আমার ছোটবেলার গল্প বলতে গেলে একটি ছোটখাটো বই হয়ে যাবে মনে হয়। অনেক কাহিনী আছে আমার ছোটবেলার। আমি একটি সঙ্গীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। ছোটবেলায় আমি খুব দুরন্ত ছিলাম! সাধারণ মেয়েরা যেমন হয় আমি কেনো যেনো সেরকম ছিলাম না। অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা ধরনের ছিলাম। সবাই খেলাধুলা করে ছোটকালে, আমিও অনেক খেলাধুলা করতাম। কিন্তু আমার গতি ছিলো ওদের চেয়ে অনেক বেশি। ওরা একহাত চললে, আমি তিন হাত এগিয়ে থাকতাম। আমি খুব মাছ ধরতাম। যা অন্যরা করতো না। পুকুরে নদীতে সাঁতার কাটতাম। মজা করে সাইকেল চালাতাম। আবার সেলাই করতাম সেই ছোটবেলা থেকেই। কাটিং করার কাজও শিখে গেছিলাম। এর ভেতর স্কুল তো আছেই। লেখাপড়া চলতো সমান তালে। আমার স্কুলটি ছিলো বাড়ি থেকে বেশ কিছু দূরে। কিন্তু স্কুল মিস দিতাম না। নিয়মিতই স্কুলে যেতাম। বেশ মজার ছিলো আমার শৈশব এবং কৈশোরকাল!

এটি খুব সত্যি কথা যে আমার শৈশব কৈশোর অনেক অন্যরকম ছিলো। এত এত দুরন্তপনায় কেটে গেলো সেই ছোটবেলা! এখন খুব মনে পড়ে। ভাবলে মনে হয় স্বপ্নের মতো। তবে অনেক অনেক দুরন্তপনা করতাম ঠিক। কিন্তু অকারণে কোথাও আড্ডা দিতাম না। আমার বাবা আড্ডা পছন্দ করতেন না। এসব বিষয়ে আমাকে খুব শাসন করতেন। এখন মনে হয় সেই শাসনই আমাকে আজকের আমি করে তুলেছে।

আড্ডা দিতাম না মানে এই নয় যে আমি বান্ধবীদের সাথে খেলতাম না!

বান্ধবীদের সাথে খেলতাম ঠিকই। কিন্তু সারাক্ষণ বান্ধবীদের সাথে কাটিয়ে দেয়ার যে বিষয় সেটি ছিলো না আমার। বলতে পারেন একাই ঘুরে বেড়াতাম। যেখানে প্রয়োজন যেতাম।

অনেকেই জানতে চান গানের জগতে কী করে ঢুকলাম আমি। আসলে সত্যি হলো- জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কোনো কিছু না বোঝার আগেই গানের জগতে ঢুকে পড়েছি!

বিষয়টি একটু বুঝিয়েই বলি-
বিষয়টি হলো আমি একেবারে ছোট যখন, অর্থাৎ শিশু যখন ঠিক তখন থেকেই গান করি। গান শিখি। মনের ভেতর গান কেমন জানি আঁকুপাঁকু করতো! মনের কোণে সুর খেলা করতো। সেই অনুভূতিটাই আমাকে গানের দিকে টেনে নিয়ে এসেছে।

অবশ্য এর পেছনে অনুপ্রেরণা ছিলো অনেকের। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ছিলো যার তিনি আমার বাবা। আমার বাবা নিজে শিল্পী ছিলেন। আমার দাদা শিল্পী ছিলেন। আমার খালাও ছিলেন শিল্পী। আমার মামা শিল্পী। আমার চাচাও শিল্পী। আমি আসলে সঙ্গীত পরিবারে বড় হয়েছি।

সত্যি কথা হলো ছোটবেলা থেকেই আমাকে গান শিখতে একরকম বাধ্য করা হয়েছে। স্কুলে যেতাম। ফিরে এসে দিনে দিনে স্কুলের পড়া শেষ করতে হতো। সন্ধ্যায় শুরু হতো গানের অনুশীলন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে গান শেখা, গান করার কাজ চলতো। আমার উস্তাদজি, তাকে

আমি কাকা ডাকতাম। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। আমাকে সন্তানের মতো আদর করতেন। শাসনও করতেন খুব। তিনি একেকটি ক্লাস নিতেন তিন থেকে চার ঘণ্টার।

যখন আমি গান শুরু করি তখন এত কিছু ভাবিনি। এত গান করবো, দেশে বিদেশে এত এত মানুষ আমাকে চিনবে এসব কিছু ভাবিনি। আসলে এসব স্বপ্ন টপ্ন বোঝার বয়সই হয়নি তখন। আব্বাও আমাকে কোনো স্বপ্ন দেখাননি। তিনি ডাক্তার ছিলেন। কিন্তু গান ছিলো তার রক্তের সাথে মেশানো। তিনিও নজরুলসঙ্গীতের ভীষণ ভক্ত ছিলেন। তো তিনি আমাকে প্রায়ই বলতেন- মা গান করো। গান করলে তোমার মন ভালো থাকবে। আর মন ভালো থাকলে শরীর ভালো থাকবে। আর যদি মন শরীর দুটোই ভালো থাকে তো তোমার সবকিছু ঠিকঠাক থাকবে।

আমি বাবার অনুমতি ছাড়া কোনো গান করিনি তখন। আবার গান করলেও কোন গানটি গাইবো সেটাও আব্বাই ঠিক করে দিতেন। কলেজে উঠেও তাই করতাম। সে অভ্যাসটিই আমার সারা জীবন থেকে গেলো। এখনও গান গাইতে গেলে কোন গানটি গাইবো সহজে ঠিক করতে পারি না। মনে হয় আহা বাবা যদি বলে দিতেন! বাবার অভাব এখনও ফিল করি খুব।

আমার বয়স তখন ৭-৮ বছর হবে। ৫ম শ্রেণিতে পড়ি। এসময় বগুড়া জেলা আর্ট কাউন্সিল একটি গানের প্রতিযোগিতার আয়োজন করলো। আমি এতে অংশ গ্রহণ করলাম। আমার জীবনের প্রথম প্রতিযোগিতা এটি। মজার বিষয় হলো আমি প্রথম প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলাম! আরও মজার বিষয় হলো এই প্রতিযোগিতাটিতে ছোট বড় ভাগ ছিলো না। সবাই একসাথে। অর্থাৎ বড়রা যারা অনেক দিন গান করেছে, প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে এমন ছেলেমেয়েরাও ছিলো। এদের মধ্যে আমি প্রথম স্থান অর্জন করি।

যে গানটি গেয়ে পুরস্কার পেলাম সেই গানটিও নজরুলের লেখা গান। এবং গানটি আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা. কে নিয়ে লেখা। গানটি হলো-

মোহাম্মদ মোর নয়ন মণি
মোহাম্মদ নাম জপো মালা।

এ গানটি আমার খুব পছন্দের গান। এ গান গেয়েই আমি প্রথম হয়েছিলাম! আহা খুব মনে পড়ে সেই দিনটির কথা। সেই দিনটা ছিলো আমার একটি স্মরণীয় দিন। আজও মনের কোণে জ্বলজ্বল করছে সেই দিনটি।

সত্যি কথা হলো- আমার ছোটবেলা থেকেই ইসলামী গানের প্রতি আগ্রহ ছিলো প্রচুর। ইসলামী গানে সুন্দর জীবনের কথা থাকে। চরিত্র গঠনমূলক কথা থাকে। আল্লাহ রাসূলের কথা খুব সুন্দর করে বর্ণনা থাকে। মনের ভেতর অন্যরকম একটা ভালোলাগা সৃষ্টি হয়। যে অনুভূতিটার মাধ্যমে মানুষ সত্য ও সুন্দরের পথে চলতে পারে। মানুষ সুন্দরের পথে চলবে এটিই তো আসল কথা।

তবে ইসলামি গানের বিষয়টি আমাদের এখানে তেমন করে প্রচার প্রসার হয়নি। যারা ইসলামি গান করে বা ইসলামি গান নিয়ে এগিয়ে যেতে চায় তাদেরকে আরও আধুনিক মানসিকতার হতে হবে। তাদের গান সম্পর্কে ভালো করে জানতে হবে। গান এমন কোনো বিষয় নয় যে ইচ্ছে করলো আর গেয়ে দিলাম। না গানের অ আ ক খ জানতে হবে। ব্যাকরণগত বিষয়গুলো অবশ্যই জানতে হবে। নইলে এ গানের কোনো প্রভাব সমাজের সাধারণ লোকদের ওপর যেমন পড়বে না। তেমনই শিক্ষিত লোকদেরকে একেবারেই টানবে না। গানের জন্য সময় দিতে হবে। ধ্যান মন প্রাণ ঢেলে দিয়ে গান করার চেষ্টা করতে হবে। আমার ছোটবেলায় এমন কোনো সন্ধ্যা ছিলো না যে সন্ধ্যায় আমি গান প্র্যাকটিস করিনি। যে সন্ধ্যায় আমার কণ্ঠে গান ওঠেনি।

আমি বিশ্বাস করি ইসলামি গানের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। যদি নিবেদিত হয়ে সিরিয়াসলি যদি ইসলামি গান করা হয় নিশ্চয় এ গান মানুষকে সুন্দর পথের দিকে আহ্বান করবে।
আজকের শিশু কিশোর যারা তোমরা গান করতে চাও, অবশ্যই করবে গান। কিন্তু লেখাপড়াটা ঠিক ভাবে চালিয়ে যেতে হবে। লেখাপড়া ভালো করবে। চরিত্র উন্নত করবে। আর সুন্দর সুন্দর গান করবে, তবেই তোমরা অনেক বড় হবে।

Share.

মন্তব্য করুন