গুলশান লেকের পশ্চিম পাশ ধরে বৈকালিন পরিবেশে হাঁটছে সুহা সাথে তার নানা। নানা দুইদিন আগে গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছেন। নানা বছরে দু’তিনবার সুহাদের বাসায় বেড়াতে আসেন। তিনদিন পার হলেই যাই যাই করে ফিরে যান। নানান রকম অজুহাত নানার। শহরের রাস্তার দু’পাশে ঘেষাঘেষি করে দাঁড়ানো দালানগুলো যেন তার মহাশত্রু। নানা বলেন, ‘দম বন্ধ হয়ে আসে, আকাশ দেখা যায় না, বাতাস জমাট বেঁধে বিষাক্ত হয়ে থাকে।’ খোলামেলা গ্রামের বাড়িতেই নাকি তার শান্তি, ঘরের বের হলেই গাছের সবুজের ফাঁকে ফাঁকে ধান খেত, সবজি খেত; এ বাড়ি ও বাড়ি দেখা যায়। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলেন, ‘আল্লাহ-এ আকাশ, এ বাতাস, এ প্রকৃতি, সবই তোমার দান।’
সুহার আম্মু সব বুঝতে পেরে বল্লেন, ‘যাওতো সুহা তোমার নানাকে নিয়ে লেকপাড় ঘুরে আস। আমি পিঠা তৈরি করছি- এসে দু’জনে খাবে।’
‘কী পিঠা বানাবে আম্মু’?
‘এখন বলবো না, তবে তোমার নানার পছন্দের পিঠাই বানাবো।’
ঠিক আছে দেখবো আজ নানার পছন্দের পিঠা কোন্টি! আমিও মজা করে খাবো।’
বাসা থেকে বের হতেই নানা বল্লেন, ‘দেখ, দেখ, সারা রাস্তায় বিদ্যুৎ টেলিফোনের খাম্বায় কেমন করে তার আর তার প্যাঁচানো। কোথাও পেঁচিয়ে রেখেছে, কোথাও ছিঁড়ে পড়ে আছে তারের মাথাগুলো, কোথাও দেখ কেমন ফাঁসের মতো গোল হয়ে মাথার কাছে ঝুলছে। যেন ফাঁদ পেতে রেখেছে মানুষ ধরার জন্য।’
সুহা বলে, ‘তাইতো বাবা সাবধান করে দিয়েছেন এসব ছেঁড়া তার এড়িয়ে যেতে। কোন্টা ইন্টারনেট, কোন্টা ডিস, কোন্টা টেলিফোন! কারেন্টের ছেঁড়া তারও থাকতে পারে।’
সুহা হাসতে হাসতে বলে, ‘খাম্বাগুলো যেন একেকটা কার্টুনের জটাবুড়ি। মাথার জটাচুল দিয়ে পুরো শহরটা যেন পেঁচিয়ে ধরেছে।’ নানা তাঁর মাত্র চারটে দাঁত বের করে হেসে বলেন, ‘ঠিকই বলেছ সুহা, একদিন এর জটাজালে তোমরাও আটকে যাবে, তারচেয়ে চলো নানাবাড়ি, কোনো জাল-জটা নেই। খোলামেলা আকাশ, শান্ত প্রকৃতি। নিজের শ্বাসের ধ্বনিও শুনতে পাবে।’
‘যেতে তো চাই, এখনতো আমাদের স্কুল ছুটি। আব্বুকে বলবো, অফিস থেকে লম্বা করে ছুটি নিতে’।
তোমাদের রাস্তাগুলোও কেমন। দেখ ভ্যান, রিকশা, মোটরসাইকেল গাড়িগুলো ফ্যাত ফ্যাত… সুহা কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলে, ‘কী বল্লে? আমাদের রাস্তা? রাস্তা আমাদের হবে কেন? রাস্তাতো…’
‘বুঝেছি, বলবে রাস্তা সরকারের। আমরা গ্রামের মানুষতো, গ্রামের সব রাস্তাকে নিজের মনে করি, ভালো লাগে-ভালোবাসি, আপন ভেবে বলি আমাদের রাস্তা, হি হি হি, নানার হাসি। লেকের পাড়ে এসে নানা-নাতিন খুব খুশি। লেকের পশ্চিমপাশ থেকে আকাশ দেখা যায়। টলমলে লেকের জল বাতাসে থির থির কাঁপছে। নানা আকাশে তাকিয়ে বলেন, ‘দেখ দেখ এক ঝাঁক বক কেমন করে উড়ে যাচ্ছে। ঐ দেখ আরেক ঝাঁক হাস, কেমন যেন একটা বাঁকানো ধনুক রেখা ওদের ওড়ার ছন্দে।’
‘তীরের ফলাও বলতে পার। কি সুন্দর ছন্দময় গতি যেন নীল আকাশের চলমান অলংকার-’
‘সত্যিইতো নানু, আসলে কখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি না। দেখবো কোথায়! আকাশওতো ‘আমাদের না’ ওর কন্ঠে অভিমান।
‘আকাশে, যে হাস উড়তে পারে কোনোদিন শুনিনি, তাই তো ওরা যে অতিথি পাখি। হাজার মাইল দূর থেকে উড়ে এসেছে, বইতে পড়েছি। ওরা আরেকটু এগিয়ে যায়। দাদু লেকের পাড়ে সাজনা গাছটার পেছনে থমকে যায়। ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে আস্তে করে বলেন, ‘সুহা চুপ, দেখ ঐ দিকে দেখ’
‘কী দেখেছো নানা, আমিতো কিছুই দেখছি না। কি দেখাবে তাইতো বল-’
‘একটা কানি বক।’
‘সেটা আবার কী’
‘ঐ যে লেকের পাড়ে খয়েরি ধরনের একগুচ্ছ পানা ভাসছে, তার ওপর দেখ কানি বকটা কেমন ঘাপটি মেরে আছে পুঁটি মাছের আশায়-’
‘কানি বকের ছাও…;’ হেসে ওঠে সুহা। নানা ‘চুপ’ বলে থামিয়ে দেন। ‘কথা বল্লে উড়ে যাবে। তুমি দেখছ?’
‘না দেখি নাইতো। হ্যাঁ হ্যাঁ এবার দেখেছি।’
‘এবার খেয়াল কর, ভাসমান পানার খয়েরি রঙের সাথে বকের গায়ের রং কেমন মিশে আছে। দু’টোর রঙই এক রকম। আবার দেখ, ভালো করে তাকাও বকটার এক হাত সামনে একটা মেনি মাছ পানিতে ডুবে আছে। নট নড়ন চড়ন-
‘মেনি মাছ কি নানা?’
‘পরে বলবো, আগে দেখে যাও। একটা গাছের ডাল পড়ে আছে পানিতে দেখেছ?’
দেখেছি নানা ঐ যে ঐটাতো? কিন্তু মেনি মাছ কোথায়?
‘ডালটার নিচে দুটো পচা আম পাতা পানিতে ডুবে আছে।’
পাতা দু’টো পচে কালচে হয়ে আছে
হ্যাঁ হ্যাঁ দেখেছি কিন্তু মেনি মাছ কোথায়?’
এবার মজা করে দেখ, দেখতো দু’টোই পচা আমপাতা মনে হয়, আসলে একটা আমপাতা আরেকটি মেনি মাছ-
‘কি করে বুঝলে?’
লক্ষ্য করো ভালোভাবে। মাছটি পাতার মতোই স্থির কিন্তু তার লেজ হালকা নড়ছে। নড়ছে মানে তার দেহের স্থিরতা আর ভারসাম্য রক্ষা করছে।’
এবার কি বুঝলে?
‘বুঝলাম, পাতার রঙের সাথে মিশে মাছটি, শিকারির দৃষ্টির আড়ালে থাকছে, ঐদিকে আবার কানা বগী, সরি বকটি পানার রঙের সাথে মিশে শিকারকে ধোঁকা দিচ্ছে।’
‘ধোঁকা নয় সুহামনি, এটা তার আহার সংগ্রহের কৌশল। প্রকৃতির দিকে ভালো করে তাকালে সৃষ্টির রহস্য এমনিভাবে জানতে পারবে। প্রতিটি প্রাণের মধ্যেই রহস্য রয়েছে নিজেকে বাঁচানোর জন্য, আবার খাবার সংগ্রহের জন্য।’
‘সত্যি দাদু, বকটার কি শিকারি বুদ্ধি, এদিকে মাছের, প্রাণ বাঁচানোর কৌশল ভাবতেই আশ্চর্য লাগে। আমিতো এতোসব ভাবিনি কখনো।’
‘আসলে সৃষ্টিকর্তার রহস্য জানার চেষ্টা করলে অনেক কিছু জানতে পারবে। এবার ফিরে যাওয়া যাক, তোমার মায়ের পান পিঠা এরিমধ্যে নিশ্চয় তৈরি হয়ে গেছে।’ নানা ঘরে ঢুকেই বলেন, ‘শাহান কোথায়? ওকে তো দেখছি না-’ সুহার আম্মু বলেন, ‘বাবা ওতো ঘুমিয়ে, উঠে যাবে এখুনি আপনি পিঠা খান। পানপিঠা আপনার পছন্দের। সুহাতো একটু অভিমানি স্বরে বলে, ‘আমিওতো পছন্দ করি।’
‘বেশতো খাও’ বলে সুহার আম্মু এক কাপ চা এনে বাবার হাতে দিয়ে মিটি মিটি হাসে। শাড়ির আঁচলটা কাঁধে টেনে বলে, ‘সুহা তুমি শুনো না আমরা বাপ-বেটি এখন কথা বলবো। সুহার নানা চায়ের কাপ ঠোঁটে তুলে নামিয়ে নেন। সুহা মন খারাপ করে উঠে যায়। সুহার আম্মু হেসে ওঠে বলেন, ‘হয়েছে মামনি যেতে হবে না। তোমার আব্বু রাজি হয়েছেন, এক সপ্তাহ পরেই আমরা তোমার নানা বাড়ি আর আমার বাবার বাড়ি যাব।’
সুহা, ‘হুররে’ বলে মাকে জড়িয়ে ধরে একদম কোলে বসে যায়। যেমনটি ছোট্টকালের সুহাটি। সুহার নানা হাসতে হাসতে বলেন, ‘তা হলে এতোদিনে তোমরা রাজি হলে? আমি কালই ফিরে যাব। দেশে তোমাদের জন্য এটা-সেটা ব্যবস্থা করতে হবে না? আরেকটি কথা, ইজানের আব্বুকে রাজি করিয়ে এক সাথে চলে এসো। খুব মজার সময় কাটবে আমাদের।’
সুহা যেন হাওয়াই মিষ্টি চটচট করে খেতে খেতে বলে, ‘খুব মজা হবে তাই না নানা।’
গত রাতে একটা মাইক্রো করে সুহার আব্বু, আম্মু, ইজানের আব্বু আম্মুসহ সবাই একসাথে গ্রামের বাড়ি এসেছে। এটা সুহার নানার বাড়ি আর ইজানের দাদার বাড়ি। সুহা ক্লাস ফাইভে ঢাকার আইডাল স্কুলে পড়ে, শাহানের বয়স চার হলেও এখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি, ইজানের বয়স সবে মাত্র তিন বছর।
বছর শেষে সুহার স্কুল ছুটিতে সবাই এক সাথে বাড়ি এসেছে মজা করতে। সুহার বাবা বল্লেন, ‘সপ্তাহ খানেক বাড়িতে থাকবেন।’ সুহার নানা বল্লেন, পুরো ছুটিটা মানে দুই সপ্তাহ থাকতে হবে।’ সকালে নানির হাতের তৈরি পিঠা খুব মজা করে খেয়েছে সুহা, শাহান। সুহা ছড়া কাটে, নানা-নানী ডাকে শাহান, দাদু-দাদা ডাকে ইজান, ফিক্ করে হেসে ওঠে সুহা।
ইজানের এসবে হিসেব নেই।
রাতে কাঁপা কাঁপা শীত পড়েছিল। নানু লেপ কম্বল ঘাড়ে তুলে বাইরে যাচ্ছেন রোদে দিতে, সুহার আম্মু আর ইজানের আম্মু সাহায্য করছে। ধবধবে সাদা মাটির উঠানের তিন পার্শ্বে লম্বা করে বাঁশ বাঁধা রয়েছে। বাঁশের ওপর কাঁথা কম্বল টাঙ্গিয়ে নানু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। রোদের গরম রাতভর কাঁথা কম্বলে ওম ধরে রাখবে। খুব মজা হবে শীতের রাতে ঘুমাতে।
সুহার নানা বাড়ির পশ্চিম পার্শ্বে পুকুর, পূর্ব পাশ্বে নারকেল সুপারির বাগান, বাড়ির সামনে পেঁপে গাছের সারি। উঠানের এক কোণে জবা, বেলী, আর গন্ধরাজ ফুলের বাগান। রাতভর মৌ মৌ ঘ্রাণে বেশ লাগছিল। কয়েকটা প্রজাপতি কাঁপা কাঁপা ডানায় ফুল গাছে বসছে আর ওড়ছে। সুহা একটু দূরে দাঁড়ানো। খুব মজা করে প্রজাপতির ডানার রঙ দেখছে। শাহান কোথা থেকে ছুটে এসে একটা প্রজাপতি ধরে ফেলে আরকি! সুহা ওকে আটকে দেয়। সুন্দর করে বলে, ‘শাহান ভাইয়া, ওদের ধরো না, দেখ না কি সুন্দর করে ওরা ওড়ছে। ওদের ডানার রঙ দেখ, কতো কতো রঙে ভরা ওদের ডানা। খুব সুন্দর তাই না-’
নানু, ডাকছেন, ‘সুহামনি তোমরা কোথায়?’
‘আসছি নানু বলে ইজানকে কোলে তুলে নেয় সুহা। কিন্তু ইজান ওর কোল গলিয়ে নিচে নেমে যায়। ও নিজে নিজেই হাঁটবে ভাবটা এমন। দু’চার কদম হেঁটে ও সামনে একটা খাদ দেখে বসে পড়ে। সুহা ওকে কোলে তুলে নিয়ে বাড়ির পেছন দিকে যায়।
সুহার চোখতো ছানাবড়া। এত সুন্দর লালশাকের বাগান, পাশ দিয়ে ফুলকপি, বাঁধাকপি সারি সারি লাগানো। লালশাকের ফাঁকে ফাঁকে ধনিয়া পাতার গাছ। সুহার নানা দুই মুঠো লালশাক তুলে গোড়া পেঁচিয়ে রেখেছেন হালকা খড় দিয়ে। ইজান এবার আর কোলে থাকতে চাইছে না। সুহার কোল থেকে নিজকে গলিয়ে ফুড়–ত করে নেমে যায়। খেতে নেমেই ছুটাছুটি শুরু করে। শাহান নানার সাথে বসে গেছে শাক তোলার জন্য। নানা ক’গাছি ধনিয়া পাতা তুলতেই ধনিয়া পাতার সুঘ্রাণে পুরো খেতের বাতাস যেন ভরে যায়।
সুহার কণ্ঠে অভিমান, ‘নানা আমাদের আগে ডাকনি কেন? আমরাও লালশাক তুলতাম। ইশ্ কি সুন্দর বাগান যেন লাল গালিচা।’ শাহান লালশাক তুলতে গিয়ে গাছের পাতা ছিঁড়ে ফেলে, দাদু ওকে দেখিয়ে দেন কিভাবে তুলতে হবে। ইজান লাফাতে লাফাতে খেতের মাঝখানে চলে যায়। নানা বলেন, সুহা দাঁড়িয়ে আছ কেন? লালশাক তুলে নাও। আমিতো জানি তুমি লালশাকের লাল ঝোল দিয়ে ভাত রাঙিয়ে খেতে পছন্দ কর। তোমার নানু পুঁটি মাছ দিয়ে রান্না করবে।’
ইজান লাফাতে লাফাতে খেতের আইলে পড়ে কান্না জুড়ে দেয়। সুহা ওকে কোলে তুলে কান্না থামিয়ে দেয়। সুহা সামনে একটা আম গাছের মাঝ ডালে একটা মৌমাছির চাক দেখে বলে, ‘নানা ঐ কালো থলেটা কীসের?’
‘সাবধান,’ ওদিকে যাবে না- ওটা মৌচাক।’ নানার চোখে সতর্ক দৃষ্টি
‘মৌচাক কি নানা?’
‘মৌমাছির বাসা। তোমরা যে মধু খাও। এ মৌচাক থেকেই সংগ্রহ করা হয়।’
‘মধু কোথায়? দেখছি নাতো। ’
‘বাইরে থেকে দেখা যায় না। ভালো করে দেখ হাজার হাজার মৌমাছি মৌচাক ঘিরে আছে। মৌচাকের ভেতর ছোট্ট ছোট্ট কুঠুরী আছে তাতেই মৌমাছিরা মধু জমা করে রাখে।’
‘মধু ওরা কার জন্য জমিয়ে রাখে?’
‘ওরা নিজেরা খায়, মানুষ মৌচাক কেটে-মধু বের করে, কেউ বিক্রি করে, কেউ খায়। জানতো মধু সুস্বাদু খাবার, মধুকে বলা হয় সর্বরোগের মহৌষধ।’
‘জান সুহা, মৌমাছি আল্লাহর শ্রেঠত্বের একটি নমুনা। মৌমাছি ফুল থেকে তার জিহ্বাকে লম্বা করে ফুলের মধু আহরণ করে, পা দিয়ে ফুলের রেণু নিয়ে এক ফুল থেকে অন্য ফুলের পরাগায়নে সাহায্য করে। মৌমাছির ছোঁয়ায় সফল পরাগায়নের মধ্য দিয়ে ফুল থেকে হয় ফল, শস্য, যা আমরা প্রাণীরা খেয়ে বেঁচে থাকি।
মৌমাছির কতো কতো কাজ। কোথায় ফুল আছে, সে ফুলের পরিমাণ কত-ওরা ইশারায়, দেহ ভঙ্গিতেই একে অপরকে জানায়। তাদের মধ্যে রয়েছে রানী মৌমাছি, স্ত্রী মৌমাছি, পুরুষ মৌমাছি, শ্রমিক মৌমাছি। ওদের সবার কাজ আলাদা আলাদা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ওদের ষড়ভুজ আকৃতির একই মাপের অসংখ্য কুঠুরি দিয়ে বাসা নির্মাণ।’
‘আরো শুনে অবাক হবে, একটি শ্রমিক মৌমাছি প্রতিদিন গড়ে সাত হাজার ফুলের মধু সংগ্রহ করে।’
‘তাই নানা? আমাদের বইতে মৌমাছির চ্যাপ্টার রয়েছে কিন্তু এত মজার মজার তথ্য নেই।’
এরি মধ্যে শাহান এক ম১ুঠি লালশাক তুলে নিয়েছে, ইজান লাফাতে লাফাতে আবার পড়ে যায়।
‘চলো, আজ আর নয় কাল তোমরাই শাক তুলবে।’ দাদুর পেছন পেছন ওরা ঘরে ফিরে আসে।
লালশাকের আঁটি হাতের মুঠো থেকে বের করতেই সুহা দেখে তার দু’হাত লাল রঙে রাঙিয়ে আছে। ও-খুব মজা পায়, শাহানের হাত দু’টোও লালে লাল। ওরা হাত তালি দিতে দিতে মজা লুফে নেয়।
পরদিন
সকাল বেলায় দাদুর কোলে চড়ে ইজান পুকুর পাড়ে যায়। সুহা, শাহানও নানার পিছু পিছু। পুকুরের ঘাটলায় দাদু ইজানকে কোলে নিয়ে বসে পড়েন। সুহা একটা মাটির ঢেলা তুলে পুকুরের পানিতে ছুড়ে মারে দেখাদেখি শাহানও। ঢুপ শব্দ তোলে ঢেলা দুটি পানির নিচে তলিয়ে যায়। ঢেলা পড়ার স্থানে দুটি ঢেউ গোল হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। একটু পরেই ঢেউগুলো মিলে যায়। সুহা আর শাহান হাততালি দেয়, ইজানও ওদের দেখাদেখি হাততালি দিয়ে দাদুর কোল ছেড়ে মাটিতে লাফাতে থাকে।
ওরা কেউ দাদু বাড়ি, কেউ নানু বাড়ি, এসেছে দুই দিন আগে। পরীক্ষা শেষে ওদের স্কুল ছুটি দুই সপ্তাহের জন্য। সাথে ওদের বাবা-মা এসেছেন। দাদু বাড়ির অনেকের সাথে দেখা হয়েছে, আলাপ হয়েছে। বড়রা ওদের আদর করছে মাথায় হাত দিয়ে, ছোটরাও বন্ধুত্ব পাতার জন্য সুযোগ খুঁজছে। খুবই মজার মজার সময় কাটছে ওদের। গাছ-গাছালিতে ভরা দাদু বাড়ি। সবজিখেত, ধানখেত দেখা যাচ্ছে উঠোন থেকেই। সুহা পুকুর পাড়ে জোড়া তালগাছ দেখে আবৃত্তি করছে, ‘ঐ দেখা যায় তাল গাছ, ঐ আমাদের গাঁ….’
এবার নিজে নিজেই বলে, ‘না-না হয়নি।’ পুকুরের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে যায় সঠান হয়ে, তারপর বলে, ‘ঐ দেখা যায় তাল গাছ, লিখেছেন কবি খান মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন।’ এবার শাহানও তার সাথে যোগ দেয়, দু’জনে এক সাথে আবৃত্তি করে। আবৃত্তি শেষ হলে নানা হাততালি দেয় সাথে সাথে বাড়ির ছোট্ট শিশুরাও জড়ো হয়ে হাততালি দেয়। ওরা পেছন ফিরে অবাক হয়ে নিজেরাও হাততালি যোগ করে।
নানা তালি দেয়া শেষ করে বলেন, ‘ঠিক করেছে সুহামনি, আবৃত্তির আগে কবির নামটি বলতে হয়।’
সকালে নানা ঘরের সামনের পেঁপে গাছ থেকে দু’টি পাকা পেঁপে পেড়েছেন। পাকা পেঁপে সুহার দারুণ পছন্দ, শাহানও পছন্দ করে তবে চামচ দিয়ে কেটে দিলে একটু একটু খায়। ইজানতো খাওয়ার আগেই লোল ফেলে দেয়। এ নিয়ে দাদির কি হাসাহাসি। দাদু পুকুরঘাট থেকে ডাকেন ‘কালু কালু’ বলে। কালু পুরান বাড়ির ছেলে। এ বাড়িতে দাদুকে এটা-ওটা কাজে সাহায্য করে, বাজার থেকে সদাইপাতি এনে দেয়।
কালু ‘জে’ বলে উচ্চস্বরে জবাব দেয় দাদু বলেন, ‘শীতলপাটিটা নিয়ে আয়-’
সুহা প্রশ্ন করে, ‘নানা, শীতলপাটি কি?’
‘আনলেই দেখতে পাবে। মোশতাকের বেত্তা দিয়ে গ্রামের বউ-ঝিরা অবসর সময়ে বসে বসে বানায়। এখন তোমাদের নানা তোমাদের একটা আল্লাহর নিয়ামত খাওয়াবে, শাহান চিৎকার করে বলে নানা আমিও খাব। ইজান লাফিয়ে বলে, ‘আমিও খাব দাদু।’
সুহা প্রশ্ন করে, ‘এখানে পুকুর পাড়ে কি খাওয়াবে দাদু, শীতলপাটি?’
হ্যাঁ, বলে দাদু হাসতে থাকেন। বাড়ির অন্যান্য ছেলেমেয়েরা জড়ো হয়ে হাসতে হাসতে বলে, ‘শীতলপাটি খাবে ওরা। কি দারুণ মজা তাই না সুহার বয়েসী তাহেরা বলে, ‘শীতলপাটি খায় না ওতে বসা যায়।’ কালু গোল করে বাঁধা একটা শীতলপাটি নিয়ে আসে। নানা বলেন, ‘ওখানে বিছিয়ে দে।’
কালু ঘাসের ওপর শীতলপাটি বিছিয়ে দেয়। নানা বলেন, ‘দেখ দেখ ঘাসের সবুজ কার্পেটের ওপর বিছানো শীতলপাটিতে আমরা এখন বসবো, সুহা বসতে বসতে বলে, ‘দাদু বলো না আল্লাহর কি নেয়ামত খাওয়াবে?’
ইজান দাদুর গলা ধরে বলে‘ ‘দাদু আমিও খাব।’ দাদু বলেন, ‘তোমরা সবাই খাবে। এখন শীতলপাটিতে বসে পড়। দেখছ না কি সুন্দর সূর্যের আলো ছিটিয়ে পড়েছে পাটিতে। এবার সূর্যালোর ভিটামিন ডি খাও, হাসতে হাসতে বলেন’
‘তাই দাদু, আমার পরিবেশ বিজ্ঞান বইতে ভিটামিন ডি ও সূর্যের আলোর চ্যাপ্টার আছে। ভিটামিন ডি শরীরের জন্য উপকারী। আমাদের শরীরে যে সকল ভিটামিন দরকার তার মধ্যে ভিটামিন ডি প্রথম সারিতে। ভিটামিন ডি ক্যালাসিয়ামের পরিমাণ বাড়ায়, চোখের সমস্যা, শরীরের পেশীর সমস্যা দূর করে।’
‘এবার বুঝেছ তোমরা? সূর্যের আলো যেমন আমাদের জন্য উপকারী তেমনি গাছ-গাছালির জন্যও। ইজানকে আদর করতে করতে নানা বলেন, ‘এটা আল্লাহর অপূর্ব এক নেয়ামত।’
সুহা পুকুরের পানিতে তাকিয়ে দেখে এক ঝাঁক মাছ থুঁতনি উঁচু করে খাবি খাচ্ছে। ও চিৎকার করে বলে ‘নানা, নানা কত কত মাছ। ওরা এমন করছে কেন?’
শাহানও পুকুর পাড়ে এগিয়ে যায়, বলে, ‘নানা আমিও দেখেছি। কতো কতো মাছ, বড় বড় মাছ। নানা আমি মাছ ধরবো।’ নানা বলেন, ‘ঠিক আছে। কাল সকালে জেলে আসবে বলে দিয়েছি। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠবে কিন্তু।’ সুহা প্রশ্ন করে, ‘নানা ওরা মুখ ভাসিয়ে এমন করছে কেন? মনে হচ্ছে কিছু বলতে চায়? তাই না শাহান?’ দাদু বল্লেন, ‘তোমরাতো বেড়াতে এসেছো, তোমাদের দেখতে চায় ওরাও দাদু হেসে এবার বলেন, শোন তোমাদের জানতে হবে, দাদুমনিরা, পুকুরের পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেলে ওরা ভেসে ওঠে, বাতাস থেকে অক্সিজেন ধার করে।’
সুহা বলে ‘হ্যাঁ নানা আমি জানি অক্সিজেন ছাড়া কোনো প্রাণী বাঁচতে পারে না।‘
‘আচ্ছা তোমরা বলতো পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা জিনিস কোন্টি? এবং সবচেয়ে দরকারিও…’
শাহান চট্ করে হাত তুলে জবাব দেয়, ‘নানা, আমি জানি, সুহা একটু ভেবে বলে, ‘পানি?’
ইজান কিছু বলতে না পেরে শুধু বলে, ‘আমি পালি, আমি পালি-’
নানু এবার ওদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘দেখ দেখ তিনটে শালিক ঘাসের ওপর কি যেন খুঁজছে আসলে ওরা খুজছে পোকা মাকড়, ফড়িং জাতীয় খাবার, ঐ দেখ একটা দোয়েল, আমগাছে বসে শীষ দিচ্ছে, মানে ওর সাথীকে ডাকছে তোমরা হাত নাড়াচাড়া করবে না, তাহলে উড়ে যাবে।’
এবার শোন, ‘সবচেয়ে সস্তা জিনিস হলো বাতাস। যা ছাড়া আমরা এক মুহূর্ত বাঁচতে পারি না। বাতাসের অক্সিজেন আমাদের নাক দিয়ে ফুসফুসে চলে যায়। ফুসফুস রক্ত পরিশোধন করে। আমাদের হার্টে পাঠায় হার্ট পাম্প করে সারা শরীরে সঞ্চালন করে তা না হলে আমরা বাঁচতে পারতাম না। জানতো কোনো প্রাণীই অক্সিজেন ছাড়া বাঁচে না।’
‘অথচ, আমরা দম নেই হিসেব করে। জোরে জোরে দম নাও। শরীর ফুরফুরে হয়ে যাবে। আর এই অক্সিজেন পাই আমরা গাছ-গাছালি থেকে। গাছ-গাছালি বাংলাদেশের প্রতিটি গাঁয়ের সজীব-সবুজ অলংকার। বলতে পার অক্সিজেন ফ্যাক্টরি। তোমরা শহরে থাক গাছ-গাছালি ক’টা দেখছ? খালি দালান আর দালান। আর আমাদের গাঁয়ে দেখছ গাছ-গাছালি আর সবুজে সবুজে ভরা। আমাদের গাঁয়ের অক্সিজেন ফ্যাক্টরির অক্সিজেন দিয়েই তোমরা শহরের মানুষ বেঁচে আছ। তাই নয়কি! এ সবই আল্লাহর নিয়ামত। আমরা এখানে পুকুর পাড়ে বসে আছি, চারদিকে অক্সিজেন ফ্যাক্টরি। ধরে নাও ধুলা-ময়লা পুকুরের পানিতে ফিল্টার হয়ে আমাদের ফুসফুসে প্রবেশ করছে নাক দিয়ে। কি বল- লম্বা করে দম নাও সবাই।’
শাহান নানার দেখাদেখি লম্বা করে দম নিতে নিতে দু’তিনটা কাশি দিয়ে ফেলে। শাহান ডান হাত মুখে চেপে ধরে। নানা হাসতে হাসতে বলেন, ‘কেশে যাও, অসুবিধা নাই।’ [ চলবে ]

Share.

মন্তব্য করুন