ভোরবেলা মিনি যখন গায়ে মোটা সোয়েটার, হাতে- পায়ে মোজা, মাথায় টুপি পরে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়, তখন সূর্যটা মাত্র মুখ দেখিয়েছে। মিনিদের ফুলের বাগানের পুরোটায় তখনও রোদ আসেনি। এদিকে এক টুকরো রোদ, আবার ওদিকে হয়ত আরেকটু রোদ। মিনি এক-পা, দু-পা করে বাগানটার দিকে এগোতেই লক্ষ করে, অসম্ভব রূপবতী ওর বয়সই এক মেয়ে বাগানে হেঁটে হেঁটে কী যেন করছে। নির্ঘাত চোরই হবে, মিনি মনে মনে ভাবে। ফুলের বাগান থাকলে এই এক সমস্যা, ফুল চুরি হবেই। কিন্তু আজ তো একুশে ফেব্রæয়ারি না। একুশে ফেব্রæয়ারি হলে ফুল চুরির অপরাধ ক্ষমা করা যেত। আজকে যদি ওই অসম্ভব রূপবতী মেয়েটা সত্যি সত্যি ফুল চুরি করে তাহলে তার অপরাধের ক্ষমা নেই। অবশ্যই তাকে শাস্তি পেতে হবে।
মিনি গেট খুলে বাইরে বের হয়ে আসে। মেয়েটির আরেকটু কাছাকাছি আসতেই দেখে তার হাতে কোনো ফুলই নেই বরং ঝুড়ি ভরা হলুদ উজ্জ্বল রঙের কী যেন দেখা যাচ্ছে। মিনি যথাসম্ভব নিঃশব্দে মেয়েটির আরও কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে। মেয়েটির কাছে যেতেই মিনির চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া! না এ-তো মেয়ে নয়! পরী। সে যে পরী, এটা সবাই বুঝতে পারবে। কারণ পরীদের ডানা থাকে, এই মেয়েটিরও ডানা আছে।
মিনি খপ করে মেয়েটির হাত ধরার প্রবল ইচ্ছাটাকে দমন করল। ভাবল যদি হাত ধরলেই মেয়েটি অদৃশ্য হয়ে যায়! কিন্তু মেয়েটি ঝুড়ি ভরে এগুলো কী নিচ্ছে বুঝতে পারল না মিনি। তবে আন্দাজ করতে পারল এগুলো রোদ কারণ পরী মেয়েটা যেসব জায়গায় রোদ সেখানে থেকেই মুঠো ভরে ভরে কী যেন ঝুড়িতে ভরছে। মিনি নির্ভয়ে এগিয়ে যায় পরীর দিকে। সে মনে মনে বলে, ‘আমি ভয় পাবো কেন? আমিতো চুরি করছি না, যে চুরি করছে সে ভয় পাক।’
: তুমি কে? এখানে করছোটাই বা কী?
: আমাকে বলছ?
: তো আর কাকে বলব? তুমি ছাড়া এখানে কেউ আছে?
: ও আচ্ছা, তাইতো, তাইতো। আমি ছাড়া এখানে তো কেউই নেই। আমি শুভ্রা পরী। আমি কী করছি তা তো দেখতেই পাচ্ছ। আমি তোমার বাগান থেকে ঝুড়ি ভরে রোদ নিয়ে যাচ্ছি।
: এটা কি তুমি ঠিক করছ? অন্যের বাগান থেকে না বলে রোদ নিয়ে যাচ্ছ?
: অবশ্যই ঠিক করছি না। কিন্তু আমি নিরুপায় এখন, এই মুহূর্তে তোমার বাগান ছাড়া কোথাও তেমন রোদ ওঠেনি।
: তা তো বুঝলাম, কিন্তু তোমার রোদ নেয়ার দরকারটাই বা কী, খুব শীত লাগলে এখানে বসে খানিকক্ষণ রোদ পোহাও। তাহলেই তো হয়। তা ছাড়া তুমি একটা বোকারাম পরী। নইলে এই শীতে কেউ সোয়েটার ছাড়া আসে।
: এটা তুমি ঠিক বললে না মেয়ে। আমি মোটেও বোকা নই। কারো সম্বন্ধে না জেনে মন্তব্য করা ঠিক না। তুমি হয়তো জানো না আমাদের পরীদের শীত লাগে না। আমাদের শরীরে সব সময় বসন্তকাল। শীত ও গরমের মাঝামাঝি।
: সরি শুভ্রা পরী। আমার ভুল হয়েছে, আমার তোমাকে ওভাবে বলা ঠিক হয়নি। আসলে আমার একটু রাগ বেশি। আর তুমিও তো একটা ভুল করেছ।
: আমি! আমি আবার কী ভুল করলাম। পরীদের তো তেমন ভুল করার কথা নয়। ভুল তো মানুষেরা করে।
: এই যে তুমি আমাকে মেয়ে বলে ডাকলে। এটা ভুল নয় বলতে চাও? আমার তো একটা নাম আছে। আছে না, বলো?
: তা ঠিক। তবে আমি তোমার নাম জানতাম না বলে বলেছি। আমি সেজন্য দুঃখিত। প্রত্যেক মানুষকে নাম ধরে ডাকা আমাদের সবারই কর্তব্য। যদিও আমাদের কথা আলাদা। আমাদের সবার নামের সাথেই একটা কমন নাম আছে পরী। যেমন আমার দুই বোনের নাম লাল পরী, নীল পরী আর আমার নাম শুভ্রা পরী। যাই হোক তোমাকে মেয়ে বলে ডাকার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত। এই আমি কানে ধরছি। এখন তোমার নামটা বলো।
: আমি মিনি।
: বাহ্ দারুণ নাম তো। তোমার নামটা আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। তুমি আমার বন্ধু হবে?
: হতেই পারি। তোমার মতো সুন্দর পরীর বন্ধু হতে কে না চাইবে বলো।
: তাহলে আজ থেকে আমরা বন্ধু হলাম।
: এই শীতের দিনে মাঝে মাঝে এসে তোমার বাগানের রোদ নিয়ে যাব। একদম রাগ করতে পারবে না কিন্তু।
: না রাগ করব না। কিন্তু বলবে কি, কেন তুমি এমন ঝুড়ি ভরা রোদ নিয়ে যাও? কেনই বা নাও?
: সে কথা তো এখন বলা যাবে না। আমার হাতে অত সময় নেই। আমার এখনই যেতে হবে। অনেকেই রোদের জন্য অপেক্ষা করছে।
: কী বলো এসব? কারা রোদের জন্য বসে আছে?
: দেখবে? তাহলে চলো আমার সঙ্গে।
: আমি কিভাবে যাব?
: কেন উড়ে উড়ে যাবে আমার সাথে।
: আমার তো ডানা নেই। আমি কিভাবে উড়ব?
: তুমি আমার হাত ধরে থাকবে। দেখবে আমি উড়লে তুমিও আমার সাথে সাথে উড়বে। যাবে? মিনি মনে মনে খুব রোমাঞ্চ অনুভব করে।
: অবশ্যই যাব।
পরীর ডান হাতটা শক্ত করে ধরে মিনি। মুহূর্তের মধ্যেই আকাশে উড়তে থাকে দু’জন। মিনি মনে মনে ভাবে নিশ্চয়ই শুভ্রা পরী তাকে তাদের দেশে নিয়ে যাবে। মিনি একবার বাবার কাছে গল্প শুনেছিল পরীদের দেশ অনেক সুন্দর। ফুলে ফুলে ঘেরা। সুন্দর সুন্দর নদী, ঝরনা, যেন স্বর্গপুরী।
কিন্তু শুভ্রা তাকে নিয়ে গেল রেললাইনের কাছে। রেললাইনের এখানে- সেখানে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে ছোট ছোট শিশু। গায়ে পাতলা জামা, কোনো গরম কাপড় নেই। মিনির খুব মন খারাপ হয়। আহা বেচারা, এই শীতে লেপ কাঁথা ছাড়া কেমন করে ঘুমুচ্ছে। শুভ্রা পরী তার ঝুড়ি থেকে টুকরো টুকরো রোদ দিয়ে ঘুমন্ত বাচ্চাদের শরীর ঢেকে দেয়। সেখান থেকে ওরা যায় বড় বড় রাস্তার ফুটপাথগুলোতে। সেখানেও একই অবস্থা অনেক শিশু এলোমেলোভাবে শুয়ে আছে গরম কাপড় ছাড়া। শুভ্রা পরী তাদের সবার গায়েই টুকরো টুকরো রোদ ছড়িয়ে দিল।
: দেখলে তো মিনি ওরা এখন কেমন আরাম করে ঘুমুচ্ছে।
: হ্যাঁ তাই তো, কিন্তু ওরা গরম কাপড় পরেনি কেন?
: ওরা খুব গরিব। এদের কারো কারো বাবা-মাও নেই, ওরা পথশিশু। ওদের গরম কাপড় নেই। তাই অমন শীতে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে।
: আমার তো অনেক গরম কাপড় আছে।
: তুমি তো ইচ্ছে করলেই তা থেকে দু’ একটা ওদের দিতে পারো। আমার তো গরম কাপড় নেই। আমরা পরীরা ওসব পরীও না। তাইতো এর ওর বাগান থেকে রোদ এনে ওদের শরীরে ছিটিয়ে দেই। এতে ওরা একটু ওম পায়।
মিনি তাকিয়ে দেখে ফুটপাথের ছোট ছোট শিশুদের গায়ে কী সুন্দর রোদ পড়েছে। রোদের আলোতে ওদের মুখ চিকচিক করছে। মিনি অবাক হয়ে লক্ষ করে তাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট শিশুটা ঘুমের মধ্যেই হাসছে। হয়ত স্বপ্ন দেখছে।
: চল মিনি তোমাকে বাড়ি দিয়ে আমি ফিরে যাই। আবার কাল আসব।
মিনিকে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়ে শুভ্রা পরী চলে যায়। মিনি মন খারাপ করে বসে থাকে বারান্দায়।
: এই মিনি উঠে পড়ো। দেখোতো কত বেলা হয়ে গেল। এখনও উঠছ না কেন?
মায়ের ডাকে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে মিনি।
হায় হায় কই শুভ্রা পরী? এখানে তো কেউ নেই। সে বসে আছে ঘরের খাটে, এর মানে হলো সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল।
মিনির মন খারাপ হয়ে যায়। সে দৌড়ে গিয়ে তার সব গরম কাপড় বের করে। সেগুলো থেকে কিছু কাপড় নিয়ে একটা ব্যাগে ভরে বাবার কাছে যায়।
: বাবা, আমার সঙ্গে চলো।
: কোথায় রে মা? এই সাতসকালে।
: বাবা ট্রেন স্টেশনে যাব।
: কেন মা?
: ওখানে কিছু পথশিশু আছে। তাদের গরম কাপড় নেই। আমার তো অনেকগুলো আছে। ওখান থেকে কয়েকটা দিয়ে দেব।
মেয়ের কথা শুনে মিনির বাবা খুব খুশি হলেন। তাড়াতাড়ি গাড়ি বের করলেন। পথ থেকে কিছু খাবার কিনে নিয়ে গেলেন। আর সাথে মিনির দেওয়া সোয়েটারগুলো।
মিনি আর তার বাবা যখন ট্রেন স্টেশনে পৌঁছায় তখন চারদিকে রোদ ঝলমল করছে। সব পথশিশু এদিক সেদিক হাঁটছে। মিনি তার গরম কাপড় চোপড় তাদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়। কাপড় পেয়ে তারা তো মহাখুশি।
এদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট যে শিশুটি সে এসে মিনির হাত ধরে। মিনি ওর হাতে একটা সোয়েটার তুলে দিতেই সে মিষ্টি করে হাসে। মিনি তার হাসির সাথে ভোর রাতে স্বপ্নে দেখা সেই শিশুর হাসির মিল খুঁজে পায়।

Share.

মন্তব্য করুন