দুরন্তপনায় কেটেছে আমার শৈশব কৈশোর। স্বর্ণালি সেইসব দিনগুলো আজও জীবন্ত। সেই স্বপ্নগুলো আজও বেঁচে আছে তেমনই। পাখিদের কলকাকলিতে ভোরের স্নিগ্ধতায় মুগ্ধ মন কেবলই স্বপ্ন পূরণের অপেক্ষায় প্রহর গুনতো। দিন যায়, মাস যায়, বছরও পেরিয়ে যায় আপন গতিতে। পুরনোর সাথে যোগ হয় নতুন স্বপ্ন। এসব স্বপ্ন, আশা-আকাক্সক্ষায় জীবন আরো নতুন হয়ে ওঠে। ভাবনা-কল্পনা যেনো ময়ূরের মতো পেখম মেলে নিজেকে প্রকাশ করতে ব্যাকুল। প্রস্তুত হয় বেঁচে থাকার আনন্দ। সে আনন্দ ঠেলে দেয় আরও স্বপ্নের দিকে। স্বপ্ন পূরণের দৌড়ে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।

টঙ্গী সরকারি কলেজে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী আমি। সামনেই পরীক্ষা। বাবার ভীষণ ইচ্ছে আমি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়ি। বাবার ইচ্ছেতে ভর্তি হয়েছি ঠিকই, কিন্তু মন পড়ে থাকতো প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতিদিনই কলেজে যাবার পথে ক্ষণিকা বাসটি চোখে পড়তো। গাজীপুর থেকে যে বাসটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতো তারই নাম ছিল ক্ষণিকা। উদাস মনে ভাবতাম, কেমন হতো যদি আমিও হতাম ওই বাসের একজন নিয়মিত যাত্রী। স্বপ্নগুলো নতুন ভাবনায় জেগে উঠতো। এভাবেই সময় গড়াচ্ছিল। পরীক্ষার জন্য রাতদিন পড়াশোনায় ব্যস্ত। এর ভেতর মনের কোণে ভেসে উঠতো ঢাবির ক্যাম্পাস। কেবলই মনে হতো আরেকবার চেষ্টা করি। সিদ্ধান্ত নিলাম পরীক্ষা দেয়ার। যদি চান্স পাই ভর্তি হয়ে যাবো।

সময় বয়ে যেতে থাকে। আমিও অপেক্ষায় থাকি। অপেক্ষারও আনন্দ আছে। আছে স্বপ্ন পূরণের সুযোগ। পরীক্ষা দিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। টিকেও গেলাম। ভর্তি হয়ে গেলাম আনন্দের সাথে। এখানে নতুন সবকিছু। তবুও শুধু মনে হতো স্বপ্ন দেখা চাই। ভাবি জীবনের মিনারটি কেমন হবে! কেমন হবে তার উচ্চতা। টঙ্গী কলেজের পথে প্রতিদিন যা ভেবেছিলাম- আজ সেই ক্ষণিকা বাসের একজন নিয়মিত যাত্রী আমি। মন দারুণ উল্লসিত। প্রতিদিনই নতুন মনে হতো জীবনকে। নতুন যাত্রা। নতুন যাত্রার আনন্দই মানুষকে সাফল্যের দিকে নিয়ে যায়। এরই মধ্যে সুযোগ এলো ইরান যাবার। ইরানে এক মাসের একটি রিফ্রেসার্স কোর্স। মনের আকাশজুড়ে তখন তারার মেলা। কী করবো। কিভাবে করবো। কেমন হবে সব। সত্যিই কি যাওয়া হবে সুদূর ইরান। এর আগে দেশের বাইরে যাইনি কোথাও। বিমানে ওঠার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কেমন যেনো এক অদ্ভুত অনুভূতি। বাসা থেকেও অনুমতি মিলবে কিনা জানা নেই। তবুও দু’চোখ ভরা স্বপ্ন। আকাশে উড়ে বেড়ানো সেই বিমানে উঠবো। দেখবো আকাশ কতটা বিশাল! কেমন তার বলয়। অদ্ভুত এক অনুভব। শত প্রশ্ন ভিড় করে মনে! বিমানের চালক কতজন? কেমন করে চালায়! আকাশের দিকে উড়ে যাওয়ার সেই মুহূর্ত কেমন! কেমন করে নীল আকাশ গাঢ় নীল হয়ে ওঠে। নিজ চোখে দেখবো কি এসব! কেমন হবে তখন! স্বপ্ন ও আশাই মানুষকে গতিশীল রাখে। পথ দেখায় ভবিষ্যতের। আমিও স্বপ্ন দেখি। আশা রাখি বুকের ভেতর।

মনস্থির করলাম বরফের দেশ স্বপ্নের দেশ ইরান যাবো। বিষয়টি জানালাম বাবা মাকে। শুরুতে বাবা-মা রাজি হলেন না। কিন্তু আমার উৎসাহ-আনন্দ দেখে রাজি হয়ে গেলেন। এতে আমি ভীষণ আনন্দিত। শুরু হলো প্রস্তুতি পর্ব। এর প্রথম প্রস্তুতি হচ্ছে পাসপোর্ট। পাসপোর্টের জন্য কাগজপত্র জমা দিয়ে এলাম। আনুষঙ্গিক কাজের প্রস্তুতিও চলতে থাকলো। সবকিছু কেমন দ্রুত গতিতে এগুচ্ছে। ইরানে তখন প্রচণ্ড শীত। বরফ পড়ছে। শুনেই কেমন জানি মনের মধ্যে এক ধরনের শীতলতা অনুভব করি। বরফ আমার এক ধরনের আকর্ষণীয় বিষয়। ইরান যাবো। বরফ দেখবো। এ খুশি ফুলে ফেঁপে উঠছিলো আমার ভেতর।

কিন্তু আমার যেতে হবে একা। সঙ্গে নেই কোনো পরিচিতজন। কেমন হবে সফর! আদৌ কি যাওয়া হবে। ভালোলাগার সাথে কেমন ভয়ও জেগে উঠছিলো। দেখতে দেখতে সময় ঘনিয়ে এলো। পাসপোর্টও হাতে। ভিসার কাজও শেষ। এখন শুধু উড়াল তোলার অপেক্ষা। নির্দিষ্ট দিনে এয়ারপোর্ট এলাম। সাথে আমার পুরো পরিবার। ছিলেন আমার নানুও। বন্ধু বান্ধবও ছিলেন অনেকেই। ডিপার্টমেন্ট থেকে এলেন শিক্ষকগণও।
এর মধ্যে দেখি মায়ের চোখের পাতা ভারী। চোখ দুটো ভিজে উঠলো অশ্রুতে। সবার মন খারাপ। আমার ইরান থাকতে হবে এক মাস। একটি মাস হঠাৎই বেশ দীর্ঘ মনে হতে লাগলো। ভাবছিলাম- কেমন করে সবাই জানবে আমি কেমন আছি! আমিই বা বাংলাদেশের খবর জানবো কেমন করে। এসবই শুধু ঘুরপাক খাচ্ছিল মনের ভেতর। মনে যাই জাগুক তবুও যেতে হবে আমাকে। বিমান ওড়ার সময় ঘনিয়ে এলো। কেনো যেনো বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছিল। কেনো জানা নেই। সব কিছুর হয়তো ব্যাখ্যা হয় না। ব্যথা চেপে রেখে বিদায় নিলাম সবার কাছ থেকে। পাসপোর্ট দেখিয়ে প্রবেশ করলাম জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। বর্তমানে এর নাম শাহজালাল আন্তর্জাাতিক বিমানবন্দর। খুঁজে নিলাম দুবাই হয়ে ইরানের প্লেনের লাইন। এখানেও পাসপোর্ট দেখলেন কর্তব্যরত অফিসার। দেখে বোর্ডিং পাস দিয়ে দিলেন। বললেন প্লেনে ওঠার সময় এটি দেখাতে হবে। এটিই সিট নম্বর।

কাচ ঘেরা এয়ারপোর্টের বাইরে আমার পুরো পরিবার। তার অপেক্ষায় আছে কখন উড়বে আমাকে বহনকারী বিমান। আকাশে বিমানটির উড়াল দেখেই তারা ফিরবে। তখনও মোবাইলের ব্যবহার সুলভ হয়নি। ফলে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। মন খারাপ নিয়েই সবাইকে দেখছিলাম। হঠাৎ একজন ইরানি মহিলা বাংলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি ইরান যাবো কি না। আমি ভীষণ অবাক। সাথে একটি বাচ্চা মেয়েও আছে। ছয় কি সাত বছর হবে মেয়েটির। মহিলাটি পরিচয় দিলো- তিনি একজন ইরানি। বাংলাদেশী একজন ডাক্তার ছেলেকে বিয়ে করে বর্তমানে চট্টগ্রাম থাকেন। এখন মেয়েকে নিয়ে নিজ দেশে বেড়াতে যাচ্ছেন। কিন্তু তার লাগেজের ওজন নিয়মের চেয়ে বেশি। ফলে এটি তার জন্য একটি সমস্যা। এ সমস্যার সমাধানকল্পে কর্তব্যরত অফিসার আমার কাছে সাহায্যের জন্য পাঠিয়েছেন মহিলাটিকে। ইরানি মহিলাটি আমাকে অনুরোধ করলো- আমি যেনো আমার বোর্ডিং পাসে তার ব্যাগের কিছু ওজন নেই। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কী বলবো আমি! কী বলতে পারি! আমার তো বিমান ভ্রমণের এটি প্রথম অভিজ্ঞতা। কিছুই জানা নেই তেমন। কিসে কী হয় কি করে বুঝবো! যদি কোনো সমস্যায় পড়ি কে সাহায্য করবে আমাকে! একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখোমুখি আমি। দ্বিধাদ্বন্দ্বে জড়িয়ে রাজি হতে চাইলাম না। কিন্তু মহিলাটি নাছোড়বান্দা। ছোট্ট মেয়েটিও অনুরোধ করতে লাগলো। কর্তব্যরত অফিসার বিষয়টি সমাধানের উদ্যোগ নিলেন। তিনি আমার পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে মহিলাটিকে আলাদাভাবে তার ব্যাগের ট্যাগ লাগিয়ে দিলেন। যাতে আমি ঝামেলায় না পড়ি। মহিলারও সমস্যার সমাধান হয়।

প্লেনে ওঠার অপেক্ষায় আমরা। এর মধ্যে শুরু হলো ইরানি মহিলা ও তার মেয়েটির সঙ্গে কথাবার্তা।
আলাপ পরিচয়ে জানলাম মহিলার নাম ইরিনা। ছোট্ট মেয়েটির নাম তাবিয়া। মেয়েটি ছিল বেশ চটপটে। খুব সহজেই মেয়েটির সাথে সখ্যতা তৈরি হয়ে গেলো। আমার বিষয়ে তার ছোট্ট মনে নানারকমের জিজ্ঞাসা। কেনো আমি ইরান যাচ্ছি। সেখানে কার কাছে থাকবো। কত দিন থাকবো। আমি কি তাদের বাসায় যেতে পারবো? এমন অনেক প্রশ্ন। তার প্রশ্নের জবাব দিতে হলো আমাকে। আমিও জানতে চাই; সে কোন ক্লাসে পড়ে। তার প্রিয় খেলা কি। বাংলাদেশ তার কেমন লাগে। এমন অনেক কথা চলতে থাকে। মহিলাটিও আমার সম্পর্কে বেশ আগ্রহী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশী একটি মেয়ে একা একা একটি কোর্সে অংশগ্রহণ করতে ইরান যাচ্ছে। এটা ছিল তার কাছে বিস্ময়ের! এতো গল্প আড্ডার মধ্যেও আমার মন কেবলই আপনজনের শূন্যতা বোধ করছিলো। আমার দেশ আমার আপনজন থেকে একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছি আমি। ভাবছি আবার কবে ফিরে আসবো প্রিয় দেশে। কেমন করে গল্প হবে বাবার সাথে। মায়ের সাথে। ভাইয়ের সাথে হবে মিষ্টি ঝগড়া। বন্ধবীর মতো আমার খালা বিলকিসের কি মনে পড়বে আমাকে। ভাবনায় ছেদ পড়ল হঠাৎ। ঘোষণা এলো প্লেনে ওঠার। আবারও ফরমালিটি। সব কিছু সেরে এগিয়ে যাচ্ছি বিমানের দিকে। যে বিমানটি আমাদেরই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। এতো কাছ থেকে বিমান কখনও দেখিনি। হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক বেড়ে গেছে যেনো। ভাবছি অবশেষে আমি বিমানে চড়বো। এতোদিন যেই আকাশ ছিল আমার কল্পনায়। সেই আকাশের কাছে পৌঁছাবো। মেঘেদের রাজ্যে ঘুরবো। অনেক উপর থেকে মাটির দৃশ্য কেমন দেখাবে! কত কী বেজে চলেছে মনের ঘণ্টায়।

সামনে দেখছি বিমানের বড় বড় চোখ। বিশাল বড় পাখা। বিমানের পিছনের দরজা দিয়ে মালামাল উঠানো হচ্ছে। আমার মনে তখন প্রশ্নের ঝড় বইছে। বিমানে কী কী আছে? কী খেতে দেবে বিমানে। আম্মাকে কোথাও যেতে সঙ্গে খাবার রাখতেন। যদি পথে ক্ষুধা লেগে যায় এই ভেবে। কিন্তু বিমানে কোনো খাবার নেয়া যায় না। তাই কোনো খাবার নিয়ে আসিনি। ভাবলাম- একটু পর জেনেই তো যাবো। এই ভেবে স্থির হয়ে গেলাম। বিমান সম্পর্কে কতরকম গল্পই না শুনেছি। আজ তা প্রত্যক্ষ করার দিন। এসবই মনের কোণে বেজে চলছিল। প্রিয় মুখগুলো মনে পড়তে লাগলো। বাবার জন্য ভীষণ কান্না পাচ্ছিলো। কেমন করে এতোদিন বাবা ছাড়া থাকবো। এসব ভেবে কখন যে দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে টেরই পাইনি। ছোট্ট মেয়েটির কোমল স্পর্শে যেন হুঁশ ফিরে পেলাম। স্বাভাবিক হতে চাইলাম। মনকে বোঝালাম যেতেই যেহেতু হচ্ছে ভেবে আর কী লাভ। মনকে বরং শক্ত করি। এইতো অ্যাডভেঞ্চার।
বিমানের পেটে ঢুকে আমার চোখত ছানাবড়া। বাইরে থেকে বোঝাই যাচ্ছিলো না বিমানে এতোটা জায়গা। কী সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো। এয়ার হোস্টেজরাও ভীষণ সুন্দর। সবাই একই রকম পোশাকে আবৃত। মাথায় সুন্দর টুপি। ভিআইপি লাউঞ্জ। সাধারণ সিট। এভাবেই সাজানো বিমানের ভেতরটা। আমার সিট ভিআইপি লাউঞ্জে। ইরিনা ও তার মেয়েটিও আমার সাথে। ছোট্ট মেয়েটির বিমান ভ্রমণ নতুন কিছু নয়। তাই সে বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছে কেমন করে আকাশে উঠবে বিমান। ইরান দেশটি কেমন। আমাকেও তাদের বাসায় নিয়ে যাবে। আসলেই সৃষ্টিকর্তা কতটা ভালোবেসে আমাদের সৃষ্টি করেছেন। একজন অচেনা অজানা মানুষের সাথেও সখ্যতা তৈরি হতে সময় লাগে না। কতটা প্রাণের মনে হয়। অল্প সময়ে ছোট্ট মেয়েটির মায়ায়ও জড়িয়ে গেলাম। গল্প চলতেই থাকে। এয়ার হোস্টেজরা একে একে সবাইকে সিট বেল্ট বেঁধে দেয়। আলট্রা সাউন্ডে ঘোষণা হতে থাকে কী কী করণীয়। একটি নির্দেশনা সংক্রান্ত বইও আছে। প্রতিটি সিটের পেছনে আছে টিভি। সহজেই তাতে দেখতে পাওয়া যায় কতটুকু উচ্চতায় উড়ছে বিমান। কোন কোন এলাকা-দেশ পার হচ্ছে। কেউ চাইলে মুভি বা গানও শুনতে পারে। সেই বিষয়গুলো একজন এয়ার হোস্টেজ একবার বাংলায় একবার ইংরেজিতে বললো। প্রতিটা সিটের ওপরে আছে জীবন লাইফ জ্যাকেট। কোনোরকম বিপদসঙ্কেত পাওয়ার সাথে সাথে তা ওপেন করতে হবে। এবং বিমানের একটি অংশকে দেখিয়ে বলে দেয় কেমন করে ঝাঁপ দিতে হবে। শুনেই কেমন থ্রিল অনুভূত হচ্ছিল। মনে পড়ছিলো মাসুদ রানার বই, তিন গোয়েন্দা বা সাইমুম সিরিজের অ্যাডভেঞ্চার। সব নির্দেশনা শেষে বললো কোনো কিছু প্রয়োজন হলে যেন তাদের জানাই। প্লেনের ভ্রমণ এতোটা সুন্দর! এতোটা গোছানো! ভীষণ ভালো লাগতে শুরু করলো।

হঠৎ প্লেনের চাকা ঘুরতে শুরু করলো। হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ির মতো চলতে থাকলো বিমানটি। এভাবেই যেতে যেতে ক্রমেই এর গতি বাড়তে থাকলো। জানালা দিয়ে দেখলাম- এয়ারপোর্টের নির্দিষ্ট কিছু গাড়ি আর ছোট ছোট বিমান ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না। বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষায় থাকা প্রিয়জনদের খুঁজছিল চোখ। যদি কাউকে দেখা যায়! ঘোষণা হলো এখন আকাশের দিকে উড়বে বিমান। সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বলা হলো। টানটান উত্তেজনা আমার ভেতর। সে সময় শরীর কেনো যেনো শক্ত হয়ে উঠেছিলো। গতিবেগ বাড়তে বাড়তে সাঁই করে সামনের দিকে যেতে যেতে ক্রমশই উঠে যাচ্ছে শূন্যে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে চাকাগুলো কেমন করে বিমানের পেটের মধ্যে ঢুকে পড়ছে। দ্রুত উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে বিমানটি। দেশের মাটির টান অনুভব হচ্ছিলো খুব। একদম উপরে উঠার সেই মুহূর্তে মাথায় কেমন একটি চাপ অনুভব হলো। কেমন জানি লেগে উঠলো। তবুও চেয়ে থাকি। যতদূর দেখা যায় দেখি বড়ি-ঘর সব ছোট থেকে আরও ছোট হয়ে উঠছে। নির্দিষ্ট সীমা উপরে ওঠে বিমান বেশ স্থির হয়ে গেলো।
ট্রেনে চড়েছি, বাসে চড়েছি কিন্তু এমন অনুভূতি পাইনি কখনও। কোনো শব্দ নেই। শুধু নির্নিমেষ তাকিয়ে দেখি শূন্যের মধ্যে কেমন করে বসে আছি আমি।
তাবিয়ার গল্প আর নুতন পরিবেশ ধীরে ধীরে অন্যরকম এক ভালো লাগা তৈরি করতে শুরু করলো। সিট বেল্ট খুলে আরাম করে বসে জানালা দিয়ে আকাশ দেখি। কত ফিট উপরে ছিলাম আজ আর মনে নেই। কিন্তু অবাক হয়ে দেখছিলাম নিচের দিকে তাকালেও কেবল ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘের কুণ্ডলীই দেখা যাচ্ছিল। কখনো আবার প্রখর সূর্যের তাপ। তাকানো যায় না এমন আলোর ঝলকানিতে। আমি মুগ্ধ। অপার আনন্দে বিস্ময়ে অভিভূত আমার মন। যেনো মন বলছিলো এই তো স্বপ্ন এবার সত্যি হলো। ভাবনার মধ্যেই এয়ার হোস্টেজ খাবারের ট্রলি নিয়ে হাজির। ম্যানুতে আছে মাটন আর চিকেন। যা পছন্দ তাই নেয়ার সুযোগ আছে। আমি চিকেন নিলাম। ইরিনা বলছিল, তুমি খেতে চাইলে আবার নিতে পারবে। খাবারের ট্রেটা খুবই সুন্দর করে সাজানো। সাথে ড্রিংক, পানি। মন চাইলে চা বা কফিও খাওয়া যাবে। বিমান ভ্রমণ সত্যিই আকর্ষণীয়।

দুবাই ল্যান্ড করবে বিমান। সময় কেমন করে চলে গেলো যেনো টেরই পাওয়া যায়নি। আবার ঘোষণা হলো বেল্ট বাঁধার। এবার সবাই নিজেদের বেল্ট বেঁধে নিলো। ঘোষণা চলাকালীন হঠাৎ মনে হলো বিমান একটু কেঁপে উঠলো। যাত্রীরা জোরে জোরে দোয়া পড়তে লাগলো। কেউ কেউ চিৎকার করে উঠলো। আমার কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সবার ভয়-বিহ্বল চেহারার মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছিলো। ইরিনা আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো। বললো একটি সমুদ্রের উপর দিয়ে বিমান যাচ্ছে। এ তেমন কিছু না। ওদিকে বারবার ঘোষণায় শান্ত থাকতে বলা হচ্ছিলো। মাত্র কয়েক মিনিটই এমন করে কাঁপছিল বিমান। জীবন হারানোর ভয় কতটা তীব্র তা মুহূর্তেই উপলব্ধি করছিলাম। মাসুদ রানা ও তিন গোয়েন্দাতে এমন অনেক গল্প পড়েছি। আমারই জীবনে এমনটা হবে কখনো কি ভাবিনি!
দুবাই বিমানবন্দর পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ততম বিমানবন্দরের একটি। অত্যাধুনিকভাবে সাজানো এই বিমানবন্দর ভৌগোলিক দিক থেকে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশের প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিত। তাই দূরবর্তী ফ্লাইটগুলো ট্রানজিট হিসেবে দুবাই বিমানবন্দরকে বেছে নেয়। আমাদের ট্রানজিট ছিল প্রায় চার ঘণ্টার। ইরিনা বললো- চলো বিমানবন্দরের ভেতরটা ঘুরে দেখি। আমিও রাজি। আমরা বের হলাম বিমানবন্দরের ভেতর মার্কেট দেখার জন্য। কতরকম আলোকসজ্জায় সাজানো সব জিনিসপত্র। কী নেই সেখানে। মাঝে মাঝে খাবারের দোকান। রকমারি চকোলেট। পোশাক থেকে আরম্ভ করে থরে থরে সাজানো নানা রকমের জিনিস। খুবই মনোমুগ্ধকর। আমার কিছুই কেনার ছিল না। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া। সময় হয়ে আসছে আবার বিমানে ওঠার। কতদূর এসেছি কেউ খেয়াল করিনি। যখন খেয়াল করলাম দেখলাম অনেক দূর চলে এসেছি। ইরিনাও বেশ অস্থির হয়ে উঠলো। আমাকে দ্রুত হাঁটার জন্য তাগিদ দিচ্ছিলো। চেকিং কাউন্টারে জিজ্ঞেস করেও কোনো সাহায্য পাওয়া যায়নি। এতোটাই ব্যস্ত সবাই কারো ভ্রƒক্ষেপই নেই কারো প্রতি। ঘড়িতে সময় দেখছি আর দৌড়াচ্ছি। এভাবে চলতে চলতে এক ইরানি মহিলাকে দেখলাম দ্রুত গতিতে যাচ্ছে। আমরা আর কোনো উপায় না পেয়ে সেই ইরানি মহিলার পিছু নেই। মহিলাটি এতোই দ্রুত হাঁটছিলো তার পর্যন্ত পৌঁছতে পারছিলাম না আমরা। কিন্তু তাকে অনুসরণ করে নির্দিষ্ট জায়গায় ঠিকমতো পৌঁছে গেলাম। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে মনে হলো এও দেখতে হলো। যদি আমাকে না নিয়ে বিমান চলে যেতো! কী হতো আমার। কতো রকম বিপদ হতে পারতো। সারা শরীর কেমন অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো। এটাও শিক্ষা পেলাম না বুঝে না জেনে অপরিচিত জায়গায় এভাবে যাওয়া উচিত নয়

বিমানে ওঠার জন্য সবাই লাইনে দাঁড়ালো। পুনরায় চেকিং। দুবাই থেকেও অনেকে ইরান যাচ্ছে। নতুন নতুন অনেক মুখ দেখতে পেলাম। ইরানি ব্যতীত অনেক বিদেশীও আছে। যথাসময়ে বিমানে উঠলাম। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ইরান পৌঁছে যাবো। ইরিনা ও তাবিয়া বারবার বলছিল আমাকে তাদের বাসায় নিয়ে যাবে। তাদের ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু আমার যাওয়া তো একটি কোর্সে, কেমন করে অন্য কোথাও যাবো। তাবিয়া বেশ মন খারাপ করছিলো। আমারও কষ্ট হচ্ছিলো। জীবনের প্রথম বিমান অভিজ্ঞতায় তাদের সঙ্গ আমাকে আপ্লুত করেছে। এরই মধ্যে খাবার এলো। এখানে খাবারে কোনো চয়েস ছিলো না। আরম্ভ হলো বাংলাদেশের বাইরে ভিন্ন সংস্কৃতির সাথে পরিচয়ের। খেতে খারাপ লাগেনি আমার। এয়ার হোস্টেজ ঘোষণা দিলো যারা বিদেশী মহিলা আছেন তারা যেন তাদের মাথায় হিজাব পরে নেন। সময় হয়ে গেছে ল্যান্ড করবার। আমি জানতাম ইরান মুসলিম দেশ। সেখানে পর্দা করতে হয়। কিন্তু এটা জানা ছিলো না যে বিদেশীদেরও পর্দা করতে হবে। আমার কৌতূহল দেখে ইরিনা বলল, অমুসলিমদের জন্যও ইরানের আইন একই। সবাই খুব দ্রুততার সাথে হিজাব, বোরকা পরে নিলো। অবাক করা এক দৃশ্য ছিলো সেটি। এখন অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। আধুনিকতা স্পর্শ করেছে। কিন্তু সেই সময়ের চিত্র এমনই ছিলো। নেমে যেতে হবে বিমান থেকে। একটি দীর্ঘ সফরের সমাপ্তি হতে যাচ্ছে। আমার জন্য তেহরানের বিমানবন্দরে রিসিভ করতে কেউ উপস্থিত থাকবে। তবুও কেমন টানটান উত্তেজনা ফিল হচ্ছিলো। নির্ধারিত সময় এসেই গেলো। বিমান ল্যান্ড করবার সময়ও এক ধরনের ঝাঁকুনি লাগলো। কেমন মাথা ধরা ধরা ফিল। যখন চাকাগুলো মাটি স্পর্শ করলো তখন অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গেলো সারা শরীরে। অবশেষে আমি ইরান এসেছি। বিমান থেকে নামার আগ মুহূর্তে এয়ার হোস্টেজ, পাইলট ধন্যবাদ জানালো সবাইকে। সব কিছুই ভীষণ পরিমার্জিত। সুন্দরতায় মেশানো। আনন্দিত মনে জীবনে প্রথম বিমানে চড়ার অভিজ্ঞতার রেশটুকু হৃদয়মাঝে জড়িয়ে পা রাখলাম তেহরানের মাটিতে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার দমকা হাওয়া যেনো আমাকে স্বাগত জানালো। একটু একটু করে স্বপ্ন পূরণের দিকে এগুচ্ছি আমি। এগিয়ে যাচ্ছি ভীষণ দৃঢ়তায়।

Share.

মন্তব্য করুন