তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে,
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই ছড়া ছোটবেলা খুব পড়েছি। এটি পড়েনি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া ভার। মাঠে ঘাটে হাওরে-বাঁওড়ে ঘুরার জন্যই যেন দুরন্ত কৈশোর। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ বাড়ির কথা মনে হতো। তখন প্রায়ই বলতাম-
ঐ দেখা যায় তাল গাছ
ঐ আমাদের গাঁ
খান মোহাম্মদ মুইনুদ্দীনের ওই ছড়া পড়ে কখনো গ্রামে তাকাতাম। কিশোর মন কি বেশিক্ষণ ঘরে থাকে! না। এ জন্য স্কুলে মাস্টারের সামনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। এই বিষয়টিও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এনেছেন এভাবে-
ঝাঁকড়া চুলো তালগাছ তুই দাঁড়িয়ে কেন ভাই
আমার মতো পড়া কি তোর মুখস্থ হয় নাই
এরকম শক্তিশালী হয়ে তালগাছ মাতিয়ে তুলছে সকলকে। চাঞ্চল্যকর এই বিষয় কি কিশোর সাহিত্য এড়াতে পারে! শুধু কি সাহিত্য! পরিবেশে সংস্কৃতিতে এমনকি ভোজন বিলাসেও তালগাছের ভূমিকা পাওয়া যায়। আকাশ ছুঁই ছুঁই তালগাছ কার না ভাল্লাগে। এটি গ্রাম বাংলার আকর্ষণীয় রূপ।
তালগাছের বৈজ্ঞানিক নাম Borassus flabellifer। ইংরেজি নামগুলো হলো doub palm, palmyra palm, tala palm, toddy palm, wine palm অথবা ice apple। এটি একটি এশিয়া ও আফ্রিকার গ্রীষ্মকালীন গাছ। এই গাছের ফলকেও তাল বলা হয়। এরা এরিকাসি পরিবারের বরাসুস গণের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। এর আদিবাস মধ্য আফ্রিকা। তালগাছ পাম গোত্রের অন্যতম দীর্ঘ গাছ যা উচ্চতায় ৩০ মিটার বা ১০০ ফুট পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। তালের পাতা পাখার মতো ছড়ানো তাই বোরাসাস গণের পাম গোত্রীয় গাছগুলোকে একত্রে ফ্যার্ন-পাম বলা হয়।
তাল ভারতীয় উপমহাদেশীয় অনেক অঞ্চলেরই জনপ্রিয় গাছ। কারণ, এর প্রায় সব অঙ্গ থেকেই কিছু না কিছু কাজের জিনিস তৈরি হয়। কিছুই যেনো ফেলা যায় না। তালপাতা দিয়ে ঘর ছাওয়া, হাতপাখা, তালপাতার চাটাই, মাদুর, আঁকার পট, লেখার পুঁথি, কুণ্ডলী, পুতুল ইত্যাদি বহুবিধ সামগ্রী তৈরি হয়। তালের কাণ্ড দিয়েও হয় বাড়ি, নৌকা, হাউজ বোট ইত্যাদি তৈরি। তালের ফল এবং বীজ দুইই বাঙালি খাদ্য। তালের ফলের ঘন নির্যাস থেকে তাল ফুলুরি তৈরি হয়। তালের বীজও খাওয়া হয় লেপা বা ‘তালশাঁস’ নামে। তালগাছের কাণ্ড থেকেও রস সংগ্রহ হয় এবং তা থেকে গুড়, পাটালি, মিছরি ইত্যাদি তৈরি হয়। তালে রয়েছে ভিটামিন এ, বি ও সি, জিংক, পটাসিয়াম, আয়রন ও ক্যালসিয়ামসহ আরো অনেক খনিজ উপাদান। এর সাথে আরো আছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি উপাদান। তবে তাল কেনার সময় নরম তাল কেনা উচিত। কারণ বেশি পাকা তাল হজম করতে সমস্যা হয়।

পেটের জ্বালাপোড়া দূর করতে সবচেয়ে কার্যকরী তালের রস। এসিডিটির সমস্যা দূর করতে তালের রস খুবই উপকারী। ত্বকের যতেœও তালের ব্যবহার অনেক। গরমে ঘামাচি থেকে মুক্তি পেতে তাল অনেক ভালো কাজ করে। তালের উপরের পাতলা স্তরটি সরিয়ে নিয়ে তালের শাঁসের ভেতরের রস আক্রান্ত স্থানে লাগালে শীতল অনুভূতি পাওয়া যায়। একইসাথে ঘামাচির চুলকানি দূর হয়। অত্যধিক তাপে ত্বকের যে লালভাব হয় তা নিরাময়ের কাজ করে তালের রস।
প্রকৃতিকে ভালোবেসে দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করে তালগাছ। মাঝে মাঝেই সরকারি সতর্কবার্তায় শুনা যায়, ‘বাড়ির আনাচে কানাচে তালগাছ লাগান’। কেন তারা এই কথা বলেন? তালগাছ বজ্রপাত থেকে রক্ষা করে। দেশে বজ্রপাতজনিত মৃত্যুর হার কমানোতে অপরিসীম ভূমিকায় থাকে তালগাছ। তাই বলতে বাধ্য হই এভাবেই-
তালগাছ!
সব গাছ ছাড়িয়ে
ভাবনাকে খাঁটি করে
মাথাটাকে উঁচু করে
মেঘ-রোদ তাড়িয়ে
সেই সাথে-
বল দেয় বাড়িয়ে!
বিজলির রাগ খেয়ে
তুফানের পাক খেয়ে
ঠাডাদের মাড়িয়ে।
জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ে কাঁচা তাল ফলের শাঁস পাওয়া যায়। এই শাঁস খাওয়ার জন্য কিশোরেরা বেশি পাগল হয়। কখনো চলে শাঁস খাওয়ার প্রতিযোগিতা। ইদানীং শহরে ওই সময়টাতে তালের শাঁসের দেখা মেলে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে তালগাছের তলায় গেলেই পাকা তালের সুবাসে মন জুড়িয়ে যেত। এমনকি ভাগ্যে থাকলে দুই-চারটি পাকা তালও পাওয়া যেত। গাছ থেকে ধুপ ধাপ শব্দে তাল পড়লে তা দূর থেকেই শোনা যেত। এই সময়টাতে পাকা তালের মৌ মৌ গন্ধে ভরে উঠতো প্রতিটি বাড়ি।
বাড়ির ঝি-বউয়েরা পাকা তালের আটি থেকে হলুদ রস বের করতো। এরপর সেই রস দুধ ও কোরানো নারকেলসহ জ্বাল দিয়ে ঘন করে পিঠা বানাতো। তালের পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যেত ঘরে ঘরে। শুধু তালের ভাজা পিঠাই নয়, তালের রুটি, তালের চুসি, তালের বড়া ও তালসত্ত্বসহ আরো কতো বাহারি রকম পিঠা! মেহমানদারিতে সেসব পিঠা ছিল স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয়। এখন সেই চিত্র আগের মতো নেই! একসময় গ্রামবাংলার অধিকাংশ বাড়ি, রাস্তা ও মাঠের প্রচুর তালগাছ দেখা যেত। তালগাছে বাবুই পাখির দারুণ সুন্দর বাসা থাকতো। হাজার হাজার বাবুই পাখির কিচির-মিচির ডাকের মনোরম দৃশ্যও চোখে পড়ে না আর।
গাছ কাটার ভয় নামক দুঃখ তালগাছেরও আছে। এই জন্যই আগের মতো বেশি তালগাছ দেখা যায় না। তবু নিজস্ব গৌরবে তালগাছ তার ঐতিহ্য রক্ষা করে চলেছে। মা মাটি প্রকৃতি আর নিজের জন্য মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ফলে সবাই তালগাছের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে। আমরাও তালগাছের মতো ভয়, দুঃখ আর বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে জাগবো! জাগাবো। মা মাটি মাতৃভূমি আর নিজের প্রয়োজনে পিছিয়ে থাকবো না কখনো। এই কথা আরো জোরালো করতে চাই এভাবে-

আমরাও!
দুঃখের বায়ুতে
তালগাছ জান হবো
মা মাটির প্রাণ হবো
জীবনের আয়ুতে।

Share.

মন্তব্য করুন