়ে যায় যদি না জীবনের সঙ্গে শৈশবের সৌন্দর্য জড়িয়ে না থাকে। কেননা শৈশবে প্রতিটি মানুষ নিষ্পাপ থাকে। সহজ, সরল এবং সুন্দর থাকে। কারো প্রতি হিংসা রাখে না। বিদ্বেষ পোষণ করে না। সবাইকে বিশ্বাস করে সরলতার মধ্য দিয়ে। বিশ্বাস করে বোকার মতো। আর খুব গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- শৈশবে খুব অবাক হয় মানুষ! বিস্মিত হয়! বিস্ময় হলো মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অবাক বা বিস্মিত না হলে মানুষের কৌতূহল থাকে না। আর কৌতূহল না থাকলে কোনো বিষয়ের প্রতি আগ্রহ থাকে না মানুষের! আগ্রহ সৃষ্টি না হলে কিছুই শেখে না মানুষ। শিখতে পারে না আসলে।

সত্যি বলতে কি আমি ছোটবেলায় কিছুটা বোকাসোকা কিসিমের ছিলাম। খুব সহজে কিছু বুঝতে পারতাম না। সরল ছিলাম খুব। যেমন একটি ঘটনার কথা বলি- আমাকে এবং আমার ছোট ভাইকে অঙ্ক শেখানোর চেষ্টা করছেন আমার বাবা। তো আমরা কিছুতেই শিখছিলাম না। তো তিনি একটি পদ্ধতি অবলম্বন করলেন। বেশ কিছু মিষ্টি ছিলো সেখানে। তিনি একটি একটি করে তিনটি মিষ্টি খাওয়ালেন আমাকে। খাইয়ে বললেন- বলোতো কয়টি মিষ্টি খেয়েছো?

আমার ছোট ভাই হঠাৎ বললো- ভাইয়া বলিস না বলিস না! মিষ্টির ভেতর দিয়ে তোকে অঙ্ক শিখিয়ে ফেলবে! এমনই বোকাসোকা ছিলাম আমি।

আমি প্রায়ই বলি স্বপ্ন দেখলে বড় করে দেখতে হবে! স্বপ্ন বড় করে দেখতে হয়। কেননা মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। সুতরাং স্বপ্ন বড় হলে মানুষও বড় হবে। স্বপ্ন না থাকলে হবে কি করে! এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা তো চাই! এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায় স্বপ্ন। বিজয়ের আকাক্সক্ষাও স্বপ্নই দেয়।

তাই শিশুদের মনে বড় স্বপ্ন ঢুকিয়ে দিতে হবে। বড় মানুষ করে গড়ে তুলতে হলে বড় স্বপ্ন দেখাতে হবে। শিশু-কিশোরদের শেখাতে হবে। শিক্ষা দিতে হবে। কিন্তু শেখাতে হবে আনন্দের ভেতর দিয়ে। হাসি খুশির মাধ্যমে। বিশাল বিশাল ওজনী কথা বলে নয়। অনেক ভারি ভারি কথা বলে নয়। জ্ঞান তত্ত্ব, সমাজ তত্ত্ব, ভূগোল তত্ত্ব দিয়ে শিশুদের শেখানো যায় না। রসগোল্লায় দুটো জিনিস আছে। একটি গোল্লা আরেকটি রস। গোল্লা বুঝবে যখন সে বড় হবে। কিন্তু শিশুদের দিতে হয় রস। রসের ভেতর দিয়ে শেখাতে হবে। মনে রাখতে হবে- সাহিত্যের বইয়ের ভেতর দিয়ে শিশুদের শেখানো সহজ। সাহিত্যে জ্ঞান থাকে, হাসি আনন্দ থাকে। দুঃখ বেদনার কথা থাকে। এককথায় সাহিত্যে জীবন থাকে। জীবনের সৌন্দর্য থাকে। ফলে সাহিত্যের ভেতর দিয়ে শেখানো সহজ হয় শিশুদের। আজকের শিশুরা পৃথিবীর সবচেয়ে অত্যাচারিত শিশু। আজকের শিশুদের ওপর অনেক প্রেসার। অনেক চাপ। বাবা মার অনেক চাহিদা তাদের ওপর। ফলে আজকের শিশুরা নানা ভয় এবং আতঙ্কের ভেতর দিয়ে বেঁচে থাক!

আমাদের সময় ছিলো অবারিত সব। সে সময় ছেলে মেয়ে প্রতিটি পরিবারে সংখ্যায় ছিলো অনেক। আমরাই তো ১১ ভাই বোন ছিলাম। আমার দাদার পরিবারে ছিলো ১৮ ভাই ও ১৪ বোন। মা বাবার আদর ভালোবাসা সবার ভেতর ভাগ হয়ে যেতো। ফলে কঠিন এবং কঠোর শাসন যেমন ছিলো না। আবার অতিরিক্ত স্নেহ মমতাও ছিলো না। যে যার মতো স্বাধীন ভাবে বেড়ে উঠতো। এখন একটি বা দু’টি সন্তান। যার কারণে আদর সোহাগ যেমন বেশি! আবার চাহিদাও বেশি। তার ওপর রাখতে হয় চোখে চোখে। কিন্তু সে অনুযায়ী শিক্ষা দেয়াটা সম্ভব হয়ে উঠছে না।

শিশুদের শিক্ষার বিষয়টি সবার নজর রাখতে হবে। আমাদের সবাইকে আলোকিত মানুষ গড়ার কাজ করতে হবে। কাজ করে যেতে হবে নিয়মিত। তাহলে দশ বছর বিশ বছর, পঞ্চাশ বা একশ বছর পরে হলেও সমাজে আলোকিত মানুষের সংখ্যা থাকবে বেশি। আজকের শিশু কিশোর যারা তাদেরও এই আলোকিত মানুষ হয়ে বেড়ে উঠতে হবে।
তবে বড় হতে হলে আগে মনের দিক দিয়ে বড় হতে হবে। মনে বড় না হলে বড় মানুষ হওয়া যায় না। বড় কাজও করা যায় না। যদি কেউ এভারেস্ট জয় করার স্বপ্ন দেখে তবে আগে মনে মনে জয় করতে হবে এভারেস্টের চূড়া। তারপর বাস্তবে জয় করা সম্ভব হবে। কেউ যদি সাহারা মরুভূমি হেঁটে পার হতে চায় তো আগে মনে মনে হেঁটে পার হয়ে যেতে হবে। এরপর বাস্তবের দিকে যেতে হবে।

তাই বলি যদি বড় হতে চাও আগে মনের দিকে বড় হও এবং যদি মানুষ হও তবে আলোকিত মানুষ হও। তবেই সুন্দর হবে সমাজ। সুন্দর হবে দেশ। সুন্দর হবে আমাদের পৃথিবী।

Share.

মন্তব্য করুন