অপরাধটা বড়ই ছিল। শাস্তিটা যে তার চেয়েও বড় হয়ে যাবে রাশেদ তা ভাবতেই পারেনি। আসলে ধরা পড়ার চিন্তাটাই তার মাথায় আসেনি। আব্বা সেই সকালে চলে গেছেন সদরঘাট। স্কুলড্রেস ব্যাগে লুকিয়ে খেলতে চলে গেলো। কিন্তু কেউ না কেউ দেখে ফেলেছে এবং আব্বাকে বলে দিয়েছে। কে সে? খুররম খলিফা, ছাতা ব্যবসায়ী আলী হোসেন, নাকি পান-দোকানদার জলিল? এ ছাড়া টঙ্গী বাজারে কেউ তো তাকে চিনে না। গাদ্দারিটা এই তিনজনের কেউ করেছে।
বাঁশের কঞ্চির অগুণতি বাড়ি খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে রাশেদ। আর যাবে না। সে হাঁটছে বিমানবন্দর স্টেশনের দিকে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে। দূরে রাজল²ী কমপ্লেক্সের বাতি দেখা যাচ্ছে। নায়ক সাহেব এই ঝোপজঙ্গলে এসে কেন এত বড় বিল্ডিং বানালেন কে জানে। নাকি এই ঝোপজঙ্গল সাফ হয়ে একদিন এর চেয়েও বড় বড় বিল্ডিং উঠে যাবে এই এলাকায়?
পিঠটা খুব জ্বলছে। ছিলে গেছে নিশ্চয়ই। শার্টটা খুলে কোলের উপর রেখে রেললাইনে বসে পড়ল রাশেদ। পশ্চিমে মুখ করে এয়ারপোর্টের দিকে তাকিয়ে রইল। পুবের বাতাস পিঠে লেগে একটু আরাম লাগছে।
পশ্চিমের লালিমা মুছে গিয়ে অন্ধকার যখন আরো গাঢ় হয়ে এল তখন একটা ট্রেন এল। কমলাপুরের দিকে যাচ্ছে ট্রেনটা। কাছে চলে এসেছে। আলো পড়ছে রাশেদের গায়ে। হর্ন বাজছে। ড্রাইভার বোধ হয় তাকেই সতর্ক করছে। রাশেদের তখন মনে হলো ইচ্ছে করে অসতর্ক হয়ে বসে থাকলেই বা কী হবে? ঠিক তখনই বয়স্ক এক পথচারী রীতিমতো ধমকে উঠল, এই ছেলে দেখতে পাও না! কানেও শুনতে পাও না নাকি! তখনই উঠে দাঁড়াল রাশেদ। রাশেদ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল ট্রেনটা ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে স্টেশনে থামল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে এদিক ওদিক তাকিয়ে সেও আবার স্টেশনের দিকে হাঁটতে শুরু করল। স্টেশনে গিয়ে কী করবে তা সে জানে না। শুধু জানে বাড়ি আর ফিরে যাবে না কিছুতেই।
ট্রেনটা চলে গেছে। স্টেশন এখন প্রায় ফাঁকা। রাশেদ প্লাটফর্মের এ-মাথা ও-মাথায় কিছুক্ষণ হেঁটে বেড়াল। তারপর হাঁটুতে মাথা গুঁজে একটা বেঞ্চে বসে রইল কিছুক্ষণ। এক সময় আবার উঠে দাঁড়াল। পকেটে কয়েকটা টাকা আছে। দুই টাকার বাদাম কিনে ঠোঙাটা হাতে নিয়ে স্টেশনের বাইরে চলে এল সে।
বাবরি চুলের কালো টিঙটিঙে এক লোক জাদু দেখাচ্ছে। বাদাম খেতে খেতে লোকটির জাদু দেখতে লাগল রাশেদ। এই জাদু আগেও দেখেছে সে। ফুল হয়ে যায় কবুতর, সাদা কাগজ দিয়ে টাকা বানায়। দেখানোর আগে অনেকক্ষণ ভঙ্গি করে। আসলে জাদু দেখানো তো তার উদ্দেশ্য নয়। তার আসল উদ্দেশ্য তাবিজ বিক্রি করা। জাদু দেখিয়ে লোক জমানোর চেষ্টা করছে। লোক জমে গেলেই তাবিজ বিক্রি করবে। এই তাবিজ নাকি যে যেই নিয়তে হাতে, গলায় বা কোমরে বাঁধে তার সেই আশাই পূরণ হয়। পুরাই মিছা কথা। রাশেদ একবার একটা কিনেছিল পড়া মনে রাখার জন্য। কোনোই কাজ হয়নি।
মাঝরাতের দিকে একটা ট্রেন এল কমলাপুর থেকে। লোকাল ট্রেন। রাশেদ প্লাটফর্মের বেঞ্চে বসে ঝিমাচ্ছিল; ট্রেনের শব্দে চোখ মেলে তাকাল। হঠাৎ তার মনে হলো এখানে বসে থাকার চেয়ে ট্রেনে উঠে পড়াই ভালো। ট্রেন যেখানে যায় যাক। সেটাই তো ভালো। কেউ আর খুঁজে পাবে না। এখানে বসে থাকা মানে সকালে আবার ধরা পড়া।
উঠেই পড়ল ট্রেনে। বগিটা অন্ধকার। এক পাশে একটা মাত্র বাতি কুপির মতো টিমটিম করে জ্বলছে। যাত্রীও কম। অল্পকিছু যাত্রী হাত-পা ছড়িয়ে বসে ঝিমাচ্ছে। রাশেদও একটা সিটে বসে পা তুলে দিল।
ট্রেন চলতে শুরু করল। কোথায়, কত দূরে যাচ্ছে এই ট্রেন রাশেদ জানে না। জানার কোনো ইচ্ছেও হলো না তার। চোখ বন্ধ করে ঝিম মেরে বসে রইল সে।
ট্রেন চলে, রাশেদ ঝিমায়। স্টেশন এলে হইচই শুনে চোখ মেলে এদিক ওদিক একটু দেখে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলে।
ঘুমিয়ে পড়েছিল রাশেদ। চিৎকার, চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে তাকিয়ে দেখে ভোর হয়ে গেছে। ট্রেন থেমে আছে একটা স্টেশনে। যাত্রী যত নামছে তার চেয়ে বেশি উঠছে। জানালা দিয়ে মাথা বের করে স্টেশনের নামটা পড়ল সে। গফরগাঁও। সঙ্গে সঙ্গে তার মনে হলো এই স্টেশনে নেমেই ফুফুরবাড়ি যেতে হয়। গ্রামের নামটাও মনে আছে; রৌহা, ফরাজিবাড়ি। তা হলে তো যাওয়াই যায়। রাশেদ ট্রেন থেকে নেমে পড়ল।
স্টেশনের বাইরে এসে একটা রিকশা নিলো। রিকশাওয়ালা প্রথমে রাজি হয়নি। পরে ফরাজিবাড়ির কথা শুনে রাজি হয়ে গেল। ফুফা বেঁচে নেই কিন্তু ফরাজিবাড়ির মর্যাদা ঠিকই বেঁচে আছে। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়ে ফুফু একাই এখন তা ধরে রেখেছেন।
ভোরের বাতাসে, ফুফুরবাড়ি যাচ্ছে সে আনন্দে, নাকি সব মিলিয়েই- রাশেদ জানে না, মনটা তার ফুরফুরে হয়ে গেল। চলতে চলতেই পুবের সূর্য উঁকি দিলো। সেই আলোয় গাছপালা, মাঠ, পুকুর, ডোবা সব ঝলমলিয়ে উঠল। রাশেদ ফরাজিবাড়ি পৌঁছে গেল ঘণ্টখানেকের মধ্যেই।

রাশেদকে দেখে ফুফুর মুখটা হাসিতে ভরে উঠলেও তা মিলিয়ে যেতেও বেশি দেরি হলো না। ফুফু যখন একের পর এক প্রশ্ন করতে লাগলেন, এত সকালে কেমনে আইলি? চিনলি কেমনে? যদি কোনো বিপদ অইত! তর চোখ দুইডা লাল ক্যা?
সব প্রশ্নের উত্তরে রাশেদ যখন শুধু বলল, আব্বা মারছে। ফুফুর মুখের হাসি তখনই মিলিয়ে গেল। বললেন, অ বুঝছি। বংশের তেজ যাবো কেমনে? পলাইয়া আইয়া ভালা করছস। থাক আমার এইখানে। তর বাপের একটা শিক্ষা হোক। আয় শার্টটা খুইল্লা দেই। পুষ্কুনিত্তে গোসল কইরা আয়। আমি খাবার দিতাছি।
শার্ট খুলে পিঠ দেখে ফুফু চোখের পানি ফেলে দিলেন, মানুষ মানুষরে এমনে মারে? গরুরেও তো এমনে মারে না। পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে আবার বললেন, যা গোসল করে আয়।
গোসল করে এসে রাশেদ দেখে ফুফু রসুন দিয়ে সরিষার তেল গরম করে বাটিতে নিয়ে বারান্দায় বসে আছেন। রাশেদকে সামনে বসিয়ে সেই তেল পিঠে, পায়ে, হাতে মাখতে মাখতে ভাইয়ের রাগের কারণে কবে কোন অঘটন ঘটেছে সেই ফিরিস্তি দিতে লাগলেন।
খেলতে যাবি, যা।
তেল মাখা শেষ করে ফুফু ভাত নিয়ে এলেন। এত সকালে খাওয়ার আয়োজন তেমন ছিল না। ঝিঙ্গা ভর্তা, ডাল। তাই শেষে আম-দুধ দিয়ে ভাত খেতে দিলেন।
পেট ভরে ভাত খেয়ে এমন এক ঘুম দিল রাশেদ এক ঘুমে বেলা মাথার উপরে।
ফুফুর বাড়ির দিনগুলি রাশেদের আনন্দেই কাটতে লাগল। ছিপ দিয়ে, জাল দিয়ে পুকুর বা বিলের নানা জাতের মাছ ধরে আনে। ফুফু সেই মাছের ঝোল খাওয়ান, ভাজা খাওয়ান। ফুফুর গাছের আম, কাঁঠাল আর গাভীর দুধের তো কোনো অভাবই নেই। এক সের দুধের তিন পোয়াই আগে বিক্রি করে দিত। এখন বিক্রি বন্ধ। রাশেদকে তিন বেলাই দুধ খেতে হয়। স্কুল মাঠে গিয়ে ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলে। এটা সেটা কিনতে মাঝে মাঝে বাজারেও যায়।
এক, দুই করে দিন চলে গেল পাঁচটা। ছয় দিনের দিন সন্ধ্যার দিকে বাজার থেকে ফুফুর জন্য পান-সুপারি কিনে ফিরে দেখে বারান্দায় টুলের উপর বসে ফুফুর সঙ্গে কথা বলছে শহর আলী। এই শহর আলী আব্বার ম্যানেজার। সব কাজে শহর আলী। রাশেদ বুকের ধাক্কাটা সামলে নিয়ে বলল, শহর আলী ভাই কেমন আছ?
: কেমনে বালা থাহিরে ভাই? তুমি এমন একটা কাণ্ড করলা। তোমার মা তো কানতে কানতে শ্যাষ। যা অওয়ার অইছে। অহন রেডি অইয়া লও। সন্ধ্যায় একটা গাড়ি আছে। আমি ইস্টিশনে খবর লইয়া আছি।
ফুফু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, না না, কাইল সকালের গাড়িতে যাবি। এই হাইঞ্জাবেলা আমি রাশেদরে ছাড়মু না।
: ওই দিগের অবস্থা তো কাহিল ফুফু।
: হোক কাহিল। কাহিল করল ক্যা? কাইল যাবি।
: যে করছে তার অবস্থা তো অত কাহিল না। কষ্ট তো পাইতাছে জেডি।
: পাক। আরেকটা রাইত পাক।
ফুফুর কথা ফেলা যায় না। শহর আলীকে পরদিন সকালেই রওনা হতে হলো রাশেদকে নিয়ে।
ফুফু বারবার করে সতর্ক করে দিলেন, শহর আলী, রাশেদের বাপরে কইবি, ফুফু কইছে- আবার যদি রাশেদ পলাইয়া আহে তাইলে আর ফেরত দিত না। রাশেদের মাথায়, পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, স্কুল ছুটি থাকলে ম্যালা খেলতে পারবি। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে খেলতে হয়; পড়া বাদ দিয়া না। অহন পড়ার সুময়, মনোযোগ দিয়া পড়ালেহা কর। মাঝ রাইতে যে তুই রেলে উইট্টা পড়লি এই গাড়ি যদি সিলট, চট্টগেরাম যাইত গা। আর পলাবি না। তর বাপ তরে মারলে আমারে চিডি লেকবি। আমি গিয়া তর বাপের বিচার করমু। যা বাজান, যা। ফি আমানিল্লাহ।
রাশেদ শহর আলীর পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করল। বাজারে গিয়ে রিকশা নিতে হবে। যতক্ষণ দেখা যায় ফুফু ততক্ষণ কাঁঠাল গাছটার নিচে দাঁড়িয়েই রইলেন।

শহর আলীর পিছে পিছে রাশেদ যখন তাদের বাড়ির উঠানে গিয়ে দাঁড়াল তখনো দুপুর হয়নি। আম্মা উঠানে জাম্বুরা গাছটার ছায়ায় বসে ডাঁটা কুটছিলেন। সেখান থেকে দিলেন এক ভোঁ দৌড়। রাশেদকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন।
আব্বা ঘরের বারান্দায় বসেছিলেন। শহর আলীর দুই হাতে চারটা লাল মোরগ দেখে বললেন, মোরগ কই পাইলি রে শহর আলী?
শহর আলী হেসে বলল, হস্তা পাইয়া গফরগাঁও ইস্টিশনে রাশেদ আপনের লেইগা কিনছে।
আব্বা বললেন, বালাই অইছে। রাশেদের মা, সাত দিন আগে আম কিইন্না আনছি অহনও মুহে দিবার পাইছি না। আম কাইট্টা আন, রাশেদরে লইয়া খাই। শহর আলী মোরগ জবো কর। আইজ আমরা পোলাও-গোশত খামু।

Share.

মন্তব্য করুন