বাংলাদেশের শিশু-কিশোর সাহিত্যে আলী ইমাম নামটি বেশ উজ্জ্বল! বেশ পরিচিত। এককথায় খ্যাতিমান একজন। শিশু সাহিত্যের সব কটি ডালে তার উপস্থিতি সরব। তিনি লিখেছেন গল্প। লিখেছেন উপন্যাস। লিখেছেন- প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ফিচারও রহস্য-রচনা। বিজ্ঞানকাহিনী লিখেছেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখেছেন। প্রকৃতি ও পরিবেশ, প্রাণী জগৎ ও প্রাচীন সভ্যতা নিয়ে লিখেছেন। লিখেছেন শিশুদের মনোজগৎ নিয়ে। লিখেছেন মিডিয়া জগৎ নিয়েও।
তার লেখালেখির জগৎটি বিশাল। বেশ বিস্তৃত। সারাজীবন লিখেই কাটিয়েছেন। লিখেছেন শুধুই শিশু কিশোরদের জন্য। অসম্ভব পরিশ্রমী লেখক তিনি। দিনে রাতে লিখেই গেছেন অনবরত। লিখেছেন, বই করেছেন। প্রকাশকেরাও লেগেছিল তার সাথে। একুশে বইমেলা আসার আগেই তার সাথে প্রকাশকদের কথা পাকা হয়ে যেতো। এক মেলায় এক দুটো বই নয় কিন্তু। প্রতি মেলায় কমচে কম ১০টি বই বেরিয়েছে। কোনো কোনো মেলায় ১৫ টি ২০টি। কোনো মেলায় ৩০টিও প্রকাশ পেয়েছে। তার প্রকাশিত বই সংখ্যা ৬ শরও বেশি! এটি বিস্ময়কর! সত্যি বিস্ময়কর! ৬ শ বই! ভাবা যায়! একজীবনে ৬ শ বই পড়তে পারে এমন পাঠকইবা কজন আছে!
আরও বিস্ময়ের বিষয়- আলী ইমাম শুধু লিখে সময় কাটিয়েছেন এমন নয় কিন্তু! তিনি পড়েছেনও বিপুল। পাঠক হিসেবেও তিনি একজন বড় পাঠক। বাংলা ভাষায় শিশু সাহিত্যে যারা খ্যাতিমান তাদের সবার সেরা বইগুলো পড়েছেন। বিশ্ব শিশু সাহিত্যেরও বড় পাঠক ছিলেন। বই পড়েই শেষ বেশ করেননি শুধু। বরং গুরুত্বপূর্ণ বই হজমও করেছেন দ্বিধাহীন।
কীভাবে বোঝা যেতো তিনি হজম করে গচ্ছিত রাখতেন নিজের ভেতর?
বোঝা যেতো যখন তিনি বক্তব্য রাখতেন। যখন আলোচনা করতেন। যখন কথা বলতেন- আড্ডায়। আসরে।
অসম্ভব স্মৃতি মুখর একজন মানুষ ছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়, সুকুমার রায় থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীম উদ্দীন, আল মাহমুদ হয়ে হাল আমলের শিশু সাহিত্যের লেখকদের রচনার খবরও ছিলো তার কাছে। অবলীলায় উচ্চারণ করতেন যেকোনো লেখকের রচনা থেকে।
কল্পনা করলে বোঝা যায়- একজন লেখক কী পরিমাণ পরিশ্রমী ছিলেন। কেমন সাধনা ছিলো তার। ৬ শ বইয়ের লেখক হয়েছেন। ছয়শ বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেছেন। গুছিয়ে নিয়েছেন এত এত বইয়ের সামগ্রিক বিষয়। প্রুফ দেখেছেন। প্রেসে বইয়ের তত্ত্বাবধান করেছেন। পুরনো ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকায় বইয়ের মার্কেট বাংলা বাজার। বাংলা বাজারে বইয়ের দোকানগুলোর ভেতর প্রবেশ করলে বোঝা যায় এটি কোন দুনিয়া। প্রায় মিনমিনে আলো! স্যাঁতস্যাঁতে জায়গা। আয়তনে চিপাচিপা। চারপাশে বই আর বই। মাঝখানে সামান্য জায়গা খালি। সেখানেই আঁটাসাঁটা টেবিল চেয়ার। এমন জায়গায় বসে দিনের পর দিন বইয়ের প্রুফ দেখার ধৈর্য কজন লেখকের থাকে। আলী ইমাম এ অসাধ্য কাজটি অত্যন্ত আনন্দের সাথে করতেন। দিনে তো বটেই। প্রুফ দেখতে দেখতে বইয়ের বান্ডিল মাথায় রেখে ঘুমিয়ে কাটিয়েছেন কত রাত! প্রেসের ভেতর কালির গন্ধ। নানান কেমিক্যালের গন্ধ! কাগজের গন্ধ! এর ভেতর ঘুমিয়ে পড়া খুব সহজ কাজটি নয়! এমন অসম্ভব কাজই সম্ভব করেছেন আলী ইমাম। যে কারণে তার বই প্রকাশও দাড়িয়েছে অবিশ্বাস্য সংখ্যায়।

তিনি টিভি ব্যক্তিত্ব। পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে টেলিভিশনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। চাকুরী করেছেন বাংলাদেশ টেলিভিশনে। এখানেই কাটিয়ে দিয়েছেন চাকরি জীবন। বিটিভির জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে অবসর নিয়েছেন ২০০৬ সালে। অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় তিনি ছিলেন উদাহরণযোগ্য। তার উপস্থাপনা ছিলো সাবলীল। স্বতঃস্ফূর্ত! জড়তা মুক্ত। আরোপিত বিষয়ে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না।
তিনি ছিলেন অভিজ্ঞ অনুষ্ঠান নির্মাতা। অনুষ্ঠান নির্মাণে ছিলো তার মেধাবী অবদান। টিভি আলোচক হিসেবেও তার ছিলো দুর্দান্ত খ্যাতি। বিষয়কে গুছিয়ে নেবার অসাধারণ ক্ষমতা ছিলো তার। বলতেনও গুছিয়ে। বলতেন আনন্দের সাথে। সহজ করে বলার ঢং ছিলো তার।
আলী ইমাম ছিলেন একজন নিরহংকারী মানুষ! এত গুণধর একজন। অথচ এর কোনো বড়াই ছিলো না তার। নিজেকে বড় করে দেখার ইচ্ছে কখনো প্রকাশ করতেন না। বরং অনেক কিছু হেসে উড়িয়ে দিতেন।
হাস্যোজ্জ্বল ছিলেন। দেখা হলেই হাসি টেনে সালাম দিতেন। কিংবা হাসি দিয়েই সালামের জবাব দিতেন।
বেফাঁস কথা বলতেন না তেমন। কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলতেও দেখা যায়নি। ছোট বড় সবার সাথে ছিলেন প্রাণখোলা। সবার সাথে আচরণ ছিলো বন্ধুত্বের। কিন্তু বয়সে বড়দের তিনি শ্রদ্ধা করতেন ভীষণ। নিজের কথা বলতেন সম্মান রক্ষা করে। অসম্মান হয় কারো এমন কথা মুখে আনতেন না।
তিনি প্রায়ই বলতেন- সুন্দর আচরণ দিয়ে শিশুদের শেখাতে হবে। শিশুদের জগৎ তৈরি করে দিতে হবে। সেটি হবে স্বপ্নের জগৎ। আনন্দের জগৎ! শিশুরা আনন্দের সাথে শিখবে। আনন্দের ভেতর দিয়েই শেখাতে হবে তাদের! শিশুর জগৎ সুন্দর হলে শিশুর জীবনও সুন্দর হবে। বড় বড় বিষয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে শিশুদের। তবেই শিশুরা বড় বিষয়ে চিন্তা করতে শিখবে। এভাবেই বলতেন- শিশুদের মন বড় করে তুলতে হবে। বড় মনের মানুষ হতে না পারলে বড় কাজ করা যায় না। বড় মানুষও হওয়ারও উপায় নেই। তাই শিশু সাহিত্যে নিজেকে নিবেদন করেছিলেন তিনি। নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন শিশু সাহিত্যে। এমন নিবেদিত সাহিত্যিক নেই তেমন।
উদার মনের মানুষ ছিলেন তিনি। প্রতিহিংসার বিরুদ্ধে ছিলো তার উচ্চারণ। তিনি সবার সাথে সদাচরণ করতেন। রাজনৈতিক হাঙ্গামায় জড়াতেন না তিনি। কিংবা রাজনৈতিক কারণে কাউকে খাটো করার চেষ্টা করেননি কখনও। বরং তিনি শিল্পের সৌন্দর্যে বিশ্বাস করতেন। বিশ্বাস করতেন সাহিত্যে অবদানের ওপর। যার যা অবদান- সাহসের সাথে বলতেন।
সম্মানজনকভাবে লেখার সুযোগ থাকলে লিখতেন সব জায়গায়। সব পত্রিকায় লিখতেন।
কিশোর পাতায়ও লিখেছেন তিনি। বেশ কটি লেখা দিয়েছেন কিশোর পাতার জন্য। কিশোর পাতার বিষয়ে তার একটি উচ্চ ধারণা ছিলো। শিশু-কিশোরদের স্বপ্ন বড় করে তোলার কাজটি কিশোর পাতা করছে- এমনই বলতেন। আরও বলতেন- কিশোর পাতা এ সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা। এটি সুসম্পাদিত এবং নির্বাচিত লেখক ও লেখার পত্রিকা। বলতেন- যতদিন বেঁচে থাকি লিখবো কিশোর পাতায়।
তিনি চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে ১৯ নভেম্বর ২০২২ এ। আমরা তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।

Share.

মন্তব্য করুন