বালিয়াড়ির ফাঁকে ফাঁকে মরুপথ ধরে চলছে কাফেলা। আবিসিনিয়ার পথে। জায়েদ সবার সম্মুখে। সাথে তার পরিবার পরিজন। পেছনে আল্ ফালানা, আবু আসম আর জয়নাবের পুত্র কন্যারা। রুগ্ণ উষ্ট্রীতে তারা সোয়রি। গাধার পিঠে পরিবারের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বোঝাই। ঝপাঝপ খুরের আঘাতে বালি ছড়িয়ে উটগুলো চলছে ধীরগতিতে এগিয়ে।
নীলনদ বিধৌত শস্য-শ্যামল ধনভাণ্ডার ত্যাগ করে পালাচ্ছে তারা। পালাচ্ছে তারা নিজ বাসভূমের মায়া ত্যাগ করে। আবু আসম চলতে গিয়ে মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়ায়। পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দৃষ্টির শেষ সীমায় তাকায়। ভাবাবেগে ঝাপসা চোখে আবু আসম দেখে পাহাড় ঘেরা প্রান্তরে খরাপোড়া ফসলের বিরান মাঠ। এরপাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে প্রবাহিত হয়ে গেছে সুবিশাল নীলনদ। শূন্য নদের মাঝখানে সামান্য কাদা-পানি নালার মত বয়ে চলেছে। নির্মেঘ আসমান। সূর্য আলো ছড়াচ্ছিলো প্রখরভাবে। সে আলোয় ঝিমিয়ে পড়া স্রোতহীন নদে গুঁড়িগুঁড়ি ঢেউ চিকমিক করছিলো।
ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো আবু আসমের হৃদয় কন্দরে ভেসে উঠেছে শৈশব, যৌবন আর প্রৌঢ়ত্বের নানা ছবি। ক্ষোভ আর অভিমানে আসমের ঝাপসা চোখের অশ্রুবিন্দু তামাটে মুখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে।
বনু জুনায়েদ বংশে আবু আসমের জন্ম। কৃষি-ই এ কবিলার (গোত্রের) প্রধান পেশা। নীলনদের তীরে তাদের ফসলি জমি। নদ থেকে সেচ করা পানি দিয়ে আসমরা ফসল ফলায়। উৎপাদিত ফসলে ভরে ওঠে আসমদের গোলাঘর। খেজুর, আঙুর, আখরোট আর আপেলের প্রাচুর্য তাদের পাহাড়ি বাগানে। মিসরের নীলনদ অববাহিকার এটা সাধারণ চিত্র।
প্রতি বছর বেঁচে যায় তাদের অনেক ফসল, অনেক ফল। বাড়তি অংশ বিক্রি করে ঘরে তোলে প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা। আবু আসম, জায়েদ, আল ফালানা ছিল বনু জুনায়েদ কবিলার উঠতি তরুণ। তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিলো মধুর। যৌবনে বহুবার কৃষি অবসর মৌসুমে আলেকজান্দ্রিয়ার জঙ্গলে হরিণ শিকার করেছে তারা। নবান্ন উৎসবে মেতে উঠতো তাদের কবিলা। পাশের বনু কোরায়জা, বনু শায়াদ গোত্রের তরুণ-তরুণীরা আসতো উৎসবে। নেচে নেচে গান করতো নতুন ফসল ঘরে তোলার। সাত পুরুষের জীবনে কখনো লাগেনি অভাবের ছোঁয়া। ক্ষুধা-দুঃখ-দারিদ্র্য কাকে বলে তারা কোনদিন তা জানেনি। কিন্তু আজ সে সব অতীত স্মৃতি মাত্র। বর্তমান দুঃখ-দারিদ্র্যের পঙ্কিল সময়ের সাথে অতীতের মধুময় স্মৃতিগুলো আসমের হৃদয়কে দারুণ ব্যথিত করে তোলে।
এক সময় জয়নাবের উট এসে আসমের উটের সাথে ধাক্কা খায়। আবু আসম সম্বিত ফিরে পায়। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে জয়নাবের প্রতি লক্ষ করে বলে- চাচী আম্মা! আমর ইবনুল আ’স আমাদের দেশ জয় করেছে ভালো কথা কিন্তু সে আমাদের রিজিকের উপর আঘাত হানবে কেন?
– ওর কথা মুখে এনো না আসম! তার নাকি ধর্ম যাবে, তাই।
– ধর্ম কেন যাবে চাচী? আমরাতো ইসলামের সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম কবুল করেছি। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে দুনিয়া ও আখেরাতের নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছি। খলিফা উমর (রা.) এর আনুগত্য স্বীকার করেছি। তবুও আমর ইসলামের প্রতিনিধি হয়ে কেন আমাদের ক্ষতি করছে?
– সে তার ব্যক্তিগত মত প্রতিষ্ঠা করতে চায় আমাদের ওপর।
আমাদের হাজার বছরের ইতিহাসকে মুছে দিতে চায়। জয়নাব এসব কথা বলতে বলতে আনমনা হয়ে ওঠে। এক সময় অস্ফুট কণ্ঠে বলে- তার জন্যই তো তোমার চাচা মারা গেলো। মাঠে ফসল ফলাতে না পেরে মানুষটা পাগল হয়ে গিয়েছিলো। নীলনদের বুক শূন্য হাহাকার আমাকেও বরণ করে নিতে হয়েছে। আজ বাপহারা এতিমদের ডানায় ভর করে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে জয়নাব। তাদের মাঝে নেমে আসে নীরবতা।
আবু আসম আবার প্রশ্ন করে- আমরা তো চলে যাচ্ছি দেশ ছেড়ে। যারা এখনো মাটি কামড়ে পড়ে আছে তাদের কী হবে?
– হবে নিদারুণ মৃত্যু। হয়তো পরবাসী জিন্দেগিতে আমিও মারা যাবো। তুমি দেখবে আসম, নীলনদে মেষ চরছে। ফসল ভরা মাঠের বদলে দেখবে ধান-গমহীন নীলনদ অববাহিকা, আগুনে পোড়া বালু রাশির বিশাল সাহারা। ক্ষুধা, দারিদ্র্য আর অপুষ্টিতে মারা যাবে হাজার হাজার বনি আদম।
– আপনি ঠিকই বলেছেন চাচী। তার আলামত তো এখনই দেখছি।
জয়নাব আবার বলে- আমর ইবনুল আসের কী ক্ষতি হতো শুকনো নীলনদে কুমারী কন্যা বিসর্জন দিয়ে পানি তুললে? আমরা তো তার মেয়েকে ঘর থেকে টেনে আনছিনে! আবু আসম হতাশ চিত্তে প্রশ্ন করে- চাচী, নীলনদে কি আর কোনদিন পানি উঠবে না?
– উঠবে, উঠবে, শতবার উঠবে। এর আগে চাই আমিরের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। প্রতি বছরের মতো এবারও কুমারী কন্যা দিতে হবে নীলনদকে। তবেই নদী ফিরে পাবে তার নাব্যতা। আসম, তোমার কি মনে নেই জোহরার কথা?
– শতবার মনে আছে চাচীজান। তার কথা কেন আমার মনে থাকবে না? সে যে ছিলো আমার খেলার সাথী। জোহরার কথা মনে পড়লে আমি এখনো স্থির থাকতে পারি না।
প্রতিবারের মতো সে বছর ‘বুল’ মাসের ১২ তারিখে নীলনদে ‘কুমারীকন্যা বিসর্জনের’ ভাগ পড়েছিলো আমাদের গোত্রের উপর। চাচা সুনামের জন্য জোহরাকে নীলনদে নিক্ষেপ করেছিলো। কবিলার নারী-পুরুষরা দফ বাজিয়ে গান করেছিলো। আপনি, আমি, আমরা সবাই কতই না কেঁদেছিলাম। জোহরা, আমার ছোট্টবেলার খেলারসাথী। লাল টুকটুকে বোনটি আমার। (আবু আসমের হৃদয়পটে জোহরার নানা স্মৃতি ভেসে ওঠে।) কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আসম আবার বলতে থাকে- আপনি নতুন ফসল আসার আগে চাচার সাথে একটি কথাও বলেননি। কিন্তু ফসলে যখন বাড়ি-ঘর সব ভরে গেল, নীলনদে যখন পানির জোয়ার বইলো- আপনি সব ভুলে গেলেন। এরপর তো প্রায়ই বলতেন, “আমার যদি আরো একটি কন্যা হতো, আমি তা নীলনদকে দান করতাম।”
– তোমার সব মনে আছে দেখছি আবু আসম। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে জয়নাব আবার বললো- আমর আমাদের সে সুযোগ আর দিলো না। সুন্দর, সে দিনগুলো কি আর ফিরে আসবে?
সূর্য গড়িয়ে গেছে পশ্চিমে। কাফেলা পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে চললো। আর তাদের মনের গহিনে লুক্কায়িত অনেক কথা, অনেক প্রসঙ্গ জায়েদ, আল-ফালানাকে নিয়ে আবর্তিত হতে থাকে।
মিসর বিজয়ী মুসলিম বীর আমির আমর ইবনুল আস (রা.)-এর দরবার। দরবারে শত শত কৃষকের ভিড়। ওরা এসেছে খরাপীড়িত নীলনদ অববাহিকা থেকে। ওদের চোখে মুখে হতাশার ছাপ। গায়ের বসনগুলো পুরাতন। ছেঁড়া কোন কোনটি। ঠোঁট থেকে মুছে গেছে হাসির রেশ। কোটরান্তর চোখগুলোতে প্রতিবাদী তীক্ষè চাহনি। আমিরের দরবার বলে এখানে নীরবতা। কৃষকরা অপেক্ষা করেছিলো আমিরকে দুঃখের কথা জানাতে।
আমির আমর ইবনুল আ’স (রা.) ধীরগতিতে প্রবেশ করলেন দরবারে। দামি কোন সিংহাসন নয়- শ্রোতা থেকে একটু উঁচু কুরসিতে বসলেন। কৃষকরা প্রথামতো সালাম জানালো আমিরের প্রতি। আমির জানতে চাইলেন তাদের আগমনের কারণ। একজন বয়সী কৃষক উঠে দাঁড়ালো। আমিরের সামনে এগিয়ে যেয়ে আরজ করলো :
হে আমির! মানুষ চলে যাচ্ছে নিজ জন্মভূমি ছেড়ে। বিশাল প্রান্তরগুলো ফসলশূন্য। ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির। নীলনদে এমন কোন পানি নেই যা আমরা পান করতে পারি। সেচ করে ফসল ফলাতে পারি। ভাষাহীন পশুদের উদর জুড়াতে পারি। খেজুর বাগানে একটি ফুলের চিহ্ন নেই। আঙ্গুর আখরোটের শূন্য ডালগুলোয় একটি সবুজ পত্রও চোখ মেলেনি। আমাদের ঘরের খাদ্য ফুরিয়ে গেছে। আমরা তীব্র খাদ্যাভাবের সম্মুখীন।
আপনার নিষেধে আমরা আমাদের শত বছরের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে ৩ মাস অপেক্ষা করেছি। কিন্তু আকাশে নেই এক চিলতে মেঘ। নীলনদে নেই এক ফোঁটা পানি। আপনি নীলনদ থেকে সৈন্য ফিরিয়ে নিন। আমাদের অনুমতি দিন কুমারী কন্যা বিসর্জনের। আপনার অনুমতি পেলে আমরা আজই তা সম্পন্ন করবো।
আর আপনি দেখবেন কাল সকালেই নদে উঠবে পানির প্লাবন। কৃষকরা সেচ দেবে জমিতে। আবার ফুলে-ফলে-ফসলে এ অঞ্চল ভরে উঠবে। মানুষের মুখে উঠবে নব জীবনের প্রাণ স্পন্দন। দেশ-ছাড়া মানুষ ফিরে আসবে নিজ নিজ গৃহে।
– না; তা কখনো হতে পারে না। পবিত্র ইসলামের আবির্ভাব হয়েছে সকল প্রকার জাহেলি প্রথা, কুসংস্কার এবং র্শিক-বিদয়াতের মূলোৎপাটন করে খোদায়ী একত্ব বিধানের জন্য। নীলনদে কুমারী কন্যা বিসর্জন সম্পূর্ণরূপে নির্দয়তা। র্শিক। এই নদ খোদার সৃষ্টি। এর নাব্যতাও খোদার হাতে। নদী কখনো কুমারী কন্যার জন্য লালায়িত হতে পারে না।
হে ভাইয়েরা, তোমরা জাহেলি যুগের কু-প্রথা থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও। আল্লাহ্র ওপর পূর্ণ ঈমান আনো। রিজিকের মালিক রাজ্জাক। গত তিন মাস তোমরা অপেক্ষা করেছ। আর কটা দিন সবুর করো। নিশ্চয়ই তিনি আমাদের দুঃখ-দুর্দশা ঘুচিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন। ইবনুল আ’স হৃদয় উজাড় করে লোকদের প্রতি আহ্বান জানালেন।
কৃষকরা নিরাশ হয়ে একে একে আমিরের দরবার ত্যাগ করলো। তাদের মধ্যে বয়ে গেলো চাপা তীব্র ক্ষোভ।
কৃষকদের ব্যথায় ব্যথিত হলেন আমির। চিন্তা করতে থাকলেন সমস্যা সম্বন্ধে, কী করে এর সমাধান দেয়া যায়। আমিরের স্মরণে এলো মহান খলিফা হযরত উমর (রা.) এর কথা। তিনি দেরি না করে খলিফার কাছে চিঠি লিখলেন- “আমিরুল মোমেনিন, আল্লাহ্র করুণা বর্ষিত হোক আপনার ওপর।
মিসর বিজয়ের পর আজ আমি বিরাট সমস্যার সম্মুখীন। প্রজারা দিন দিন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে আমাদের কানুনের উপর। শুষ্ক মৌসুমে নীলনদে কুমারী কন্যা বিসর্জনের জাহেলি প্রথাকে রহিত করে আমি প্রজাদের বিরাগভাজন হচ্ছি। গত তিন মাস এখানে বৃষ্টি হয়নি। কৃষকরা মাঠে ফসল ফলাতে পারে নি। খরায় মাঠ ঘাট চৌচির। নীলনদে পানিপ্রবাহ নেই। খাদ্যাভাবে মানুষ দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। নব দীক্ষিত মুসলমান ভাইয়েরা খোদায়ী পরীক্ষায় ধৈর্য হারিয়ে ফেলেছে। আপনি দয়া করে একটি সিদ্ধান্ত পাঠান, যাতে করে এ গুরুতর সমস্যার সমাধান দেয়া যায়।”
পত্রখানি সাথে দিয়ে আমির আমর ইবনুল আ’স (রা.) একজন দূত পাঠালেন মদিনা শরিফে। দূত মাত্র কয়দিন পর দ্রুত ফিরে এসে আমীরকে আশ্বস্ত করে বললো- আমিরুল মোমেনিন আপনার রায়কে সমর্থন করেছেন। সাথে সাথে এও বলেছেন যে, জাহেলি যুগের কোন প্রথার কাছে আমরা যেন মাথা নত না করি। এই নিন, তাঁর পক্ষ থেকে একখানি চিঠি। এটি নীলনদে নিক্ষেপ করার জন্য তিনি আপনার প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। আমর ইবনু আ’স (রা.) খুশি মনে বলে উঠলেন- আলহাম্দুলিল্লাহ্- সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য।
পরদিন নীলনদ অঞ্চলে ঘোষণা করে দেয়া হলো : কাল সন্ধ্যায় সবাই নদের তীরে হাজির থাকবে। আমির খলিফার পক্ষ হতে নীলনদে চিঠি নিক্ষেপ করবেন। আর সবাইকে নিয়ে খোদায়ী মদদের জন্য দোয়া করবেন।
মুহূর্তের মধ্যে এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো এক কবিলা থেকে অন্য কবিলায়। কিন্তু এ সংবাদকে তারা স্বাগত জানালো না। তাদের মনে এসে দানা বাঁধলো নানা সন্দেহ। সৃষ্টি হলো বহুবিধ কল্পকথা, টিপ্পনী, কানাকানি। অন্য দিকে বনু জুনায়েদের এক নওজোয়ান তাজি ঘোড়া নিয়ে ছুটে গেলো জায়েদ-জয়নাবদের ফিরিয়ে আনতে আবিসিনিয়ার পথে।
সন্দেহ সংশয় থাকলেও আমিরের নির্দেশ অমান্য করার মতো দুঃসাহস কারো ছিলো না। সন্ধ্যায় নদের তীরে নারী-পুরুষ-যুবক-কিশোররা দলে দলে এসে হাজির হলো।
দিনের ক্লান্ত সুরুজ ঢলে পড়েছে দূর পাহাড়ের কোলে। সবার মাঝে ঔৎসুক্য আমিরের পরবর্তী কাজের ফলাফল দেখার। আমির যেখানে এসে পৌঁছবেন সে স্থানটি ঘিরে সারি বেঁধে দাঁড়িয়েছে সবাই। গোধূলি সন্ধ্যায় আমির আমর ইবনুল আ’স (রা.) সাথীদের পরিবেষ্টনে এসে পৌঁছলেন। সমবেত জনতা তাঁকে সাদর অভিবাদন জানালো। আমির খলিফার পত্রখানা বের করলেন জুব্বার পকেট থেকে; এরপর সমবেত জনতার উদ্দেশে বললেন- এ চিঠিখানি সুদূর মদিনা শরিফ থেকে পাঠিয়েছেন আমিরুল মোমেনিন হযরত উমর ফারুক (রা.)। শুষ্ক নীলনদের প্রতি এটি খলিফাতুল মুসলেমিনের নির্দেশ।
ইবনুল আ’স এবার দৃষ্টি মেলে তাকালেন প্রাণহীন নীলনদের প্রতি। আবার চোখ বুলিয়ে নিলেন জনতার চোখে-মুখে। তাদেরকে পড়ে শোনাতে থাকলেন খলিফার পত্র।
আল্লাহ্র বান্দা ওমর- আমিরুল মুমেনিনের পক্ষ থেকে নীলনদের প্রতি-
“হে নীলনদ! যদি তুমি নিজ শক্তিতে প্রবাহিত হও, তবে তুমি প্রবাহিত হয়ো না। আর যদি আল্লাহ তোমাকে প্রবাহিত করে থাকেন- তবে আল্লাহ্কে জানাচ্ছি: হে মহান রাব্বুল আলামিন! তুমি নিজ শক্তিতে তোমার অসহায় বান্দাদের জীবন ও জীবিকার জন্য নীলনদকে চির নাব্যতা প্রদান করো।”
পত্র পাঠ শেষে সবাইকে সাথে নিয়ে তিনি মুনাজাত করলেন আল্লাহ্র দরবারে। এরপর নীলনদের কাদাপানিতে নিক্ষেপ করলেন খলিফার চিঠি। সদলবলে ইবনুল আ’স (রা.) ফিরে গেলেন রাজধানীতে। কবিলার লোকজন যে যার বাড়ি চলে গেল। পৃথিবীর বুকে নেমে এলো রাত। ফাঁকা মরু ময়দান অল্প সময়ে তলিয়ে গেলো গভীর অন্ধকারে। শুধু দূরে দূরে গিরি শৃঙ্গগুলো দেয়ালের মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। আর নীলনদ আচ্ছাদিত হলো ঘন কুয়াশায়।
শূন্য মরুর বিচ্ছিন্ন কবিলাগুলোতে তখনো ঘুমের গভীরতা কাটেনি। মসজিদ থেকে ওঠেনি মুয়াজ্জিনের সুমধুর আজান ধ্বনি। অবশ্য অন্ধকারে নিমজ্জিত মরুর বুকে ফুটে উঠেছে সুবহি সাদিকের আবছা আলো। ঠিক সে সময় বনু জুনাইদ কবিলার সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখা গেলা একটি ক্ষুদ্র কাফেলা! জায়েদ জয়নাবের পরিবার পরিজন। কবিলার মধ্যবর্তী হয়ে তারা সমস্বরে চিৎকার দিয়ে ঘোষণা করলো, লাব্বায়িক- আমরা হাজির, আমরা উপস্থিত। আল্লাহু আকবার-আল্লাহু আকবার। আল্লাহ মহান, আল্লাহ সর্বশক্তিমান।
এবার আবু আসম তার দরাজ গলায় উচ্চস্বরে আহ্বান জানালো- হে বনু জুনায়েদের আবালবৃদ্ধবনিতা, কান পেতে শোন নীলনদের কুলুকুলু ধ্বনি। ঘুম থেকে ওঠো; দেখে আসো নীলনদের ঢেউ জাগানো প্রাণস্পন্দন।
ভোর হতে না হতে নীলনদ তীরে ঢল নামলো হাজার হাজার নারী পুরুষের। তারা চোখ জুড়িয়ে দেখলো দিগন্ত বিস্তৃত নদীর বুকে থইথই পানির প্রাচুর্য। চারিদিকে ফুটে উঠেছে জীবন ও জীবিকার প্রাণবন্যা। নীলনদ প্রভাতি সূর্যের সোনালি রোদে ঝিক্মিক করে উঠলো। আন্দোলিত ঢেউ যেনো ধান, গম আর যব গাছের মাথা নোয়ানো শীষ মহানন্দে দোল খাচ্ছে।
…. …. …. ….
সে দিন থেকে আজ অবধি নীলনদে হয়নি এক ফোঁটা পানির অভাব। নদে জাগেনি কোন দুশমন চর। কোন হারামি পিতা তার কন্যাকে ছিনিয়ে নেয়নি মায়ের কোল থেকে। বিসর্জন দেয়নি কেউ জোহরার মতো নিষ্পাপ কিশোরী কন্যাকে নীলনদে। আল্লাহ্র অপার মহিমা ছড়িয়ে নীলনদ অববাহিকার শ্যামল মাটিতে শিকড় বিস্তৃৃত হলো খোদার বিধানের। আর তার অধিবাসীরা আনুগত্যের শির নত করলো লা শরিক আল্লাহ্র কুদরতে। মিসর হয়ে গেল নীলনদের দান।

Share.

মন্তব্য করুন