আমরা যে বিশ্বে বাস করি তার বহু নাম আছে। বিশ^ আগেই বললাম। এর ইংরেজি ওয়ার্ল্ড । এছাড়া পৃথিবী বা আর্থ এবং প্লানেট বলেও তাকে বুঝানো হয়। এর সমার্থক আরো শব্দ হচ্ছে- বসুধা, বসুন্ধরা, ধরা, ধরনী, ধরিত্রী, ধরাতল, ভূমি, ক্ষিতি, মহী, দুনিয়া ইত্যাদি। বুঝতেই পারছ এই পৃথিবীর কতগুলো নাম। পৃথিবী শব্দটি এসেছে সংস্কৃত থেকে। এর অপর নাম পৃথ্বী। অনেকগুলো মহাদেশ বা কন্টিনেন্ট এবং প্রায় দুশো দেশ বা কান্ট্রি নিয়ে পৃথিবী গঠিত। এই মহাদেশগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে এশিয়া, যে মহাদেশে আমাদের বাস। আরেকটি মহাদেশ আছে যার নাম এন্টার্কটিকা। নাম শুনেছ আশা করি। আজ এই মহাদেশ নিয়েই কথা বলবো। অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ অত্যন্ত শীতল হওয়ায় এই মহাদেশের অধিকাংশ স্থান সারাবছরই ১-২ কিমি পুরু স্থায়ী সাদা বরফের চাদরে ঢাকা থাকে বলে একে সাদা মহাদেশও বলা হয়। কারণ বরফে ঢাকা অংশ সাদা দেখায়।
মহাদেশ বা ইংরেজিতে কন্টিনেন্ট বলতে পৃথিবীর বড় ভূখ-সমূহকে বুঝায়। পৃথিবীতে ৭ টি মহাদেশ রয়েছে। এগুলো হল এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ওশেনিয়া, ও অ্যান্টার্কটিকা। এসব কথা ভাগ্নে ভাগ্নিদের বলছিলাম। এমন সময় রবিন বলে উঠল অস্ট্রেলিয়া এই তালিকায় নেই কেন? আসলেই তো। সবাই জানি অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের কথা। একটি দেশ নিয়েই একটি মহাদেশ। ঘটনা হচ্ছে দ্বীপসমূহকে পার্শ্ববর্তী মহাদেশের অন্তর্গত হিসেবে ধরা হয়। এর ফলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপসমূহকে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের অন্তর্ভুক্ত করে নতুন ভূ-রাজনৈতিক অঞ্চল ওশেনিয়া সৃষ্টি করা হয়েছে। এই ওশেনিয়ার মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। তা হলে কথা দাঁড়ালো এই যে পৃথিবীতে ৭ টি মহাদেশ রয়েছে। মহাদেশগুলো হল এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ওশেনিয়া ও অ্যান্টার্কটিকা। হাসি ফুটলো রবিনের মুখে।
বলছিলাম অ্যান্টার্কটিকা বা এন্টার্কটিকার কথা। বাংলায় দু’ভাবেই লেখা হয় এর নাম। এটি পৃথিবীর দক্ষিণতম মহাদেশ । অ্যান্টার্কটিক সার্কেল প্রায় সম্পূর্ণ দক্ষিণে অবস্থিত এবং দক্ষিণ মহাসাগর দ্বারা বেষ্টিত এই মহাদেশ। এটিতে ভৌগোলিক দক্ষিণ মেরু রয়েছে। অ্যান্টার্কটিকা হল বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম মহাদেশ। আয়তনে অস্ট্রেলিয়ার প্রায় দ্বিগুণ। এর আয়তন ১,৪২,০০,০০০ বর্গ কি:মি: । ৫৫,০০,০০০ বর্গমাইল । অ্যান্টার্কটিকার বেশিরভাগ অংশই বরফ দিয়ে আবৃত। এর গড় পুরুত্ব ১.৯ কি:মি: বা ১.২ মাইল । বুঝতে পারছ কি অবস্থা?
১৭৭৩ সালে জেমস কুক এবং তার নাবিকদল সর্বপ্রথম অ্যান্টার্কটিক সার্কেল বা কুমেরুবৃত্ত অতিক্রম করেন ও এর নিকটবর্তী দ্বীপগুলো আবিষ্কার করেন। বিশ্ব বিখ্যাত কোষ গ্রন্থ এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা বলছে : Antarctica, the world’s southernmost and fifth largest continent. Its landmass is almost wholly covered by a vast ice sheet. Often described as a continent of superlatives, Antarctica is not only the world’s southernmost continent. It is also the world’s highest, driest, windiest, coldest, and iciest continent. Antarctica is about 5.5 million square miles (14.2 million square km) in size, and thick ice covers about 98 percent of the land. The continent is divided into East Antarctica (which is largely composed of a high ice-covered plateau) and West Antarctica (which is largely an ice sheet covering an archipelago of mountainous islands).
উইকিপিডিয়া বলছে : অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের গড়ে মধ্যে সবচেয়ে ঠাণ্ডা , শুষ্কতম এবং বায়ুপ্রবাহপূর্ণ এবং সর্বোচ্চ গড় উচ্চতা রয়েছে। এটি প্রধানত একটি মেরু মরুভূমি, যেখানে বার্ষিক ২০০ মিমি (৮ ইঞ্চি) বৃষ্টিপাত হয় উপকূল বরাবর । বিশ্বের প্রায় ৭০% স্বাদু পানির রিজার্ভ সেখানে হিমায়িত রয়েছে। তা যদি গলে যায় বৈশ্বিক সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৬০ মিটার (২০০ ফু) বেড়ে যাবে। বোঝ কি কঠিন অবস্থা হবে তখন । অ্যান্টার্কটিকা পৃথিবীর সর্বনিম্ন মাপা তাপমাত্রার রেকর্ড মাইনাস(−) ৮৯.২ সেলসিয়াস (−)১২৮.৬ ফারেনহাইট) । তৃতীয় ত্রৈমাসিকের (বছরের শীতলতম অংশ) গড় তাপমাত্রা মাইনাস −৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস (মাইনাস− ৮১ ডিগ্রি ফারেনহাইট) । মাইনাস হচ্ছে হিমাংকের নিচের তাপমাত্রা। সেখানে প্রাণীর সংখ্যা কম। স্থানীয় প্রজাতির মধ্যে রয়েছে মাইট, নেমাটোড, পেঙ্গুইন, সীল এবং টার্ডিগ্রেড । গাছপালা তুন্দ্রা নিয়ে গঠিত।
অ্যান্টার্কটিকার মহাদেশীয় স্তুপ সম্ভবত ১৮২০ সালে প্রথম দেখা গিয়েছিল, যখন ফ্যাবিয়ান গটলিব ভন বেলিংশউসেন এবং মিখাইল লাজারেভের নেতৃত্বে রাশিয়ান অভিযান ফিম্বুল বরফের চর দেখেছিল। মহাদেশটি ১৮৪০ সালের জানুয়ারিতে লেফটেন্যান্ট চার্লস উইলকসের অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুসন্ধান অভিযান দ্বারা আবিষ্কৃত হয়; এবং জুলস ডুমন্ট ডি’উরভিলের অধীনে একটি পৃথক ফরাসি অভিযান চলে।
উইল্কস অভিযান : যদিও এটি অবতরণ করেনি-এই অঞ্চলে ১,৩০০ কিমি (৮০০ মাইল) জরিপ করার জন্য যথেষ্ট দীর্ঘ ছিল উপকূলের সীমানা। ১৮৯৫ সালে একটি নরওয়েজিয়ান দল প্রথম নিশ্চিতভাবে অবতরণ করেছিল। গ্রীষ্মের মাসগুলোতে ৫,০০০ লোক গবেষণা স্টেশনগুলোতে বসবাস করে, যা শীতকালে প্রায় ১,০০০-এ নেমে আসে। অ্যান্টার্কটিকায় প্রায় ৩০টি দেশ রয়েছে, যার সবকটিই ১৯৫৯ অ্যান্টার্কটিক চুক্তি ব্যবস্থার পক্ষ। চুক্তির শর্তাবলী অনুসারে, সামরিক কার্যকলাপ, খনি, পারমাণবিক বিস্ফোরণ এবং পারমাণবিক বর্জ্য নিষ্পত্তি সবই নিষিদ্ধ।
আরেকটু খুলে বলি। সাড়ে পাঁচ কোটি বছর আগের সেই সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ংকর ফল টের পায় পৃথিবী। পুরো বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে যায় প্রচ-ভাবে। সে সময়ের গড় তাপমাত্রাকে বলা হয় ইতিহাসে সর্বোচ্চ। বিজ্ঞানীরা বলেন, প্যালিওসিন-ইওসিন থার্মাল ম্যাক্সিমাম। প্যালিওসিন আর ইওসিন দুটো যুগের নাম। তখনো অ্যান্টার্কটিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকা রয়েছে একসঙ্গে। এ সময় দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ক্যাঙ্গারুর মতো প্রাণীরা শত-সহস্র মাইল পাড়ি দিয়ে চলে আসে অ্যান্টার্কটিকায়। পরে আবার জলবায়ু তুলনামূলক শীতল হয়ে এলে এগুলো ধীরে ধীরে চলে যায় অস্ট্রেলিয়ায়। এরপর শুরু হয় অ্যান্টার্কটিকার ভাঙন। ভেঙে অস্ট্রেলিয়ার পাশ থেকে সরে তো আসেই, একসময় চারপাশে সমুদ্রবেষ্টিত হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আর সব স্থলভাগ থেকে।
অ্যান্টার্কটিকাকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে মহাসমুদ্র। এই মহাসমুদ্রে অ্যান্টার্কটিকার চারদিকে বয়ে যায় পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিস্রোত। সেকেন্ডে প্রায় ১৪ কোটি ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। পরের প্রায় আড়াই কোটি বছরে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা কমে যায় প্রায় ১৫ ডিগ্রি। অ্যান্টার্কটিকা ধীরে ধীরে ঢাকা পড়তে থাকে পুরু বরফের চাদরে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় অ্যান্টার্কটিক সারকামপোলার কারেন্ট বা এসিসি। বাংলায় বলা যায়, অ্যান্টার্কটিক ঘূর্ণিস্রোত।
অ্যান্টার্কটিকাকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে মহাসমুদ্র। এই মহাসমুদ্রে অ্যান্টার্কটিকার চারদিকে বয়ে যায় পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিস্রোত। সেকেন্ডে প্রায় ১৪ কোটি ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। এই ভয়ংকর তীব্র ঘূর্ণিস্রোত উষ্ণ পানিকে বয়ে নিয়ে যায় উত্তরদিকে। পাশাপাশি সমুদ্রের গভীর গহিন থেকে তুলে আনে লবণাক্ত শীতল পানি। এর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে অ্যান্টার্কটিকাতেই। একদিকে পৃথিবীর তাপমাত্রা কমে যাওয়া, আরেকদিকে এই স্রোতের প্রভাব—দুইয়ে মিলে অ্যান্টার্কটিকা পরিণত হতে থাকে বরফমেরুতে। এক সময়কার গ্রীষ্মম-লীয় গাছ, পশু-পাখি এই শীতে আর টিকতে পারেনি। বিলুপ্ত হয়ে গেছে ধীরে ধীরে। শুধু টিকে যায় শীত সহ্য করতে পারে, এমন উদ্ভিদ ও প্রাণীরা। এভাবে ধীরে ধীরে প্রায় প্রাণহীন এক মহাদেশে পরিণত হয় অ্যান্টার্কটিকা। শেষ প্রায় ২৫ লাখ বছর আগে এ বরফমেরু পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে জীবনধারণের উপযোগিতা। এই হলো সাদা মহাদেশের কাহিনী।
এন্টার্কটিকা নাম এলো কি করে
এন্টার্কটিকা নামটি অ্যান্টার্কটিক শব্দ থেকে এসেছে। অ্যান্টার্কটিকা নামটি প্রকৃতপক্ষে গ্রিক যৌগিক শব্দ আন্তার্কতিকে-এর (গ্রিক: ἀνταρκτικός) রোমান রূপ। এই শব্দটি গ্রিক আন্তার্কতিকোস (গ্রিক: ἀνταρκτικός) শব্দটির স্ত্রীলিঙ্গবাচক প্রতিশব্দ যার অর্থ “আর্কটিকের বিপরীত” বা “উত্তরের বিপরীত”। জানা যায়, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ অব্দ নাগাদ অ্যারিস্টটল তাঁর মেতেওরোলজিকা গ্রন্থে একটি অ্যান্টার্কটিক অঞ্চলের কথা উল্লেখ করেন। কথিত আছে, খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে তিরের মারিনোস তাঁর অসংরক্ষিত বিশ্ব মানচিত্রে এই নামটি ব্যবহার করেছিলেন। রোমান লেখক হাইজিনাস ও এপুলিয়াস (খ্রিস্টীয় প্রথম-দ্বিতীয় শতাব্দী) দক্ষিণ মেরু অর্থে রোমানীকৃত গ্রিক পোলাস আন্তার্কতিকাস (লাতিন: polus antarcticus) নামটিকে গ্রহণ করেন। এই নামটি থেকে ১২৭০ সালে প্রাচীন ফরাসি পোলে আন্তার্তিকে (প্রাচীন ফরাসি: pole antartike; আধুনিক ফরাসি ভাষায়: pôle antarctique) নামটির উদ্ভব ঘটে। এই ফরাসি শব্দটি থেকে ১৩৯১ সালে জিওফ্রে চসার একটি পরিভাষাগত সনদে মধ্য ইংরেজি পোল আন্টার্কটিক (মধ্য ইংরেজি বানান: pol antartik; বর্তমান ইংরেজি বানান: Antarctic Pole) নামটি গ্রহণ করেন। বর্তমান ভৌগোলিক নামটি অর্জনের আগে এই শব্দটি “উত্তরের বিপরীত” অর্থে একাধিক স্থানের নাম হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ষোড়শ শতাব্দীতে ব্রাজিলে স্থাপিত স্বল্পকাল স্থায়ী ফরাসি উপনিবেশটিকে বলা হত “ফ্রান্স আন্তার্কতিকে”। ১৮৯০-এর দশকে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে একটি মহাদেশের নাম হিসাবে “অ্যান্টার্কটিকা” শব্দটি ব্যবহৃত হয়। স্কটিশ মানচিত্রাঙ্কনবিদ জন জর্জ বার্থেলোমিউকে এই নামকরণের হোতা বলে মনে করা হয়।
আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত ইউরোপীয়রা টেরা অস্ট্রেলিয়া অস্তিত্বে বিশ্বাস করেছে। ইউরোপ, এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার উত্তর ভূমির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য পৃথিবীর সুদূর দক্ষিণে একটি বিশাল মহাদেশ ধ্রুপদী প্রাচীনকাল থেকেই একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ধারণা হিসাবে বিদ্যমান ছিল। এমন একটি ভূখ-ের বিশ্বাস অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
মজার বিষয়, ১৯ শতকের গোড়ার দিকে আবিষ্কারক ম্যাথিউ ফ্লিন্ডার্স অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণে একটি বিচ্ছিন্ন মহাদেশের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, যাকে তখন নিউ হল্যান্ড বলা হয়েছিল। এইভাবে অস্ট্রেলিয়ার পরিবর্তে “টেরা অস্ট্রালিস” নামটি ব্যবহার করার পক্ষে সমর্থন করেছিলেন। ১৮২৪ সালে সিডনির ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে নিউ হল্যান্ড মহাদেশের নাম পরিবর্তন করে অস্ট্রেলিয়া রাখে, অ্যান্টার্কটিকার উল্লেখ হিসাবে “টেরা অস্ট্রালিস” শব্দটি বোঝার মতো নয় বলে রেখেছিল। পরবর্তী দশকগুলোতে ভূগোলবিদদেরকে “অ্যান্টার্কটিক মহাদেশ” এর মতো আনাড়ি বাক্যাংশ দিয়ে কাজ করতে হয়েছিল। তারা আলটিমা এবং অ্যান্টিপোডিয়ার মতো বিভিন্ন নাম প্রস্তাব করে আরও কাব্যিক প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন বলে জানা যায়। অ্যান্টার্কটিকা শব্দটি ১৮৯০-এর দশকে গৃহীত হয়েছিল। নামটির প্রথম ব্যবহার করেনস্কটিশ মানচিত্রকার জন জর্জ বার্থলোমিউ।
এন্টার্কটিকা আবিষ্কার হলো কি করে
আবিষ্কারের নেশায় অভিযাত্রী দল এখানে সেখানে নানা অভিযান চালান। তেমনি একজন জেমস কুক। ১৭৭৩ সালে জেমস কুক এবং তার নাবিকদল সর্বপ্রথম অ্যান্টার্কটিক সার্কেল বা কুমেরুবৃত্ত অতিক্রম করেন ও এর নিকটবর্তী দ্বীপগুলো আবিষ্কার করেন। তবে তারা অ্যান্টার্কটিকার মূল ভূখ- দেখতে পাননি। ধারণা করা হয় যে তারা মূল ভূখ-ের প্রায় ২৪০ কি.মি.(১৫০ মাইল) দূরে অবস্থান করছিলেন। দুঃসাহসী নাবিক জেমস কুকের জন্ম ১৭২৮ সালের ২৭ অক্টোবর ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের ক্লেভল্যান্ডের মার্টন নামক এক গ্রামে। কুকের বাবা ছিলেন কারখানার ফোরম্যান। লেখাপড়ার পাশাপাশি কুক একটি জেনারেল স্টোরে কাজ করতেন, যা ছিল সাগরের কাছে। সাগর দেখতে দেখতে তাঁর মনে সাধ জেগেছিল সাগর পাড়ি দেওয়ার। ১৮ বছর বয়সে তাঁর পরিচয় ঘটে জন ওলকার নামে এক জাহাজ মালিকের সঙ্গে। তিনি কুককে জাহাজে কাজ দেন। এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর নাবিকজীবন। ১৭৫৮ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল, শুক্র গ্রহ নাকি পৃথিবীর ওপর দিয়ে যাবে। আর এ অলৌকিক দৃশ্যটি পৃথিবীর একটি দ্বীপ থেকে ভালো দেখা যাবে। কিন্তু প্রশান্ত মহাসাগরের এই দ্বীপে জাহাজ নিয়ে কে যাবে? সে সময় একজন সাহসী নাবিকের খোঁজ করতেই ক্যাপ্টেন কুকের নাম উঠে এলো। পাল তোলা জাহাজ নিয়ে ক্যাপ্টেন কুকের নেতৃত্বে ওই ভয়ংকর সাগর পাড়ি দিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। এনডেভর নামের জাহাজটি নিয়ে প্রমত্ত মহাসাগরের তাহিতি দ্বীপে পৌঁছাতে সময় লেগেছিল আট মাস। তিনি শুনেছিলেন, এদিকে আরো অনেক দ্বীপ আছে, যা মানুষ জানে না। একটানা সমুদ্রযাত্রা করে তিনি পৌঁছালেন এক নতুন দেশে। দেশটির নাম ‘নিউজিল্যান্ড’। এ দ্বীপটি ১৭৪৬ সালে ইংল্যান্ডের এক নাবিক আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু তিনি কোনো জরিপ চালাননি। এ জরিপের কাজটি করলেন ক্যাপ্টেন কুক। আবার জাহাজ ভাসালেন। ১৭৭০ সালের ১৯ এপ্রিল তিনি পৌঁছালেন অস্ট্রেলিয়া। এখানে আগে যারা এসেছিল, তারা দ্বীপটির রুক্ষ আর মরুময় উপকূল দেখেছিল। কিন্তু কুক আবিষ্কার করেন সুজলা-সুফলা এক অপরূপ সুন্দর দেশের। দ্বীপের এ প্রাণময় আবিষ্কারের কারণে মূলত জেমস কুক ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
১৮১৯ সালে ৭৪ টি কামান বিশিষ্ট সান তেলমো জাহাজের ৬৪৪ জন নাবিকের মধ্যে কয়েকজন সম্ভবত হাইপোথার্মিয়ায় মৃত্যুবরণ করার পূর্বে অ্যান্টার্কটিকায় প্রথম পা রাখেন। যদিও এ ঘটনার কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না। এর এক বছর পর ১৮২০ সালের ২৭শে জানুয়ারি ফাবিয়ান গোতলিয়েব ফন বেলিংশসন ও মিখাইল লাযারেভ এর নেতৃত্বে পরিচালিত এক অভিযানে তারা প্রিন্সেস মার্থা উপকূলের সাথে সংযুক্ত একটি বরফের চাঁই এর তাক বা আইস শেলফ আবিষ্কার করেন যা পরবর্তীতে ফিম্বুল আইস শেলফ নামে পরিচিত হয়। বেলিংশসন ও লাযারেভ আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যান্টার্কটিকার মূল ভূখ- দর্শনকারী ও আবিষ্কারকরূপে পরিচিত হন। এর তিনদিন পর ১৮২০ সালের ৩০শে জানুয়ারী, এডওয়ার্ড বার্নসফিল্ডের নেতৃত্বে এক ব্রিটিশ অভিযাত্রীদল ট্রিনিটি পেনিনসুলা দেখতে পান, এবং এর দশ মাস পরে ১৭ই নভেম্বর, ১৮২০ তারিখে আমেরিকান সীল-শিকারী নাথানিয়েল পামার অ্যান্টার্কটিকা দেখতে পান। প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যান্টার্কটিকায় মানুষের পদার্পণ ঘটে সম্ভবত মাত্র এক বছর পরে যখন ক্যাপ্টেন জন ডেভিস নামে একজন আমেরিকান সীল-শিকারী সেখানে বরফের উপর পা রাখেন।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিককে “অ্যান্টার্কটিক অভিযানের স্বর্ণযুগ” আখ্যা দেয়া হয়। এ সময় বেশ কয়েকটি অভিযাত্রীদল দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছাতে চেষ্টা করেছিল। এদের মধ্যে অনেকেই আহত হন ও মৃত্যুবরণ করেন। নরওয়ের রুয়াল আমুনসেন ব্রিটনের রবার্ট ফ্যালকন স্কটের সাথে এক নাটকীয় প্রতিযোগিতার পর ১৩ই ডিদিসেম্বর১৯১১ সালে অ্যান্টার্কটিকায় পৌঁছেছিলেন।
অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের কোন স্থায়ী অধিবাসী নেই এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত কোন মানুষ এই স্থানকে দেখেছিলেন বলে কোন প্রমাণ নেই। এতৎসত্ত্বেও প্রথম শতাব্দী থেকেই একটি বিশ্বাস প্রচলিত ছিল যে, পৃথিবীর দক্ষিণে টেরা অস্ট্রালিস নামক এক বিশাল মহাদেশ উপস্থিত থাকতে পারে। টলেমি মনে করতেন যে, ইউরোপ, এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা নিয়ে গঠিত তৎকালীন যুগে পরিচিত পৃথিবীর ভূমিসমষ্টির সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য এই মহাদেশ দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। এমনকি সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে অভিযাত্রীরা দক্ষিণ আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কারের পর যখন জানা যায়, এই দুইটি মহাদেশ প্রবাদ হিসেবে প্রচলিত অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের অংশ নয়, তখনও ভৌগোলিকরা বাস্তবের থেকে দ্বিগুণ আকারের মহাদেশের অস্তিত্বের কথা বিশ্বাস করতেন। অ্যান্টার্কটিকার প্রবাদের সঙ্গে প্রচলিত হলেও অস্ট্রেলিয়াকে টেরা অস্ট্রালিস নামটি দেওয়া। কারণ, তখন ভুল ধারণা ছিল যে অস্ট্রেলিয়ার পর দক্ষিণে আর কোনো মহাদেশ নেই। অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কারের পর অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের নামকরণ টেরা অস্ট্রালিস শব্দটি থেকে করা হয়, কারণ তখন ম্যাথিউ ফ্লিন্ডার্স নামক অভিযাত্রী সহ বেশ কিছু মানুষ মনে করতেন অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণে উল্লেখযোগ্য মাপের কোন মহাদেশ পাওয়া সম্ভব নয়।
অ্যান্টার্কটিকা চুক্তির কথা
১৯৫৯ সালে ১২টি দেশের মধ্যে অ্যান্টার্কটিকা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়; যাতে ৪৬টি দেশ স্বাক্ষর করেছে। এ চুক্তির মাধ্যমে অ্যান্টার্কটিকায় সামরিক কর্মকা- এবং খনিজ সম্পদ খনন নিষিদ্ধ, বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে সহায়তা এবং মহাদেশটির ইকোজোন সুরক্ষিত করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশের ১০০০ – ৫০০০ বিজ্ঞানী অ্যান্টার্কটিকায় বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন।