(গত সংখ্যার পর)

তাকে ফোঁস ফাঁস করে তেড়ে গেলাম। সেও বুঝলো লাভ নেই। দুজন দূরে সরে গিয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। আমিও মাথা উঁচিয়ে তাকিয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ পর দুটোই পালিয়ে গেল। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। রাতের শেষদিকটা এলো, আমি দুবার হাম্বা করে ডেকে উঠলাম। দূরের মসজিদে আজান হলো। আমি আবারো জিরিয়ে নিলাম। সকালের সোনা রোদ এসে চোখে পড়তেই ঘুম গেল ভেঙে। দেখলাম চারিদিকে রোদে ভরে গেছে। জায়গাটা অচেনা মনে হলো। রাতের পরিবেশ আর দিনের দেখা পুরোটাই আলাদা। সত্যি কি বিচিত্র এই পৃথিবী! আমার মনে হলো এই প্রকৃতি অনুভব করা যেন একটা গরুর বাড়তি তৃপ্তি। পৃথিবীতে গরুর তেমন কিছুই অর্জন নেই। মানুষের এত কাজ করে দেবার পরও ওরা ছড়ি দিয়ে পিটাতেই থাকে। একটু এদিক ওদিক করার জো-নেই। ফসল ফলাতে, মানুষের জীবন ধারণে দুধ, দই, চামড়া, জুতা, সবই গরু থেকে মানুষ পায়। তবু একটু কৃতজ্ঞতা যেন নেই। এসব দার্শনিক চিন্তা একটা গরুর মানায় না।
যেদিক থেকে এসে ছিলাম তার উল্টা দিকের মাঠে নেমে হাঁটতে লাগলাম। এরই মধ্যে মাঠে ঘাস খেয়ে পেট ভরিয়ে নিলাম। যাতে সময় মতো জাবর কাটা যায়। মাঠটার শেষদিকে চোখে পড়লো কাঁচাসড়কটা। এরই মধ্যে মাঠে দু’চারটা ছাগল, গরু চলে এসেছে। তাই নিজেকে আর একা মনে হলো না। কাঁচা সড়কের কাছাকাছি যাওয়া মানে ধরা পড়ে যাওয়া। এখন মুশকিল হলো লোকমান চাচার বাড়ি চিনে যাওয়া। আবার অন্য দিকে মকসেদ আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কোন দিকে যাওয়া যায়? এমন একটা দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে মাঠ ধরে সোজা হাঁটতে লাগলাম। ধানের আল দিয়ে, ভরা ধানের জমি, কাঁচা ধান, পাকা ধান, পেরিয়ে হেঁটেই চললাম। দু’একজন কৃষক সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছিল। আমি বুকটান করে হেঁটে পেরিয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে ফাঁকা কোন জমিতে ঘাস দেখলে ঘাস খেয়ে নিচ্ছিলাম। একবার মুখ তুলে দূরে তাকিয়ে শ^াস নিলাম। বুকের মধ্যে ধক করে আনন্দের একটা পরশ লাগলো। ওইতো নদী, বেশ দূরে সোঁতা দেখা যায়। এই নদীর ধারে আমার গোয়াল ঘর। আমি নদীর দিকে হেঁটে চললাম। যত কাছে আসছি ততই নদী স্পষ্ট হয়ে উঠলো। এক সময় হেঁটে নদীর ধারে এসে পড়লাম। সামনে নদীর স্রােত, নৌকা এসব দেখে আমার আশার আলো আরো স্পষ্ট হলো। বুক ভরে নিঃশ^াস নিলাম। তারপর বাতাস শুঁকে পশ্চিম দিকে শুরু করলাম চলা। নদীর ধারের অনেক গাছ গাছালি, মানুষ পেরিয়ে যাচ্ছিলাম। কোথাও দাঁড়ালেই মানুষ সন্দেহ করবে তাই হেঁটেই চললাম। নদীর ধারে বটগাছ তলায় এসে একটু দাঁড়ালাম। গাছতলায় একটা মাচায় দুজন লোক বসে গল্প করছিলো। তাকিয়ে মনে হলো চেহারার মধ্যে একটা চোর চোর ভাব। আমি আবার হাঁটতে লাগলাম। যা ভেবেছিলাম তাই, লোক দুটো দৌড়ে এলো ধরতে। আমিও দৌড়াতে লাগলাম। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারলাম না। দু’জন মিলে আমাকে ধরে ফেললো। আমি দুবার ঢিশ দেবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কাবু করতে পারলাম না। গলার দড়িটা তারা এমন ভাবে ধরলো যে আর ছুটতেই পারলাম না। শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে গেলাম। আবার ধরা পড়তে হলো! আমাকে ওরা দুজন টেনে, একটা নারকেল গাছের সাথে বেঁধে ফেললো। তারপর দুজন খুব খিক্ খিক্ করে হাসলো। একজন বললো- খাইরুল মনে হয় কোরবানির হাট থেকে পালিয়েছে। অন্যজন বললো- শোন বদরুল এটা লুকিয়ে কেশর হাটে নিতে হবে। বুঝলাম দাড়ি ওয়ালা বদরুল আর মোচওয়ালা খাইরুল। বদরুল বললো- তুই ছুরি আর কোপা গুলো নিয়ে আয়। আমি গরু দেখছি। খাইরুল গেল ছুরি বঁটি আনতে। এরা যে কসাই সেটা বুঝলাম। বাঁচার আশা কি ছেড়ে দিতে হবে বুঝছি না। আমি খুব হতাশ। কেশর হাট নামটা খুব চেনা-চেনা মনে হলো। মনে হয় আমি আমার গ্রামের কাছাকাছি চলে এসেছি। লোকমান চাচা মজনুর মুখে এই হাটের নাম শুনেছি অনেকবার।
বদরুল আর খাইরুল দুজনই যে কসাই, গরু চোর, এতে সন্দেহ রইলো না। এখন এদের হাত থেকে কি ভাবে পালানো যায় সেটাই চিন্তা করছি। এমন সময় একটা মাইকের শব্দ ভেসে এলো- একটি নিখোঁজ সংবাদ, গতকাল আমলকীর হাট থেকে। কেনার পর একটি বলদ গরু হারায়ে গিয়াছে। গরুটির গায়ের রঙ সাদা। মাথায় বাদামি ছাপ। গরুটি যদি কোন হৃদয়বান ব্যক্তি পাইয়া থাকেন। তাহলে যোগাযোগ করুন-কালুর মোড়ের মকসেদের দোকান। মোবাইল ০১ীী…..। মাইকে শোনার পর বদরুল মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। হায় হায় এইড্যা যে মকসেদ দালালের গরু। মামুর ব্যাটা মকসেদ তো খুব শেয়ানা। এরই মধ্যে খাইরুল ছুরি বঁটি নিয়ে হাজির। সেও মাইকের খবর শুনেছে। তাই খাইরুল, বদরুল দুজনকেই বেশ উদ্বিগ্ন মনে হলো। মনে হলো, এদের চাইতেও বেশি শেয়ানা মকসেদ। তাই তারা চিন্তায় পড়ে গেছে। আমিও তক্কে তক্কে আছি। একটু সুযোগ পেলে যেদিকে পারি দৌড় দিব। বদরুল খাইরুলকে বললো- শুন গরু আজ রাতে বাগানেই বাঁধা থাক। ভোর রাতে কেশর হাটে জবাই করা হবে কি বলিস? খাইরুলও তার কথায় সাড়া দিলো। বদরুল একটা খড়ের আঁটি এনে আমাকে দিলো। আমি কষ্ট করে সেটা খেতে থাকলাম।
সন্ধ্যা থেকে রাত। চারিদিকে অন্ধকার। নারকেল বাগানের ফাঁকে ফাঁকে জোসনা দেখা যায়। খাইরুল আর বদরুল দূরে ঘাসের উপর চাটাই পেতে বসে গল্প করছে। আমি জাবর কাটতে কাটতে ভাবছিলাম- কিভাবে পালানো যায়?
ভোর রাতের আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম খাইরুল আর বদরুল আমার দড়ি খুলে দাঁড়িয়ে আছে। দুজন শলাপরামর্শ করে আমাকে টেনে নিয়ে হাঁটতে লাগলো। আমিও আমার শেষ পরিণতির কথা ভেবে মন খারাপ করে হাঁটছি। একটা পায়ে হাঁটা রাস্তা দিয়ে চলেছি। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে সাদা আভা। আরো একটা দিনের মধ্যে এসে পড়ছি।
আমার মনে হলো হাটের কাছাকাছি চলে এসেছি। শেষ বারের মতো সামনের পায়ে নিজেকে আটকে দিলাম। খুব জোরে টানতে লাগলো খাইরুল আর বদরুল। বদরুল কষে ছড়ি দিয়ে আমার পিঠের চামড়ায় আঘাত করতে লাগলো। আমি অনড়, দুজন মাঠের মধ্যে আমাকে নিয়ে টানা হেঁচড়া করছে। একজন ল্যাজ ধরে, আরেক জন দড়ি ধরে কৌশল করে, আমাকে নিয়ে যাবার প্রাণপণ চেষ্টা। ভোর সকালে আশপাশে মানুষ জন খুব কম। হঠাৎ করে কে যেন ধমকে উঠলো। ধমক শুনে থমকে দাঁড়ালো বদরুল আর খাইরুল। তারপর গরু ছেড়ে দিয়ে থ মেরে সামনের ছাতাওয়ালা লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি বুঝতে পারলাম না। ভালো করে তাকিয়ে দেখি- হলুদ দাঁত বের করে, বড় একটা লাঠি হাতে মকসেদ দাঁড়িয়ে। খাইরুল আর বদরুল আমাকে ছেড়ে পিছু হটতে লাগলো, মাঝখানে আমি। মকসেদ গালাগাল দিতে দিতে আমার কাছে চলে আসছিলো। আমি ভাবলাম এইতো একটা সুযোগ, পালাতেই হবে। আমি লাফিয়ে উঠে ল্যাজ উঁচিয়ে, পড়ি কি মরি দিলাম এক দৌড়। এবার আমার পেছনে দৌড় দিলো মকসেদ। বদরুল আর খাইরুল উল্টো দিকে পালিয়ে গেল। আমি দৌড়াচ্ছি, মকসেদ দৌড়াচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে একটা বটগাছের কাছে আসতেই চেনাচেনা ঠেকতে লাগলো জায়গাটা। মনে পড়লো এখানকার আশপাশে একটা খোঁয়াড় আছে। যেখানে আমি একদিন কাটিয়ে ছিলাম। আমার মনে হলো আমি ঠিক রাস্তায় দৌড়াচ্ছি। মকসেদ দৌড়াতে দৌড়াতে কাছে চলে এসেছিল। সে লোকজনের উদ্দেশ্যে- এই ধর ধর করে উঠলো, তেমন কেউ আমাকে ধরতে আগ্রহী হলো না। আমি আমার দৌড় বাড়িয়ে দিলাম। মকসেদ আমার পিছু ছুটে চললো। আমাকে ছাড়ার পাত্র সে নয়। আমি যে আমার গ্রামে চলে এসেছি, সে ঘ্রাণ আমি পেয়েছি। তাই নিজের প্রতি আস্থা আরো বেড়ে গেল।
আরো কিছু দূর দৌড়ে রাস্তায় দেখা গেল ভেলুকে। সে আমাকে দেখে ঘেউ ঘেউ করে চিনে ফেললো। বুঝে ফেললাম এই রাস্তায় আমার বাড়ি। খোঁয়াড় থেকে মজনুর সাথে এদিক দিয়েই দৌড়ে এসেছিলাম। এবার আমার কোনো ভয় থাকলো না। সময় মতো পৌঁছে গেলাম সেই চিরচেনা কদম তলায়। কেমন কেমন করে যেন পৌঁছে গেছি নিজের বাড়ি। সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো মজনু, সে আমাকে দেখে ভূত দেখার মতো চেঁচিয়ে উঠলো। আমার দড়ি ধরে কদম কাছের সাথে বেঁধে ফেললো। আমি স্বস্তির নিশ^াস ফেললাম। নিজের বাড়ি ফিরে আশায় সব ক্লান্তি যেন দূর হয়ে গেছে। গোয়াল থেকে লাল গাই, বকনা আমার দিকে তাকিয়ে হাম্বা করে উঠলো। আমিও ডেকে উঠলাম ঘাঁ-আ করে। মজনুর চিৎকারে বাড়ির লোকমান চাচা, সাজু, রাজু, চাচি, রাজুর মা, নুরুর মা, চাকর, সবাই বের হয়ে এসেছে। সেই সাথে দৌড়াতে দৌড়াতে দালাল মকসেদও হাজির। মকসেদ দৌড়ে এসে হাঁস ফাঁস করছে। সে বলে- এটা আমার গরু। লোকমান চাচা মকসেদ এর চোখে চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। লোকমান চাচা বললো- বল কি বলছিলি? মকসেদ বুঝলো ভাড়া সে বজলুকে আগে থেকেই চেনে। তারপরও বললো- বজলু আমার কাছে গরু বেচে দিয়্যাছে- তাই?- তাহলে বজলুকে ডেকে আনা। মকসেদ বলে- আমি কি কর‌্যা জানবো? দুদিন আগে আমি হাট থাক্যা গরু কিন্যাছি। বজলু বেচেছে। কিন্তুক পথে মধু চাচার বাড়িতে গরু দিতে যাছুনু। তখন গরু ছুট্যা পালিয়্যা গেছে।
বজলুকে তুই ক’ টাকা দিয়্যাছিস? প্রশ্নের উত্তরে মকসেদ নীরব। -বল ক টাকা? মকসেদ বলে- চাচা তুমি তো জানো আমি দালাল। গরু মধু চাচার বাড়ি দিয়্যা, টাকা আন্যা বজলুকে দিবার কথা ছিলো কিন্তুক………।
-থামলি ক্যান বুল। -কিন্তুক রাস্তার মধ্যে গেল গরু ছুট্যা, সেই গরু ধরতে আমার দু’দিন। এর মধ্যে গরু-খাইরুল আর বদরুল কসাইয়ের হাতে পড়্যাছিলো। সেখ্যান থেক্যা উদ্ধার করতে, আমার টাকা-কড়িসব লস। দুট্যা দিন শ্যাষ মাইকিং কর‌্যাছি, সেখ্যানে টাকা ফেলতে হয়্যাছে। আমি এখন কি করবো? চাচা তুমিই এ বিচার করো? লোকমান চাচা জিজ্ঞেস করলো- কতোতে বেচা-কেনা হলো। -তিরিশ হাজার, তার মধ্যে আমার পাওনা দু হাজার। সত্যি কথা বুলছি চাচা। আর মাইকিং করা আর দুদিন লস তুমি এ্যার কি করব্যা? -আমি কি করবো বুল, শুধু আড়্যা দুট্যা বেচার কথা ছিলো। কিন্তু বজলু বলদ-ডাকে লিয়্যা পালালো। তারপর থাক্যা অরতো কুনু খোঁজই নাই। বজলু আসুক তার পর তোর পাওনা মিটাবো। একথা শুনে মকসেদ লোকমান চাচার পা ধরে পড়ে গেল। চাচা আমার গ্রাম এখ্যান থাক্যা পাঁচ কোশ। আমাকে বাড়ি যাত্যে হবে, তার পর হাটে যাবো। না হল্যে আমার সব লস। চাচা শুনে বললো- তুই তাহলে বৈঠক খানায় বস খাওয়া দাওয়া কর, তোর টাকা সব মিটিয়্যা দিবো হল্যোতো?
কথা শুনে মকসেদ আমতা আমতা করে বৈঠক খানায় গিয়ে বসলো। আমি সব শুনছিলাম। এর মধ্যে মজনু আমাকে খোল ভুসি মাখিয়ে দিয়েছে। আমি মুখ ডুবিয়ে খেতে লাগলাম। মুখ তুলে দেখলাম মকসেদ হতাশ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আবার খোল ভুসির নাদে মুখ দিলাম। গোয়ালের এঁড়ে দুটো বেচা হয়ে গেছে তাই গোয়ালটা অনেক ফাঁকা। ওদিকে কাঁঠাল তলায় বলদ চারটা বাঁধা আছে। বুড়ো বলদটা আমাকে হাম্বা করে ধন্যবাদ দিলো। ফিরে এসেছি তাই। মকসেদকে ভাত দেয়া হয়েছে। সে গপাগপ খাচ্ছে। দেখে ভালোয় লাগছিলো। বেচারা আমাকে খুঁজতে কম পরিশ্রম করেনি। একটু বাদে লোকমান চাচা বেরিয়ে এলো। মকসেদ ভাত খাওয়া শেষে কুলকুচা করে নেমে এলো- পেটে ভাত পড়ায় মনটা ভালো। লোকমান চাচা বললো- এখন বল তোকে কয় টাকা দিলে খুশি হবি?
মকসেদ আমতা আমতা করে বলে- আসলো খরচ খরচা তো মেলা হয়্যাছে, তা তুমি চার হাজার দিলে খাটনির টাকাডা উঠে।
চাচা ধমকে উঠে-কিসের খাটনি?
মকসেদ বলে মাইকিং কর‌্যাছি, তার পর নিজে ধুড়তে, খুঁজতে দুদিন। ঘুম খাওয়া হারাম কর‌্যাছি। তার পর ধরো খাইরুল বদরুলের হাতে কেশর হাটে, এতক্ষণ গরুর গোশত হয়্যা যাতো। ভাগ্যিস গেলছুনু বুল্যা গরু থুয়্যা পালালো। -যাহোক যেভাবে হোক গরুডা ফির‌্যা আস্যাছে। তুই তিন হাজারে খুশি হয়্যা বাড়ি যা। মকসেদকে ভাত খাওয়ানোর জন্য মনে হয় মনটা ভালো। তাই টাকাটা পকেটে গুঁজে নিলো। চাচাকে সালাম দিয়ে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। পিঠে একটা থাবা দিলো, তারপর ছাতাটা বগলে করে রাস্তা ধরলো। আমি তার চলে যাওয়াটায় স্বস্তির নিশ^াস ফেললাম।
কোরবানি ঈদ চলে এলো। পাড়ার গরু ছাগলের মাথায় লাল ফিতার ফুল। চিক চিকি কাগজ লাগিয়ে সাজানো হলো। দুঃখ পেলাম আমাদের গোয়ালের বুড়ো বলদের শিঙে যখন লাল ফিতা বাঁধা হলো। তাকে নিয়ে রাজু, সাজু খুব ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। খুব জাঁকজমক আর উৎসবের মধ্য দিয়ে কোরবানির ঈদ পালিত হলো। বহু গরু ছাগল, ভেড়া মোষ, সেই উৎসবে আত্মোৎসর্গ করলো। আমার তাতে দুঃখ নেই। কেননা আমরা মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি হয়েছি। কিন্তু দুঃখ গোয়ালের বুড়ো বলদটা কোরবানি হলো। আর তার জায়গায় আমাকে দাঁড় করিয়ে দিলো। যদিও এখন ট্রাক্টর মেশিন দিয়ে জমি চাষ করা হয় তার পরও নজর আলীর ইচ্ছা লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ করবে। একদিকে কাশেম ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করছে। অন্য দিকে নজর আলী বলছে- সে ট্রাক্টর চালাতে জানে না আর শিখবেও না। লাঙ্গল চালাবে। তার কথা মতো সে আমাকে লাঙ্গলের জোয়াল তুলে দিবে কাঁধে। তার আগে আমার কাঁধে গাড়ির জোয়াল তুলে দেয়া হলো। মুখে মুখোড় লাগানো হলো। কাঁধে গাড়ির জোয়াল নিয়ে তেমন কষ্ট লাগলো না। হাশেম গাড়িতে উঠে লাগাম টেনে ধরলো। তখন বুঝলাম লাগাম নামক দড়িটার টান অনুযায়ী, আমার সামনে যাওয়া, থামা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। তা না হলে নাকের মধ্যে দিয়ে যে দড়ি গিয়েছে, তাতে হ্যাঁচকা টান পড়বে। আমাকে এক সকালে গাড়িতে জুড়ে নজর চললো মাঠের মধ্যে দিয়ে। ফাঁকা গাড়িটা নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে ছুটলাম মাঠের রাস্তা দিয়ে। নজর আমাকে গাড়িতে জুড়ে পরীক্ষা করছে বলে মনে হলো। কিন্তু দুঃখ পেলাম যখন অযথা ছড়ি দিয়ে পিঠে কোমরে আঘাত করা আর লেজ মোচড়ানো হচ্ছে। এটা মনে হয় গাড়োয়ানদের একটা অভ্যাস। মাঠে দৌড়ে গাড়িটা গিয়ে থামলো জমির পাশে উঁচু খোলানে। ধান কেটে উঁচু উঁচু ঢিবি করে রাখা হয়েছে। ধান কাটা শ্রমিকরা একটা গাছের তলায় বসে ছিলো- তারা গাড়িতে কাটা ধান সাজাতে লাগলো। বাড়ি থেকে এই মাঠটা অনেক দূরে, তাই গাড়িতে করে ধান বয়ে নিতে হবে। সবাই হাতে, মাথায় করে গাড়ি বোঝাই করে ফেললো। তারপর আমাদের কাঁধে জোয়াল তুলে দেয়া হলো। সেই জোয়াল চেপে বসলো কাঁধে। প্রথম দিন গাড়ির জোয়াল যে কি ভারি বুঝলাম। শরীরটা টলে উঠলো। মনে হলো জোয়াল ফেলে দিই অথবা বেরিয়ে যাই। নজর আলী সতর্ক ছিল, লাগাম টেনে ধরলো। কাঁধে প্রচুর চাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। নজর গাড়িতে উঠেই লেজে মোড়চ দিলো। আমি টালমাটাল চলতে শুরু করলাম। কিছুদূর টেনে নিয়ে যাবার পরই একটা লাফ দিয়ে সরে যাবার চেষ্টা করলাম। গাড়ি টলে উঠলো, নজর টলে উঠলো। আমি ঘাড় নিচু করে ফেললাম, কেননা প্রথমদিনে আমি খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। ঘাড়ে খুব ব্যথা লাগছিল। গাড়িটা একদিকে টাল খেয়ে গেল। আর তখনই নজর আলী গাড়ি থেকে নেমে জোয়াল চেপে ধরলো। আমি জোয়াল থেকে ঘাড় সরিয়ে নিলাম। সুযোগ বুঝে অন্য বলদটাও ঘাড় সরিয়ে নিলো। শেষ পর্যন্ত নজর ধর ধর করে জোয়াল মাটিতে নামিয়ে দিলো। গাড়িটা গেল বেঁকে, কিছু ধানের আঁটি গড়িয়ে পড়লো সামনে। নজর আমার উপর প্রচণ্ড রেগে গেলেও কিছু বললো না। কেননা আমার আজ প্রথম জোয়াল কাঁধে নেওয়া। আমাদের গাড়ির সাথে বেঁধে নজর আলী কোথায় যেন চলে গেল।
আমি আজ প্রথম ঘাড়ে গাড়ির জোয়াল নিয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দিলাম, তাই পাশের বলদটা মহা বিরক্ত। বলে- হ্যারে, দামড়া শরীর নিয়ে গাড়ি টানতে পারলি না। আমরা তো এগুলো কিছুই মনে করিনি। তোকে আসলে প্রশ্রয় দিয়ে বড় করা হয়েছে। তোর মতো বয়সে আমরা বহু লাঙ্গল চাষ দিয়েছি। আমি আমতা আমতা করে বললাম- তাই বলে প্রথম দিনেই এত ভারি গাড়ি। জবাবে বলদটা বললো- এ এমনকি ভারি, এর চেয়ে কত ভারী ভারী মাল টেনেছি। কথা-বার্তার মধ্যে নজর আলী বাড়ি থেকে অন্য জোড়ার একটা বলদ নিয়ে চলে এসেছে। মানুষ আমাদের কথা বোঝে না। তাই কিছু বললাম না। জোড়ার বলদের কথা শুনে আমার মধ্যে একটা আত্মবিশ^াস চলে এলো। মনে হলো আমিও পারবো। তারপরও নজর বলদটাকে গাড়িতে জুড়ে দিয়ে উঠলো। গাড়ি চলতে লাগলো। আমাকে গাড়ির পেছনে বাঁধা হয়েছে। আমি হেঁটে হেঁটে গাড়ির সঙ্গে বাড়ি ফিরে এলাম।
ধান মাড়াই মেশিন, ড্রাম, কিনে ফেলেছে লোকমান চাচা। তারপরও নজর গরু ঘুরিয়ে মাড়াই করবে। এতে কাশেমের সাথে তর্ক লেগে গেল নজর আলীর। লোকমান চাচা এসে বললো- বহু দিনের গরু ঘুরিয়ে ধান মাড়াই ব্যবস্থা। নজর যদি গরু ঘোরাতে চাই তো ঘুরাক, কাশেম তুমি মেশিন চালাও। ধান কাটা শ্রমিকেরা নজরকে প্রথমে সাপোর্ট দিলো না। মেশিনে যখন সহজে হবে তাহলে গরু ঘোরানোর দরকার কী। নজর পুরাতন ঐতিহ্যের মায়া ছাড়তে পারছে না, তাই সে মলন মাড়াই করবে গরু ঘুরিয়ে। শেষ পর্যন্ত খোলানের এক পাশে মাড়াই মেশিন চালু হলো। আর নজর আলী বলদগুলো বেঁধে খোলানে ধানের আঁটি ছড়াতে লাগলো। সাথে শ্রমিকরাও যোগ দিলো। ধানের গন্ধে চারিদিকে মৌ মৌ করছে। আগে নাকি সব মৌসুমে-ধান হতোনা, সারা বছরে একবার কি দুবার। এখন বহু জাতের ধান। সব মৌসুমেই ধান লাগানো, ধান কাটা, মাড়াই আর জমি চাষ চলছেই। চাচা তার হাতল ওয়ালা চেয়ারে বসে মাড়াই দেখছে। একদিকে মেশিন চলছে অন্য দিকে গরু ঘুরছে। সাজুকেও দেখলাম নজর আলীর সাথে তাল মিলিয়ে গরুর সাথে ঘুরতে। আমি ঘুরছিলাম সবার সাথে। মাঝে মাঝে দু একটা ধান গাছ মুখে নিয়ে চাবাচ্ছি আর ধানের ঘ্রাণে মাতাল হয়ে যাচ্ছি।
রাজুর সাথে সাজুও বড় হচ্ছে, সেও এখন গরুর রচনা পড়ে। গরুর গোবর থেকে উন্নত মানের সার হয়। সেই সারে জমির উর্বরতা বাড়ে এসবও পড়ে। আগে ছিলো তিন রকমের ধান, আউশ আমন, বোরো। এখন সেসব ধানের খোঁজই পাওয়া মুশকিল। আমি এখন যে বলদের সাথে জোড়া বেঁধেছি তার কাছে গল্প শুনেছি।
ধানের বিছানো খোলানে ঘুরছি। এই সব দৃশ্য পাড়ার বুড়ো জোয়ান, শিশু সবাই বৈঠকখানায় বসে দেখছে। ঠেংনি বা বাঁশের লাঠি দিয়ে ধানগুলো উল্টে পাল্টে দিচ্ছে- কৃষানরা। পাশের ভেটুল গাছটায় সাত ভাই পাখিরা কিচির মিচির ঝগড়া করছে। ছাগল-ভেড়া গুলো আশপাশে ঘুর ঘুর করে দু’একটা ধান খাওযার চেষ্টা করছে। অনেকক্ষণ মলন ঘোরার পর কাজ শেষ হলো। শেষে কাঁঠাল গাছের সাথে বাঁধা হলো আমাকে।
আমি আর কদমতলায় বাঁধা থাকি না। বুড়ো বলদটা কোরবানি হবার পর এখন আমি তার স্থানে কাঁঠাল গাছটার সাথে বাঁধা থাকি। কদমতলায় বাঁধা হয়েছে লাল গাইকে। সেখানে এখনও যদু ঘোষ দুধ দোহাতে আসে। আমরা রাতেই শুধু গোহালে থাকি আর দিনে কখনো কাঁঠাল তলায়, কখনো মাঠে। পরের দিন সকালে আমার মুখে মুখোড় পরানো হলো। নাকের দড়ি শক্ত করে বেঁধে নজর আলী আমাকে তৈরি করে নিলো। কেননা আজ আমাকে লাঙ্গলে জোড়া হবে। আমি মনে মনে আত্মবিশ^াস বাড়িয়ে নিলাম। আমার জোড়া লাল বলদটা আমাকে গাড়ি বহন করতে না পারায় ঠাট্টা করেছিলো। আজও বললো-ওরে আজ লাঙ্গল ঠিকমতো কাঁধে নিস। গাড়ির মতো ছেড়ে পালাস না। নজর খুব রেগে যাবে। আমিও বললাম- চলো তো দেখি। আমাদের তাড়া দেবার আগে নজর কাঁধে লাঙ্গল চাপিয়ে নিলো। তারপর তাড়া দিয়ে উঠলো- এই চ্ চ্- চুকচুক। আমরা দুজন জোড়া হয়ে মাঠের দিকে হাঁটা ধরলাম। রাস্তায় দেখা কাশেমের সাথে। সে ট্রাক্টর লাঙ্গল চালাবে। সে ঠাট্টা করে বললো-হ্যারে নজর সেই গেঁয়োই থেকে গেলি। মেশিন চালানো শিখে নিলি না? নজর কাশেমের কথায় হাসলো না কাশলো বোঝা গেল না। তবে মনে তার সব সময় খুশি খুশি ভাব। আমরা যখন নাড়ার জমিতে এসে পড়লাম তখন থামতে হলো। নজর শক্ত করে বেঁধে জোয়ালটা কাঁধে তুলে দিলো। তার পর শক্ত করে জমির মধ্যে চেপে ধরলো ফালটা। আমাদের লাঠি উঁচিয়ে তাড়া দিলো এই যা, যা, যা। আমরা ঘাড়ের জোয়ালে টান দিলাম। শক্ত মাটিতে চেপে ধরা ফালটা টেনে নিয়ে চললাম শক্তি দিয়ে। মাটির মধ্যে পড় পড় শব্দ তুলে দুই ভাগ হতে লাগলো। শক্ত মাটি ফেড়ে আমরা লাঙ্গল চালিয়ে নিতে লাগলাম। প্রথম প্রথম কষ্ট হলেও এ বলদ জীবন মানিয়ে নিয়ে চাষে মনোযোগ দিলাম। নজর আমাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মুখে শব্দ করছে এই বা, বা। বা বললে, বামদিক জিনিসটা নজর তার হাতের ছোঁয়ায় আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলো। এই ডা, ডা বললে, ডানদিক সেটাও বুঝিয়ে দিলো। সাথের লাল বলদটাকে অনুসরণ করে মাটি ফেড়ে চাষ করা শিখে নিলাম। যখন খুব ক্লান্ত মনে হলো তখন নজর বুঝতে পেরে আমাদের থামিয়ে দিতে মুখে- এই র-অ-ও, র..ও-ও বললো। আমরা দাঁড়িয়ে গেলাম। নজর গাছ তলায় গিয়ে ঢকঢক করে পানি খেল। তারপর সেই ধোঁয়ার বিড়ি ধরিয়ে পা বিছিয়ে বসলো। আমি জোয়াল লাঙ্গলে মানিয়ে নিয়েছি, তাই বুঝি তার চোখে মুখে তৃপ্তি। সকালে খেয়ে আসা খোল ভুসিগুলো জাবর কাটতে লাগলাম। জমি চাষ করাতে পাখিদের মনে হলো খুব ভালো হয়েছে। শালিক, ফিঙে, বুলবুলি, বুনোকবুতর সবাই মাঠে পোকামাকড় খুঁজে খাচ্ছে। আমাদের গায়ে ফিঙেগুলো উড়ে উড়ে বসছে। মাঠের মধ্যে একটা ভালো লাগার পরিবেশ। আমাদের লাঙ্গলে চষা মাঠ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে খুব তৃপ্তি পাচ্ছিলাম। পাশের জমিতে ট্রাক্টরে চাষ করছে কাশেম। সেও নজরের সাথে কথা বলছে, হাসা-হাসি করছে। লাল বলদের শিঙে ফিঙের ঠোঁট ঘষা-ঘষি, কখনো কখনো পাখি গুলো আমাদের গায়ে লেগে থাকা মশা, মাছি, এঁটেল পোকা খেয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছে। ঠোঁট দিয়ে আঁচড়ে দিচ্ছে শরীর। রোদ আমাদের গায়ে সয়ে গেছে। চৈত্র বৈশাখ জ্যেষ্ঠের কড়া রোদের মধ্যে মজনুর সাথে মাঠে মাঠে ঘাস খেতে খেতে, রোদে গরমে কোন কষ্ট হয় না। মাঠে চরে খাওয়ার সময় সারা আষাঢ়, শ্রাবণ, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে, শরীরে যেন সব সয়ে গেছে। এখন মাটি চষে যাচ্ছি, সেটাও আর কষ্ট হচ্ছে না। তাই আমার গরু জীবন ধন্য হলো। আমার কাজের নতুন রুটিন শুরু হয়ে গেছে। মাঠে মাঠে লাঙ্গল চষা। গাড়িতে করে চাল, ধান বয়ে নেয়া। লোকমান চাচা, মাঝে মাঝে পরিবার নিয়ে বেড়াতে যায়। তখন গাড়িতে চাপানো হয় টাপা। সেই টাপার গাড়ি টেনে নিয়ে যেতে হয় ধূলি ধূসরিত পথ দিয়ে। পথ না চেনা রাস্তা। নজরের লাগামের টানে যেদিকে নিয়ে যায় সেদিকেই হেঁটে যাই। কখনো হাঁটু অবধি ধুলো, কখনো গর্ত, কখনো উঁচু কাঁচা সড়ক। বর্ষাকালে সেই সড়ক হযে যায় কাদার সড়ক। সেই কাদার সড়কে গাড়ি টেনে নিয়ে যাওয়া যে কি কষ্ট তা বলে বোঝানো যাবে না। একবার গাড়ি পাকে পড়ে গেলে প্রাণপণ টান দিয়ে তুলতে হয়। তার সাথে হাশেমের ছড়ির আঘাতের কষ্ট যে কি, তা মুখে বলা যায় না।
গরুর গাড়ির উপর ছই বসিয়ে দিলেই সেটা টাপাগাড়ি হয়ে যায়। সেটার মধ্যে বাড়ির বউ ঝি, ছেলে মেয়ে নিয়ে, কখনো আত্মীয়ের বাড়িতে, কখনো মাহফিলে যেতে হয়। মাঝে মাঝে কোথাও ধর্মীয় জলসা হলে বাড়ির বৌঝিদের নিয়ে গাড়ি জুড়ে দেয় নজর। জলসা সন্ধ্যায় শুরু হলেও গভীর রাত অবধি চলতে থাকে। সেখানে রীতিমতো বেচা-কেনার মেলা বসে যায়। একদিকে চা, মিষ্টির দোকান. অন্য দিকে হুজুরদের বয়ান। বেশ ভালোয় লাগে। এমনি ভাবে আমার দিন কেটে যাচ্ছিল। আমি আমার যৌবন পেরিয়ে যাচ্ছি। বাড়ির রাজু সাজুরাও বড় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের বাবা বজলুকে ভালো করা যায়নি। বজলু লোকমান চাচার জমি জমা থাকায় বেয়াড়া ভাবে ঘুরে ফিরে বেড়ায়। মাঝে মাঝে বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করে আনে। মানুষের কাছে টাকা ধার নিয়ে, ফুর্তি করে বেড়ায়। আমাকে দুই’দুবার চুরি করতে গিয়ে ব্যর্থ হলেও বাড়ির অনেক কিছু সে চুরি করে বেচে দিয়েছে। বজলু বন্ধু বান্ধবদের সাথে নিয়ে টাকা উড়িয়ে বেড়ায়। রাত ভোর যাত্রাপালা দেখে, জুয়া খেলে, এমন ছেলে নিয়ে লোকমান চাচা খুব বিব্রত। নাতি রাজু আর সাজুকে সে আগলে রেখে পড়াশুনা করায়। তারপরও রাজু কিছুটা বাবার মতো বেয়াড়া। আমি ছোটবেলা থেকেই একটু মারমুখো বলদ। মাঝে মাঝে ফুঁস ফাঁস করে শিঙ ঝাঁকালে আশপাশের সবাই সরে দাঁড়ায়। আমাকে কেউ বিরক্ত করলে ধাপুস ধুপুস ঢিশিয়ে দিতে দেরি করি না। তাই কাশেম, আর নজর আলী আমাকে সমীহ করে চলে। কিন্তু বেশি রাগ দেখালে, নজরের ছড়ির পটাস, পটাস আঘাত, আমার রাগ কমাতে ব্যবহার করে ফেলে। আমিও এক সময় শান্ত হতে বাধ্য হই। হাটে মধু চাচা আমাকে এঁড়ে বলে ভুল করে ছিলো। সেই থেকে আমার মধ্যে এঁড়েদের মতো শক্তিভর করেছে। তবে বাড়ির চেনা লোকদের সাথে এমন করি না। আমার সাথের লাল বলদটা বুড়ো হয়ে যাচ্ছে, সে তেমন আর শরীরে বল পায় না। বাড়িতে যে লাল গাইটা সেটাও বুড়ো হয়ে বাড়িতে আছে। তার পেট থেকে যে বকনাটা হয়ে ছিলো সেটা এখন গাই গরু, তার পেটের একটা বাচ্চা এখন বড় হচ্ছে। হয়তো দুদিন পরে তাকেও গাড়িতে জুড়ে দেবে। আমার এখন মধ্য বয়স। আরো কিছুদিন শক্তিটা থাকবে। তার পর জীবনের শেষ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাবো। চাষের জমিতে ট্রাক্টর কেনার জন্য অন্য দুটো বলদকে আগেই বেচে দিয়েছে চাচা। তাই গাড়ি বহানো আর নজর যদি মনে করে চাষ করবে, তখন মাঠে যাই চাষ করতে। যদু ঘোষ এখনও দুধ দুহাতে আসে। সেও যেন দিন দিন বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। সময় কিভাবে যে চলে যায় বোঝা খুব মুশকিল।
একদিন সকালে উঠে লোকমান চাচার বাড়িতে সাজ সাজ আয়োজন। গরুর গাড়ি চড়ে সবাই যাবে দূর গ্রামে-আত্মীয়ের বাড়ি। নজর আমাদের খাওয়া দাওয়া করিয়ে টাপা সাজিয়ে ফেললো। বুঝলাম বহু দূরের পথ, মানে বহু ঝক্কি। আমি আর লাল বলদটাকে জুড়ে দিলো গাড়িতে। চাচা চাচী, রাজু সাজু, আর রাজু সাজুর মা সবাই সেজে গুজে ওঠে বসলো গাড়িতে। আমরাও রওনা দিলাম কাঁচাসড়ক দিয়ে। ধুলো ধূসরিত পথ আর দুই ধারে ধানি জমি, পার হয়ে চললাম দূর গ্রামে। মাথার উপর সূর্য জ¦লছে। নজরের এক হাতে লাগাম আর হাতে ছড়ি। তার পেছনে ছাতা ফুটিয়ে বসে আছে লোকমান চাচা। আমরা চলেছি তো চলেছি মাঠ ঘাট ফসল পার হয়ে। খুব সকাল সকাল রওনা দিয়েছি। দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে অথচ ঠিকানা যে কোথায় বুঝতে পারছি না। ভাগ্যিস ধুলো বালির রাস্তা। কাঁদা হলে অতদূর যাওয়া মুশকিল ছিল। যা হোক অনেক পথ পেরিয়ে আমরা হাজির হলাম এক বাড়িতে। সেখানে গিয়ে দেখি বিশাল আয়োজন। বুঝলাম, এটা বিয়ে বাড়ি। আমাদের দেখে বাড়ির মালিক দৌড়ে আসলেন। লোকমান চাচার সে খুব ভক্তলোক। চাচার পায়ে কদমবুসি করে, সবাইকে বিয়ে বাড়ির হট্টগোলের মধ্যে নিয়ে গেল। গাড়িটা একটা নিমগাছের পাশে রাখা হলো। আমাদেরও বাঁধা হলো। আমি আর লাল বলদটা শুয়ে পড়লাম নিমগাছের ছায়ায়। কিছুক্ষণ বাদে নজর কোথা থেকে খড় এনে ভেঙে দিলো। ক্ষুধায় সেই শুকনো খড়ই অমৃত। তারপর একটা ছোট নাদে খোল ভুসি মাখিয়ে দিলো। আমরা খেলাম পেট পুরে। তারপর গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে মনে হলো- যাক পরিশ্রমের ক্লান্তি অনেকটা দূর হয়েছে। আমি আর লাল বলদটা জাবর কাটতে কাটতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এর আগে জীবনে কোনদিন এত দূর রাস্তা পাড়ি দিইনি। হইচই শব্দে ঘুম ভাঙল। দেখি বিকেল হয়ে গেছে। নজরকে খুব তাড়া দিলো লোকমান চাচা। তাড়া-তাড়ি আমাদেরকে গাড়িতে জোড়া হলো। উঠে বসলো সবাই। তার পর আবার বাড়ির ফিরতি পথ। যতদূরেই যাই না কেন যখন বাড়ির দিকের রাস্তা ধরি তখন মনে হয় রাস্তা বুঝি ছোট হয়ে গেছে। আর গাড়ি টানতে কঠিন মনে হয় না। আমাদের দ্রুত ছুটে চলা, নজরের ছড়ির আঘাতে বেশ জোরে গাড়ি চলছিল। কিন্তু কেন যে নজর আরো দ্রুত দৌড়াতে বলছিল বুঝতে পারিনি। রাস্তায় চারদিক দিয়ে অন্ধকার ঘিরে ফেলছিলো। রাত হবার আগেই বাড়ি ফেরার জন্য এত তাড়াহুড়ো। সাধ্যমতো পা চালিয়ে চলছিলাম। কিন্তু আমরা তো জানিনে যে, এই রাস্তায় রাত হলে বিপদ আছে। ভূতের ভয় নয় মানুষ ভূতের ভয়। তার মানে ডাকাত। নজর আর লোকমান চাচা সেই আশঙ্কা করছে। আমরা প্রায় অর্ধেক রাস্তা পেরিয়ে এসেছি। তখনই অন্ধকারের চাদরটা ঘিরে ধরলো। নজর একটা বাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে হারিকেন ধরিয়ে গাড়িতে বাঁধলো তার পর আবার চলা। লোকমান চাচা সামনে টর্চের আলো ফেলছেন। আমরা এগিয়ে চলেছি। নজরের লাগামের টানে মানুষের বসতি পেরিয়ে, ধানি জমির মধ্যে দিয়ে চলতে শুরু করেছি। দুই ধারে ধানি জমি। আকাশে একথালা খই ফোটানো তারা। জন মানবের বসতি নাই। কেমন একটা গাছমছম করা রাস্তা। এই ভয়ই করছিলো নজর। যা সন্দেহ করা হয়েছিল তাই হলো। ধানের জমি থেকে চার পাঁচ জন ষণ্ডা মার্কা ডাকাত উঠে এলো। নজর লাগাম টেনে ধরলো- লোকমান চাচা চেঁচিয়ে বললো কি চাই? একজন ডাকাতের হাতে বড় রামদা সে এসে দাঁড়ালো সামনে। চাচা গাড়ি থেকে ছাতা হাতে নামলো। ডাকাতটা এসে বললো- কারো মৃত্যু চাই না। শুধু যার কাছে যা আছে সব দিয়ে দিলেই হবে। ছেড়ে দেব। লোকমান চাচা বললো- কেন দিতে হবে? ডাকাত বললো- না দিলে এই দায়ের আঘাতে আপনার মুণ্ডু রাস্তায় পড়বে। লোকমান চাচা অনেক আগে থেকেই ছিলো সাহসী মানুষ। তাই সে তার কথায় ঘাবড়ালোনা। বললো- ঠিক আছে আমাদের কাছে যা আছে দিচ্ছি। এরই মধ্যে ছইয়ের ভেতরে থাকা চাচী আর সাজুর মা কান্না-কাটি শুরু করে দিয়েছে। আরেক জন ধমকে উঠলো। আমরা গাড়ি কাঁধে নিয়ে চুপ চাপ দাঁড়িয়ে আছি। নজর লাগাম টেনে ধরে স্থির। আমার মুখের সামনে একটা ডাকাত, আর লাল বলদের সামনে আরেক জন। আমার মনে হলো গাড়ির জোয়াল থেকে বেরিয়ে ডাকাতটাকে খুব জোরে ঢিশিয়ে দিই। কিন্তু করার কিছু দেখছি না। লোকমান চাচার সামনে মূর্তিমান একজন। আরেক জন ডাকাত সোনা দানা গুলো খুলে নিচ্ছিল। লোকমান চাচার পকেটে হাত ঢুকিয়ে কিছু আছে কি না দেখাছিলো চাপাতি ওয়ালা। হঠাৎ ধড়াস করে একটা শব্দ। লোকমান চাচা ছাতার বাট দিকে চাপাতি ওয়ালার মাথা বরাবর একটা কষে বাড়ি দিয়েছে। সাথে সাথে নজর লাগাম ছেড়ে দিয়ে লেজে দিলো মোচড়। সামনে থাকা দুজন ডাকাতের উপর দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে দিলো। একটা ডাকাত গাড়ির তলায় পড়লো, অন্যটা আমার শিঙের আঘাতে পাশে গিয়ে পড়লো। লোকমান চাচাকে রেখেই গাড়ি ছুটিয়ে দিলো নজর। পেছন পেছন দৌড়ে আসছে লোকমান চাচা, তার পেছনে ছুটে আসছে দুজন ডাকাত। আর নিস্তার নাই। হাশেম যখন বুঝলো চাচা পেছনে, তখন লাগান টেনে ধরলো। আমরা দৌড়ের মাথায় লাগামে টান পড়ায় দ্রুত নামতে গিয়ে জোয়াল থেকে ঘাড় গেল সরে। গাড়িটার জোয়াল নিচে পড়ে গেল আর অমনি ভেতরে বসে থাকা রাজু, সাজু, চাচী আর সাজুর মা- হুড়মুড় করে গাড়ির সামনে গড়িয়ে পড়লো। সাথে সাথে, ও মা, বাবা গো করে শুরু করলো চেঁচাতে। আমি লাগাম মুক্ত হয়ে চাচাকে ধাওয়া করে আসা ডাকাতটাকে পেয়ে গেলাম সামনে। সাথে সাথে শিঙ দিয়ে ধাই ধাই করে দুই দুটা ঢিশ দিয়ে দিলাম। তাতে সে গিয়ে পড়লো পেছনে ধাওয়া করে আসা ডাকাতটার উপর। লোকমান চাচার তার ছাতার কাঠের বাঁট দিয়ে সপাসপ ডাকাতদের পিটাচ্ছিলেন। এই মধ্যে আশপাশে থেকে টর্চ, লাইটের আলো এসে পড়তে লাগলো আমাদের উপর। তাতে মনে হলো, আশপাশে মানুষজন ছিলো। আমাদের চেঁচানোতে তারা বুঝতে পেরে, সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছে। ডাকাত দলের চারজন খুব একটা সুবিধা করতে পারলো না। কিন্তু যে ডোকাতটাকে আমি ঢুশিয়ে দিয়েছিলাম, সে উঠে আমাকে আবার আঘাত করতে এলো। আমি শিঙ উঁচিয়ে তেড়ে গেলাম কিন্তু সে পালানোর আগে ছুড়ে মারলো তার চাপাতি। এসে লাগলো আমার পেছনের পায়ে। একটা কনকনে ব্যথা অনুভব করলাম। তারপর বসে পড়লাম। এরই মধ্যে আশপাশে লোকজন চলে আসায় ডাকাত দল চম্পট দিয়েছে। আমরা সবাই একটু আধুট আহত হলেও আমার আঘাতটাই হলো বেশি। একটা লোক টর্চ দিয়ে আমার পায়ে রক্ত দেখে বললো- এখানে একটা বাঁধন দাও। লোকজন সবার সেবা করতে লাগলো। কিন্তু আমার যা অবস্থা হলো, তাতে আর গাড়ি বয়ে নেয়া সম্ভব নয়। একটা লোক বললো চাচা তোমরা চলো আরেকটু সামনে আমার বাড়ি। লোকমান চাচা যাবে না। তাই সেই লোকটা বাড়ি থেকে একটা বলদ ধার করে এনে গাড়ি জোড়া হলো। ধীরে ধীরে লোকজন আরো বাড়লো। রাজু সাজু, চাচা, সাজুর মা, হাউ মাউ করে কান্নাকাটি করছিলো। লোকজন দেখে থেমে গেছে। আমার ঠ্যাঙে গামছা দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হলো। তারপর গাড়ি জুড়ে আমরা ফিরতে লাগলাম। আমাকে গাড়ির পেছনে বাঁধা হলো আমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে প্রায় তিন ঠ্যাঙে হেঁটে বাড়ি ফিরে এলাম। বেশ ক’জন লোক গাড়ির পেছন পেছন এসে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল।
বাড়িতে আসার পর পাড়ায় জানাজানি হয়ে গেল। সবাই টর্চ, হারিকেন নিয়ে আমাদের দেখতে এলো। বাড়ির অনেকে আহত হলেও ছেলে বুড়োরা আমাকে দেখতে ভিড় করলো। আমার পায়ের জখম অংশে টর্চ জে¦লে সবাই দেখলো আর হায় হায় করলো। লোকমান চাচা এক সময় আমার কাছে এসে জড়িয়ে ধরে বললো- এই বলদটা না থাকলে কি যে হতো। ও যদি ডাকাত দলকে ঢিশিয়ে না দিতো তাহলে বুঝি বাঁচতাম না। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। একথা শুনে লোকজনের ভালোবাসা যেন আরো বেড়ে গেল। সবাই আমার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করলো। এসব শুনে নিজেকে খুব গর্বিত মনে হলো। কিন্তু কনকন করে উঠলো পায়ের আঘাতটা।
পরের দিন সকালে সাইকেল নিয়ে এসে দাঁড়ালো একজন পাতলা-সাতলা লোক। লোকটা লোকমান চাচাকে হাঁক ডাক দিলেও সে আমাকে দেখছিলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। লোকমান চাচা বের হয়ে হাঁক দিলো- এই কে আছিস একটা চেয়ার নিয়ে আয়তো। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম এটা একজন ডাক্তার। নাম নলিনিকান্ত। তিনি মানুষের যেমন চিকিৎসা করেন, তেমনি পশুদেরও। লোকটা আমার বেঁধে রাখা পা-খানা খুলে দেখলেন তারপর আঘাতের আশপাশে টিপে দেখে বললেন। আঘাতটা গুরুতর, তবে সেরে যাবে, কিন্তু কিন্তু বলায় চাচা খুব চিন্তিত হয়ে বললেন- কিন্তু কী দাদা?
ডাক্তার বললো-ওকে দিয়ে আর গাড়ি বহানো অথবা লাঙ্গল চালানো যাবে না। মানে সে খোঁড়া হয়ে থাকবে। এ কথা শুনে চাচা মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ডাক্তার বললো বয়সতো হয়েছে বেশ। বেচে দিয়ে নতুন বলদ কিনলেই হয়। চাচা হায় হায় করে উঠলো- গত রাতে ডাকাতের হাত থেকে এই বলদটায় আমাদের রক্ষা করেছে। এরে বেচে দেওয়া ঠিক হবে না। -সেটা আপনার মর্জি। ডাক্তার একটা ইনজেকশন বের করে তাতে ঔষধ ঢুকালো তারপর আমার কোমরে ঢুকিয়ে দিলো। বেশ কষ্ট হলো। একবার ইচ্ছা হয়েছিলো পায়ের একটা চাটি দিয়ে দিই কিন্তু পেছনের একটা পায়ে দাঁড়িয়ে আছি। আরেকটা পা খোঁড়া, পারলাম না। কি করে দিই ডাক্তার নালিনি একটা সাদা কাগজে খস খস করে কিসব লিখে দিলো। বললো- ঔষধগুলো কিনে খাওয়াবেন। চাচা কাগজটা হাতে মন খারাপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার মন খারাপ। কারণ আমাকে দিয়ে আর কাজ হবে না। সেই সাথে আমি যে তাদের ডাকাতের হাত থেকে রক্ষায় সাহায্য করেছি। সে কথা ভেবে কিনা জানি না। ডাক্তার যাবার আগে আমার ঠ্যাংগে একটা শেলাই দিলেন তার পর সাদা কাপড় দিয়ে খুব করে বেঁধে দিলো। আমি চুপচাপ কষ্ট সহ্য করে নিলাম। কারণ গতকাল থেকে শরীরে খুব ধকল গেছে। ডাক্তার চলে যাবার পর একটু নিজের প্রতি আস্থা ফিরে পেলাম, ঠ্যাংটা তাহলে সেরে উঠবে। কিন্তু লোকমান চাচার বাড়িতে আর আয়ু থাকবে কিনা জানি না।
একদিন পরই বাড়িতে কসাই এসে হাজির।
সকাল সকাল ইয়া মোচওয়ালা একটা লোক নিমতলায় এসে দাঁড়ালো। লোকটার নাম রুস্তুম কসাই। পাড়ার সবাই চেনে। গরু ছাগলের আতঙ্ক।
চাচা বের হয়ে এসে জানিয়ে দিলো সাদা বলদটা খোড়াঁ হলেও তাকে এখন বেচা যাবে না। বাড়িতেই থাক। রুস্তুম অনেক বোঝালো চাচাকে, লোকমান চাচা তার কথায় মাঝে মাঝে দুর্বল হলেও শেষ পর্যন্ত না করে দিলো। রুস্তুম কসাইয়ের লাল চোখ দিয়ে আমাকে দেখলো, মনে হলো ওর চোখ আমাকে মেপে বলে দিচ্ছে আমার মাংস কতটুকু হবে। আমি বুঝলাম আমি আর কোন কাজে লাগবো না। রাতে গোয়ালে শুয়ে ঘুমাই, সকালে কাঁঠাল তলায় জাবনা খাই। নতুন দুটো বলদ এখন গাড়ি টানে। লাল গাইটার একটা বাচ্চা এখন বলদ। আরেকটা গাভী। সেটা বাঁধা থাকে নিমগাছের তলায়। বলদটা গাড়িতে জোড়া হয়েছে। সাথে বুড়ো বলদটা আছে। আমি আহত হবার কারণে কর্মহীন বেকার। আমার কোন কাজ নেই শুধু মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা। যদু ঘোষ এখনও আসে। লাল গাভীটার বাচ্চা এখন সাদা-কালো রঙের গাভী। সেটার দুধ দোহায়। যদু ঘোষ বুড়ো হয়ে যাচ্ছে-সাথে সাথে আমিও। একদিন রাতে খুব হইচই হলো। দেখলাম পুলিশের গাড়ি। সেই গাড়িতে বজলুকে হাতে হ্যান্ডকাফ করে তুলে নিয়ে গেল।
সে নাকি কার সাথে মারামারি করে ঠাং ভেঙেছে। লোকমান চাচা কোন দুঃখ না করে পুলিশের হাতে তুলে দিলো বজলুকে। একদিন সকাল আবার রুস্তুম কসাই এসে হাজির। লোকমান চাচা এবার আর কিছু বললো না। মনে হলো কথা আগে থেকেই হয়ে আছে। আমাকে গোয়াল থেকে বের করে এনে মজনু কাঁঠাল কাছে বাঁধলো। প্রথম দিকে বেশি খোঁড়ালেও এখন বেশ বল পাই। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হলো না। শেষ পর্যন্ত কসাইয়ের হাতে পড়তে হলো। বুড়ো বলদ হয়ে গেলাম। সাজু এসে দাঁড়ালো, গায়ে হাত বুলালো তাতেই আমার সুখ। লোকমান চাচা মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিলো। মনে হলো চোখে তার পানি এসেছিলো। আমি যে সব বুঝে ফেলেছি তা জানানোর মতো কোন আচরণ করিনি। আমি শুধু আমার গোয়ালঘর, নিমগাছ, কাঁঠাল গাছ। সাজু, মজনু, রাখাল, কাশেম, নজর ওদের চেহারাটা একবার দেখলাম। রুস্তুম কসাইয়ের হাতে দড়ি ধরিয়ে দিলো লোকমান চাচা। আমি নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করে হাঁটতে লাগলাম। আমরা বেঁচে থাকতেও মানুষের উপকার করে গেলাম। মরণের পরেও তাদের উপকারে নিজেকে উৎসর্গ করে গেলাম।

Share.

মন্তব্য করুন