বাংলা ভাষাকে আমি আনন্দের ভাষা বলেছি এবং সবসময় বলেই যাবো বলেই যাবো। কেনো আনন্দের ভাষা বললাম হয়তো তোমরা প্রশ্ন করতে পারো। আমার যেমন অধিকার আছে বলার এবং এ বলাটার অনেক অনেক যুক্তিও আছে। একইভাবে তোমাদের প্রশ্ন করার অধিকারও আছে কিন্তু। ঠিক একইভাবে বলি- প্রশ্ন না করলে তোমরা জানবে কী করে! জানার জন্য বোঝার জন্য যেমন পড়তে হয় অনেক কিছু তেমনি প্রশ্নও করতে হয় বারবার। প্রশ্নের মাধ্যমে সবার জানাটা খুব সহজ হয়ে ওঠে। সুতরাং তোমাদের প্রশ্ন আমাকে উৎসাহিত করতে সাহায্য করবে বলে আমি মনে করি। হ্যাঁ তোমাদের প্রশ্নের জবাব আমি দেবো।
তার আগে বলে রাখি সারা বিশ্বে কয়েক হাজার ভাষা আছে। এর মধ্যে বাংলা ভাষা বিশ্বের প্রথম সারির চার পাঁচটি ভাষার মধ্যে অন্যতম একটি ভাষা। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক বলে আমি মনে করি। বাংলা ভাষার এ গুরুত্ব এখন অনুভব করে জাতিসংঘেও। দুনিয়াব্যাপী প্রায় সকল দেশের মানুষ বাংলা ভাষার ৫২ এর রক্তরাঙা ইতিহাসের কথা জানে। জানে আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারির সেই ’৫২ এর আগুন জ্বলা দুপুরে একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভংগ করার খবর। শুধু কি জানে! সারা বিশ্ব এখন প্রতি বছর বেশ আয়োজনের সাথে বাংলা ভাষা দিবস পালনও করে থাকে
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আমাদের মতো বিশ্বের কোনো জাতি বা দেশের মানুষ মাতৃভাষা রক্ষা করার জন্য সংগ্রাম করেনি। কেউ ভাষার জন্য লড়াই, মিছিল, স্লোগান, রক্ত কিংবা জীবন দেয়নি। আসলে ভাষা যেহেতু মানুষের প্রতি মহান সৃষ্টিকর্তার দান। যেহেতু ভাষা প্রকৃতির মতই মানুষের জন্ম থেকে তার অধিকার। সে কারণে অন্য কোনো জাতিকে তার মাতৃভাষার জন্য জান প্রাণ দিতে হয়নি। আসলে মাতৃভাষা বা মুখের ভাষার মর্যাদা রক্ষা নিয়ে লড়াই সংগ্রাম করতে হবে এ কথা কেউ ভাবতেও পারে না কখনও। অথচ আমাদেরকে মায়ের ভাষা রক্ষা করার জন্য সংগ্রাম লড়াই জীবন এবং রক্ত দিতে হয়েছে। আমরা অকাতরে দিয়েছি। এই রক্ত এবং জীবন দিয়ে আমরা রক্ষা করেছি আমাদের ভাষার মর্যাদা ও সম্মান। এ কারণে আমাদের বাংলা ভাষা গৌরবান্বিত হয়েছে। মর্যাদাবান এবং সম্মানিত হয়েছে বলে জগতের সবাই মনে করে। আমরা নিজেরাও এর জন্য সম্মানিত বোধ করি সদা সর্বদা। খুব জোর গলায় আমরা বলে থাকি- বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়েছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে মূলতঃ ভাষা আন্দোলনের মাধ্যম হয়ে।
এখন একটু টক কথা বা সমালোচনা করি। সমালোচনাটি কিন্তু আমাদের জাতির আত্মসমালোচনা। সমালোচনাটি হলো- এত রক্ত এত জীবন এত সংগ্রাম করে যে ভাষা পেয়েছি, আমরা সেই ভাষার সেই মর্যাদা রক্ষা করতে পারছি কি! সেই ভাষার মর্যাদা এবং সম্মান দিতে পারছি কি! এর উত্তর হবে না, আমরা পারছি না। যদি না পারি তাহলে এর পরের প্রশ্ন জাগে- পারছি না কেনো? কি সমস্যার কারণে আমরা ভাষার মর্যাদা সম্মান রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছি। যে জাতি তার ভাষার জন্য নাগরিকের তাজা জীবন দিয়ে দিয়েছে, সে জাতি কেনো ভাষার সম্মান রক্ষা পারছে না।
এখন আসি ভাষার অসম্মান হচ্ছে যে বললাম তা হচ্ছে কীভাবে! কীভাবে সবাই অপমান করছে রক্তরাঙা এ ভাষাটিকে! এ বিষয়টি জানা আমাদের সবার জন্য অবশ্যই জরুরি। নাহলে আমরা তো বুঝতেই পারবো না যে আমরা কেমন করে ভাষার অপমান করছি।
প্রথম কথা হলো- পৃথিবীর সকল ভাষারই অনেক অনেক আঞ্চলিক ভাষা থাকে। একেক অঞ্চলে ভাষার একেক রকম ব্যবহার এবং আলাদা কিছু শব্দ বাক্য থাকে। এটি অবশ্য খুব মজার একটি বিষয়। যেমন আমাদের সিলেট অঞ্চলের ভাষার সঙ্গে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভাষার কোনো মিল নেই। চট্টগ্রামের সাথে বরিশালের কোনো মিল নেই। নোয়াখালীর সাথে একদম মিলে না ময়মনসিংহের ভাষা। ঢাকাইয়াদের ভাষা সবার থেকে অন্যরকম। এভাবে প্রতিটি অঞ্চলের মানুষ আলাদা আলাদা বৈশিষ্টে কথা বলে। কিন্তু এসব আঞ্চলিক ভাষার উর্ধে ভাষার একটি জাতীয় রূপ আছে। এটি হলো শুদ্ধ ভাষা বা ভাষার শুদ্ধরূপ। এরূপে যারা কথা বলেন তারা যে অঞ্চলেরই হোন না কেনো একই উচ্চারণে কথা বলবেন এবং বলেন। কিন্তু আমরা আমাদের ভাষার জাতীয় রূপটি সম্বন্ধে খুব বেখবর। আমাদের বেশির ভাগ নাগরিক জাতীয় পর্যায়ে দায়িত্বশীল হয়েও আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। আঞ্চলিক উচ্চারণে বলতে থাকেন প্রতিনিয়ত। তিনি জানেনই না যে জাতীয় ভাবে দায়িত্ব পালন করতে হলে ভাষার জাতীয় রূপটি তার জানা থাকতে হবে। জাতীয় রূপেই কথা বলতে হবে তাকে। যখন একজন শিক্ষিত লোক জাতীয় দায়িত্বেও থাকেন, আর তিনি আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন- এটিই ভাষার অপমান।
আবার আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেসব সম্মানীত শিক্ষক বাংলা ভাষা পড়ান। তাদেরও বেশির ভাগের উচ্চারণ শুদ্ধ নয়। নিজেরা যখন অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন, অশুদ্ধ উচ্চারণ করেন। সেখানে শিশু কিশোর বা ছাত্র ছাত্রীগণ কীভাবে শুদ্ধতা শিখবে! উচ্চারণ শুদ্ধ না হলে অনেক অসুবিধা হতে পারে। ঘাটে ঘাটে হয়েও থাকে। লিখতে অসুবিধা হয়। অর্থাৎ বানান ভুল হয়ে যায়। কারণ মুখে বা মনে যা উচ্চারণ করে তা-ই লেখে সবাই। তো উচ্চারণ যখন ভুল হয় লেখা কীভাবে শুদ্ধ হবে! আবার একটি জিনিস হয় তো চাচ্ছে কিন্তু উচ্চারণ ভুলের কারণে অন্য জিনিস শোনাচ্ছে। তখন সমস্যাটা কি আর ছোট থাকে! নাকি বড় হয়ে যায়। আসলে এভাবেই একটি ভাষা অসম্মানিত হয়ে যায়। ভাষার অপমান হয়। আরও নানা কারণে অসম্মান ঘটে ভাষার।
আমাদের শহর নগরে দোকানের নাম, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম, বিভিন্ন সাইনবোর্ড, বিলবোর্ডে বেশির ভাগই অশুদ্ধ বানানে লেখা হয়। এগুলো দেখার কেউ আছে বলে হয় না। একুশের চেতনার কথা বলে সবাই জোর গলায়। দলে দলে প্রভাতফেরি করে শহীদ মিনারে ফুল দেয়া হয়। সারা বছর শহীদ মিনারে জুতা স্যান্ডেল পরে ওঠে। শুধু একুশে ফেব্রুয়ারির সময় জুতা খুলে ওঠার নিয়ম পালন করে দায় এড়াতে চায়। এটি কেমন কথা হলো! একুশের চেতনা কি শুধু একদিন বা একমাস থাকবে। নাকি সারা বছর থাকা উচিৎ। একুশের সত্যিকার চেতনা সবচেয়ে বেশি থাকা উচিৎ ভাষার উন্নতির দিকে। ভাষার শুদ্ধতার বিষয়টি আমাদের সবার মনে এবং চিন্তায় থাকতে হবে। এর আয়োজনও করতে হবে সবার জন্য। বিশেষ করে আমাদের কোমলমতি শিশু কিশোরদের জন্য এ ব্যবস্থা সহজ করা খুব জরুরি।

Share.

মন্তব্য করুন