আমি গরু। আমাকে তোমরা সবাই চেন। যারা গ্রামে বাস করো তারা তো হরহামেশায় দেখ। আর যারা শহরে বাস কর তারা তো প্রথমে ছবিতে দেখ তার পর টিভিতে। একটু বড় হলে হঠাৎ করে জ্যান্ত দেখে ফেল বাড়ির পাশে, খেলার মাঠে অথবা রাস্তায়। তারপর পড়তে গিয়ে পেয়ে যাও গরুর রচনা। আর এই রচনা কে না পড়েছে বলো? ধনী গরিব সবাই পড়ে। গরু একটি উপকারী প্রাণী, তার চারটি পা আছে, একটি লেজ আছে, সেটা দিয়ে মশা মাছি তাড়ায়, গরুর দুধ দিয়ে দই, ছানা তৈরি হয়। চামড়া দিয়ে এটা সেটা। আচ্ছা আমার চেহারাটা সামনে দাঁড় করালেই তো হলো, সব জানা হয়ে যাবে। তার পরও কথা থাকে জানার থাকে। তাহলে আমার আর আমাদের গল্পটা তোমাদের বলি।
বিরাট গেরস্থ বাড়িতে আমার জন্ম। আমার মায়ের আমি হলেম শেষ দিকের বাছুর। সব ছোট ছোট বাচ্চাদের মতো আমিও খুব মিষ্টি হয়ে জন্মেছিলাম, তাই কিনা বাড়ির সবার চেহারার মধ্যে একটা হাসি হাসি ভাব হয়েছিল। আমি জন্ম নেবার পর আমার পাশে আগুন জ্বেলে আমাকে গরম দেওয়া হলো। তখন ছিলো হালকা শীত। মা সারাদিন আমার শরীরে জিভ দিয়ে আদর করে দিয়ে ছিলো। জন্ম হয়েই একটা মা পাওয়া আদর পাওয়া খুব মজার। তারপর দাঁড়িয়ে গেলাম একটা কদম গাছের তলে। সেখান থেকে শুরু হলো পৃথিবীটাকে দেখা। পৃথিবীতে রোদ আর ছায়া আছে, গরম আছে শীত আছে, আর আছে বৃষ্টি। বড় হতে হতে সব কিছুই আমাদের সহ্য করতে হয়। আমরা কিন্তু খুব বেশি দিন বাঁচি না। এই ধরো বিশ বছর আয়ু। মানুষের কাছে এ সময়টা কিছুই না।
কদম গাছের পাশেই আমাদের থাকার জন্য বিশাল গোয়াল ঘর। সেখানে মার সাথে এক কোণে থাকতে শুরু করলাম। গোয়ালের মেঝেতে বালিমাটি দেয়ার কারণে খুব একটা স্যাঁতস্যাঁতে হয় না। সকাল সকাল সব গোবর পরিষ্কার করার জন্য একটা মেয়ে আসে তার নাম ‘নুরুর মা’ সবাই তাকে ‘নুরুর মা’ বলেই ডাকে। তার মনে হয় খুব দুঃখ। গোবর তুলতো আর কাঁদতো। সে গোবর রান্নাঘরের দেয়ালে গোল গোল চাকতি করে লাগিয়ে দিতো নুরুর মা। চাকতি লাগাতো আর কান্না কান্না কণ্ঠে বলতো-জমিদার ঘরের মেয়ে আমি। এমন সুয়ামির হাতে আমাকে তুলে দিল যে আমাকে গোবর ঘাঁটতে হয়। হায় হায়। এসব প্রতিদিনের ব্যাপার। আমাদের গোয়ালে দুটো ষাঁড়, একটা লাল গাই, তার বাছুর, চারটে বলদ ছিলো। রোজ সকালে যদু ঘোষ আসে, বিরাট তার ভুঁড়ি। সে চার পাঁচটা বালতি নিয়ে একটা ভাঙাচোরা সাইকেলে করে আসে। আমার গলায় দড়ি দিয়ে মায়ের কাছ থেকে দূরে একটা খোঁটাতে বেঁধে ফেলা হয়। তার পর মাকে কদম গাছের সাথে বেঁধে দুধ দোহায়। যদু ঘোষ যখন গান গাইতে গাইতে দুধ দোহায় তখন মনে হয় আমার জন্য বুঝি কিছু রইলো না। কিন্তু না দুধ দুহে যাদু ঘোষ আমাকে ছেড়ে দেয়। আমি এক দৌড়ে তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে এসে দুধ খাই তখন খুব মজা হয়। কিন্তু একটু পরে যদু ঘোষ আমাকে আবার টেনে নিয়ে সেই খুঁটাতে বেঁধে ফেলে। তারপর আবার গাবুর গুবুর চ্যাচু চ্যাচু করে দুধ দোহায়। মাঝে মাঝে দৌড়ে গোয়াল থেকে সামনের রাস্তাটায় যাই, আবার এক দৌড়ে মার কাছে আসি। আমাদের গোয়াল থেকে সামান্য দূরে নদী। সেই নদী পর্যন্ত যেতে খুব ইচ্ছে হয়। কিন্তু বিশাল পদ্মা নদী পর্যন্ত যেতে খুব ভয় হয়। তবে দৌড়ে দৌড়ে প্রতিদিনই একটু একটু করে রাস্তা আমার বাড়ছে। আমি দৌড় দিতে শেখার পর গেরস্তের ছোট ছেলেটার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তার নাম সাজু। সে কষ্ট করে আমাকে জড়িয়ে ধরতে চায়। ইচ্ছে সে আমাকে কোলে নেবে। তাই কি হয় …।
সাজু আমাকে আদর করে, আমার গলায় হাত বোলায় তখন খুব ভালো লাগে। বাড়ির ভোলা কুকুরটার খুব হিংসে। আমার এমন দৌড়া-দৌড়ি তার পছন্দ না। সাজু যে আমাকে ভালোবাসে সেটাও তার হিংসে। মাঝে মাঝে সে আমাকে ঘেউ-ঘেউ করে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। গেরস্থ লোকমান সরকার লাঠি দিয়ে ভোলাকে ভয় দেখায়। তখন ভোলা ল্যাজ নাড়িয়ে লাজুক লাজুক ভাব দেখিয়ে কেটে পড়ে। যেন সে খুব ভুল করে ফেলেছে।
আমাদের বিরাট গোয়ালে আরো যারা থাকে, তাদের সবাইকে আলাদা আলাদা দূরত্বে বেঁধে রাখা হয়। না হলে এঁড়েগুলো সারারাত ঝামেলা করে। গরুদের চারনামে ডাকা হয়। প্রথমে নাম থাকে ‘এঁড়ে’ আর বকনা। মানে তোমাদের মানুষদের মতো পুরুষ আর নারী। এঁড়ে গরুকে অপারেশন করে করা হয় বলদ, আর বকনা গরুর বাচ্চা হলেই তাকে গাই ‘গরু বলে’ ডাকে। আমি মায়ের এঁড়ে বাছুর। আমি এঁড়ে থাকবো না বলদ গরু হবো, এটা গেরস্থের মর্জি। আমাদের গোয়ালের পাশে ছাগল ভেড়াদের থাকার ঘর। তারা দিনরাত ব্যা ব্যা, ম্যা ম্যা করে চেঁচায়। সকালে আসে মজনু রাখাল। সবাইকে খড়, ভুসি, খোল এসব মজার খাবার মিশিয়ে দেয় তখন গরুগুলো মুখ ডুবিয়ে চুমুক-চুবুক করে খেয়ে পেট একেবারে ভরিয়ে ফেলে। তারপর যার যা কাজ। যে বলদ দুটো মাঠে যাবে তাদের আলাদা করে বেঁধে ফেলে নিম গাছটার সাথে। যে দুটো গাড়ি কাঁধে নেবে তাদের গোয়ালের সাথে বেঁধে রাখে। যখন লাঙ্গল চাষের সময় হয় তখন চারটে বলদকেই নিয়ে কৃষান কাশেম আর নজর আলী মাঠে যায়। বাদ বাকি ছাগল-ভেড়া আর এঁড়েদের মাঠে চরাতে যায় মজনু।
সবাইকে নিয়ে মজনু আর কৃষানরা মাঠে চলে যাবার পর আমি আর আমার মা একা হয়ে পড়ি। মা বাঁধা থাকে, আমি তখন ছাড়া। যে-দিক ইচ্ছে সেদিকে দৌড় দিই। দৌড়ে একদিন চলে গেলাম গেরস্থের বাড়ির মধ্যে। গিয়ে দেখি বিশাল উঠোন, তার এক পাশে ধান সিদ্ধের বড় বড় ডেকচি, চুলা। উঠোন জুড়ে ধান শুকোতে দেওয়া হয়েছে। এক পাশে ঢেঁকি ঘর, সেখানে দুটো মেয়ে একটা কাঠের ঢেঁকিতে লাথি দিয়ে চলেছে। আর ধাই ধুপুস, ধাই ধুপুস শব্দ চলছে তো চলছেই। আমাকে দেখে বাড়ির গেরস্থ বউ হেসে উঠে বলে-এই দেখ নতুন বাছুরটা চলে এসেছে। বাহ্ দেখতে তো খুব সুন্দর হয়েছে। ভেলু নামের কুকুরটা উঠোনের এক পাশে হেলান দিয়ে বসেছিলো। আমাকে দেখে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। আমি একটু ভয় পেয়ে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠেছিলাম। এমন সময় মা, গাঁ-আ করে ডাক দিলো, তুই কোথাই গেলিরে। আমি তখনি এক লাফে ছুটতে ছুটতে মার কাছে চলে এলাম। মা আমাকে আদর করে দিল। এমন সময় দেখলাম বাড়ির ছোট ছেলেটা, ধুলো বালি মেখে কোথা থেকে উদয় হলো। তারপর আমাকে ধরার জন্য চেষ্টা করতে লাগলো। আমি আরো একটা লাফ দিয়ে ছুট লাগালাম নদীর ধারের রাস্তায়। দেখলাম সেখানে একটা আম বাগান। বাগানে অনেক জংলি ফুল ফুটে আছে। তার গন্ধও আছে নানা রকম।
আমার পিছু পিছু ছুটে আসছে সাজু ছেলেটা। সে ছুটতে ছুটতে প্যান্ট খুলে যাবার মতো অবস্থা তারপরও খালি গায়ে খিল খিল হাসি হেসে দৌড়াচ্ছে তো দৌড়াচ্ছে। তারপর কি যে হলো, সাজু ধুলো বালির মধ্যে উবু হয়ে ধপাস। গোটা বুকে, পেটে, মুখে কপালে ধুলোবালি লেগে অদ্ভুত হলো চেহারা। আমি তখন বাগান থেকে এক দৌড়ে সাজুর কাছে এসে দাঁড়িয়েছি। এর মধ্যে সাজুর আব্বু কোথা থেকে এসে পড়লো, তার হাতে বন্দুক। সাজুর এমন অবস্থা দেখে একটা হেঁচকা টানে তাকে দাঁড় করিয়ে দিলো। তার অবস্থা দেখে খুব হাসি পেল। কিন্তু দুঃখ পেলাম যখন সাজুর আব্বা সাজুর পেছনে কসে একটা থাপ্পড় লাগালো। থাপ্পড় খেয়ে সাজু ও দিলো এক দৌড়। আমি তখন তিড়িং করে লাফিয়ে সাজুর আগেই পৌঁছে গেলাম মায়ের কাছে। দেখলাম সাজু দৌড়ে কাঁদতে কাঁদতে আসছে। আমাকে দেখে একবার কান্না থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর আবার কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। আমি আমার মায়ের গা ঘেঁষে ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে আছি। দেখলাম সাজুর বাবা এসে দাঁড়ালো কদম গাছের তলায়। পকেট থেকে সাদা মতো একটা জিনিস বের করে কাঠি ঘষে আগুন ধরাল। তারপর মুখ দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া ছাড়তে লাগলো। অবাক হয়ে দেখলাম ধোঁয়া বের হচ্ছে। মানুষরা এগুলো কেন খায় বোঝা মুশকিল। এটার নাম সিগারেট আর গেরস্থ চাচা যেটা খায় সেটার নাম হুকোঁ। দুটোতেই ধোঁয়া বের হয়।
মানুষের কথা বার্তা শুনতে শুনতে আর দেখতে দেখতে অনেক কিছুই চিনে ফেলছি, শিখে ফেলছি। মানুষরা যে সৃষ্টির সেরা সেটা হাড়ে হাড়ে শিখেছি। কারণ মানুষরা যা করাতে চায় গরু, ছাগল অন্যান্য জীব জন্তু তাই করতে বাধ্য হয়। গৃহপালিত জীব জন্তুরা তাই করে। কিন্তু যারা জঙ্গলে থাকে তাদের কথা আলাদা, তারা জঙ্গলে স্বাধীন হলেও জঙ্গলের বাইরে এলে খবর আছে। মানুষের ছেলেরা সব হই হই, রে রে করে তাড়িয়ে দেয়। এই যে সেদিন একটা শেয়াল ঢুকেছে গাঁয়ে, কে যেন দেখে ফেলেছে। আর যায় কোথা, লাঠি ঠেঙ্গা নিয়ে চারদিক থেকে লোকজন ধর ধর করে ঘিরে ফেললো বেচারাকে। এদিকে সাজুদের বাড়ির ভেলুটা ঘেউ-ঘেউ করে পিছু নিলো। আশপাশে যত কুকুর ছিলো সব হা হা, খা খা করে তেড়ে এলো। কিন্তু শেয়ালটা খুব চালাক, তার কাছাকাছি কুকুরগুলো যেই গিয়েছে আর অমনি শেয়ালটা বিচ্ছিরি গন্ধ ছাড়লো। সেই গন্ধে কুকুরগুলো গেল পিছিয়ে, সেই সুযোগে শেয়ালটা কোন মতে রক্ষা পেল। আর ষাঁড়গুলো যতই রোয়াক দেখাক, যতই শিঙ ঝুঁকিয়ে ভয় দেখাক, শেষ পর্যন্ত মানুষের কাছেই বন্দি থাকতে হয়। তাইতো মা গরুটা আর পাশের লাল গাইটা ভদ্রভাবে যদু ঘোষকে দুধ দোহাতে দেয়। সেই দুধ মানুষে খায় আমরাও খাই। একদিন সকালে বাড়ির কৃষান কাশেম আর নজর আলী সকাল বেলা হেসে হেসে গল্প করছিল। তাতে বোঝা গেল ষাঁড় দুটোকে নিয়ে কি একটা ফ্যাসাদ হয়েছে। গেরস্থ লোকমান সরকারের ছেলে বজলু বিক্রি করে দিতে চায়। এই নিয়ে বিরোধ। এই এলাকার মোড়ল হলো লোকমান সরকার। কিন্তু তার ছেলে বজলু একটু বেয়াড়া, বাপের কথা শুনে না।
মোড়ল গাঁয়ের মানুষের উপকার করে, অথচ বজলু যত রকমের খারাপ কাজ করে। এই নিয়ে মাঝে মধ্যেই বাপ বেটার ঝগড়া হয়।
আমরা হলাম গরু। গরুর মধ্যেও ঠেলাঠেলি লেগে যায়। তখন সবাই হাম্বা হাম্বা রব তোলে। মোড়ল বা রাখালটা যখন বুঝতে পারে, তখন এসে কার কি দোষ এ সব না খুঁজে ষাঁড় দুটোকে আগে ভালো মতো পেটায়। তার পর সব চুপ চাপ। মানুষরা বলে দুষ্টু গরুর চাইতে শূন্য গোয়াল ভালো। এইতো সেদিন দুধ দোহানো শেষে রাখালটা মাকে নিয়ে গেল স্কুলের মাঠে। সেখানে খুঁটোতে বেঁধে চলে এলো। আমি তাকিয়ে দেখি পাশের স্কুল ঘরে মাস্টার মশাই ছাত্র পড়াচ্ছে। ছেলেগুলো হইচই করে পড়ছে। মাস্টার মশাই মাঝে মধ্যে রাগ করে বলছে- তোরাতো এক একটা গরু। পিটিয়ে তোদের মানুষ করতে পারলাম না। মাথায় ঘিলুতো নাই আছে গোবর। সেদিন শুনে খুব হাসি পেয়েছিল। যাই হোক মোড়লের ছেলে বজলু মানুষের মধ্যে তাহলে গরু, মাথায় গোবর। আমি যতই বড় হচ্ছি ততই শিখছি, বুঝছি কিন্তু গরুর শিক্ষার একটা পর্যন্ত আছে। সেই পর্যন্ত শিখতে পারলেই হলো। বেশি শিক্ষা লাগে না।
তো সেদিন মোড়লের সাথে ছেলে বজলুর কথা কাটাকাটি চলছিল। বজলুর টাকার দরকার তাই ষাঁড় দুটো বেচবে না হলে জমি। চাচা তাতে রাজি নয়, সে ষাঁড় দুটো কোরবানির ঈদের হাটে বেচতে চায়। এই নিয়ে ফ্যাসাদ বাধলো। মোড়ল রাজি না হওয়ায় বজলু বন্দুক হাতে কোনদিক যেন চলে গেল। মোড়ল গেল বাড়ির মধ্যে। মা বাঁধা ছিল কদম গাছের গোড়ায়। হঠাৎ করে আবার উদয় হলো বজলু, সাথে মুখে গামছা বাঁধা একটা চোর চোর ভাব লোক। লোকটা আমার মাকে কদম গাছ থেকে খুলে নিয়ে ধানের জমিতে নামলো। আমিও নিরুপায় মায়ের পিছু নিলাম। মাকে টেনে নিয়ে জমির আল দিয়ে চলতে থাকলো। আমিও সাথে চলেছি। পেছনে বন্দুক হাতে বজলু। জীবনে এমন ঘন জমিতে ঢুকিনি, তাই ভয় ভয় লাগছিলো। আমি শুধু দৌড়ে দৌড়ে মায়ের গা ঘেঁষে- চলেছি, জানি না কোথায় গিয়ে থামবো। মা শুধু নাক মুখ দিয়ে ফসফস আওয়াজ করছিল। মা বুঝছিলো তাকে মোড়লের ছেলে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এঁড়ে গুলো বাদ দিয়ে মাকে কেন নিলো। লোকটা পেছন ফিরে বজলুর সাথে মাঝে মাঝে দুচারটা কথা বলছে তাতে বোঝা গেল- গোয়াল থেকে মা দূরে থাকায়- সহজে নিতে পেরেছে। তাছাড়া বাছুরসহ গাভীর খরিদ্দার পাকি বেশ পাওয়া যায়। তারা মূল রাস্তা ছেড়ে ধানের ক্ষেতের আল ধরে যাওয়ার কারণ হলো- লোকে বজলুকে চেনে, তারা দেখলে চিনে ফেলবে তারপর খবর চলে যাবে মোড়লের কানে।
মায়ের রঙ সাদা তাই তাকে ধলি বলে ডাকে। মা বেশ বুড়ো হয়ে গেছে। যদু ঘোষ রোজ দুধ দোহাতে এসে বলে- বাবু ধলি গাইয়ের দুধ কমে আসছে। বয়স হয়েছে তো, বেশি দিন আর টিকবে না। সেই বুড়ো মায়ের সাথে চলেছি। আমাদের বেচে দিতে চায় বজলু। আমার খুব দুঃখ হচ্ছে, বাড়িটা, কদম গাছটা আর সাজুর জন্য। কি আর করা মানুষ যা করে তার উপরে আমাদের হাত নেই। অনেক মাঠ পেরিয়ে এসে পৌঁছালাম এক ধুলো বালির রাস্তায়। সামান্য রাস্তা পার হয়ে কানে এলো অনেক গরু বাছুরের হাম্বা হাম্বা রব। দেখলাম একটা মাঠে অনেক গরু ছাগল, আর মোষ। সেই সাথে অনেক মানুষ। মাঠের শেষ দিকে আমার ধলী মাকে একটা খুঁটায় বাঁধা হলো। তারপর দু’একজন লোক ধলি মা আর আমাকে নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগলো। বিরাট হাট, জীবনে এক সাথে এত গরু ছাগল আর মানুষকে প্রথম দেখলাম। হাটের অনেক মানুষই মোড়লের ছেলে বজলুকে চেনে। হাটে গরুগুলোকে সামলাতে মানুষের হিমশিম অবস্থা। লাঠি দিয়ে বেয়াড়া গুরুগুলোকে পটাপট পেটাচ্ছে। দেখলাম, একটা হ্যাংলা মতো লোককে একটা এঁড়ে গুরু শিঙ এর গুঁতোয় মাথার উপর তুলে ফেলে দিলো। লোকটা তো পড়ে গিয়ে হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করলো। এই অবস্থা দেখে তার সাথে থাকা আরেকজন ষাঁড়টাকে লাঠি দিয়ে এমন ধোলায় দিলো যে হাটের মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে গেল।
এগুরু ও গরুকে ঠেলা দেয়, ঢিশ দেয়। হাট সামলাতে হিমশিম অবস্থা। এই ভিড় ভাট্টার মধ্যে হাম্বা হাম্বা আর মানুষের চেঁচামেচিতে একটা কদাকার অবস্থা দাঁড়ালো। এই ঠেলা ঠেলির মধ্যে এক চাচা ছাতা বগলে নিয়ে লাফিয়ে এলো আমাদের সামনে। মুখোমুখি হয়ে গেল বজলুর আর গামছায় মুখ ঢাকা চোরটার সামনে। এসেই বিস্ময় নিয়ে তাকালো বজলুর দিকে। বজলু কে মনে হলো চাচা চেনে। বজলু মুখ লুকানোর চেষ্টা করে পারলো না। ব্যাপারটা রহস্যজনক। চাচা বললো- কিরে বজলু এই বুড়ো গাই আর বাছুরটা নিয়ে হাটে কেনরে? বজলু কি আর বলবে বুঝতে পারলো না। আমতা আমতা করতে লাগলো। মনে হলো গরু বাছুর ছেড়ে পালাতে পারলে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। শেষ পর্যন্ত তোতলাতে তোতলাতে বললো। – গাইটা বুড়ো হয়ে গেছে তো, তাই বেচতে আনলাম। তাহলে বাচুরটা, ওটাতো এখনও দুধ খায়? বজলু বললো-চাচা কিছু করার নাই টাকার দরকার। চাচা চমকে উঠে বললো- তোর বাপ কি জানে? জানবে না কেন জানে। চাচা বললো- লোকমান ভাইতো কিছু বললো না। এমন গরু বাছুর বেচলেতো আমাকে আগে জানাতো। বোঝা গেল, চাচা গরু বেচা কেনার ব্যবসায়ী। চাচা ঠাট্টার ছলে হাসলো- তারপর মুখের পান চিবাতে চিবুতে বললো- বল তাহলে বাছুর সহ গরুর দাম কত নিবি? বজলু লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে বললো- চাচা তুমি এ গরু কিনো না। চাচা হেসে বললো- এ গরু যদি আমি না কিনিতো কাউকে কিনতে দেব না- বল কত দাম দিবো। বজলু বললো- তুমি যখন কিনতে চাও তখন ত্রিশ হাজার দিলেই হবে।
-বাছুর সহ?
-জি বাছুর সহ- ঠিক আছে তোর বাছুরসহ গরু আমি নিলাম- তবে দিবো পঁচিশ হাজার টাকা। বজলু কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু থেমে গিয়ে গামছা পরা চোরকে চোখ টিপে দিলো। পঁচিশ হাজারেই রফা হলো। চাচা হাঁক দিলো উল্টো দিকে- এই হাবু, হাবু এদিকে আয়তো। একটা রোগা মতো লোক কোথা থেকে ‘রহিম চাচা’ বলে এসে পড়লো। বোঝা গেল চাচার নাম রহিম। হাবু এসে গামছা মুখো চোরের হাত থেকে ধলি মার দড়িটা নিয়ে, চেনা চেনা চোখে, গামছা ঢাকা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো, তার পর বললো- তুমি আক্কাস না? আক্কাস কে চিনে ফেলায় সে গামছা খুলে বললো। -হ্যাঁ আমি আক্কাস- কি করবি? ধমক খেয়ে হাবু সরে এলো। রহিম চাচা গুনে গুনে পঁচিশ হাজার টাকার ময়লা কাগজগুলো আক্কাসের হাতে ধরিয়ে দিলো। ততক্ষণে বজলুর সেখানে থেকে সরে গেছে। কি আর করা মন খারাপ করে ধলি মায়ের সাথে হাঁটা ধরলাম উদ্দেশ্যে নতুন কোন গেরস্তের বাড়ি। ধলি মায়ের দড়ি ধরে হাবু লোকটা ধুলো বালির সড়ক দিয়ে আমাদের নিয়ে চললো। সন্দেহ হলো আমাদের কেনা বেচার মধ্যে কোন নাটক আছে। লোকমান চাচা এতক্ষণে নিশ্চয় হইচই বাধিয়েছে। হয়তোবা আমাদের খুঁজতে লোকজন লাগিয়ে দিয়েছে। এই সব ভেবে মোড়ল লোকমান চাচার জন্য দুঃখ হতে লাগলো আর সাজুর কথা মনে পড়ছে খুব।
ধুলো উড়িয়ে পশ্চিম মুখো রাস্তাটা ধীরে ধীরে নদীর পাশে ওঠে এলো। নদী দেখে মনে হলো- আমি বোধ হয় আমার চেনা এলাকা দিয়েই হাঁটছি। নদীতে নৌকা চলছে রাস্তার ডান দিকে গ্রামের মধ্যে রাস্তা। আমরা চলতে চলতে বিকেল শেষ হয়ে এলো। চারিদিকে ঝুপঝাপ অন্ধকারের চাদরটা ঢেকে দিলো। আমি আর ধলি মা-রাস্তা ছেড়ে একটা বাড়ির আঙ্গিনায় উঠে দাঁড়ালাম। আমাদের একটা খুঁটার সাথে বেঁধে ফেলা হলো। বাড়ির মধ্যে হারিকেনের মৃদু আলো। হাবু বাড়িতে ঢুকে জোরে জোরে কি সব কথা বলতে লাগলো বুঝা গেল না। আমাদের খুঁটার পাশে দুটো মস্ত পোয়ালের পালা। একটা চাড়িতে খোলভুসি মাখানো ছিলো। ধলি মা- সেই খোল ভূসি ফুঁস ফাঁস করে খেতে শুরু করেছে। চাড়ি থেকে একটা ঝাঁজের মতো গন্ধ ভেসে আসছিল। আমিও সেই ঝাঁজের টানে মুখ দিলাম চাড়িতে। বাহ্ খেতে তো বেশ ভালোই। আমার বোধ হয় আজ থেকে মায়ের দুধের সাথে এই খোল খড়ও খাবার শুরু হলো। খেতে খেতে খেয়াল করে দেখলাম, সেই হাটের রহিম চাচা এসে পড়েছে। বাড়ির লোকজনও বের হয়েছে। কেউ হারিকেন নিয়ে, কেউবা টর্চ হাতে। আমাদের ঘুরে ঘুরে দেখছে আর বজলুর দুর্নাম করছে। বুঝলাম না গরু কেনার সাথে বজলুর দুর্নামের সম্পর্ক কী? যা হোক কিছুক্ষণ পর আমাদের ছাগলের ঘরে বেঁধে রাখা হলো। পাশে একটা গরুর গোয়াল আছে, কিন্তু আমাদের ছাগলের ঘরে রাখা হলো কেন বুঝলাম না! ছাগল গুলো আমাদের দেখে মহা ক্ষেপেছে- কেউ কেউ তো রীতিমত ব্যা ম্যা, ব্যা ম্যা করে গালাগাল দিতে লাগলো। দু চারটে ভেড়া আছে তারা পর্যন্ত আমাদের গালি গালাজ করছে। পাঁঠাটা এক কোণে বাঁধা, সে শিঙ ঘষে ঘষে বলছে- দাঁড়া শুধু ছাড়া পাই ঢুশিয়ে ঢুশিয়ে তোদের পেট ফাটাচ্ছি। ধলি মা এদের কথায় কান না দিয়ে চুপ চাপ শুয়ে পড়লো। আমিও ভয়ে ভয়ে মায়ের পাশ ঘেঁষে চুপচাপ শুয়ে পড়লাম।
ফজরের আজানের পর লোকজনের কথাবার্তায় ঘুম ভেঙে গেল। আমাদের বাইরে নিয়ে আসলো হাবু। হাবু যে এ বাড়ির বাঁধা কৃষান বোঝা গেল। বাইরে এসে চমকিত হলাম লোকমান চাচাকে দেখে। ধীরে ধীরে সব খোলাসা হলো। রহিম চাচা ইচ্ছা করেই টাকা দিয়ে বজলুর কাছ থেকে আমাদের কিনে নিয়েছে। কারণ বজলু তার বাবার অনুমতি ছাড়াই আমাদের বেচতে গিয়ে ছিল। শেষে লোকমান সরকার পঁচিশ হাজার টাকা রহিম চাচাকে ধরিয়ে দিলো। আমরা আবার ফিরে চললাম লোকমান চাচার বাড়ি। লোকমান চাচার সাথে যে রহিম চাচার বন্ধুত্বের সম্পর্ক সেটা বোঝা গেল। শুধু শুধু আমাদের হাট ঘুরে আসতে হলো। তাতে অবশ্য আমার খুব উপকার হয়েছে। দুনিয়াটা যে কত বড় সেটা আঁচ করা গেছে। আমরা আমাদের চিরচেনা কদম গাছের তলায় এসে দাঁড়ালাম। সাজু কোথা থেকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলো। ছুটে এলো নুরুর মাও।
আমারও চোখে পানি এসে গেল। গেরস্থ লোকমান চাচা সাজুকে কোলে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাটের কথা ভাবছিলাম। কিছুক্ষণ পর লোকমান চাচা হুঁকো আর আরাম কেদারা নিয়ে কদম তলাতে এসে বসলো। তার কিছুক্ষণ পর-হাবু এসে চাচাকে সালাম দিয়ে বললো-চাচা বজলুকে কোথাও পাওয়া গেলনা। চাচা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে বললো- আমার ছেলে এমন কুলাঙ্গার হবে ভাবতেই পারি না। অরে নিয়ে কি করি বলতো?-চাচা আমরা তো অরে ভালো হতে বলি, ওকি আমাদের মতো গরিব মানুষের কথা শুনে? শোনে না। চাচা ফোঁস করে আবার দীর্ঘশ^াস ছেড়ে। হাবু ধীর পায়ে সেখান থেকে চলে যায়। এর পর তিনদিন আর বজলুকে এ বাড়িতে দেখা গেল না। আমার ধলি মায়ের পাশে লাল গাভীটা অনেক জোয়ান, তাই তার দুধ বেশি হয়। একদিন সকালে যদু ঘোষ লোকমান চাচাকে বললো- ধলির দুধ কমে গেছে। আর বুঝি তার বাচ্চা হবে না। একটা ব্যবস্থা করা ভালো হবে। লোকমান চাচা বললো- ধলি অনেক দিন থেকে এ বাড়িতে আছে। অর কি ব্যবস্থা করবো। ও আছে থাক। আমি বুঝলাম আমার আর ভয় নাই।
আমি বেশি দিন এঁড়ে বাছুর থাকলাম না, একদিন সকালে আমাকে বলদ বানানো হলো। মানে ভবিষ্যৎতে আমার কাজ হবে কাঁধে জোয়াল নিয়ে গাড়ি টানা অথবা লাঙ্গলের জোয়াল কাঁধে নিয়ে জমি চাষ করা। তবে বলদ বানানোর পরে আমার ক্ষুধা গেল বেড়ে। আমি তিন বেলা খোলভুসি খাওয়া শুরু করলাম।
খোলভুসি খাই, ঘাস খাই। মজনু আমাকে অন্য সব গরু ছাগলের সাথে মাঠে নিয়ে চললো। বড় বাছুরটা এখন বকনা গরু। সে আমার সাথে সাথে চললো। এঁড়ে দুটো সামনে, দুটো বলদ, আর লাল গাই। কিছু দূর ধুলো উড়িয়ে কাঁচা সড়ক পার হয়ে চললাম নদীর ধারে। তার পর এসে পড়লাম ধান কাটা বিশাল জমিতে। সেটায় আমাদের চরে খাওয়ার মাঠ। সেই মাঠের একদিকে ধানি জমি, অন্য দিকে ঝোপ ঝাড় আর আম বাগান। আলে আলে কচি ঘাস, ধান কাটা জমিতে এলো মেলো গজিয়ে ওঠা ছোট ছোট দূর্বাঘাস। সেই সব ঘাস কচ কচ করে ছিঁড়ে খেতে বেশ লাগে। তোমরা হয়তো অনেকে জানো গরুর চারটে পাকস্থলী। প্রথমে ঘাসগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে আমরা প্রথম পাকস্থলীতে পাচার করি। পরে সেগুলো বের করে জাবর কাটি, তারপর দ্বিতীয় পাকস্থলীতে পাচার করে দিই, সেখানে আধা-সিদ্ধ হয়ে তৃতীয় পাকস্থলীতে যায় তারপর গোবর। সে জন্যই আমাদের গোবর ফেলনা নয়। এই গোবর দিয়ে জমির সার হয়। গোবরের ঘোটা শুকিয়ে জ্বালানি হয়, নোদা হয়। তার চেয়ে বড় একটা কাজ হয় সেটা হলো বায়োগ্যাস। সেটা দিয়েও মানুষেরা রান্না করে। আমরা মনুষ্য জাতির প্রচুর উপকার করে থাকি। তাইতো তোমরা আমাকে নিয়ে রচনা পড়ো। আর মানুষের মধ্যে অনেকে আমাদের দেবতা বলে, মা বলে সেটা কেন বলে তা তারাই ভালো জানে।
এই দেখ প্রথম দিন মাঠে চরতে এসে জ্ঞান দিয়ে ফেললাম তাতে কী? কথাগুলো তো সত্যি। মাঠে আমাদের সাথে চার পাঁচটা ছাগল ভেড়াও এসেছে। তারাও স্বাধীন ভাবে সারা মাঠ চরে বেড়াচ্ছে। মজনু এত ছাগল গুরু সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। শুধু মজনু কেন আরো রাখাল, আরো গরু ছাগল বিশাল মাঠটা জুড়ে। তারাও ছড়ি দিয়ে সামলানোর কাজ করছে। আবার মাঝে মাঝে তারা বসে গল্প গুজবও করছে। পাশের বাগান থেকে কেউবা কুল পেড়ে এনে লবণ দিয়ে মাখিয়ে খাচ্ছে। কেউ মাথাল মাথায়, কেউবা গামছা মাথায়। রাখালদের মাঝে ছোট বড় সব ধরনের মানুষ আছে। একটা বুড়ো মত লোক ছোকরাদের সাথে হাসাহাসি করছে, ইয়ারকি মারছে, যেন তারা বন্ধু। এটা গরুদের মধ্যে খুব একটা হয় না। বরং রেষারেষি বেশি। তবে হাসি পায়, মাস্টার মশাই যখন মানুষকেও গরু বলে গালি দেয়। হঠাৎ হইচই শুরু হলো। চমকে গেলাম, আমবাগানের ঝোপ থেকে একটা শেয়াল বেরিয়ে একটা ছাগলের বাচ্চাকে তুলে নেবার চেষ্টা করেছে, আর যায় কোথায়? যত রাখাল ছিলো সবাই লাঠি আর ঢিল দিয়ে তাড়াতে শুরু করলো। গরু ছাগল গুলোর মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ায় এদিক এদিক পালাতে চেষ্টা করছিল। শেয়ালটা পালিয়ে যাওয়ার পর রাখালদের সেই সব গরু ছাগল সামলাতে হিমশিম অবস্থা। এরই মধ্যে আমাদের গোয়ালের একটা ষাঁড়ের সাথে অন্য এক ষাঁড়ের লেগে গেল মারামারি- ঢুশাঢুশি ফোঁস-ফাঁস। দুই রাখাল চেষ্টা করছে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে দুজনকে মারামারি থেকে ছাড়ানোর। কিন্তু কোন-মতে দুজনকে ছাড়ানো যাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত আমাদের গোয়ালের ষাঁড়টা ঢিশ খেয়ে ল্যাজ তুলে পালিয়ে এলো। জয়ী ষাঁড়টা কিছুদূর ধাওয়া করে এলেও রাখালের লাঠির পিটুনিতে আর অগ্রসর হলো না। চুকে গেল লড়াই। দুপুর পেরিয়ে গোধূলি বেলা। “গোধূলি” শব্দটা কিন্তু আমাদের জন্যই হয়েছে, কেননা আমরা যখন রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরি, তখন পায়ের আঘাতে ধুলো উড়তে থাকে। সেই ধূলি উড়ার বিকেলকে বলে গোধূলি বেলা। তো আবার সেই পথে ফিরতে হলো। সড়ক পেরিয়ে নদী-ধারের রাস্তায় ধূলি উড়িয়ে উড়িয়ে। প্রথম দিন মাঠ থেকে ফিরে বেশ ভালো অনুভূতি হলো। পৃথিবীটা কেমন যেন ভালো খারাপের মিশেল বোনা। আমি একটু বড় হয়েছি আমার চেহারা বদলে যাচ্ছে, শিঙ গজাচ্ছে। সাজুও মনে হচ্ছে বড় হয়েছে। আগের মতো কাছে আসলেও জড়িয়ে ধরে আদর করে না। মায়ের প্রতি সেই টান আর আগের মতো নেই। মাঝে মাঝে মায়ের পাশে যাই, মা গায়ে মুখ ঘষে আদর করে ভালোলাগে। এখন সময় কাটে বকনার সাথে। বকনাটা বেশ শান্তশিষ্ট, ওর সাথে মাঠে একসাথে ঘাস খাই।
আমাদের গোয়ালের পাশে বেশ কয়টা গাছ। একটা নিমগাছ সেখানে বাঁধা থাকে লালগাই আর কদমতলায় বাঁধা থাকি আমি আর মা। বেশি দিন এখানে থাকা হবে না এটা বোঝা যাচ্ছে। একটু দূরে একটা গরুর গাড়ি সেখানকার চাড়িতে বাঁধা থাকে বলদগুলো। পাশে একটা কাঁঠাল গাছ। মাঝে মাঝে আমাকেও বলদগুলোর নাদে খেতে দেওয়া হচ্ছে। বড় হয়ে যাওয়া মানে আমার উপর ভারি কাজের ভার পড়বে। দুটো লাঙ্গল জোয়াল গেরস্থ বাড়ির রান্নাঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা। সেগুলোর দিকে চোখ গেলে বুক ধড়াস করে ওঠে। মনে পড়ে লাঙ্গল টানার কথা। মুখের মুখোড় গুলো ঝুলানো আছে বেড়ার সাথে। চারটে বলদকে প্রায়ই অলস জাবর কাটতে দেখা যায়। কারণ তারা সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে মরে। দুটো গাড়ি টানে, দুটো লাঙ্গল বয়। যাহোক আমার মা বুড়ো হয়ে গেছে, তার জন্য খুব দুঃখ লাগে। জানি না কবে তার কী হয়। গোয়ালের পাশ ঘেঁষে একটা পায়ে হাঁটা রাস্তা পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে এঁকে বেঁকে কাঁচাসড়কে পড়েছে। সেই ছোট বেলা থেকে দেখছি কত রকমের ফেরিওয়ালা এই রাস্তা দিয়ে যায় আসে। মাটির হাঁড়ি বেচতে আসে একটা মেয়ে মানুষ। একটা দড়ির জালের মধ্যে মাটির হাঁড়ি অথচ সেগুলো ভাঙে না। মাঝে মাঝে কাঁঠাল তলায় কারো সাহায্য নিয়ে মাটির হাঁড়ি, বাসনগুলো নামিয়ে রাখে। পাড়ার অনেকেই সেগুলো কিনতে আসে। বেচা কেনার ফাঁকে ফাঁকে সেই কুমোর মেয়েটা পাতার বিড়ি খায়। ছেলেদের হুঁকো বিড়ি খেতে দেখলেও এই প্রথম মেয়েদের বিড়ি খেতে দেখা। তাছাড়া কত রকমের ফেরিওয়ালা, মাছওয়ালা, মিষ্টিওয়ালা, কটকটি, কাপড় ওয়ালা, আলতাচুড়ি কত কিছু যে মানুষ বেচতে আসে। দেখে দেখে প্রায় সবারই চেহারা চেনা হয়ে গেছে। একদিন মাছওয়ালাটা উঠে এসে আমার মা ধলির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার পর হাঁক পাড়ে- লোকমান চাচা আছো? ও লোকমান চাচা। কয়েকবার ডাকতেই লোকমান চাচা বেরিয়ে আসে। -কিরে হারান বড় মাছ আছে নাকি? সেই হারান মাছওয়ালা ফিকফিক করে হেসে বলে- চাচা মাছ আজ বেচবুনা মাছ শেষ। আজ একটা জিনিস কিনতে চাই। লোকমান চাচা অবাক হয়- কী কিনবা তুমি? ওই যে তোমার বুড়ো গাইটা। ওইটা আমার দরকার। লোকমান সরকার দীর্ঘশ^াস ফেলে বলে- ওতো ধলি, আমার অনেক দিনের গরু। অরে কিনে কী হবে? আর তুমিই বা এটা কিনবা কেনে? হারান মুখের ওপর হাসি ঝুলিয়ে রেখেই বলে- বুড়া গাই, তুমি বা কদিন ধরে রাখবা? একদিন হঠাৎ করে মরে গেলেই কাম শেষ। আমার কাছে বেচে দাও কাজ হবে। লোকমান চাচা একটু ভেবে বললো- তোমারই বা কী দরকার? আমার কাজ হলো, আমার ভায়ের ছেলের বিয়ে, সেই বিয়েতে বড় খানা দানা হবে। সেই খানায় তোমার গরুটা লাগবে। শুনে লোকমান বিষণœ হলো- ধুর মিয়া এই বুড়ো গরু দিয়ে কী করবা? ফোকলা দাঁতে হেসে হারান বললো- দামটা ওই পঁচিশ হাজারই পাবেন। লোকমান সরকার ফোঁস করে আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে- ভেবে দেখি, তুমি আজ যাও পরে জানাবো।
আমার মনে হলো ফোকলা দাঁত লোকটাকে কাছে পেলে জোরে একটা ঢিশ দিয়ে দিতাম। লোকটার ফোকলা দাঁতে হাসি যেন থামে না। সে হাসি হাসি মুখ করেই ধলি মায়ের বুড়ো জীর্ণ শরীরের দিকে তাকিয়ে চলে গেল। মনটা গেল খারাপ হয়ে। মা বুঝলো পৃথিবীতে তার আর বেশি দিন সময় নেই। তাই আমার কাছে এসে গলার সাথে মুখ ঘষলো। বুঝলাম গরুর জীবন বুঝি মানুষের উপকার করার জন্যই। সারা জীবন দুধ, দুই, মিষ্টি, গরুর দুধ থেকেই। গোবর থেকে জৈব সারের জ্বালানি। আর বুড়ো হলেও ছাড়ান নাই। জবাই করে গোশত হতে হয়। আমি উদাস ভাবে বলদ জোড়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মায়ের দিকে আর তাকাতে পারলাম না। চোখে পানি এসে গেল। তবুতো ধলি মা এত বয়স পেল, ওইযে ষাঁড়গুলো তারা তো দাঁত উঠলেই কোরবানির যোগ্য হয়ে যাবে। তার মানে দুধের দাঁত খসে বড় দাঁত বের হলেই সে খাবার যোগ্য হয়ে যায়। মানে বয়স দুই তিন বছর হলেই দাঁত উঠে। দাঁত নিয়ে যখন কথা উঠলো, তখন বলি- গরুদের কিন্তু এক পাটি দাঁত। উপর পাটিতে দাঁত থাকে না, শুধু মাড়ি থাকে। আর নিচের পাটিতে দাঁত। নেই দাঁত আর মাড়ি দিয়ে গরুরা জাবর কাটে।
(চলবে)