ঈদ আরবি শব্দ। যার অর্থ খুশি। আনন্দ। বিশ^ মুসলিম উম্মাহর দু’টি ঈদ উৎসব রয়েছে। একটি ঈদুল ফিতর অন্যটি ঈদুল আযহা। সাধারণ অর্থে ঈদুল ফিতর শুরু হয় তিরিশ রোজা শেষে। শাওয়াল মাসের চাঁদ ঈদের খশবু ছড়ায়। ঈদুল ফিতর হলো প্রকৃতিতে বা স্বাভাবিকতায় ফিরে যাওয়ার আনন্দ। রমযান মাসে দিনে পানাহার বন্ধ। কিন্তু রোযা শেষে আবার দিনে পানাহার শুরু হয় ঈদে আনন্দ উদযাপনের মধ্য দিয়ে। অপরদিকে ঈদুল আযহা হলো ত্যাগের আনন্দ। অর্থ এবং পশু কোরবানির মাধ্যমে যে ত্যাগ সেটাই হলো কোরবানির ঈদ। এটা মূলত আল্লাহকে খুশি করার জন্য করা হয়। অপরদিকে ঈদুল ফিতর নিজে এবং অপরকে খুশি করার মধ্য দিয়ে শুরু হয়। ঈদের দিনে সমাজের সর্বশ্রেণীর লোকেরা নতুন পোশাক পরে ঈদগাহে ঈদের নামাজ পড়ে একত্রে। পরস্পর বুকে বুক মিলিয়ে কোলাকুলি করে। গোটা বাংলাদেশ উৎসবে মেতে ওঠে। সারা পৃথিবীর দেশে দেশে আনন্দের সুবাতাস প্রবাহিত হয়ে সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয় ঈদ। সমাজের অন্য ধর্মের লোকেরাও এ আনন্দবৃষ্টিতে সিক্ত হয়। আনন্দের বন্যা বয়ে যায় সর্বত্র, চলনে বলনে, পোশাকে-আশাকে, শিল্প-সাহিত্য, কবিতা-গানে মুখরিত হয় আবালবৃদ্ধবনিতা। ঈদ উপলক্ষে বের হয় বিশেষ ঈদ ম্যাগাজিন। পত্রপত্রিকাগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র এবং ঈদ ম্যাগাজিন প্রকাশ করে। এসব ম্যাগাজিন এবং সাহিত্য পত্রিকায় ছাপা হয় ঈদের ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, ফিচার, নাটক, উপন্যাস প্রভৃতি।

আমাদের দেশে ঈদ উৎসব সাড়ম্বরে শুরু হয়েছে মাত্র এক দেড়শ বছর পূর্ব থেকে। ক্রমে ক্রমে ঈদ আমাদের জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। ঈদকে কেন্দ্র করে মধ্যযুগে বা আধুনিক যুগ অব্যবহিত পূর্বে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো কবিতা, গল্প, নাটক সৃষ্টি হয়নি। অনেকের মতে সৈয়দ ইমদাদ আলী ঈদের কবিতার প্রথম রচয়িতা। ১৯০৩ সালে তাঁর সম্পাদিত ‘নবনূর’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় তার ঈদ বিষয়ে কবিতা। এটি পরবর্তীতে তাঁর ‘ডালি’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণে স্থান লাভ করে। ঈদের এই প্রথম কবিতাটি ঐতিহাসিক। কিছু অংশের উদ্ধৃতি:
কুহেলী তিমির সরায়ে দূরে
তরুণ অরুণ উঠিছে ধীরে
রাঙিয়ে প্রতি তরুণ শিরে
আজ কি হর্ষ ভরে।
আজি প্রভাতের মৃদুল বায়ে
রঙে নাচিয়া যেন কয়ে যায়
মুসলিম জাহান আজি একতায়
দেখ কত বল ধরে।
তবে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমানকে মনে রাখতে হবে যে মানুষের ক্ষমতা সীমিত। আমাদের সকল সাফল্যের মূলে রয়েছে সর্বশক্তিমান আল্লাহর আশীর্বাদ। তাই ঈদের খুশি সামাজিকভাবে ভোগ করার আগে মুসলমান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এই জন্য যে, তিনি তাকে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার তৌফিক দান করেছেন। দিনের আলোকে সবার সঙ্গে আনন্দ উপভোগ করার আগে সে ছুটে যায় ঈদগাহে এবং সবাই সম্মিলিতভাবে নামাজ আদায় করে।

তারপর শুরু হয় সামাজিক দিক। প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া, কোলাকুলি করা, মিষ্টি খাওয়া, ছেলে-মেয়েদের নতুন জামা-কাপড় পরে ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি। অতএব সে উৎসবে অংশগ্রহণ মধ্যে তার উৎসবপ্রিয়তার কারণ নিহিত আছে। তাছাড়া মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করে। সমাজের অধিকাংশ মানুষ আনন্দ-উৎসবে মেতে উঠেছে, তাতে অংশগ্রহণ করাটা সমাজবদ্ধতার পরিচয় বহন করে।

কিন্তু এই ধুমধামের মধ্যে ঈদ উৎসবের আসল উদ্দেশ্যটা হারিয়ে যাচ্ছে। যেখানে সংযম, কৃচ্ছ্রতার শিক্ষা গ্রহণ করার কথা সেখানে অপচয় অসংযমকে আমরা নির্বিচারে গ্রহণ করে নিয়েছি। যে খোদাভীতি বা চেতনা রোজার মর্মকথা সে চেতনা জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। রমজান মাসেই মজুদদারি মুনাফাখুরি, সুদ, ঘুষ আগের মতোই চলতে থাকে। যে শয়তান শৃঙ্খলিত থাকার কথা সেই শয়তানের কর্মকাণ্ড অব্যাহত গতিতে চলতে থাকে। এর অর্থ কি এই নয় যে, এই মাসে আমরা কিছু আচার পালন করছি, কিন্তু এই আচারের ংঢ়রৎরঃ বা মর্মকথা আমরা অনুধাবন করিনি? রমজানের শিক্ষা আমাদের কাছে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে। আমরা পূত-পবিত্র হয়নি; পঙ্কিলতার আবর্তে আকণ্ঠ ডুবে আছি। আমাদের জীবনযাত্রার মধ্যে, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কোনো পরিবর্তন হয়নি। যে সংযম ও আত্মশুদ্ধির প্রশিক্ষণ আমরা নিয়েছি তার কোনো সুফল আমাদের জীবনে আসেনি- আমরা মোত্তাকি হতে পারিনি।

ঈদকে কেন্দ্র করে বর্তমান সময়ের অনেক কবিই প্রচুর কবিতা লিখেছেন- যেগুলো একত্রিত করে আলাদা ঈদের কাব্যগ্রন্থ রচিত হতে পারে। বাংলা সাহিত্যের যেসব কবি ঈদ নিয়ে ছড়া ও কবিতা লিখেছেন তাদের সৃষ্টিসমূহ একত্রিত করে ‘ঈদের কবিতা’ শীর্ষক সম্পাদনাগ্রন্থ রচিত হতে পারে। উদঘাটিত হতে পারে সৃষ্টিমুখর ঈদ কবিতা সা¤্রাজ্যের। এ সাথে একথাও সত্য ঈদকে নিয়ে যত রচনা হচ্ছে তার চেয়ে ঈদ উপলক্ষে বিশেষ ম্যাগাজিনে যে সব ভিন্ন ধারার কবিতা ছড়া রচিত হয়েছে তার সংখ্যাও অপ্রতুল নয়। ঈদকে নিয়ে কাব্য নাটক এমনকি একক সনেট গ্রন্থ কিংবা কোনো মহাকাব্যও রচিত হতে পারে। নতুন নতুন দিগন্তে নিরন্তর সৃষ্টিমুখর হওয়াই জীবনবাদিতার লক্ষণ। আমাদের সাহিত্য-ঈদকেন্দ্রিক কাব্যজগৎ, একদিন বিশ^সাহিত্যকে শাসন করবে- এ আশা আমরা এখন সঙ্গত কারণেই প্রত্যাশা করতে পারি।
তাই ঈদ বয়ে আনুক সবার জীবনে অনাবিল শান্তি।

Share.

মন্তব্য করুন