বাংলাদেশ শব্দটিই ভীষণ আনন্দের! ভীষণ গৌরবের!গভীর ভালোবাসার। শব্দটি একটি উৎসব মুখর শব্দ। একটি উচ্ছাসময় শব্দ। একটি প্রাণবন্ত এবং জীবন্ত শব্দ! বাংলা-দেশ যেমন তেমনই বাংলা-ভাষা। এইযে বাংলা একটি শব্দ! একটি শব্দের সাথে দেশ এবং ভাষার নাম এমন কোথাও নেই বিশ্বে। এটিও আনন্দের খুব!
বাংলাদেশ শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সবুজ সমারোহ। সবুজও কতরকমের- বৃক্ষের সবুজ। ফসলী মাঠের সবুজ। পাহাড়ী অরন্যের সবুজ। এবং আদিগন্ত সবুজের উল্লাস। জড়িয়ে আছে দিগন্ত বিশারী নীল আকাশ। কখনও গাঢ নীল। কখনও হাল্কা নীল। কখনও নয়ন জুড়ানো নীল। বাংলাদেশের আকাশ এমনই – হঠাৎ ঝড়।হঠাৎ বৃষ্টি। আবার দিনের পর দিন থাকে রোদের উৎসব। আহা কতরকম রোদ! কমলা রোদ। হলুদ রোদ। সাদা রোদ এবং অসাধারণ সোনালি রোদের উষ্ণতা।
বাংলাদেশ শব্দটির সঙ্গে মোড়ানো সমুদ্রের কল্লোল। উত্তাল নদীর তরঙ্গ। বহমান নদীর উচ্ছাস। পাহাড়ী ঝর্ণার কলকলে ধারা। নদীর বুক জুড়ে রূপালি স্রোত। গাঙচিলের ডানা খোলা ঝাঁক। দূর দিগন্তের কোথাও বিস্ময় ঈগল!
আমার বাংলাদেশ ভোরের দোয়েল-কণ্ঠে মধুর সুর হয়ে বাজে। শিশির মাখা ঘাসের ঘ্রাণে উজ্জীবিত। দীর্ঘ রাত যখন নিঃশ্বাস ফেলে ভোরের শরীরে। তখন কী বিস্ময় রঙের খেলা খেলতে থাকে আকাশ। এত বিচিত্র রঙের জাল ছড়িয়ে পড়ে আকাশ গাঙে। আহা সুন্দর! আহা আনন্দ! মুহূর্তে মুহূর্তে রঙ বদলায়। ক্ষণে ক্ষণে জন্মায় নতুন রঙ। দেখতে দেখতে ফোটে উজ্জ্বল রঙের লালা। মেঘের শরীর যেনো রঙের নাও। কিংবা রঙিন নদী ছড়িয়ে থাকে পুব আকাশের গায়ে।
সন্ধ্যার বর্ণিল আকাশও অবাক বিস্ময়ের! পশ্চিমাকাশ যেনো বাটা পলাশের প্রান্তর। যেনো রক্তজবার মাঠ। সেই লাল আকাশের শূন্যতা বেয়ে নীড়ে ফেরে পাখিরা। বাতাসে ভেসে আসে আজানের সুর।
বাংলাদেশ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেছেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ‘নম নম নম/ বাংলাদেশ মম/ চির মনোরম / চির মধুর।’ এভাবেই কবিতায় রোপিত হলো প্রথম বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশ আমার তোমার এবং আমাদের। এবং সকলের। এ বাংলাদেশ ধ্বনি গরীবের। তাঁতী কুলিদের। জেলে চাষীদের। মুটে মজুরের। দুঃখী সুখীদের।
কী সহজ জীবন এখানে এই মানুষগুলোর। কত কম চাহিদার মানুষ এরা। অল্পতেই চলে জীবন। সামান্যতেই অংক কষে জীবনের। দুয়ে দুয়ে চার হয়ই। হবেই। কিন্তু যখন কেউ দুয়ে তওনেও চার করে বসে থাকে! কও তার জবাব হয়! না জবাব কিছুই হয় না! এখানে বেড়ে ওঠে বিস্ময়! কেনো? কারণ গায়ে প্রচ- জ্বর। জ্বরওয়ালাকেই জিজ্ঞেস করলেন – কেমন আছেন? দিব্বি জবাব দেবে- ভালো আছি! একি সম্ভব স্বাভাবিক ভাবে! না সম্ভব নয়। অথচ এই জনপদের মানুষগুলো অবলীলায় জ্বরের প্রচ- তাপ ধরেই বলে – ভালো আছি! একি দুয়ে তিনে চার নয়!
আমার বাংলাদেশের প্রকৃতি যেমন সহজ। যেমন সহজেই জন্মায় বৃক্ষ। সহজেই পল্লবিত হয় লতাপাতা। তেমনই সহজে উৎসবমুখর হয় ফসল। মাঠে মাঠে বিচিত্র ফসলের রূপ! মন ভরিয়ে তোলে। ফসলের নানা রঙ ও রকম দৃষ্টিকে দীর্ঘ করে তোলে। ঠিক ফসলি মাঠের বুক চিরে কোথাও কোথাও নদীর ধারা বয়ে গেছে আপন মনে। দু’ধারে গাছালির সমাহার! গাছে গাছে পাখির নিবিড় কূজন! সুরের মূর্ছনায় ছায়ার শীতল! কী অদ্ভুত আনন্দের মুহূর্তগুলো পার হয় এখানে।
আমার দেশকে বুকে রাখি আমি। বুকের গভীরেই রাখি। তুলে রাখি হৃদয়ের কাছে। আমার বাংলাদেশ আমার বুকের মতন। আমার হৃদয়ের মতন। আমার স্বপ্নের সৌন্দর্যের মতন। আমার আনন্দের মুখরতার মতন।
কাঁঠাল পাতার হঠাৎ দুলে ওঠা সৌন্দর্যের দিকে চেয়ে থাকি আমি। ডালে থাকা হলুদ পাতার কথা ভাবি। সেই হলুদ পাতাটি লাল মেখে ঝরে যায়। বাতাসে গড়িয়ে গড়িয়ে পাতাটি পড়ে ঘাসের ওপর। ঝরা পাতাটি হাতে তুলে নেই। আহা কি রঙ পাতার! আমি চেয়ে থাকি। পাতার গায়ে দু চারটি পিঁপড়ের হাটাহাটি। কী খোঁজে পিঁপড়েরা। কাকে চায় তারা! ভাবি। এভাবে সবুজ পাতার বার্ধক্য আসে। বদল হয়ে যায় পাতার শরীর। সবুজ থেকে হলুদ। হলুদ থেকে হয়ে লাল! কি বিস্ময় ধারা তার!
আমি বাংলাদেশকে ভালোবাসতে শিখেছি জীবনের শুরুতেই। সেই কৈশোরেই। যখন জীবনের আনন্দগুলো কল্পনার পাখায় উড়তো। যখন স্বপ্নগুলো বিহার করতো আকাশ পাতাল! পৃথিবীকে চেনার আগেই চিনেছি বাংলাদেশ। যেহেতু আমি পৃথিবীতে এসেছি এদেশের বুকের ওপর। এদেশের বুকেই আমি হেঁটেছি। হাঁটছি। এবং হাঁটবো। এদেশের বাতাস থেকে শ্বাস নিয়েছি। নিচ্ছি। এবং নেবো। এদেশের আলো অন্ধকারে আমার ঘুম জাগরণ! এদেশের মাটিতে মাখামাখি করেই বেড়েছে আমার শৈশব। আমার কৈশোর। কাদা মাটির গন্ধ এখনও লেগে আছে যেনো আমার গায়ে। আমার পায়ের সর্বত্র। মাটির সেই মানচিত্র আমার বুকের ভেতর গেঁড়ে আছে। সেই কাদা বা লোদ মাখা শরীরের দৃশ্য এখনও উজ্জ্বল! যখন কাদাগুলো ঝিরঝিরে বাতাসে শুকিয়ে যেতো। যখন শুকনো কাদায় টান পড়তো! কোথাও কোথাও রোমকূপে থাকতো সামান্য ব্যথার ঝিলিক! কী অদ্ভুত ছিলো সেই মুহূর্তগুলো! এমনই মুহূর্তে কখনও কখনও হঠাৎ বৃষ্টি নামতো। বৃষ্টির ছাঁটে ধুয়ে যেতো শরীর। কাদাগুলো ঘোলা পানি হয়ে গড়িয়ে পড়তো। বৃষ্টি ফোঁটায় স্বচ্ছ হয়ে উঠতো শরীর।
তারপর বৃষ্টিধোয়া শরীর নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়তাম পুকুরে। ডুব দিয়ে পানির নীচ থেকে শুনতাম বৃষ্টি ঝরার শব্দ। সেকি সুর! সেকি ছন্দ! হঠাৎ কানে বেজে ওঠে আজও।
কৈশোর পেরিয়ে যতই বেড়ে উঠেছি ততই বেড়েছে দেশ প্রেম। দেশের প্রতি নিখাঁদ ভালোবাসা। জোসনাধোয়া রাত্রির কথা কার না মনে পড়ে। ঝোপ জঙ্গলে জোনাকির জ্বলা নেভার গল্প কে না বলে! চাঁদনির রূপালি রাতে শীতের কুয়াশা আহা কী মায়াবী রহস্য ছড়িয়ে থাকতো। এই দেশে। এই আমার দেশে।
চাঁদহীন রাতের অন্ধকারে ফোটে তারকার রূপালি ফুল। তারার চোখে জ্বলতো রূপালি রাত। হেমন্তের রাতে আরও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ তারার মিছিল।
এভাবেই শ্রাবণ দিনের ঝরণীর কথা মনে পড়ে। বর্ষার অঝর ধারায় নতুন হয়ে ওঠে আমার বাংলাদেশ। রাতভর এবং সারাটি দিন জুড়ে বর্ষণের উৎসব বয়ে যায় আমার দেশে।
শীতরাতের কুয়াশার ধ্ববল রূপ কী রহস্যময়! কী কৌতুক জাগিয়ে রাখে আপন শরীরে। বসন্তের ফুলের সমারোহ নতুন স্বপ্ন জাগানিয়া। গ্রীষ্মের খরতাপ গলিয়ে তোলে আমের শরীর! মেঠোপথের ধারে দুর্বাঘাসগুলোর শিরে শিশিরের মতি চোখ আটকে রাখে না কার!
ফুলে ফুলে প্রজাতির ঝাঁক মনকে রাঙা করে দেয়! সেই রঙ জেগে ওঠে নতুন দিন। চারিদিকে সবুজের বুক। সবুজ বুকে কত রঙের ফুল ফল। কত ভোমরের গুঞ্জন। মৌসুমি হাওয়ায় দোলে ফুলের পাপড়ি। দখিনে বাতাসে ওড়ে মেঘ।
এমন স্বপ্নের মতো দেশটি স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ এ। নয় মাস যুদ্ধ করে স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা। এ স্বাধীনতার মর্যাদা রক্ষা করতে হবে আমাদের। রাখতে হবে স্বাধীনতার মান। বাংলাদেশ আমার প্রিয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাও প্রিয়। প্রিয় স্বাধীনতা থাকুক জাগ্রত চিরদিন।

Share.

মন্তব্য করুন