বহু বছর আগে, এক দেশে এক রাজা ছিলেন। তিনি সবসময় নতুন নতুন পোশাক পরতে ভালবাসতেন।
তার সমস্ত অর্থ পোশাকের জন্য ব্যয় করতেন তিনি।
প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় আলাদা আলাদা স্যুট পরতেন।
বড় একটা শহরে রাজার রাজধানী, সেখানে তিনি আনন্দে সময় অতিবাহিত করতেন। অপরিচিতরা প্রতিদিন রাজদরবারে আসত। একদিন, দু’জন দুর্বৃত্ত এসে, নিজেদেরকে তাঁতি বলে পরিচয় দেয়।
তারা বলেছিল যে তারা কিভাবে সবচেয়ে সুন্দর রঙ এবং নতুন নতুন প্যাটার্নের পোশাক বুনতে জানে।

‘পোশাকগুলো অবশ্যই চমৎকার হতে হবে!’ ভাবলেন রাজা। তিনি উভয় তাঁতিকে প্রচুর অর্থ দিলেন যাতে তারা তাড়াতাড়ি পোশাক তৈরি জন্য তাদের কাজ শুরু করতে পারে।
তারা সবচেয়ে সূক্ষ্ম রেশম এবং খাঁটি সোনার সুতো চাইল। রাজা তা তাদের তা দিলেন। ভণ্ড দুই তাঁতি হলের পছন্দ মতো জায়গায় পোশাক তৈরি শুরু করলো।
‘আমি জানতে চাই যে তাঁতিরা আমার পোশাক তৈরির কাজ কেমন করছে।’ রাজা মনে মনে ভাবলেন।
তাঁতিরা কেমন কাজ করছে তা দেখার জন্য একজন লোককে পাঠাতে রাজা মনস্থ করলেন।
‘আমি আমার বিশ্বস্ত পুরনো মন্ত্রীকে তাঁতিদের কাছে পাঠাব,’ রাজা শেষ পর্যন্ত চিন্তা-ভাবনা করে বললেন, পুরনো মন্ত্রী পোশাকটি দেখতে কেমন তা সবচেয়ে ভালোভাবে দেখতে পারবে; কারণ তিনি একজন বুদ্ধিমান মানুষ, অন্য কেউ এটা পারবে না।

বিশ্বস্ত বৃদ্ধ মন্ত্রী হলের মধ্যে গিয়ে দেখলেন, যেখানে তাঁতিরা তাদের খালি তাঁত নাড়াচাড়া করছে। ‘এর মানে কি হতে পারে?’ বুড়ো মন্ত্রী ভাবলেন। তারপর চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘আমি তাঁতে একটা সুতোও দেখতে পাচ্ছি না।’

প্রতারক দুই তাঁতি তাকে খুব বিনয়ের সাথে অনুরোধ করল তাকে তাদের তাঁতের কাছাকাছি আসতে। কাছে এলে তারা তাকে জিজ্ঞাসা করল যে নকশাটি তাকে খুশি করেছে কিনা আর রঙগুলো খুব সুন্দর কিনা।
বৃদ্ধ মন্ত্রী সে সময়ে খালি ফ্রেমের দিকে তাকালেন। বেচারা বৃদ্ধ মন্ত্রী তাকিয়ে দেখেন, তাঁতের উপর তিনি কিছু দেখতে পাচ্ছেন না। আসলে সেখানে কিছুই ছিল না।
বৃদ্ধ মন্ত্রী এবার নিজেকে প্রশ্ন করলেন, ‘এটা কি সম্ভব যে আমি একজন সাধারণ মানুষ? আমি যদি আসল কথাটা রাজাকে বলি তবে তিনি ভাবতে পারেন আমি আমার অফিসের জন্য অযোগ্য? না, এটাও বলা উচিত নয়। আমি কখনই স্বীকার করব না যে আমি কিছুই দেখতে পাইনি।’
‘আচ্ছা, মন্ত্রী মহোদয়!’ একজন তাঁতি বলল, ‘এখনও কাজ করার বুদ্ধি আঁটছি। আপনি বলবেন না জিনিসটি আপনাকে খুশি করেনি।’
‘ওহ, এটা চমৎকার!’ বৃদ্ধ মন্ত্রী তার চশমা দিয়ে তাঁতের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলেন। ‘এই প্যাটার্ন ও রং, হ্যাঁ, চমৎকার। আমি দেরি না করে রাজাকে বলিগে’ তারা কত সুন্দর কাজ করছে।

‘আমরা আপনার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ থাকব,’ ভণ্ড তাঁতিরা বিভিন্ন রঙের নাম এবং প্যাটার্ন বর্ণনা করল। বৃদ্ধ মন্ত্রী তাদের কথা মনোযোগ সহকারে শুনলেন, যাতে তিনি সেগুলো রাজার কাছে হুবহ বলতে পারেন।
তারপর তাঁতিরা আরও রেশম এবং সোনা চাইল। তারা বলল যে তারা যা শুরু করেছে তা সম্পূর্ণ করা দরকার।
রাজা তারপর তার দরবারের আরেকজন অফিসারকে পাঠালেন তাঁতিরা কিভাবে কাজ করছে তা দেখতে এবং পোশাকটি শীঘ্রই প্রস্তুত হবে কিনা তা নিশ্চিত হতে। সেই ভদ্রলোকও মন্ত্রীর মত সব দেখলেন। তিনি চারপাশের তাঁতগুলো জরিপ করলেন, কিন্তু খালি ফ্রেম ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলেন না।
‘এসব কি আপনার কাছে ততটা সুন্দর লাগছে না, যেমনটা আমাদের মাননীয় মন্ত্রীর কাছে লেগেছিল?’ এক প্রতারক তাঁতি অফিসারকে জিজ্ঞেস করল।
রাজার দ্বিতীয় দূত দেখলেন প্রতারকরা কিছুই করেনি।
‘আমি বোকা নই! আমি আসল কথাটা বললে রাজা ভাববেন, আমি আমার ভালো, লাভজনক অফিসের জন্য উপযুক্ত নই! এটি খুবই অদ্ভুত; তবে, কেউ এটি সম্পর্কে কিছু জানতে পারবে না।’ এবং তদনুসারে তিনি যে জিনিসগুলি দেখতে পাননি তার প্রশংসা করেছিলেন এবং ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি রঙ এবং নিদর্শন উভয়টা দেখেই আনন্দিত। তিনি ফিরে এসে রাজাকে বললেন, ‘তাঁতিরা যে পোশাক তৈরি করছে তা অসাধারণভাবে সুন্দর।’
পুরো শহরের লোকজন তাঁতিদের তৈরি রত সেই জাঁকজমকপূর্ণ পোশাকের কথা বলাবলি করতে লাগল।
রাজা নিজেই তাঁতিদের ব্যয়বহুল কাজ দেখতে চাইলেন। তখনও তার পোশাক তাঁতেই ছিল। দরবারের নির্বাচিত সংখ্যক অফিসারের মধ্যে দু’জন সৎ লোক ইতোমধ্যে কাপড়ের প্রশংসা করেছিল। তিনি ধূর্ত প্রতারকদের কাছে গেলেন, যারা রাজার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অবগত হওয়ার সাথে সাথে আরও নিষ্ঠার সাথে কাজ করার ভান করতে লাগল।
যদিও তারা তখনও তাঁতে একটি সুতোও ভরেনি।
দুই কর্মকর্তাকে তাঁতিরা বলেছিল, ‘আপনাদের মহারাজ এটা দেখে খুশি হবেন! কী দুর্দান্ত নকশা! কী জমকাল রঙ!’

‘এটা কেমন?’ রাজা নিজেই বললেন। ‘আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না! সত্যিই একটি ভয়ানক ব্যাপার! আমি কি একজন সাধারণ মানুষ, নাকি আমি একজন রাজা হওয়ার জন্য অযোগ্য? এ কথাটা হতে পারে সবচেয়ে খারাপ- ওহ! কাপড়টি কমনীয়,’
তিনি একটু থেমে জোরে জোরে বললেন, ‘এতে আমার সম্পূর্ণ অনুমোদন আছে।’
তারপর তিনি অত্যন্ত করুণভাবে হেসে শূন্য তাঁতের দিকে ঘনিষ্ঠভাবে তাকালেন।
কোন কারণেই তিনি বলবেন না যে তিনি দেখতে পাননি। তার রাজদরবারের দু’জন কর্মকর্তা কিসের কারণে এত প্রশংসা করেছেন।
রাজা ভাবলেন, তাঁতি দুজন কাজ না করে বিপুল অর্থ, রেশম ও সোনা আত্মসাৎ করলেও রাজ দরবারের কর্মকর্তারা তাদের প্রশংসা করেছে। তিনি রাজা হয়ে কেনই বা তাদের প্রশংসা করবেন না।
প্রতারক তাঁতি দুটোর জয়জয়কার হলো। তারা রাজার পোশাক না তৈরি করেই লাভবান হলো। হ

হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেন
(২ এপ্রিল ১৮০৫-৪ আগস্ট ১৮৭৫)
একজন ড্যানিশ লেখক। তিনি নাটক, ভ্রমণকাহিনী, উপন্যাস ও কবিতার একজন বিশিষ্ট লেখক। তার লেখা রূপকথার জন্য তিনি সবচেয়ে বেশি স্মরণীয়।

Share.

মন্তব্য করুন