আমার কিশোর কাল কেটেছে গাঁয়ের বাড়িতে। আমাদের গাঁয়ের বাড়ি ফরিদপুর জেলার সালথা উপজেলায় খারদিয়া গ্রামে। আমরা বলি খায়েরদিয়া। এই খায়েরদিয়া গায়ের পশ্চিম মিয়া পাড়া আমার জন্মস্থান। কুমার নদীর পাড় ঘেঁষে এক্কেবারে কালির দোপ পর্যন্ত আমাদের বাড়ির একটানা সীমানা। এখন অবশ্য মাঝে মধ্যে দুয়েক ঘর বসত করছে কেউ কেউ। আমাদের বাড়ির চৌহদ্দি প্রায় বিশ বাইশ বিঘার জমিনে ঘেরা। সামনে খরস্রোতা কল কল্লোলিনী কুমার নদী। পাড় ঘেঁষে পাকা রাস্তা। এ সড়কটি আমাদের বাড়ির তিন দিক দিয়ে গিয়েছে। আমাদের বাড়িটি মিয়া বাড়ি হিসেবে খ্যাত। আমাদের স্থানীয় টাইটেল মিয়া। এই মিয়া বংশের নামকরণে মহল্লার নাম মিয়া পাড়া।
আমাদের পূর্বপুরুষ জমিদার ছিলেন কিন্তু তাদের মধ্যে একটি ধর্মীয় মোড়ক ছিলো। শান শওকত করে দালান কোঠা আমার পূর্বপুরুষেরা কেউ করেননি। তাঁদের কেউ কেউ ছিলেন আধ্যাত্মিক মধ্যপন্থী জমিদার শ্রেণীর।
বাড়িতে পাকা ইটের ঘর না তোলার একটা কুসংস্কার ছিল। তবে আমাদের বাড়িতে ছোট বড়ো ঘর দরোজা ছিলো বেশ। আলাদা কাচারি ঘর, মসজিদ, স্কুল, পাঠশালা, মক্তব রয়েছে আমাদের বাড়ির জমিনে।
আমার বাবা কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন। তার চাল চলনে ছিলো জমিদারি, সম্ভ্রান্ত রাশভারি ভাব। এলাকার হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে তাকে খুব শ্রদ্ধা করতো। শেষ জীবনে তাঁকে সুফি সাধকের মতো জীবন চালাতে দেখেছি। আমি আমার মা বাবার জ্যেষ্ঠ সন্তান। আমার বাবা আমাদের বাড়িতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। নাম ছিলো ওয়াকিদুন্নেছা প্রাথমিক বিদ্যালয়। এটি দাদীর নামে স্থাপন করেছিলেন বাবা। পরবর্তীতে এ স্কুলের নাম পরিবর্তন করে মহল্লার নামে নামকরণ করা হয়। এখন এর নাম খারদিয়া পশ্চিম মিয়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। আমি এ স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। এরপর পার্শ্ববর্তী শ্রীনগর প্রাইমারি বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছি।
আমাদের বাড়ির চারপাশে নিবিড় গাছগাছালির মৌ-মুগ্ধতা। নারকেল বাগান, সুপারি, আম, জাম কাঁঠাল লিচুর ঘন বন বিহারিতে মন জুড়িয়ে যায়। স্কুল পেরিয়ে নদীর পাড়ে চরের ওপর আমাদের মেহগনি, শাল বন, তার পাশেই খেজুর বীথি আর আম, লিচুর বড়ো বাগান। তারপর দোয়ালের দিগন্ত বিসারী ধানক্ষেত। এখানের ৯০% জমিই আমাদের। আমি কিশোর বয়সে এসব স্থানে ঘুরে বেড়াতাম। আমাদের বাড়ির পিছনে পুকুর। পুকুরের চার পাড়ে নারকেল গাছ, বরই গাছ, জাম গাছের হাতছানি আমাকে নিবিড় ভাবে টানতো। পুকুরের পাড়ের নিচে পুব, দক্ষিণ উত্তরে আছে আম, সুপারি বাগান আর তার ফাঁকে ফাঁকে আমার পিতার নির্দেশে লাগানো হয়েছিল, রজনীগন্ধা, টগর, জুঁই, বেলি আর হাসনাহেনার গাছ। আহ্ কী খোশবু ছিলো সেই বাগান বাড়ির বাতাসে। আমি প্রায় সময় লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে এখানে এসে ফুলের সুবাস নিতাম। বুক ভর্তি করে সুগন্ধি সুবাসে ফুসফুস ফুরফুরে করে নিতাম। মনের আনন্দে সেই বালক বয়সে ছড়া কবিতা লিখতাম।

দুই.
আমার নানা আমাকে শৈশব কালে দুটি বই উপহার দিয়েছিলেন। একটির নাম -‘বালক নূর’ এবং অন্যটির নাম ‘বাল্যবোধ’। বই দুটোই ছিলো চমৎকার নীতিকথা আর শিশুতোষ ছড়া কবিতায় ভরপুর। আমার নানা তার বাড়িতে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষকতা করতেন। পরবর্তীতে এটি খারদিয়া হাটখোলাতে সরিয়ে নেওয়া হয়।
আমাদের বাড়িতে বাবা কাচারি ঘরে সন্ধ্যার সময়ে একটি বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র চালু করেন। এখানে মহল্লার নিরক্ষর লোকদের অক্ষর জ্ঞান এবং কোরআন শিক্ষা দেওয়া হতো। সকালে আমাদের বাড়ির মসজিদে ছোট ছেলেমেয়েদের মক্তব খোলা হলো। এখানে ছোটদের সিপারা, ও কোরআন শরীফ পড়ানো হতো। একাজে আমাদের বাড়িতে একজন মৌলভী শিক্ষক বা হুজুর রাখা হয়েছিল। আমি ছোট বেলা থেকে দেখেছি আমাদের বাড়িতে পরপর কয়েক জন মৌলভী শিক্ষক এবং স্কুলের অন্য শিক্ষক জায়গির থাকতেন। আমরা ভাই বোনেরা আলাদা ভাবে মৌলভী শিক্ষকের কাছে কোরআন শরীফসহ অন্যান্য ধর্মীয় বই পুস্তক পড়েছি। বালক বয়সে আমি কোরআন খতম করেছি।
বাড়ির জামে মসজিদে আমাকে বালক বয়সেই নিয়মিত ভাবে জামাতে নামাজ পড়তে হতো। বাবা বাড়িতে না থাকলে কখনো কখনো জামাতে নামাজ না পড়ে বাইরে কোথাও চলে যেতাম। আসলে তখন নামাজ আমার জন্য ফরজ হয়নি। নামাজের গুরুত্ব বুঝতাম না। বাবার ভয়ে অনেক সময় নামাজ পড়তাম। নামাজ না পড়লে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেওয়ার কড়া হুকুম ছিলো বাবার।
আমি ক্লাসের ফার্স্ট বয় ছিলাম। আমার সহপাঠী ছিলো আমার বোন হামিদা, চরপাড়ার ইউনুস, হারুন, আমাদের মহল্লার আবদুল বাকী, মধ্য মহল্লার আবদুল মজিদ, মজিবর, বিশ্বাস বাড়ির নৃপেন বিশ্বাস প্রমুখ।
আমাদের স্কুলের শিক্ষক ছিলেন মৌলভী সুলতান আহমদ, নাজিমউদ্দীন মুনসী, মজিবর রহমান, পরবর্তীতে ছিলেন ধীরেন্দ্র গুহ। এরপর আমি কুমার নদী পার হয়ে শ্রীনগর প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হই। এই স্কুল এলাকার মধ্যে একটি নামকরা ভালো স্কুল ছিলো। স্কুলটি তখন ছিলো রামকানাই সাহা বাবু বাড়ির দেউড়িতে।
এ স্কুলের দ্বিতীয় প্রধান শিক্ষক ছিলেন আমার বাবা। আমার বাবা এই স্কুলটিকে নিজ চেষ্টায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করেছিলেন সেই প্রাক-পাকিস্তান আমলে। আমার বাবা স্বেচ্ছায় অবৈতনিক শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি বেতন নেওয়া পছন্দ করতেন না।
আমি ১৯৬৫ সনের দিকে এই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলাম। তখন এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন বাবু অনাথ
বন্ধু কর্মকার, সহকারী শিক্ষক ছিলেন অতুল চন্দ্র খা, হরিপদ ভট্টাচার্য আর মজিবুর রহমান স্যার। আমি বরাবর ক্লাসে রেকর্ড মার্ক পেয়ে ফার্স্ট হতাম। পঞ্চম শ্রেণীতে আমি বাংলায় ৯৬, অংকে ১০০, ইংরেজিতে ৯৮, সমাজ পাঠে, বিজ্ঞানে ৯০ এর ওপরে এবং ইসলামিয়াতে ১০০ নম্বর পেয়েছিলাম। আমার থেকে শত মার্কের দূরে ছিলো দ্বিতীয় স্থান অধিকারী হারুন রশীদ। তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিল আমার অন্যতম বন্ধু সুশীল কুমার কর্মকার।
হেডস্যার আমার বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলে খুশি হয়ে গোল্ডেন পেন উপহার দিয়েছিলেন। তিনি আমার সম্পর্কে ছাত্র শিক্ষক সাধারণ মিটিংয়ে বেশ প্রশংসা করেছিলেন। এই ঘটনাটি আমাকে উজ্জীবিত করেছিলো আরও বড়ো হতে।
তখন আমাদের সহপাঠীদের মধ্যে শতকরা ৯০ জন ছিলো হিন্দু সম্প্রদায়ের। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে ছিলো সুশীল কর্মকার, নিমাই দত্ত, ধলা দত্ত, বিনয় পোদ্দার, অপূর্ব খা, করুনা রাণী খা, ভোলানাথ, কালাবুড়ী, হারুনর রশীদ, মজিবর সরদার, জিয়াউর রহমান খোন্দকার, মিলন বেগম প্রমুখ।

তিন.
আমার বাবার প্রতিষ্ঠিত স্কুলে যে নামতা পড়েছিলাম তা এখনো কানে বাজে। স্কুলের পড়া শেষ হলে সব ক্লাসের ছাত্র ছাত্রীদের বারান্দায় দাঁড় করিয়ে শতকিয়া নামতা মুখস্থ করানো হতো কোরাস গানের সুরে সুরে।
‘বল বীর
বল উন্নত মম শির’
যেন।
শতকিয়ার কয়েক পঙক্তি –
এক -এ চন্দ্র, দুই -এ দ্বি-পক্ষ, তিন-এ ত্রি-নেত্র, চার-এ চতুর- বেদ, পাঁচ -এ পঞ্চবান,
ছয়-এ ষড়ঋতু, সাত-এ সাত সমুদ্র, আট-এ অষ্ট বসু, নয়-এ নবগ্রহ, দশ-এ দশের দিক।
এগুলো পড়াতেন আমাদের বাড়ির জামে মসজিদের খতিব, অত্র স্কুলের শিক্ষক সুলতান আহমদ।
তিনি মসজিদে, বাড়িতে বাড়িতে মিলাদ পড়াতেন আবার সনাতনধর্ম মিশ্র এই কোরাসও সুরে সুরে মুখস্থ করাতেন!
আমার কিশোর বেলা এমন এক সর্বধর্ম সহাবস্থানের শিক্ষায় উদ্ভাসিত হয়েছিল। তবে একটি চয়ন তিন-এ, ত্রিনেত্র। এই ত্রিনেত্র বা তৃতীয় নয়ন, কোথায় তা সেদিন খুঁজে না পেলেও আজ তার সন্ধানে বিপুল ব্যাপৃত। শ্রীনগর প্রাইমারি স্কুলের ৯০% বেশি হিন্দু ধর্মমতের ছাত্রছাত্রীরা রইলেও আমার একটা আলাদা মর্যাদা ছিলো। আমার বাবা এলাকার প্রভাবশালী সম্ভ্রান্ত বিজ্ঞজন তদুপরি আমি ক্লাসের ফার্স্ট বয় হওয়ার কারণে একটু বেশি আদৃত ছিলাম।
ছাত্রছাত্রীসহ প্রিয় শিক্ষকবৃন্দ আমাকে খুব স্নেহ করতেন। অনেকে আমাকে সমীহ করে চলতো। আমি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার সাথে খোলা দিলে মিশতাম। এলাকার হিন্দু ধর্মমতের ছেলেমেয়েরা একটু বেশি সংস্কৃতিবান হওয়ায় তারা আমার খুব প্রিয় ছিলো। সহপাঠীদের মধ্যে সুশীল কর্মকার আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলো। স্থানীয় বাজারে তাদের একটি জুয়েলারি দোকান ছিলো। সে আমাকে তাদের দোকান থেকে সোনার আংটি, বিভিন্ন রকম রুপার মেডেল উপহার দিতো। আমাকে সেগুলো নিতে হতো গোপনে গোপনে। অন্য ক্লাসমেটরা যাতে না জানে, সে জন্য কাউকে বলা নিষেধ ছিলো তার। উপহার সামগ্রী না নিলে আমাকে তার চোখ রাঙানি খেতে হতো। আমি সুশীলের আবাল্য-বন্ধুত্বের সেতুবন্ধ ছিন্ন করতে পারতাম না। ওদের দোকানে, ওদের বাড়িতে কাকীমার হাতে অনেক খেয়েছি।
আমার বাবার বন্ধু ছিলেন ডাক্তার মুকুন্দ লাল সাহা। বাজারের নামকরা ডাক্তার এবং এলাকার প্রভাবশালী লোক।
আমাকে বাবার কথামতো তার চেম্বারে হাজিরা দিতে হতো। আমরা তাকে মামা ডাকতাম। তিনিও আমার লেখাপড়ার খোঁজখবর নিতেন। তাদের বাসায়ও মাঝে মধ্যে নাশতা করা লাগতো। নইলে বাবার কাছে নালিশ যেতো।
তখন ছিলো কাঁচা রাস্তা, পায়ে চলা মেঠোপথ! বাড়ি থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে ছিলো শ্রীনগর প্রাইমারি স্কুল। গ্রামের বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম। মর্নিং স্কুল হতো ষাট দশকে। মার্চ, এপ্রিল মাসে সকাল সাতটায় ক্লাস শুরু হতো। আমি আর আবদুল বাকী মিয়া তখন এক সাথে স্কুলে যেতাম। মা আমাদের দুধ আম, আবার কখনো দুধে ভিজানো আমসত্ত্ব দিয়ে ভাত মাখিয়ে দিতেন। স্বাদের খাবার গোগ্রাসে খেয়ে আমাদের ঘাটের বাঁশের সাঁকো পার হয়ে শেখপুরা, ময়েনদিয়া মাঠ আর ঘন জঙ্গলময় বাঁশঝাড় পাড়ি দিয়ে বাজার পেরিয়ে স্কুলে যেতাম।
এখন কুমার নদীর ওপর আমাদের স্কুলের ঘাটে পাকা ব্রিজ, আর পাকা সড়ক চলে গেছে স্কুলের পাশ ঘেঁষে।

চার.
আমার বাবা যেমন ছিলেন কড়া মেজাজি, তেমন ছিলেন বিনম্র অপত্যস্নেহের রেশমি পরশ। আমাদের কড়া শাসনে নিয়মের গ-িতে গড়ে তুলেছিলেন। আমাদের বাড়িতে নিয়মিত পুরুষ ও মহিলা কর্মী ছিলেন পাঁচ ছয় জন।
ফসলি মৌসুমে এ সংখ্যা ৫০-৬০ জনের মতো হতো। আমাদের বাড়ির পুরুষ কর্মী ছিলেন, খলিল সেখ, আমিন উদ্দিন, সাত্তার ও পান্নু। এদের মধ্যে সাত্তার ও পান্নু আমার বয়সের বড়ো, ছোট হবে। অন্যেরা ছিলেন বয়সে আমার বেশ বড়ো।
বাজারে বা অন্য কোথাও বেড়াতে গেলে এরা সর্বদা আমার সাথে থাকতো। স্কুল থেকে এলে নদীতে গোসল করার সময় সাত্তার আমার সাথে থাকতো। নদীর পানিতে যাতে বেশিক্ষণ গোসল না করি কিংবা কোন নোংরা ছেলেপেলেরা যাতে আমার সাথে না মেশে সে খবরদারির কাজ ছিলো তার।
দুপুর বেলা ঠিক সময়ে খাবার খেয়ে সুবোধ বালকের মতো লিখতে পড়তে হতো। আমি আমাদের পশ্চিমের ঘরে, আবার কখনো দোতলা ঘরে আমার রুমে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করতাম। আব্বা পড়ার নির্দেশ দিয়ে নিজের পড়ার টেবিলে ইংরেজি সাহিত্য, কখনো সাহিত্য পত্রিকা, আবার কখনো কোরআনের তফসির অধ্যয়ন করতেন।
আমার লেখাপড়ার তদারকি করতেন আমার স্নেহমহী মা। উল্লেখ্য, আমার কোন প্রাইভেট টিউটর ছিলো না। স্কুলের শিক্ষকবৃন্দ যা পড়াতেন এবং যে নির্দেশনা দিতেন তাতেই আমার লেখাপড়া চলে যেতো। আমি নিজে নিজেই গণিতসহ অন্যান্য বিষয় অধ্যয়ন করতাম। কেবল মাঝে মধ্যে আব্বা আমাকে ইংরেজি পড়াতেন।
ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত আমার বাবাই আমাকে ইংরেজি আয়ত্ত করার কৌশল, গ্রামার শিখাতেন।
বিকেলে আসর নামাজ বাদে মাঠে ফুটবল, দাঁড়িয়াবান্ধা, ছি বুড়ী বা ছি কুত কুত খেলতে যেতাম।
খেলা শেষ করে মা আমাকে এক গ্লাস গরুর দুধ, আবার কখনো ছানার গোল্লা এবং ডিমপোস খেতে দিতেন।
এগুলো ঠিক মতো খেয়েছি কি না তার হিসাব দিতে হতো বাবাকে। তার কড়া হুকুমে আমরা ভাই বোনেরা বিকেলের এই নাশতা খেতে বাধ্য হতাম। সকালে ফজর নামাজ পড়ে বৈঠক খানায় আবার কখনো কখনো নিজের রুমে ব্যায়াম করতে হতো। এটাও বাবার নির্দেশ ছিলো। সাত্তার, আমার এই দৈনন্দিন কাজের ফিরিস্তি বয়ান করতো বাবার কাছে।
আবার কখনো কখনো নিজের কাজের বর্ণনা দিতে হতো বাবার কাছে। পড়ালেখার জন্য আমি কখনো মা-বাবার চোখ রাঙানি শুনিনি। বরং খেলা বাদ দিয়ে একটানা সন্ধ্যা পর্যন্ত লেখাপড়া করলে আমি কখনো কখনো আব্বার ধমক শুনতাম। আমি সারাদিন ১২-১৪ ঘণ্টা লেখাপড়া করতে পারি। এখনো এই বয়সে এ অভ্যাসটি রয়েছে।
মাঝে মধ্যে বিনোদনের জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং গ্রাম্যমেলা বা আড়ং, নৌকাবাইচ, ঘোড়দৌড় দেখেছি।

পাঁচ.
আমার বাবা শুধু আমার লেখাপড়ার জন্য তদারকি করেননি বরং আমার শরীর গঠন, খেলাধুলার জন্যও খুব খেয়াল রেখেছেন।
আমার বাবা ফরিদপুর জেলা স্কুলের ছাত্র ছিলেন সেই ব্রিটিশ আমলে। ভালো ছাত্র ছিলেন যেমন তেমনই ভালো হকি প্লেয়ার এবং ফুটবল প্লেয়ার ছিলেন। তিনি ছিলেন সুঠাম শরীরের গৌরবর্ণের সুপুরুষ। ফরিদপুর জেলার নামকরা বক্সিং প্লেয়ার এবং কুস্তিগিরও ছিলেন বটে। তিনি ছাত্র বয়সে নিয়মিত শরীর চর্চা ও ব্যায়াম করতেন। খেলাধুলা করতেন। এ জন্য তিনি চাইতেন আমিও তাকে অনুসরণ করি। বাবার মতো আমি ভালো ছাত্র হতে চাইলেও খেলার প্রতি আমার ঝোঁক তেমন বেশি ছিলো না।
আমি পাঠ্যপুস্তক পড়ার পাশাপাশি অন্য বইপত্র বিশেষ করে কবিতা, গল্প, উপন্যাস পড়তে বেশি আগ্রহী ছিলাম। বাড়িতে বাবার টেবিলে এবং বুকশেলফে বিভিন্ন বই পুস্তক ছিলো। আমি বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সেই কিশোর বয়সে সেগুলো পড়ে আনন্দ পেতাম। বিকেলবেলা আমাকে বাধ্য হয়ে বাড়ির স্কুলের খেলার মাঠে আবার কখনো মহল্লার চরের ওপর খেলার মাঠে যেতে হতো। অবাক কা- আমার মধ্য বয়সী রাশভারি পিতাকেও সেখানে মাঝে মধ্যে ফুটবল খেলতে দেখেছি। মহল্লার ছোট বড়ো বিভিন্ন বয়সী লোকেরা হা-ডু-ডু খেলতো, দাঁড়িয়াবান্ধা খেলতো। আমি কখনো হা-ডু-ডু খেলিনি। তবে সমবয়সী ছেলেদের সাথে দাঁড়িয়াবান্ধা খেলেছি কখনো কখনো। আবার কখনো শুধু দর্শকের সারিতে থেকে বিভিন্ন রকম খেলা উপভোগ করেছি।
ডাংগুলি এবং মার্বেল খেলা আমাদের ছেলেবেলার জনপ্রিয় খেলা ছিলো। এখন এ খেলা গ্রাম বাংলায় নেই। এখন সেখানে চলছে ত্রিকেট খেলা, ফুটবল খেলা তবে কখনো কখনো হা-ডু-ডু দেখা যায়। আমার প্রিয় খেলা ছিলো দাঁড়িয়াবান্ধা এবং ছি বুড়ী বা ছি কুত কুত। ছি কুত কুত মেয়েদের খেলা কিন্তু আমাদের ছেলেবেলায় ছেলেরাও এ খেলা খেলতো। আমি ভেতর বাড়ির উঠোনে বড়ো বোনদের, ছোট বোনদের সাথে ছি কুত কুত খেলেছি। সে খেলায় একটা অম্লমধুর সুখকর স্মৃতি ছিলো।
একটু ভুল হলে বা দম দিয়ে ছি বুড়ীর বৌ কে ছুঁতে না পারলে বড়ো বোনদের কিল হজম করতে হতো ছি কুত কুত নিয়ে কিশোর বেলায় কি লিখেছিলাম তা সব মনে নেই।
কাছাকাছি একটা ছড়া তো লেখা যায়-
ছি কুত কুত ছি
মৌমাছিদের ঝি।
কামড়ে দিলে হুল ফোটাবো
মধু চুরির ঝাল উঠাবো।
ছি কুত কুত ছি
কানা বুড়ির ঝি,
কানা বুড়ি আসলো তেড়ে
ঘর সামলা আগে বেড়ে।
লেখাপড়ার পাশাপাশি যেমন খেলাধুলায় অংশ নিতে আব্বা আমাকে উৎসাহিত করতেন তদ্রƒপ এলাকার নৌকা বাইচ, গ্রাম্যমেলা বা আড়ং এবং ঘোড়দৌড় দেখতে অনুপ্রাণিত করতেন।
আমার ছোটবেলায় আমাদের গ্রামের ডাঙ্গী নামক দুই কিলোমিটারের লম্বা, তিনশো ফুটের ওপরে চওড়া এবং তিন ফুটের ওপরে উঁচু ময়দান সদৃশ স্থানে ঘোড়দৌড় হতো। আড়ং হতো সেখানের বটতলায়।
আমি আমাদের কর্ম সহযোগী, সাত্তার, আবার কখনো কখনো মুজাম ফকিরের সাথে সেই মেলায় যেতাম। আমার বাবা এসব আড়ং বা মেলা এবং হাটবাজারে কম যেতেন।
আশ্বিন কার্তিক মাসে আমাদের কুমার নদীতে নৌকা বাইচ হতো। আমাদের গ্রামের পশ্চিম দক্ষিণ দিকে নদীর ওপারের বঙ্গরাইল গ্রামের ঘোষের বাগানের ঘাট থেকে আমাদের বাড়ি নতুন গাঙের মুখ এই দুই কিলোমিটার নদীর ওপর নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হতো। বাইচ শেষে ঘোষের বাগানের বিশাল আমবাগানে প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার প্রদান করা হতো। এ উপলক্ষে বিরাট আম্রকাননে মেলা বসতো। মেলায় রকমারি জিনিসপত্র, খেলনাসামগ্রী, গৃহস্থালির নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, চুড়ি, ফিতাসহ নারীদের সৌন্দর্য সামগ্রীর পসরা সাজিয়ে, কৃষিপণ্য নিয়ে বেচাবিক্রির বিরাট আয়োজন হতো।
আমাকে আকর্ষণ করতো, মনোহরা সাজে সজ্জিত, ময়ূরপঙ্খি সদৃশ নৌকার বাইচ বা নৌকা দৌড় আর সেই নৌকার বাহারি সাজের মাঝি মাল্লার জারি সারি গান আর ‘সংধরার’ বাহারি নৃত্য।

নৌকা বাইচের ছন্দবদ্ধ ছড়া-গান এখনো আমার কর্ণকুহরে বেজে ওঠে-
‘হিয়াব্বোল বাইছের নাও
জল-কাইচা নাও রে আমার
ময়ূরপঙ্খি নাও,
চোখের পলকে তুমি উইড়া উইড়া যাও,
সব্বাইকে পিছে ফেলে সামনে চলে যাও।
জল কাইচা নাওরে আমার
ময়ূরপঙ্খি নাও,
উজান ভাটির বাও-কুড়ালি
তুড়ি মাইরা যাও।
হিয়াব্বোল বাইছের নাও
জল কাইচা নাওরে আমার সাধের বাইছের নাও।

Share.

মন্তব্য করুন