শিরোনাম দেখে অবাক হওয়ারই কথা। রঙধনু তো আকাশেই উদিত হয় কিন্তু নদীতে কি করে সম্ভব! হয়তো এটি আমাদের চিন্তায় কুলাবে না। কিন্তু মহান আল্লাহ এই পৃথিবী এমন বিস্ময়করভাবে সৃষ্টি করেছেন যে, এই সৃষ্টির রহস্য একমাত্র তিনিই ভালো জানেন। তবু আমরা চেষ্টা করবো এই সৃষ্টির রহস্য জানার। দেশটির নাম কলম্বিয়া। নদীর নাম ‘কানো ক্রিস্টেলস’। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নদীগুলোর একটি। যে নদীতে দেখা যায় রঙধনুর সাতরঙের খেলা। তাই কেউ এই নদীকে ‘‘River of Five Colors’’, আবার কেউ বলেন ‘The Liquid Rainbow। তবে নদীটির অফিসিয়াল নাম হলো ‘Cano Cristales’ বা ‘Rio Cano Castales;। নদীর বুকজুড়ে এমন রঙিন উৎসব খেলার কারণে স্থানীয় লোকজন বলেন, “স্বর্গ হতে উৎপত্তি হওয়া নদীটি নাকি ভুলক্রমে পৃথিবীর বুকে চলে এসেছে!”
কানো ক্রিস্টেলস পৃথিবীর একমাত্র রঙিন নদী। নদীটি বয়ে চলেছে কলম্বিয়ার সেরেনিয়া দি লা মাকারেনা রাজ্যের এক দুর্গম পাহাড়ি পথ বেয়ে। কলম্বিয়ার প্রতিবেশি দেশ ভেনেজুয়েলার সীমান্ত এলাকায় অসংখ্য ঝর্ণার পানি থেকে সৃষ্ট এই নদী। লম্বায় ১০০ কিলোমিটার। চওড়া ২০ মিটার এই নদীর পানি কিন্তু সবসময় এমন রঙিন থাকে না। কেবল বর্ষা মৌসুম এলেই এই নদী মেতে ওঠে রঙের খেলায়। তার সাথে সাথে প্রকৃতির চারপাশও রঙিন হয়ে ওঠে। কানায় কানায় পানি ভরে গেলে নদী পূর্ণতা ফিরে পায়। যেন অসংখ্য প্রজাপতি তার রঙিন ডানা মেলে নদীর তলদেশে করছে খেলা। তখন মনে হয় যেন, সৃষ্টিকর্তা যেন তার কুদরতি নিপুণ হাতে রঙতুলি নিয়ে বসেছেন নদীটি সাজাতে।
রঙের জাদুর খেলা চলতে থাকে জুলাই থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত। এ সময়টাতে নদীর স্বচ্ছ পানির নিচে শুরু হয় রঙের বিস্ফোরণ। শুকনো মৌসুম পেরিয়ে বর্ষার নতুন পানি পেয়ে নদীর তলদেশে জলজ উদ্ভিদ, প্রবাল ও নানারকমের গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ দ্রুত বাড়তে থাকে। যার ফলে নদীতে এই অপূর্ব রঙের সমাবেশ ঘটে। তখন ‘মাকারেনিয়া ক্লাভিগেরা’ নামক লাল রঙের এক বিচিত্র গুল্ম দ্রুত বাড়তে থাকে। এই গুল্ম লতাগুলো নদীর স্রােতের সাথে দুলতে থাকে। নদীর যে দিকটায় স্রােত বেশি থাকে, সেখানে লাল রঙের গুল্মটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। আর এ কারণেই তখন এই নদীর পানির রঙ লালচে দেখায়। দিনের বেলায় বিভিন্ন বিভিন্ন সময়ে সূর্যের আলোর কমবেশির ওপর নির্ভর করে মাকারেনিয়া ক্লাভিগেরা গুল্মটি কোথাও রক্তবেগুনি, কোথাও বা উজ্জ্বল লাল বর্ণ থেকে গভীর বেগুনী রঙয়ের আকার ধারণ করে।
আবার নদীর তলদেশেও পাথরের গায়ে সবুজ গুল্ম ও শ্যাওলার কারণে অনেক জায়গায় সবুজ রঙের মেলা বসে। নদীর যে অংশে সূর্যের আলো যেতে পারে না, সেখানে নদীর নীল জলরাশি এবং কালো পাথরের কারণে নীল রঙ খুব ভারী হয়ে দেখা দেয়।
যেখানে গুল্ম লতা জন্মাতে পারে না, সেখানে হলুদ বালির কারণে নদীর পানি রঙ হলুদ দেখায়। এভাবে নদীর কোথাও লাল রঙের বর্ণচ্ছটা, কোথাও সবুজ, নীল, হলুদের এক অদ্ভুত মিশ্রণে মোহনীয় জলধারার সৃষ্টি হয়। নদীর এই রঙের জাদু খেলা দেখতে হলে যেকোনো সময় গেলে হবে না। যেতে হবে যখন নদীর পানির গভীরতা কম নয় আবার বেশিও নয় এমন সময়ে। এ সময়টি হয়ে থাকে সাধারনত সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত। তখনই কানো নদীর এই সৌন্দর্য সবচেয়ে বেশি পষ্ট হয়। আর তখন এর স্থায়ী হয় মাত্র কয়েক সপ্তাহ।
কানো ক্রিস্টেলসে জলজ উদ্ভিদ থাকলেও এখানে কোনো জলজ প্রাণী, মাছ বা সরীসৃপ নেই। যদিও নদীর তলদেশ ধূসর পলি মাটির শিলায় তৈরি। কিন্তু উপরিভাগে বালুকণা কম থাকায় নির্মল পরিস্কার পানিতে নিজের ছবি পষ্টই চিনতে কোনো ভুল হয় না। যার কারণে নদীর প্রতিটি রংই আলাদা আলাদা চেনা যায়।
শুধু বৈচিত্র্যময় রঙের কারণে কানো ক্রিস্টেলস পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে এমন নয়। বরং এর চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য, গাছগাছালি, পাহাড়ের অসংখ্য ঝর্ণা, পাথুরে পাহাড়ে ঘেরা কাফ্রি নদী। নদীর অগভীর জলে আরেকটি দৃশ্য মুগ্ধ করে সবাইকে যখন সাঁতার কাটতে নামা হয়। দেখা পাহাড়ের আড়ালে রয়েছে শত শত গুহা! এসব চমৎকার সব দৃশ্য নদীর সৌন্দর্য যেমন বাড়িয়েছে তেমনি পর্যটকদের যেন হাত বাড়িয়ে ডাকছে।
পাহাড় আর সমতল জায়গা মিলে কানো নদীর এলাকাটি প্রায় ১৬ মিলিয়ন হেক্টর নিয়ে গঠিত। এই সমতলভূমিতে কলম্বিয়ার রয়েছে চারভাগের এক ভাগ অংশ। সমতলভূমিটি ‘লস ল্যালনস’ নামে পরিচিত। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকা হিসেবে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সবুজে ঘেরা সমতলভূমি। এখানে শিকারী পাখি ও এনাকোন্ডার মতো বিশাল সাপেদের বসবাস রয়েছে। অনেক বিপণœ প্রাণীদের বসবাসের স্থান হিসেবে গড়া এখানকার পরিবেশ। তাই লস ল্যালনসের মাত্র ২৫৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় পর্যটকদের ভ্রমণের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
কানো এলাকার পাহাড়সহ এটিকে সংরক্ষিত জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে কলম্বিয়ার এ এলাকায় প্রতি বছর বাড়ছে পর্যটকদের ভীড়। কিন্তু সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেপরোয়া হয়ে উঠে। এ সময় গেরিলা আক্রমণের কারণে পর্যটকদের জন্য স্থানটি কিছু কাল বন্ধ ঘোষণা করে সরকার।
২০০৯ সালের পর আবার পর্যটকদের জন্য এলাকাটি খুলে দেয়া হয়। তবে জলবায়ু এবং পরিবেশ যেন নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রেখে দিনে ২০০ এর বেশি পর্যটক ঘুরার অনুমতি পায় না।
কিন্তু নানা পর্যটন সংস্থা গড়ে ওঠায় পর্যটকদের নদী এবং নদীর চারপাশ ঘুরে দেখতে কোনো অসুবিধা হয়না। নদীর পাশে থাকা এমনকি বনভোজনে ব্যবস্থাও আছে। জোছনা রাতে নদীর পাশ্ববর্তী এলাকা এক স্বর্গীয় খেলায় মেতে উঠে, তাই পূনির্মার সময় অন্য দিনের চেয়ে একটু বেশি ভিড় দেখা যায়।
Share.