লেবুগাছে বসে রয়েছে শালিক ছানা। মাটি থেকে লোভাতুর দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে একটা হুলো বেড়াল। লাফ দিয়ে শালিক ছানার নাগাল পাওয়া যায় কিনা- ভাবছে বেড়ালটা। নাগালে পেলে বেশ সুস্বাদু খাবার হতে পারতো পাখির ছানাটি। শালিক ছানার সে খেয়াল নেই। সে অবাক হয়ে দেখছে চারপাশ। মাটির এতো কাছাকাছি আগে কখনো আসেনি ছানাটি। তেঁতুলগাছের বাসায় সমবয়সী ভাইকে রেখে স্বল্প উচ্চতার লেবুগাছে নেমেছে মাটির সাথে পরিচিত হবার জন্য। ভাইয়ের চেয়ে তার কৌতূহলের মাত্রা খানিকটা বেশি। মাটিতে কোন ধরনের প্রাণী বাস করে। তারা দেখতে কেমন। এসব না জানলে তার আর চলছিলো না। ছানাদের খাবার সংগ্রহ করতে গেছে মা শালিক। ভাই শালিক বারণ করেছিলো বোনকে।
‘আপু বাসা ছেড়ো না। এখনও আমরা ভালো করে উড়তে পারি না। তুমি ঘুমিয়েছিলে। যাবার সময় মা বলে গ্যাছে, এখানে আমরা নিরাপদ। নিচে ওঁৎ পেতে রয়েছে নানা বিপদ। বেড়াল নামের একদল নিষ্ঠুর প্রাণী আছে। তারা পাখিদের শত্রæ।’
‘তুই থাক তো ভাই ঘরে। আমি বেশ উড়তে শিখেছি। ওই লেবুগাছ থেকে ঘুরে আসি। এতো দূর থেকে নিচে ভালো করে ঠাহর করতে পারি না। এই যাবো আর একটু দেখেই চলে আসবো।’
ভাই শালিককে আর কথা বলার সুযোগ দিলো না সে। ফুড়ুত করে উড়ে লেবুগাছের এক কচি ডালে এসে বসলো। নরম লেবু পাতার ঘ্রাণ আর মৃদুমন্দ বাতাস এলোমেলো করেছে তার শিশু হৃদয়।
হুলো বেড়ালটা বেজায় খাদ্যরসিক। প্রতিবেলায় নতুন নতুন আহার চাই তার। শালিকের মাংস কখনো জোটেনি তার ভাগ্যে। এই শালিক ছানাটিকে বাগে আনতেই হবে। বেশ বোঝা যাচ্ছে, ছানাটি এখনো তেমনভাবে উড়ান দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি। আর ছানাটির চোখে খেলা করছে মুগ্ধতা। এর মানে হলো এই যে, শালিক ছানা এখন অসতর্ক অবস্থায় আছে। এটাই মোক্ষম সুযোগ। কূটকৌশল ভেবে নিয়েছে বেড়ালটা।
বেশ খানিক দূরে সরু গর্ত থেকে কেবল মুখ বের করেছে এক ইঁদুরছানা। শয়তান হুলো বেড়ালটিকে দেখে ভয় পেয়েছে সে। কিন্তু ভেতরের নিরাপদ স্থানে ফেরত যাবার সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। বেড়াল মশায় ওপরে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। ওটার চোখে ভেসে আছে হিংস্রতা। কী আছে ওপরে? ওহ হো! এক শালিক ছানা যে!
কী মখমলে মায়াবী দেখতে ছানাটি। নিশ্চয়ই খুনে হুলো বেড়াল ফাঁদে ফেলে ধরতে চাইছে ছা শালিককে। হুলোটাকে লেবুগাছের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে দেখে কৌশলটা ধরে ফেলছে ইঁদুরছানা। নিশ্চয়ই পেছনের পায়ে ভর করে সামনের দুই পা দিয়ে সজোরে লেবুগাছে ঝাঁকুনি দিতে চায় ধুরন্ধর বেড়াল। মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ইঁদুর কন্যা- কোনক্রমেই শালিক ছানাটিকে মরতে দেবে না সে। পদক্ষেপ নিতে দেরি করা যাবে না। হুলোর নজর ওপরে। গর্ত থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়লো ইঁদুরছানা। চারপাশে ঘুরে দেখে নিতে চাইছে সে। বুঝতে চাইছে তার জন্য কী কী সুবিধা আছে। মা বলেছে, উদ্দেশ্য মহৎ হলে সবসময় কোন না কোন সুযোগ থাকে।
পাশের সুপারিগাছ থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে একটা কাঠবিড়ালি কন্যা। ওর সাথে চোখাচোখি হতেই বুঝে নিলো তাদের উদ্দেশ্য এক। এবার দেরি না করে একছুটে হুলো বেড়ালের পাশ দিয়েই লেবুগাছে উঠে গ্যালো ইঁদুরছানা। চোখের নিমেষে পৌঁছে গ্যালো শালিক ছানার কাছে। ততক্ষণে লেবুগাছের নিচে অবস্থান নিয়েছে শিশু কাঠবিড়ালি। ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে উঠলো শালিক ছানা।
‘ও নওল শালিক। নিচে দ্যাখো। কিন্তু ভয় পাবে না। দেখছো? ওটা একটা শয়তান হুলো বেড়াল। এক্ষুনি লেবুগাছটা ধরে তীব্র একটা ঝাঁকুনি দেবে সে। সেটা তুমি- আমি কেউ-ই সামলাতে পারবো না। তুমি কি উপর দিকে উড়তে পারবে? না মনে হয়। পাখা মেলে নিচে নামা যতটা সহজ উপরে ওড়া ততটাই কঠিন। তারচেয়ে দ্রæত পাশের ডালে চলে যাও। দূরে সরে যাও যতটা পারো। পড়লে যেনো হুলোর সামনে না পড়তে হয়। কাঠবিড়ালি নিচে অপেক্ষা করছে। ওর আশপাশে পড়বে। তোমার ওজন খুব কম। ব্যথা পাবে না। তড়িৎগতিতে কাঠবিড়ালির পিঠে চড়ে বসবে। তোমার চোখা নোখ দিয়ে শক্ত করে কাঠবিড়ালি কন্যাকে ধরবে। পরের কাজটা কাঠবিড়ালির।’
শালিক ছানা ভয় পেলেও থ্রিল অনুভব করলো। ইঁদুর কন্যার কথাগুলো মাথায় গেঁথে নিলো। বাবা সেদিন বলেছে, ‘কখনো হাল ছাড়বে না। ভালো ভালো বন্ধু বানাবে। বিপদকে ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মোকাবিলা করবে। বন্ধুরা মিলে লড়বে।’
তীব্র ঝাঁকুনি খেয়ে নিচে পড়ার আগে শালিক ছানা চোখের কোণ দিয়ে নিচে অপেক্ষমাণ কাঠবিড়ালি কন্যাকে দেখে নিয়েছিলো। অনেকটা সরে গিয়েছিলো পূর্বের জায়গা থেকে। সবকিছু ইঁদুরছানার পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটলো। ভাগ্যও সাহায্য করলো ওদের।
একদম কাঠবিড়ালির পিঠেই পড়লো শালিক কন্যা। খামচে ধরলো কাঠবিড়ালির তুলতুলে পিঠ। সড়সড় করে তেঁতুলগাছের মাথায় উঠে গ্যালো কাঠবিড়ালি। ইঁদুরছানা আরো ক্ষিপ্র। লেবুগাছ থেকে এক লাফে শক্তপোক্ত একটা তেঁতুল ডাল ধরে ফেললো।
ঘটনা বুঝতে বেশ সময় লাগলো হুলো বেড়ালটার। শালিক ছানা দিয়ে ভুঁড়িভোজের ফন্দি কাজে লাগলো না বুঝতে পেরে হতাশ হলো সে। ফ্যাল ফ্যাল করে ওপরে তেঁতুল ডালের দিকে তাকিয়ে রইলো।
ওদিকে শালিক কন্যা, ইঁদুর কন্যা আর কাঠবিড়ালি কন্যা তেঁতুল গাছের মগডালে বসে গল্প জুড়ে দিয়েছে।
‘বুঝলে বান্ধবী, ব্যাটার ভালো শিক্ষা হয়েছে আজ।’
ইঁদুর কন্যার কথায় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো অন্য দুই কন্যা। কাঠবিড়ালি কন্যা লেজ দিয়ে নিজের পিঠ নাড়তে নাড়তে অনুযোগ করলো, ‘বান্ধবী শালিক, তুমি খামচে ধরে আমার পিঠটাকে জখম করে দিয়েছো।’
খিলখিলিয়ে হাসলো ইঁদুর কন্যা। বললো, ‘ওর কি আর হুঁশ ছিলো?’
তিন বান্ধবীর মধ্যে শালিক কন্যা বেশ লাজুক। দুঃখিনী হলো সে। কাঁদোকাঁদো কণ্ঠে বললো, ‘স্যরি বান্ধবী। ভুল হয়েছে’ মৃত্যুর বিভীষিকা থেকে মাত্রই ফিরে এসেছে ও! এখনো ধাতস্থ হতে পারেনি।
‘বন্ধুদের মধ্যে স্যরি বলে কিছু নেই।’ শেষ কথাটি বললো ইঁদুরছানা।

Share.

মন্তব্য করুন