বাংলাদেশের ইতিহাসের মতোই ডাকটিকিটের ইতিহাসও সংরক্ষিত রয়েছে। ডাকটিকিট সাধারণত চিঠি পাঠানোর খামে ব্যবহৃত হয়। যা ডাক মাসুল হিসেবে পরিচিত। নানা রঙ আর প্রতীকে সাজানো ডাকটিকিটে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, স্থান, কাল ইত্যাদি। চারকোণ আকৃতি ও পাশে খাঁজকাটা ছাড়াও ত্রিকোনাকার, গোলাকার, স্টারসহ বিভিন্ন আকৃতির কাগজের তৈরি ডাকটিকিট আমরা দেখতে পাই। কাগজ ছাড়াও কাঠের ফাইবার, সিনথেটিক কাপড়ের ডাকটিকিটও পাওয়া যায়। এটি শুধু বাংলাদেশে ব্যবহৃত এমন নয়। বরং বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই ডাকটিকিটের সফল ব্যবহার রয়েছে। ডাকটিকিটের মাধ্যমে একটি দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরা হয়। এ কারণে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে ডাকটিকিট প্রকাশ পায়। বছরের বিশেষ দিনগুলো স্মরণীয় করে রাখতেও ডাকবিভাগ এগুলো প্রকাশ করে থাকে।

পৃথিবীতে ডাকটিকিটের ইতিহাস প্রায় দু’শো বছরের। ১৮৩৭ সালে বৃটিশরাই সর্বপ্রথম ডাকমাশুল হিসেবে এই ডাকটিকিটের প্রচলন শুরু করে। সেটা একটু জটিল ছিল বটে। চিঠি প্রেরককে নয় বরং প্রাককেই এই ডাকমাশুল গুণতে হতো। ডাকমাশুল নির্ধারিত হতো চিঠির উপর নয়; চিঠির পাতার সংখ্যার ওপর। কিন্তু প্রাপক নানা ছল-ছুঁতো খুুঁজতো এবং ডাকমাশুল দিতে চাইতো না। কিন্তু বৃটিশ নাগরিক রোল্যান্ড হিল এসব সমস্যা দূর করতে সর্বপ্রথম ডাক বিভাগ সংস্কার করেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। তার মধ্যে অন্যতম ছিল ডাকটিকিটের প্রচলন। ১৮৪০ সালে তার সংস্কার অনুযায়ী প্রাপক নয় বরং প্রেরককেই ডাকমাশুল দেয়ার রীতি চালু হয়। তবে সেটা পাতার ভিত্তিতে নয় চিঠির ওজনের ভিত্তিতে। এ জন্য রোল্যান্ড হিলকে ডাকটিকিটের জনক বলা হয়। কিন্তু সেই ডাকটিকিট দেখতে এখনকার ডাকটিকিটের মতো রঙচঙা ছিলো না। ছিলো পুরো কালো রঙের। রঙের কারণে এর নাম হয়েছে ব্ল্যাক। এদিকে আবার সেই ডাকটিকিটের মূল্য এক পেনি নির্ধারিত হয়। এই দুয়ে মিলে টিকিটের নাম করণ করা হয় পেনি ব্ল্যাক। আর এই টিকিটের প্রথম প্রতিকৃতি হিসেবে অংকিত ছিল বৃটেনের রানী।

উপমহাদেশে প্রথম ডাকটিকিট
উপমহাদেশে সিন্ধু প্রদেশে প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশিত হয় ১৮৫২ সালের পহেলা জুলাই। ৫২ সালে চালু হলেও সিন্ধু প্রদেশ থেকে প্রকাশিত হওয়ায় বলা হয়: ১৮৫৪ সালের পহেলা অক্টোবর উপমহাদেশের প্রথম ডাকটিকিট চালু করা হয়। পরবর্তিতে সিন্ধু প্রদেশ পাকিস্তানভুক্ত হয়ে যায়। যার কারণে ভারতে প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশের তারিখ ধরা হয় ১৮৫৪ সালকে। এদিকে আবার ১৮৫২ সালে সিন্ধুতে যে ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়েছে তারও আগে ভারতে দুই রকম ডাকটিকিট ছিল। যা ১৮৫০ সালে কলকাতার টাকশালে ছাপানো হয়েছিল। এতে নকশা হিসেবে ছিলো সিংহ ও তালগাছের ছবি। এ থেকে বোঝা যায় ১৮৫০ সালে কালকাতার টাকশালে যে ডাকটিকিট ছাপা হয়েছিল তাই উপমহাদেশের প্রথম ডাকটিকিট। যদিও এ টিকিটগুলো শেষ পর্যন্ত আর চালানো হয়নি। ১৮৫২ সালের পহেলা জুলাই সিন্ধুতে যে টিকিট ছাপানো হয়েছিল তাতে লাল, সাদ ও নীল এবং একটি গোলাপি বেল্টের মাঝখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তীর আঁকা একটি নকশা ‘এম্বস্’ করে দেওয়া হতো। তাতে লেখা থাকত Scinde District Dawk  (সিন্ডে ডিসট্রিক্ট ডওক)। অইসব ডকাটিকিটের মূল্য ছিল দু’পয়সা।

বাংলাদেশে ডাকটিকিট ইতিহাসের সূচনা
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য জন স্টোনহাউসের পরামর্শে ১৯৭১ সালের এপ্রিলের শেষদিকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ডাকটিকিট প্রকাশের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। তাজউদ্দীন আহমদ ডাকটিকিটের নকশা করার দায়িত্ব দেন বৃটেন প্রবাসী পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি গ্রাফিক শিল্পী অধ্যাপক বিমান মল্লিককে। তিনি যথাসময়ে ডাকটিকিটের নকশা প্রস্তুত করে দেন। পরে সেগুলো লন্ডনের ফরম্যাট ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস থেকে ১৯৭১ সালের ২৯ শে জুলাই বাংলাদেশের প্রথম আটটি ডাকটিকিট ছাপানো হয়।

এই ৮টি ডাকটিকিট ও ফাস্ট ডে কাভার বিভিন্ন দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ উপলক্ষ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট একটি অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করে। সে সময় মুদ্রিত ডাকটিকিটগুলো ছিল ১০ পয়সা, ২০ পয়সা, ৫০ পয়সা, ১.০০ টাকা, ২.০০ টাকা, ৩.০০ টাকা, ৫.০০ টাকা এবং ১০.০০ টাকা মূল্যমানের।

Share.

মন্তব্য করুন