তখন কার্টুন দেখতাম ‘পাপাই’। ওরে কি প্রিয় পাপাই! মুচকি হাসি পাপাই স্পিনাচ খেয়ে সব প্রব্লেম সলভ করে। আর নানাভাই একটা টুলবক্স নিয়ে ম্যাকগাইভারের মতন যাবতীয় অসুস্থ মেশিন সারিয়ে ফেলে! মনে করতাম পুরোটাই মিল। সেজন্য জন্য সাবকনশাসলি আমি নানাভাইকে পাপাই ভাবতাম আর উনাকে পাপাই ডাকতাম!
নানাভাই এতো যত্নশীল যা মানে স্বাভাবিক না। বাংলা নায়ক স্টাইলে কারেন্টের খাম্বার সাথে মাথায় ধাক্কা খেলেও ভুলে যাওয়ার মতো না! সেভেন এইটে পড়ি-বুড়ি, তবুও রাস্তা পার করে দিতো স্কুলে যাওয়ার সময় যেখানে উনার নিজেরই হাঁটতে কষ্ট হয়। বলতাম, ‘নানাভাই, খিদা লাগছে।’ হাতে মানিব্যাগটা ধরিয়ে দিতো। গল্প করতাম আমরা। আমি অনেক নতুন এবং সুন্দর ইংলিশ শব্দ শিখেছি নানাভাইয়ের কাছ থেকে। নানাভাইয়ের সামনে চোখ ঘষলেও উনি জিজ্ঞেস করতে থাকতেন আমি কাঁদি নাকি। হাউমাউ শুরু করে দিতো! এমন অনেক হয়েছে যে আমি কাঁদছি তাই উনিও কান্না করছেন আমার সাথে!
রূপগঞ্জের ফ্যাক্টরিতে নানাভাই যখন ম্যানেজারির চাকরি করতেন তখন সপ্তাখানেক উনাদের সাথে ফ্যাক্টরির কোয়ার্টারে ছিলাম। আমার অত্র জীবনের সবচাইতে মধুরতম সাত দিন ছিলো সেই ট্রিপ। আম্মু আব্বু বেব কেউ নাই। শুধু আমি, নানু আর নানাভাই। সকাল হলেই নানু সুন্দর করে চুল আঁচড়ে দিতেন। যত্ন করে আমার চশমা মুছে দিতেন। তারপর ফাটাফাটি কিছু একটা নাস্তা করে নানাভাইয়ের সাথে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতাম। পিঁপড়ার ডিম নাকি মাছেদের কাচ্চি বিরিয়ানি। কোথা থেকে নানাভাই এই দুর্লভ জিনিস উদ্ধার করলো তার ঘটনা শুনতাম। আগে যদি জানতাম এমন আনন্দের সময় আর ফেরত আসে না তাহলে কিছু মেমোরি আলবত লিখে রাখতাম!
উনাকে একবার কি বুঝে যেন জিজ্ঞেস করলাম, ‘নাতি-নাতনির মধ্যে আপনার সবচাইতে পেয়ারের কে?’ নানাভাই উনার সিলগালা হাই-ফ্রিকোয়েন্সি হোহোহাহা হাসি দিলো। কোন জবাব দিতে চাইলো না। কিন্তু আমি ঘাউড়া কিসিমের। প্রচুর মুলামুলি করলাম। কাতুকুতু দিলাম। তারপর নানাভাই উত্তর দিলেন, ‘আবাবিল’। আমার খালামনির বড় ছেলে।
তৎক্ষণাৎ একটা প্রবল ঝুনঝুন শব্দ হলো। আমার ক্লাস থ্রিয়ের কাচ হৃদয় ভেঙে হলুদ গুঁড়ো – মরিচ গুঁড়ো হয়ে গেলো। আমি ৯৯% কনফার্ম ছিলাম আমার নামই উঠবে লটারিতে। কিন্তু ১% এর জয় হয়ে গেলো! এরপর থেকে আমি বহুবার বুঝার চেষ্টা করেছি যে আদৌ ভাইয়া নানাভাইয়ের বেশি প্রিয় কিনা। যদিও কাজ- কথা- মুখের হাবভাব কোন কিছুতেই আমি স্নেহের কোনো উপর নিচ দেখি নি। জিন্দেগিতেও উনি বায়াসড না। এখানেই আমার নানাভাই স্পেশাল। আমার নানাভাই স্মার্ট।
এই লোকটার কাছ থেকে শিখেছি কত দারুণভাবে স্নেহ প্রকাশ করা সম্ভব। আমিও আমার নানাভাইকে অনেক স্নেহ করি। খুব সম্ভবত আম্মুর চাইতেও বেশি পেট পুড়ে নানু-নানাভাইয়ের জন্য। কারণ এটাই সায়েন্স। যারা আমাকে সর্বাবস্থায় হাজার হাজার কিউসেক মমতা অফার করলো তাদের জন্য রিফ্লেক্সের মতো আমার মনেও মমতা তৈরি হবে। হ্যাঁ, এক পিস জীবনে কষ্টে কাইত চিত হওয়ার মতো এক্সপেরিয়েন্স আছে। কিন্তু, সব ছাপিয়ে আমি আল্লাহর কাছে অনেক গ্রেইটফুল আমার নানু-নানাভাইয়ের জন্য।
আজকাল এই ভেবে সিরিয়াস পীড়া লাগে যে উনারা বুড়ো হয়ে গিয়েছেন। জানি না কে কয়দিন বাঁচবো। শুধু দোয়া করতে থাকি যাতে উনাদের সাথে আবার কিছু সুন্দর সময় কাটাতে পারি। মজা করে চানাচুর মুড়ি মাখিয়ে খেতে পারি। নানাভাই কেন এত কাছে থেকে টিভি দেখে এই ব্যাপারে উনাকে একটু হুলুস্থুল বকা দিতে পারি! নানুর সাথে এক নাম্বারে উইন্ডো শপিং করতে পারি। আর আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে পারি।

Share.

মন্তব্য করুন