শান্তির বনটা বেশ ঘন ও সবুজ। রাতে পিনপতন নীরবতা থাকে। দুপুরেও দূর থেকে তেমন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না। তবে সন্ধ্যায় পাখিদের কিচিরমিচির ডাকে বনের ধ্যান ভাঙে। পশুপাখিরা যে যার মত গহিন বনে চলে যায়। শান্তিতে ঘুমায়। তাই এই বনকে সবাই ‘শান্তির বন’ বলে।
ইদানীং রাতে গভীর বন থেকে শোরগোল ভেসে আসে। বানর, বনবিড়াল, হনুমান, হরিণ, শিয়াল ও বনমোরগের চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে আসে। বাঘ এসেছে বাঘ এসেছে- বলে চিৎকার করে বনের পাখপাখালি। অথচ এই বনে কোনো বাঘ-সিংহ নেই। হঠাৎ কোত্থেকে বাঘ এলো? সবার মনে একই প্রশ্ন। এই বনের রাজা সবাই। সবাই সবাইকে খুব সম্মান করে। ছোটদেরকে বড়রা স্নেহ করে। সবাই সবার ভালো মন্দের খোঁজখবর রাখে। অথচ গত রাতে বাঘের হালুম হুলুম ডাক শুনে সবার শান্তির ঘুম হারাম হয়ে গেছে। এখন বনের সকল পশুপাখি ভীষণ ভয়ে আছে।
বনের ঠিক মাঝখানে জরুরি সভা বসেছে। সভায় হাতি সভাপতি। সভায় হাজির সবার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ দেখা যাচ্ছে। জিরাফ তার গলা বাড়িয়ে বললো, ‘এই বনে আমরা সবাই খুব শান্তিতেই ছিলাম। বাঘ-সিংহ ছিল না।’ একটা হনুমান বললো, ‘কোনো বাঘটাগ এই বনে থাকতে পারবে না। কী বলেন সবাই?’ সাথে সাথে বনের অন্য পশুরা ঠিক ঠিক বলে সহমত জানালো। হাতি এবার তার গম্ভীর মুখ তুলে বললো- ‘তা বটে তা বটে। তবে বাঘটাকে ত আগে খুঁজে বের করতে হবে। তার অবস্থান জানতে হবে। গতিবিধি বুঝতে হবে। তারপর তাকে বন থেকে তাড়ানোর বুদ্ধি করতে হবে।’ সবাই নিজ নিজ ঘরে চলে গেল। সাথে করে ঘরে নিয়ে গেল বাঘের জুজু।
কয়েকদিন চলে গেল। এই ক’দিন বাঘের ডাক শুনেনি কেউ। বাঘের এইরকম না ডাকা আরো ভয়ঙ্কর! কেউ জানবেও না- বাঘটা কোথায় আছে? কার ঘাড় যে কখন সে মটকে দিবে! একটা টিয়ে পাখি হন্তদন্ত হয়ে বনে এলো। হাতির মাথার কাছে বসে টিয়ে পাখিটা হাঁপাচ্ছে। সে বড্ড ক্লান্ত। টিয়ের কথাগুলো হাতি মনোযোগ দিয়ে শুনলো। গভীর রাতে হাতি তার শুঁড় উঁচিয়ে বনের সবাইকে ডাকলো। বনের ভেতর হই হই রই রই পড়ে গেল। মুহূর্তে বনের সবাই হাজির হলো। হাতি বললো- ‘আমি একটা জাদু শিখেছি। এক তুড়ি দিয়েই আমি সবার বাঘের জুজু কাটিয়ে দিতে পারি। দেবো?’ সবাই বলে উঠলো- ‘তবে তাই হোক। তবে তাই হোক।’
হাতিটা উঠে দাঁড়ালো। হেলেদুলে সবার মাঝখানে গিয়ে বসলো। তার চারদিকে দাঁড়িয়ে আছে বনের সব পশুপাখি। কেউ কেউ মাটিতেও বসে আছে। হাতি বললো- ‘আমরা এখন একটা মজার খেলা খেলবো। খেলাটি হলো উপস্থিত সবাইকে নিজের ডাক ছাড়া বনের অন্য পশু বা পাখির মতো ডাকতে হবে। যে যত নিখুঁতভাবে ডাকতে পারবে- সে হবে এই খেলায় জয়ী। তাকে আমরা সবাই বনের রাজা হিসেবে মেনে নেবো। খেলা শুরু হলো। মুখপোড়া হনুমান মায়া হরিণের মতো ডাক দিতেই উপস্থিত সবাই হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। একে একে সবাই ডাকছে। হাসির মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। এবার ডাকতে আসছে দক্ষিণ বনের মেছো শেয়াল। বীরদর্পে হেঁটে এসে ঠিক মাঝখানে দাঁড়ালো সে। মুখটা আকাশের দিকে তুলে সে ডাক দিলো। তার ডাক শুনে উপস্থিত সবাই থ বনে গেল। একদম সেই ডাক। পরিচিত সেই বাঘের ডাকের মতো নিখুঁত। হাতি বললো- ‘এই হলো সেই বাঘ- যার কারণে শান্তির বনে কোনো শান্তি নেই। আজ টিয়ে পাখি মেছো শেয়ালকে মেঘ পাহাড়ে দেখে এসেছে। ঐ পাহাড়ে বসে সে বাঘের মতো ডাকার জন্য প্র্যাকটিস করছে। টিয়ে এসেই আমাকে খবরটা দিলো। এখন তার কী শাস্তি দিবো? আপনারাই বলেন।’
বানর বললো- তাকে ইচ্ছেমত ছেঁচা দিয়ে শান্তির বন থেকে বের করে দিতে হবে। মেছো শেয়াল অবস্থা বেগতিক দেখে হাতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাইতে গেল। কিন্তু এর মধ্যে বনের সকল পশুপাখি মেছো শেয়ালকে তাড়া করলো। তাড়া খেয়ে উত্তরের মেঘ পাহাড় পেরিয়ে আরো গহিনে সে পালিয়ে গেল। সভাপতি হাতি হাঁপাতে হাঁপাতে বললো- ‘মেছো শেয়াল, ওপারের বনে কিন্তু বাঘ আছে রে!’

Share.

মন্তব্য করুন