ফেব্রুয়ারি মাস হলো আমাদের ভাষার মাস। বাংলা ভাষার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামের মাস প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি পুরো মাস জুড়ে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বইমেলা। এ বইমেলার সমস্ত আয়োজন করে থাকে বাংলা একাডেমি। প্রকাশক সমিতি এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এ মেলা আয়োজনে সাহায্য করে থাকে। এখানে সাড়ে ৬ শ থেকে সাতশত প্রকাশনী তাদের স্টল নিয়ে হাজির থাকেন প্রতিটি মেলায়। একসময় প্রকাশক বা প্রকাশনীর উপস্থিতির সংখ্যা এত এত ছিলো না। আস্তে আস্তে বছর বছর করে প্রকাশনীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাড়তে বাড়তে এখন সংখ্যা দাড়িয়েছে সাত শ এর মতো। অবশ্য অংশ গ্রহণ করার জন্য আবেদন পড়ে আরও অনেক বেশি। মেলা আয়োজন কমিটি বিভিন্ন কারণে সব প্রকাশনীর আবেদন মঞ্জুর করে না। ফলে আবেদন যত প্রকাশনী করে অংশ গ্রহণ তার চেয়ে কিছুটা কম হয়। তাতেই সাড়ে ৬ শ থেকে ৭ শত স্টল হয়ে যায়। বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার নতুন বই প্রকাশিত হয়। এবার অবশ্য কাগজের দাম অনেক অনেক বেশি। বেশি মানে আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। ফলে বইয়ের মূল্য বেড়ে যাবে বহুগুণ। এত খরচ করে বই করবে কিনা প্রকাশকগণ এটি একটি প্রশ্ন নিশ্চয়! করলেও সংখ্যায় হয় তো আগের মতো অত বেশি হবে বলে মনে হয় না। তাই হয় তো এবার অন্য সময়ের তুলনায় বইয়ের সংখ্যা কম হতেও পারে। তবুও প্রকাশকেরা ব্যস্ত তাদের কর্মযজ্ঞ নিয়ে। বই গোছগাছ এবং ছাপা বাঁধাই নিয়ে সারাক্ষণ সময় কাটছে তাদের।
নতুন বই প্রকাশ হয় যেগুলো এর মধ্যে কবিতার বই, উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, ভ্রমণ কাহিনি, গবেষণা ধর্মী, অনুবাদ, কার্টুন, বিজ্ঞান, ইতিহাস ইত্যাদি বিষয় থাকে। ছোটদের বইয়ের সংখ্যাও খুব কম হয় না কিন্তু। বড়দের তো আছেই এবং হয়ই।
বইমেলা আগে একসময় হতো বাংলা একাডেমির নিজস্ব জায়গায়। একাডেমির মাঠেই হতো এ মেলার আয়োজন। কিন্তু মাঠের জায়গাটি প্রয়োজনের তুলনায় খুব খুব ছোট। তাই খুব বেশি প্রকাশনা সংস্থা অংশ গ্রহণ করতে পারতো না। আবার যারা অংশ গ্রহণ করতো তাদের স্টলের সাইজও অনেক অনেক ছোট ছিলো। ছোট স্টলে অল্প কিছু বই নিয়ে বসতে হতো প্রকাশকদের। যারা বই কিনতে আসতো তারাও মনের মতো বইগুলো খুঁজে নিতে অনেক অসুবিধার মধ্যে পড়ে যেতো। ফলে প্রকাশক এবং পাঠক মিলে উভয়েরই সমস্যা হতো অনেকটা।
কবি সাহিত্যিক লেখক এবং বেশির ভাগ প্রকাশকের দাবী ছিলো – মেলাটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজন করা হোক। যেহেতু বাংলা একাডেমির সামনেই, রাস্তার ওপারেও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। সেহেতু উদ্যানের বড় জায়গায় আয়োজন করা যায় মেলাটর। একসময় এ দাবীটি অনুমোদন হলো সরকারের তরফ থেকে। ফলে শুরু হলো বইমেলা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বইমেলা পেলো নতুন একরূপ। এর আয়তন হয়ে গেলো বিশাল থেকে বিশালতর। যেহেতু বড় জায়গায় মেলা তাই মেলায় প্রকাশকদের উপস্থিতিও বাড়তে লাগলো। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যাও বাড়তে লাগলো প্রচুর। একইসাথে পাঠকদের উপস্থিতিও বেড়ে গেলো বহু বহুগুণ।
বইমেলা হলো লেখক পাঠক প্রকাশকের মেলবন্ধনের এক সুন্দর মেলা। এখানে লেখকেরা নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রকাশকও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। একইসাথে পাঠকও গুরুত্বপূর্ণ অনেক। লেখক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ তো আমাদের সকলেরই জানা। কারণ একজন লেখক বই না লিখলে কীভাবে হবে বইটি। আবার লেখক বইটি লিখলেন খুব ভালো করে, মান বজায় রেখে। কিন্তু বইটি ছাপা হলো না কোনোভাবেই। প্রকাশক বই ছাপার কোনো উদ্যোগ নিলেন না। তাহলে কী হবে অবস্থাটা! বই কে কোথায় পাবে কেমন করে পাবে!
ঠিক একইভাবে লেখক শ্রম এবং মেধা খাটিয়ে লিখলেন বই। প্রকাশক ছাপলেনও খুব সুন্দর করে, মজবুত বাঁধাই, দামী কাগজ ইত্যাদি দিয়ে। কিন্তু পাঠক কিনলো না বইটি। তাহলেও সমস্যার শেষ হলো না। এখন বিষয়টি এই দাঁড়ালো যে- লেখক বইটি লিখবেন প্রকাশক সুন্দর করে ছাপবেন এবং পাঠক বইটি কিনবেন। এই তিনের সমন্বয়ে দাড়াবে বা প্রস্তুত হবে একটি বই। তবেই একটি পরিপূর্ণ মেলার আয়োজন আমরা পাবো।
বই হলো জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু এবং গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গী। একটি ভালো বই একজন মানুষের শ্রেষ্ঠ সঙ্গী হতে পারে যদি তিনি বইয়ের গুরুত্ব বুঝতে পারেন। একটি ভালো বই সঙ্গে থাকলে কেউ একাকীত্ব অনুভব করবে না এবং একাকীত্ব অনুভব করতে পারে না। কারণ তার বইটিই তাকে সঙ্গ দেবে বা বইটিই তার একান্ত সঙ্গী হয়ে উঠবে। একটি ভালো বই একজন মানুষের জীবন বদলে দেয়ার জন্য বিরাট কাজ করতে পারে। একটি বই একজন ছাত্র বা ব্যক্তির জীবন গঠন করে দিতে পারে বলে বিশ্বাস করা যায়। আবার একটি জীবনকে বদলেও দিতে পারে।
আমরা জানি বইয়ের ভেতর ঘুমিয়ে থাকে অতীত ও ভবিষ্যত। অতীতের ইতিহাস এবং স্মৃতির সবকিছু বইয়ের পাতায় থাকে। অতীত মানেই তো জীবনের সবকিছুর একটি যোগফল। বই সেই যোগফল সামনে তুলে ধরে। একজন পাঠক বই থেকে তার জীবনের জন্য অনেক কিছু খুঁজে নিতে পারে যা তার জীবনকে উন্নত করবে। বইয়ের ভেতর ঘুমিয়ে থাকে একটি দেশ ও জাতির ইতিহাস। শুধু একটি জাতির কেনো বলি- আসলে হতে পারে পৃথিবীর ইতিহাসও লুকিয়ে থাকে এ বইয়ের বুকে।
সে বইটি যদি কারো হাতে থাকে বা কারো সঙ্গে থাকে তো তার জীবনের জন্য এটি একটি বিরাট বিষয় হতে পারে। পড়ে পড়ে সে পৃথিবীর অনেক কিছু জানবে। পৃথিবীর মানুষ ও মানুষের চরিত্র সম্পর্কে জানবে এবং নিজেকেও জানবে অত্যন্ত গভীর থেকে আরও আরও গভীরে গিয়ে।
একুশের বইমেলা থেকে একরকম গুরুত্বপূর্ণ বই বাছাই করে সংগ্রহ করা জরুরি বলে আমরা মনে করি। এমন বই কিনে আনা উচিৎ যে বই পড়লে আনন্দ তো পাবেই আবার যেনো নতুন স্বপ্নও জেগে ওঠে। মন এবং মনের জগৎ যেনো বড় এবং বড় হয়ে ওঠে। কতরকমের কত বিষয়ের বই লেখা হয় তার তো কোনো হিসাব নেই। যার যে বিষয় পছন্দ সে বিষয়ের বই সংগ্রহ করলে পড়তে মজা হবে নিশ্চয়। যে বিষয়ের প্রতি মনের আগ্রহ বা ইচ্ছা থাকে সে বিষয় পড়ার মজাই আলাদা অনুভব হয়। পড়ে পড়ে মনের জগৎ বড় করে তুলতে হবে। মনের জগৎ বড় হলে বড় স্বপ্ন জন্ম নিতে পারে। আর বড় মানুষ হওয়ার জন্য স্বপ্নও বড় বড় হতে হয়। বইমেলা আমাদের জীবনের সেই স্বপ্নকে অনেক অনেক বড় করে তোলে। বইমেলার গুরুত্বের কথা বলে সত্যি সত্যি শেষ করা যাবে না।

Share.

মন্তব্য করুন