ঠকঠক্!
দরজায় শব্দ শোনে মিনহাজ উেিকঠন শরীফের কাগজে কলম থেমে গেল মুহূর্তের জন্য। তিনি একটি গল্প লিখছিলেন। মিনহাজ উেিকঠন শরীফ একজন মহান লেখক। তিনি শিশোদের জন্য শত শত গল্প লিখেছেন। শিশো, ভূদৃশ্য, পরিবেশ, পাখি, প্রাণী, সাম্প্রতিক ঘটনা এবং সামাজিক সমস্যাসহ তার গল্পগুলো খুব জনপ্রিয়। তাই তিনি যা লিখেছেন তা সকলের পছন্দ হয়েছে। দরজায় ঠকঠক শব্দ তাকে কলম ছেড়ে উঠে যেতে বাধ্য করলো। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কে ভাই, দরজা ভেঙে ফেলবে নাকি?
তারপর তিনি এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বৃদ্ধ একজন। পরনে ডাকপিয়নের পোশাক। এই ইন্টারনেটের যুগে এরকম পোশাক এখনও কেউ পরে? তা ছাড়া পোস্ট অফিসগুলো এই জমানাতেও সচল কিনা সে খবরও তিনি জানেন না। ডাকপিয়ন তাকে দেখে বললো, মিনহাজ সাহেব! তুমি কি ঘুমাচ্ছিলে?
মিনহাজ উেিকঠন শরীফ বললেন, আমি গল্প লিখছি, ঘুমাচ্ছিলাম না। কিন্তু আপনি সেই সময় এসে আমার লেখার মজাটা ছুটিয়ে দিলেন।
মিনহাজ সাহেবের কথা শোনে বৃদ্ধ হেসে বললেন, মিনহাজ সাহেব! আপনিও একজন ভালো মানুষ। আপনি যখন গল্প লিখতে বসেন, তখন মনে হয় আপনি তার মধ্যে হারিয়ে যান এবং সবকিছু ভুলে যান। আমি ধাক্কা মারছিলাম এতক্ষণ দরজা। আমার হাত এখন ব্যথা করছে।
মিনহাজ সাহেব অবাক হয়ে বললেন, কিন্তু আমি তৎক্ষণাৎ উঠে দরজা খুললাম, আর আপনি বলছেন যে আমি দরজা খুলতে দেরি করেছি।
বুড়ো ডাকপিয়ন বললো, আচ্ছা তোমার এই চিঠিটা নাও। আমাকেও অন্য জায়গায় যেতে হবে। আল্লাহ হাফিজ।
আচ্ছা এখনও কি পোস্ট অফিসগুলো খোলা থাকে? এখন তো ইন্টারনেটের যুগ। সবাই এখন মেইল পাঠায়।
বুড়ো ডাকপিয়ন কোনো জবাব না দিয়ে মিনহাজ সাহেবের হাতে একটা খাকি খাম দিয়ে চলে গেলো। মিনহাজ সাহেব দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে চলে আসেন। তিনি তার চেয়ারে বসে খামটি উল্টিয়ে দিলেন, তারপর খাম থেকে একটি চিঠি বের করে পড়লেন, খুব নোংরা বিচ্ছিরি, এবং মোটা হাতের লেখা-
মিনহাজ সাহেব!
আশা করি ভালো ছিলেন, তবে এখন হয়তো ভালো নেই। আপনি আপনার ছেলে মিলহানের কান ধরে বনের উত্তরাঞ্চলে যান। দুঃখের বিষয় যে আপনি আপনার লেখা দিয়ে সমাজ সংস্কার করছেন, কিন্তু তার চেয়েও দুঃখের বিষয় যে আপনি আপনার ছেলে মিলহানকে সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ দিতে পারেননি। আমার চিঠি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বনের উত্তরাঞ্চলে চলে যান।
চিঠি পড়ে মিনহাজ সাহেব বিরক্তি নিয়ে বিড়বিড় করে বললেন, ‘এটা কী ধরনের চিঠি? কেউ আমাকে নিয়ে মজা করেছে মনে হয়।’ তারপর তার মুছলেমের কথা মনে পড়লো। তার ছোটবেলার বন্ধু। গাছপাগল বন্ধু। গাছ খুব ভালোবাসে। কেউ গাছের পাতা ছিঁড়ছে দেখলে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। সে মাঝে মাঝে এরকম উল্টো-পাল্টা চিঠি লিখতো। তিনি এই চিঠিটিকে মুছলেমের চিঠি মনে করে একপাশে রেখে গল্প লিখতে শোরু করেন।
পরদিন রাতে মিনহাজ সাহেব তার ঘরে বসে গল্প লিখছেন, এমন সময় হঠাৎ বিকট শব্দে দরজা খুলে বেশ কিছু গাছ তার ঘরে ঢুকে গেলো। এসব জীবন্ত গাছ দেখে মিনহাজ সাহেবের নিঃশ্বাস উঠে গেলো।
একটা গাছ গজগজ করে বললো, তোমার নাম মিনহাজ উেিকঠন শরীফ?
মিনহাজ সাহেব অনেক কষ্টে ঢোক গিললেন। এবং বললেন, হ্যাঁ, আমি মিনহাজ উেিকঠন শরীফ। কিন্তু আপনি কে? আপনি কি চান?
মিনহাজ সাহেব বিস্ময় আর ভয়ে গাছগুলোর দিকে তাকালেন। গাছগুলোর হাত, পা, চোখ, নাক, কান, মুখ সব কিছু আছে। তারা মানুষের মতো কথা বলছে। গাছগুলো মিনহাজ সাহেবের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাকে দু’পাশ থেকে টেনে টেনে গ্রামের পাশের জঙ্গলে নিয়ে যায় এবং একটি পুরনো বটগাছের সামনে মাটিতে ফেলে দেয়।
বুড়ো বটগাছ ঘুমিয়ে ছিলো। শরীফ সাহেবের পড়ে যাওয়ার শব্দ শোনে চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে বললো, হ্যাঁ, তুমি মিনহাজ উেিকঠন শরীফ! এদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক।
মিনহাজ সাহেব থমকে দাঁড়ালেন, ব্যঙ্গ করা ভঙিতে হাসলেন। বললেন, কিন্তু… তুমি… তুমি কে?
গাছটি দুঃখের সঙ্গে মাথা নাড়লো। তারপর বললো, কাল তুমি কি আমার চিঠি পাওনি? আমাকে চিনতে পারোনি?
মিনহাজ সাহেবের ভয় ঢুকে গেলো। তিনি অনবরত থরথর করে তোতলাতে তোতলাতে বললেন, তুমি… তুমি… তুমি কি মুছলেম?
মুছলেম চোখ ঘুরিয়ে বললো, হ্যাঁ।
এর কিছুক্ষণ পর দুইটি সৈন্যগাছ মিনহাজ সাহেবের ছেলে মিলহানকে নিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গে মিলহানকে মুছলেমের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। সে চিৎকার করে উঠে বাবা মিনহাজ সাহেবের কাছে দৌড়ে যায়। সে ভয়ানক কাঁপছে।
বাবা! এই হাঁটা গাছগুলো কত ভয়ংকর, এদের থেকে আমাকে বাঁচাও।
মুছলেম হেসে বললেন, এখন তোমার বাবাও তোমাকে বাঁচাতে পারবে না।
মিলহান কাঁদতে কাঁদতে বললো, আমার আর বাবার কি দোষ?
মিলহান বাবার হাতটা শক্ত করে ধরলো। যে সৈন্যরা তাকে গাছে ধরেছে তাদের সে সবচেয়ে বেশি ভয় পাচ্ছে।
মুছলেম আবার উচ্চস্বরে হেসে বললেন, এটা তোমার দোষ যে তুমি ছুরি দিয়ে গাছে তোমার নাম খুঁড়ে, তাদের আহত করো আর তাদের ডাল ভেঙেছো। অনেক গাছ আমার কাছে তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। কিন্তু আমি কাজ চালিয়ে গেলাম, ক্ষমা। কিন্তু কাল যখন তুমি আমার গালে তোমার নাম খুঁড়েছিলে, আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভাগ্যক্রমে তুমি আমার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছো। আমি সেই মুহূর্তে ভেবেছিলাম যে আমি তোমাকে শাস্তি ছাড়াই ছাড়বো না। তোমার বাবার জন্যও দোষ। তার দোষ এজন্য যে, তিনি কখনও তোমাকে গাছের প্রাণ সম্পর্কে বোঝায়নি। যদি সে তোমাকে বোঝাতো যে, গাছ খোদাই করা উচিত নয় এবং তাদের ডাল কাটা উচিত নয়। গাছও বেঁচে থাকে, তারাও কষ্ট পায়।
মুছলেম চুপ হয়ে গেলেন। তার পাশের গাছটি বললো, আমরা তোমাকে শীতল ছায়া এবং তাজা বাতাস দিই। আমরা তোমাকে ভেষজ এবং ফল দেই। তুমি আমাদের কাঠ থেকে আসবাব তৈরি করো। আমাদের থেকে তোমার অনেক সুবিধা পাও, কিন্তু তুমি… এই বলে গাছগুলো তাকে আঘাত করলো এবং প্রচ-ভাবে কাঁপতে লাগলো। আশপাশের সমস্ত গাছ ক্রোধে চিৎকার করে, এই দুই মানবের শাস্তির দাবি করতে লাগলো।
মুছলেমের নির্দেশে মিনহাজ সাহেব ও মিলহানের ওপর সব গাছ পড়ে যায়। দু’জনেরই ভয়ার্ত চিৎকারে সেখানে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। গাছগুলো তাদের ঘিরে ধরে আঁচড়াতে থাকে। তাদের পালানোর উপায় নেই। চারিদিক থেকে রাগান্বিত গাছগুলো তাদের ওপর পড়ছে।
হঠাৎ মিনহাজ সাহেবের মনে হলো তার চেয়ারের পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। তিনি দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন তার ছেলে মিলহান। বাবার লেখা একটা নতুন গল্প মনোযোগ দিয়ে পড়ছে সে। মিলহান বিব্রত হয়ে বললো, আমি দুঃখিত, বাবা! আমি তোমাকে লেখার সময়ে বিরক্ত করেছি। তবে, গল্পটি খুব মজার। এরপর কী হবে?
মিনহাজ সাহেব মুচকি হেসে বললেন, এটা হবে যে, ছেলেটির বাবার চোখ খুলে যাবে। আসলে তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন। তখন তিনি বুঝতে পারেন যে, তার ছেলের চেয়ে তিনি বেশি অপরাধী। তিনি সমাজের খারাপ দিকগুলো তুলে ধরেন, কিন্তু তিনি কখনোই তার সন্তানদের সংস্কারের চেষ্টা করেননি। সবাই যদি ঘর থেকে শোরু করে তবেই মন্দ কাজগুলো নির্মূল করা যায়।
মিলহান বললো, শেষটাও ভালো, কিন্তু তুমি তোমার গল্পে আমাকে খারাপ ছেলে বানিয়েছো।
মিনহাজ সাহেব উত্তর দিলেন, যাতে তুমিও শিক্ষা নিতে পারো।
মিলহান অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকালো, কিন্তু বাবা আবার গল্প লিখতে ব্যস্ত।

Share.

মন্তব্য করুন