ক্রিকেটের জ্ঞানীগুণী পণ্ডিতজনেরা বলে থাকেন Cricket is funny game. অর্থাৎ কি না ক্রিকেট হলো হাস্যকর একটি খেলা।
অবশ্য এর কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন, যে ব্যাট্সম্যান, না না, ব্যাটসম্যান নয়- এখন বলতে হবে ব্যাটার- কারণ নারী-পুরুষ সবাই যেহেতু খেলছেন তখন সবাইকে একসাথে ব্যাটার বলাটাই সহজ।
হ্যাঁ, তো ওই যে বলছিলাম গুণীজনদের কথা- যে ব্যাটার অ্যান্ড চমৎকার রানগড়ের মালিক- ফিল্ডারের দারুণ এক ক্যাচে শূন্যতে আউট হয়ে গেলেন। আর সাধারণ মানের একজন ব্যাটার একই ম্যাচে তিনবার ক্যাচ পড়ার কারণে শতক হাঁকিয়ে ব্যাট উঁচু করে মাঠ ছাড়েন। এটাতো আজবই। আর এখনতো DRS এর কারণে LBW সিদ্ধান্তে হাস্যকর সব ব্যাপার ঘটছে হরহামেশা। যেহেতু ফিল্ড আম্পায়ার আউট দেননি তাই DRS ক্যামেরাতে বল উইকেটে লাগলে আউট হবে না- কারণ কী? না, আম্পায়ার্স কল।
তারপরও মজার কথা আছে। যে ব্যাটার আউট হলেন- আসলে তিনি ইন করেছেন প্যাভিলিয়নে। আর যিনি next better in তিনি আউট হচ্ছেন প্যাভিলিয়ন থেকে। আরো মজা আছে- যে ছয়টি ছড়ি (Stamp) দু’পাশে দাঁড় করানো হয় তাদের বলা হয় (wicket) উইকেট আবার একজন ব্যাটার যখন আউট হন বলা হয় একটি উইকেটের পতন হলো। আরে বাবা মানুষ কি কখনো Stump বা লাঠি হয়। কিন্তু হয়। ক্রিকেটে হয়।
সাধারণত মানুষজন বলে থাকেন- ক্রিকেট একটা ম্যাড়মেড়ে খেলা, লেশমাত্র নেই উত্তেজনার। কিন্তু যারা খেলাটা বোঝেন এবং মন দিয়ে দেখেন- তারা জানেন যে কী পরিমাণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এই খেলাটিতে। এমনকি পাঁচ দিনের নিরুত্তাপ টেস্ট ম্যাচের যে কী ধরনের উত্তেজনার সৃষ্টি হতে পারে, সেটা ক্রিকেট বিশ্ব বেশ কবার দেখে ফেলেছে। এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৯৬০ সালে এবং ১৯৮৬ সালের দুটো টেস্ট।
প্রথমটি ঘটেছিল ১৯৬০ এ অস্ট্রেলিয়ার ব্রিসবেনে। বিপক্ষে ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পাঁচ দিনের শেষ দিনে শেষ ওভার পর্যন্ত খেলা চলেছিল এবং শেষ বল পর্যন্ত চলেছিল সে খেলা। শেষ হয় সমান সমান স্কোরে।
দ্বিতীয়টিতেও ছিল অস্ট্রেলিয়া, বিপক্ষে ভারত। টেস্টে, ১৯৮৬-তে। এখানেও সেই সমান সমান স্কোরে শেষ বল পর্যন্ত খেলা হয়। এখানে অবশ্য নানা রকম তর্কবিতর্ক হয়েছিল খেলোয়াড়দের মধ্যে এমনকি আম্পায়ারদেরও নানান রকমভাবে খারাপ ব্যবহারের লক্ষ্য হতে হয়েছিল।
তো এবার আসি এই যে খেলায় ঝগড়াঝাঁটি, কুমন্তব্য, উত্তেজনা ভঙ্গি একে অপরের প্রতি- এসব কিন্তু এ খেলার অঙ্গ কখনো ছিল না। একে বলা হতো রাজা-বাদশার খেলা- ভদ্রলোকের খেলা। বেশির ভাগ পণ্ডিতদের ধারণা খেলাটা শুরু হয়েছিল ষোলো শ শতকে- সম্ভবত দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডে। তখন লর্ড বায়রন এঁরাই খেলতেন- অবসর সময় কাটানোর জন্য। অবশ্য কিছু মানুষের ধারণা ক্রিকেট আসলে চীনের আবিষ্কার- সেখান থেকে কিভাবে যেন এসে গেছিল ইংল্যান্ডে। অবশ্য এখন চীন ক্রিকেট বর্জন করেছে বা কখনো মন দিয়ে গ্রহণ করেনি, কারণ এ খেলায় অযথা মানুষের মূল্যবান সময় নষ্ট হয় তার চেয়ে অ্যাথলেটিকস অনেক উপকারী এবং সম্মানের বিষয়।
আঠারো শতাব্দীতে ক্রিকেট একটি প্রতিঠিত খেলা হিসেবে স্থান করে নেয়। যদিও একেবারে প্রথম দিকে এটা শিশুদের খেলা হিসেবে প্রচলিত ছিল। পরে নানান সমস্যা পার হয়ে এক সময় প্রতিষ্ঠিত হয় একটি আন্তর্জাতিক মানের খেলা হিসেবে। ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রণ নেয় মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব (MCC); পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠিত হয়। ICC (International Criket Council) যারা এখন ক্রিকেটের হর্তাকর্তা বা নিয়ন্ত্রক।
প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা হয় ১৮৪৪ সালে কানাডা এবং আমেরিকার মধ্যে, নিউ ইয়র্কে। ১৮৭৭ সালে। অস্ট্রেলিয়ায় খেলা ইতিহাসের প্রথম দুটি টেস্টম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে।
একটা সময় ছিল যখন শুধুই ক্রিকেট হতো মাঠে। পাঁচ দিন চলতো ম্যাচ, তবে একাধারে পাঁচ দিন নয়। মাঝে তিন দিন এর একদিনের থাকতো বিরতি। ছয় দিনের টেস্ট ম্যাচও হয়েছে অনেক সময়। একটা সময় ছিল যখন টেস্ট ম্যাচের কোনো সময় ছিল না নির্ধারিত। যতক্ষণ না খেলা পুরোপুরি শেষ হবে, খেলা চলবে।
এটা নিয়ে একটা ঘটনা ঘটেছিল সাউথ আফ্রিকায়। খেলা চলছিল ইংল্যান্ড এবং সাউথ আফ্রিকার মধ্যে। খেলা চলছে তো চলছেই। এ দিকে ইংল্যান্ডের বাড়ি যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। জাহাজের টিকিট কাটা- একটু পরেই ছাড়বে জাহাজ- ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়রা সব খেলা ফেলে দিয়ে জাহাজে চড়ে পড়লো বাড়ি ফিরতে। খেলা ড্র হলো আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে।
খেলাটা হয়েছিল ১৯২৯ সালে ডারবানে। Timeless test. দু’দিন রিবতিও ছিল তারপরও খেলা শেষ হয়নি খেলোয়াড়রা চলে যাওয়ার কারণে। তাদের অবশ্য যুক্তি ছিল ওই জাহাজে না যেতে পারলে দীর্ঘদিন অপেক্ষায় থাকতে হতো পরবর্তী জাহাজের জন্য।
টেস্টম্যাচ এক সময় দর্শকদের নিকট হারালো আকর্ষণ। তখনই অস্ট্রেলিয়ার এক ব্যবসায়ী ক্যারি প্যাকার নিয়ে এলেন ক্রিকেটের এক নবরূপ One day cricket. রঙিন পোশাকে সাদা বলের খেলা দিবা-রাত্রির খেলা। ৬০ ওভার করে খেলা। (পরে অবশ্য কমিয়ে ৫০ ওভার করা হয়)। অসাধারণ সাফল্য আসে ক্রিকেটে। বাণিজ্যিক সাফল্যের রূপ পায়। খেলোয়ড়রা প্রফেশনাল হতে শুরু করে ওয়ানডের জন্য। এ নিয়ে নানান মামলা মোকদ্দমা হলেও শেষ পর্যন্ত ক্যারি প্যাকারই জিন্দাবাদ। খুবই ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় One Day International. ICC. ওঈঈ অনুমোদন দেয়। সবাই খেলতে শুরু করে। এই One day match শুরু হয়েছিল জানুয়ারি ৫ তারিখে, ১৯৭১-এ মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে।

এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৩-এ এলো টি-২০ গেম। টেস্ট খেলায় যে উত্তেজনা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, সেটা আনার চেষ্টা হলো ODI দিয়ে। যে খেলা ৪ দিনের পরিবর্তে দিনে দিনে শেষ হয়। কিন্তু এবার এলো আরো ক্ষুদ্র পরিসরের খেলা twenty twenty (T-20) International যা খুব কম সময়ের মধ্যে দর্শকদের দেবে অপার উত্তেজনা আর আনন্দ।
এখন অবশ্য কোথাও কোথাও Ten 10 (T-10) শুরু হয়ে গেছে। সিঙ্গেল উইকেট খেলা তো বহুদিন আগেই শুরু হয়েছিল। সেখানে প্রতি দলে ছয়জন করে খেলে।
আবার এর মধ্যে এলো রাত-দিনের টেস্টম্যাচ। বদল হলো বলের রঙ। লাল-সাদার পর এলো গোলাপি বল। এমনিতে তো ক্রিকেটের আইন কানুনের কোনো ইয়ত্তা নেই, আবার সেগুলো বদল হয় যখন তখন। এভাবেই এগোচ্ছে হাস্যকর এবং সময়ের খেলা ক্রিকেট।
এই আমি একজন ক্রিকেটের পোকা। ছোট্টবেলা থেকে ক্রিকেটের প্রতি ছিল আমার প্রচণ্ড আকর্ষণ। মনে পড়ে ফোর-ফাইভে যখন পড়তাম আমাদের এক বিহারি বন্ধু ছিল জাহাঙ্গীর সিদ্দিক। সে পড়তো ইংরেজি মিডিয়ামে- সেন্ট প্রাসিড স্কুলে। সে আমাদেরকে সব ক্রিকেটের গল্প শোনাতো। নিজেই ব্যাট কিনে দেখাল- আমরা কেউ বল কিনলাম, কেউ কিনলাম ঝঃঁসঢ়, আবার একজন প্যাড কিনে ফেললো। যদিও এই কেনাকাটা খুবই কষ্টের ব্যাপার ছিল আমাদের! সেখান থেকেই খেলাটা শেখা বা জানা।লেকজান্ডারের নেতৃত্বে। ওয়েসলি হল, গারফিল্ড সোবার্গ, সনি রামাদিন, ল্যান্স গিবস, এই সব জগ
সেই সময় পাকিস্তানে এলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিম। গ্যারি আৎশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়দের নাম শুনলাম। পাকিস্তানের হানিফ মোহাম্মদ, ফজল মাওমুদ, সাঈদ আহমেদ, ভালকান সার্প, ওয়ালস মেআয়াস, মাহমুদ হোসেন এবং আরো যেন কে কে!

জাহাঙ্গীরের বাসায় রেডিও ছিল। ও আমাদের কমেডি শোনাতো। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম- আর এভাবেই ক্রিকেটের ভক্ত হয়ে গেলাম এক সময়।
নিজে প্রথমে ব্যাটার হওয়ার চেষ্টা করি। ভালো না পারায় বোলার হতে চাইলাম- সেখানেও ব্যর্থ হয়ে হলাম অলারাউন্ডার! এরপর অবশ্য আম্পায়ার হয়েই সন্তুষ্ট হতে হলো।
তারপরও স্কুলে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের ক্লাবকে দু’তিন দফা প্রতিনিধিত্ব করেছি। আসলে এই খেলাটা আমার মিশে গেছে রক্তের মধ্যে। ক্রিকেট শুনেই উত্তেজিত হয়ে উঠি, সাথে সাথে খুঁজতে থাকি কোন চ্যানেলে দেখা যায় ক্রিকেট। না হলে মোবাইলের ESPN GPI তো রয়েছে। যে টিমের খেলা, যেখানে হোক আমার দেখা চাই। সে ভোর ৪টায় অস্ট্রেলিয়ার খেলাই হোক কিংবা রাত ১২টায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের হোক। ক্রিকেট খেলা আমার আনন্দের সাথী।
আমার স্ত্রী এক সময় খুব বিরক্ত হতো আমার এই কমেন্ট শোনা আর খেলা দেখা নিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশ যখন খেলতে শুরু করলো তখন থেকে তার বাড়তে লাগলো উৎসাহ। আর আজ সে নিজেই খোঁজ-খবর রাখে ক্রিকেটের।

লেখাটা প্রায় timeless circket test-এর মত হয়ে যাচ্ছে তাই এবার এক নব্য ক্রিকেট দর্শক দম্পতির গল্প বলে শেষ করি কড়চা।
নবদম্পতি গিয়েছেন খেলা দেখতে। ছাতা, টিফিন ক্যারিয়ার, রেডিও, মোবাইল সবই নিয়েছেন সাথে- যাতে খাওয়া-দাওয়া চলে আবার খেলার কোনো মুহূর্তের উত্তেজনাগুলো না মিস করেন।
বেশ জমিয়ে চলছিল তাদের ক্রিকেট দর্শন। টিফিন বাটি থেকে মুরগির রানটান বের করে চিবুচ্ছেন তারা। কফি মগে ধোঁয়া উড়ানো কফিও হাতে, এমন সময় মাঠে চিৎকার- OUT!
ওরাও লাফিয়ে উঠলেন- ‘আউট’ বলে।
তারপর স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন-
এই কে আউট হলো?
স্বামী পাশের মানুষকে জিজ্ঞেসা করে জেনে নিয়ে বললেন,
বিরাট কোহলি।
ওমা তাই? কিভাবে আউট হলো?
ভদ্রলোক আবার পাশের দর্শকের কাছ থেকে জেনে নিয়ে বললেন,
এলবিডবিøউ।
উহ! ক্যাচটা কে ধরলো গো?
ভীষণ উত্তেজিত মহিলা আনন্দে।
আজ এ পর্যন্তই।
ক্রিকেটের দর্শক বাড়ছে। যে প্রকারেই হোক বাড়ছে এটা বড় কথা।
জয় হোক ক্রিকেটের। হাস্যকর ক্রিকেটের!

Share.

মন্তব্য করুন