ছোটবেলার রোজার কথা মনে পড়লে খুব হাসি আসে আপন মনে। কারণ ছোটবেলায় রোজা রাখার নাম করে কত বায়না যে ধরেছি তার ঠিক নেই। রোজার উসিলায় লেখাপড়া কম করার বায়নাটা ছিলো সবচেয়ে বেশি। আব্বা আম্মা পড়ালেখার কথা বললেই বলতাম, আমি রোজা আছি না! রোজা থেকে বেশি পড়াশোনা করা যায় নাকি! কষ্ট হয় না আমার! এক প্রকার আবেগ নিয়ে বলতে বলতে কেঁদেই ফেলতাম। মা তার পরনের শাড়ির আঁচল দিয়ে আমার চোখের পানি মোছাতে মোছাতে বলতেন, থাক থাক এখন পড়তে হবে না। আমার ছোট্ট পুচকিটা রোজা রেখে কেমন শুকনো শুকনো হয়ে গেছে। বাবাকে বলতেন, দেখেন আমার ছেলেটার মুখ ঠোঁট একদম শুকিয়ে গেছে। ছোট্ট খোকা রোজা রাখে এই তো অনেক বেশি। ওকে পড়ালেখার জন্য বেশি চাপ দেয়ার দরকার নেই। ইফতার করে যদি পারে পড়বে তখন।
মায়ের কথা শুনে বাবা আমাকে আরও ভালো করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে বলতেন, হ্যাঁ ঠিকই বলেছো। ছেলেটা রোজা রেখে মুখ টুখ শুকনো করে তুলেছে।
তারপর আমার কাছে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, আমার ছোট্ট বাবাটা রোজা রেখেছে। ওর জন্য মজার মজার ইফতারি বানাও। মজা করে যেনো খেতে পারে আমার ছেলেটা।
আম্মা মুচকি হাসি দিয়ে বলতেন, আজ কিন্তু ওর পছন্দের ইফতারি বানাবো। তোমাদের কাউকে দেবো না কিন্তু। শুধু আমার ছোট্ট রোজাদারের পাতে দেবো ওই ইফতারি।

আমার তখন খুব খুশি খুশি লাগতো। আমার মনের ভেতর কে যেনো কথা বলতো। বলতো আরও আরও রোজা রাখো। রোজা ভেঙো না কিন্তু! ঠিক তখন মনে মনে আমি নিজেকে নিজেই বলতাম, একটি রোজাও ভাঙবো না আমি যত কষ্ট হোক না কেনো।
আসলেও কষ্ট হতো রোজা রাখতে। দুপুর পর্যন্ত কোনো অসুবিধা হতোই না। দুপুর পার হলেই বুকটা যেনো কেমন কেমন করে শুকিয়ে জিহবাও শুকিয়ে যেতো। ক্ষুধাও লাগতো বেশ। কিন্তু একটি বিষয় ছিলো যে ক্ষুধা লাগলেও কিছুক্ষণ পর ক্ষুধা আর মনে হতো না। কিন্তু ক্ষুধা গেলে কী হবে! পানির পিপাসা খুব বড় হয়ে দেখা দিতো বুকের ভেতর। মনে হতো কত কত গ্লাস পানি খেয়ে নিতে পারবো তার কোনো হিসাব নেই।
এত কষ্ট হলেও রোজা ভাঙার কথা মনে পড়লেই মন শক্ত হয়ে যেতো। মনই মনে হয় মনকে বলতো, না কক্ষনো রোজা ভাঙার কথা বলবে না। মনের এমন শক্ত ভাব দেখে আমি নিজেই অবাক হয়ে চুপচাপ করে বসে থাকতাম। কোনো অবস্থাই রোজা ভাঙতাম না।
এদিকে পানির পিপাসায় যখন বুক জিব শুকিয়ে উঠতো তখন অনেক সময় গোসল করতে যেতাম। গ্রামের বাড়ির বিরাট পুকুরে নেমে গোসল করতাম আমরা অনেকেই মিলে। আমরা সবাই সমবয়সী ছিলাম বলে সবাই একসাথে গোসল করতাম এবং খেলাধুলা করতাম।
রোজার সময়ও আমরা একসাথে পুকুরে নামতাম।
তবে রোজার আগে পরে পুকুরে যখনই গোসল করতে নামতাম আমরা একসাথে লাফ দিয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়তাম। কিন্তু রোজা রেখে লাফিয়ে পড়তাম না। কারণ ছিলো মক্তবের উস্তাদ আমাদেরকে বলেছেন যে যদি পুকুরে লাফ দিয়ে পড়ি তো হঠাৎ পানি গলায় চলে যেতে পারে। অথবা নাক তালুতে পানি উঠে যেতে পারে। যদি এমন হয় তো রোজা ভেঙে যাবে। রোজা ভাঙার এই ভয় আমাদের সবার মনে খুব বড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। তাই আমরা কেউ পুকুরে ঝাঁপ দিতাম না। খুব সাবধানে পুকুরে নেমে ধীরে ধীরে ডুব দিয়ে গা ঘষে ধুয়ে উঠে যেতাম। এখানে একটি মজার কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যখন পানিতে ডুব দিতাম তখন খুব মন চাইতো চুপেচুপে একটু পানি খেয়ে নিতে। ভাবখানা ছিলো ডুব দিয়ে পানি খেলে কেউ তো দেখবে না! কেউ যেহেতু দেখবে না তাহলে ডুবে পানি খেলে কি অসুবিধা! কথা তো সত্যি! কিন্তু এখানেও আমাদের উস্তাদের একটি কথা তখন খুব মনে ভাসতো। তিনি বলেছিলেন, রোজা শুধু মহান আল্লাহ তায়ালার জন্য রাখা হয়। তো পানির নিচে কোনো মানুষ না দেখলেও আল্লাহ তো দেখেন। এ কথাটা আমাদের মনে সাংঘাতিক ভাবে গেঁথে গেলো। কিন্তু তখন এত চিন্তা ভাবনা করে চলার বয়স তো ছিলো না। উস্তাদ বলেছেন বলে আমরা কথাটাকে মনের ভেতর খুব করে রেখে দিয়েছি। যখনই ডুব দিয়ে পানির নিচে গেছি, পানি খাওয়ার কথা ইচ্ছে হতো, তখনই উস্তাদের মুখের ওই কথাটা মনে আসতো। সাথে সাথে পানির নিচ থেকে উঠে মুখের পানিগুলো ফেলে বারবার থুথু ফেলতাম। যাতে করে সামান্য পানিও গলায় না চলে যায়। এর পর একটি ঘটনা ঘটতো মনের ভেতর। সেই ঘটনাটা তখন বুঝতে পারিনি এটা সত্যি কথা। এখন খুব করে মনে পড়ে সেই অনুভূতিটা। সেটা হলো ডুব থেকে উঠে যখন বারবার মুখ থেকে পানি ফেলে দেয়ার পর মনে একটা সুন্দর অনুভূতি জন্ম নিতো। সেই অনুভূতি হলো পবিত্রতার অনুভূতি।

একইসাথে জীবনের জন্য একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পেয়েছিলাম সেই তখনই। তবে তখন আগেরটার মতো বেশি বুঝিনি। বড় হয়ে বুঝলাম সেই শিক্ষাটা হলো জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। সেটা হলো কেউ যা দেখে না আল্লাহ তা দেখেন। কেউ যেখানে থাকে না আল্লাহ সেখানে থাকেন। এই শিক্ষাটাই আমার ছোটবেলার রোজা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। বড় হয়ে যখন বিষয়টা খুব পরিষ্কার করে বুঝলাম। তখন থেকে এখন পর্যন্ত মন বলে, এই একটা শিক্ষা যদি মানুষ তার জীবনের সব কাজে লাগায় তাহলে কারো পক্ষে কোনো ধরনের অন্যায় করা সহজ হবে না। কারণ যখন কেউ গোপনে অন্যায় করতে যাবে তখনই তার মনে হবে, এখানে কেউ নেই তো কি হয়েছে। আল্লাহ তো আছেন সবসময় সবখানে। তিনি দেখছেন গোপন প্রকাশ্য সবকিছু। এই মনোভাব যখন মনে জাগবে তখন কারো পক্ষে অন্যায় করা সম্ভব নয় কোনোভাবে।
আমার মনে হয় আমার ছোটবেলার রোজার এই শিক্ষাটা যদি সকল মুমিন মুসলমানের মনে বা যারা রোজা রাখেন তাদের মনে জাগে, তাহলেই তো ব্যক্তিগত, পারিবারিক সামাজিক এবং রাষ্ট্রের সকল কিছু সুন্দর হয়ে যেতো। কেউ কারো উপর অন্যায়ভাবে কিছু করার সাহস করতো না। কেউ কারো অধিকার দখল করার কোনো রকম মনোভাব রাখতো বলে আমার মনে হয় না।
আমার ছোটবেলার রোজা আমাকে যেমন করে শিক্ষা দিয়েছে, তোমাদেরকেও অবশ্যই সেই শিক্ষা দেবে বলে আমার মনে হয়।
তাই বলি কি তোমরা যারা এখনও ছোট তারা রোজা রাখো সেই সাথে রোজার শিক্ষাও নিজের জীবনে বাস্তবায়নের চেষ্টা চালাও। রোজা রাখার আনন্দটা তখনই পূর্ণ হবে, যখন রোজার শিক্ষা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করতে পারবে।
তবে এখন আমার মনে হয় যদি আবার ছোটবেলা ফিরে পাওয়া যেতো কতইনা ভালো হতো!

Share.

মন্তব্য করুন