এক যে ছিল শহর। অদ্ভুতুড়ে এক শহর সেটা। সেখানকার লোকজন সবাই ভীষণ অলস। কেউই কোনো কাজকর্ম করতে চায় না। শুয়ে বসে আড্ডা দিয়ে তাদের সময় কাটে। দিন রাত সব সময়। কাজ করাকে তারা অপমান বলে মনে করে। কাজ করতে গেলে কষ্ট আছে। মজুরের মতো সেই কষ্ট কেউ করতে নারাজ। মেহনত করে বেকুবেরা। ফাও ফাও যদি আরাম আয়েশ করা যায়, সব কিছু হাতের নাগালে মেলে, তাহলে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। তারা ভাবে, শুধু শুধু গায়ের ঘাম ঝরিয়ে কী লাভ? এরচেয়ে বাপু এই তো বেশ আছি। গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ানো যায়। শরীর মন হালকা ফুরফুরে থাকে সারাক্ষণ।

ওই শহরের কোনো লোকই যার যার বাড়ির আঙ্গিনা ঘরদোর পরিষ্কার করে না। রাস্তাঘাট সাফসুতরো করার তো প্রশ্নই ওঠে না। সারা বছর ফসল, সবজির খেত নানারকম আগাছায় ভরপুর থাকে। কেউই সেদিকে কোনো নজর দেয় না। কোনো দরকারই মনে করে না। এই যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি, সেটা শহরের যিনি প্রধান, সেই ভদ্রলোকের মোটেও পছন্দ না। রাজ্যের কুঁড়ে লোকদের নিয়ে তিনি আছেন মহাবিপদে। এদের তিনি মোটেও সুনজরে দেখেন না। ঘৃণা করেন রীতিমতো। কখনোই কেউ কোনো কাজকর্ম করবে না, এটা একটা কথা হলো নাকি? ছি ছি ছি, বড়ই শরমের ব্যাপার। এটা কোনো স্বাভাবিক বিষয় না। অন্য শহরের লোকেরা জানলে মাথা কাটা যাবে। কাউকে মুখ দেখানোর কোনো উপায় থাকবে না।

দিন যায়। মাস যায়। বছর গড়ায়। দেখতে দেখতে শহর এত বেশি নোংরা হয়ে গেল যে, টিকে থাকাটাই দায় হয়ে দাঁড়ালো। দুর্গন্ধে পথ চলা মুশকিল। শহর-প্রধান ঠিক করলেন, শহরজুড়ে তিনি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভিযান চালাবেন। সবজি ও ফসলের ক্ষেত থেকে ফালতু আগাছাগুলো তুলে ফেলতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। রীতিমতো ঢাকঢোল পিটিয়ে, অনেক প্রচারের পর অভিযান চালানো হলো। পরিকল্পনা তার ভালো ছিল ঠিকই। উদ্দেশ্যও ছিল মহৎ। কিন্তু হায়! এই অভিযানে কোনো সুফলই পাওয়া গেল না। কারণ এত অল্প লোক এতে হাত লাগালো যে কাজের কাজ কিসসু হলো না। সমস্যা যেমন ছিল, ঠিক তেমনই থেকে গেল।

একদিন প্রচণ্ড ঝড় হলো। এত বড় ঘূর্ণিঝড় কেউ কখনো দেখেনি। ঝড়ের নির্দয় তাণ্ডবে শহরের বেশির ভাগ গাছপালা গেল উপড়ে। সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে রাস্তা, সেটি গেল বন্ধ হয়ে। বিরাট বড় একটা গাছ পড়ে আছে সেই রাস্তায়। শহরের বড় যে বাজার, সেখানে যেতে হলে এই রাস্তা দিয়েই যেতে হয়। বলা চলে, একপ্রকার অচলাবস্থা দেখা দিলো। ঝড় থেমেছে বটে। কিন্তু বিপর্যয়ের সবে শুরু। সবার আগে যে লোকটি তার পণ্য নিয়ে বাজারের দিকে রওনা হয়েছিল, সে এখানে এসে তাজ্জব। উরে সর্বনাশ। এই রাস্তা দিয়ে হাঁটা চলার করা কোনো উপায় নেই যে। সে আপনমনে বিড়বিড় করলো:
এই গাছ সরানোর কাজ তো আমার না রে ভাই। যেমন আছে তেমনটাই থাকুক পড়ে। যত তাড়াতাড়ি পারি মাল নিয়ে বাজারে পৌঁছুতে হবে আমাকে। গাছ সরানোর কাজ করার মতো ঢের ঢের লোকজন আছে। তারা নিশ্চয়ই করবে এ কাজটা। এরপর এই পথে দ্বিতীয় জন এলো। সে কোনো গা করলো না। তৃতীয় জনের ভাবগতিকও একইরম। যে যার কাজে চলে গেল। লোকজনের আসা-যাওয়া ক্রমেই বাড়লো। কিন্তু কোনো লাভ নেই। তাদের কেউই হাত লাগালো না এই কাজে। যে যার গন্তব্যে চলে গেল। গাছ পড়ে থাকলো রাস্তাজুড়ে।
শহরের যিনি প্রধান, তার কানে গেল খবরটা। তিনি খুবই চিন্তিত যে একটা রাস্তা এতক্ষণ ধরে আটকে আছে। এতে সব্বারই খুব অসুবিধা হচ্ছে চলাফেরায়। দ্রুত এর একটা বিহিত করা দরকার। অফিসের লোকজনের উদ্দেশ্যে তিনি হাঁক দিলেন,
ওহে, কে কোথায় আছো তোমরা? কয়েকজন মিলে তো এই গাছটা এতক্ষণ সরিয়ে ফেলতে পারতে। এমন কোনো কঠিন কাজ ছিল না সেটা। কী অলস যে তোমরা হয়েছো এক এক জন। তোমাদের নিয়ে আর তো পেরে উঠছি না বাপু। এভাবে কি একটা শহর চলতে পারে?
তার কথায়, ব্যাকুল আহ্বানে কেউ সাড়া দিলো না। আলসে, গপ্পবাজ লোকের দল পাত্তাই দিলো না এ কথার। কয়েক দিন কেটে গেল। গাছ সরানোর কোনো তাগিদ নেই কারোই। শহরের প্রধান অনেক ভাবলেন এই সমস্যাটা নিয়ে। অনেক ভাবনা-চিন্তা করে সমস্যা সমাধানের উপায় বের করলেন। মজার একটা পরিকল্পনা আঁটলেন তিনি। পরের দিন খুব সক্কালবেলা তিনি চলে গেলেন সেই রাস্তায়। তখনো সূর্য ওঠেনি। চারপাশে আবছা অন্ধকার। কয়েকজন বিশ্বস্ত চাকরবাকর আছে তার সঙ্গে। চাকরদের তিনি বললেন, গাছটার ঠিক নিচে একটা গর্ত খুঁড়তে। তাই করা হলো। দশটা চকচকে সোনার মোহর তিনি সেই গর্তে লুকিয়ে রাখলেন। তারপর সেই গর্তটা পড়ে থাকা গাছের পাতা, ডালপালা দিয়ে নিখুঁতভাবে ঢেকে দেয়া হলো। ব্যাপারটা যেন এক্কেবারে গোপন থাকে, সে বিষয়ে চাকরদের শপথ করালেন তিনি। ওদের সাবধান করে দিলেন এ ব্যাপারে।
বাড়ি ফিরে গেলেন শহর প্রধান। নকিবকে দিয়ে তিনি ফরমান জারি করালেন যে, বিকেলে যেন শহরবাসী সবাই ওই গাছের কাছে হাজির থাকে। কেউ না এলে শাস্তি পাবে।
বিকেলে সবাই ওখানে গিয়ে সমবেত হলো। তিনি আবারও তাদের বললেন,
তোমরা যদি আলসেমি না করতে, সব্বাই মিলে একটু হাত দিতে, তাহলে এই গাছ এতদিন এখানে এভাবে পড়ে থাকতো না।
তোম্বা মুখো এক চাষি জবাব দিলো,
জনাব, এই গাছ তো আমরা কেউ এখানটায় ফেলিনি। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে গাছটা পড়েছে। বেকায়দা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে সে জন্যই। বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ একটা বিশাল গাছ উপড়ে পড়ার ফলে বন্ধ হয়েছে রাস্তা। কাজটা যেহেতু ঘূর্ণিঝড়ের, সুতরাং সেই ঘূর্ণিঝড়েরই দায়িত্ব এটা সরিয়ে নেয়ার। আমাদের কারো কিছু করার নেই।
শহরের প্রধান মোটেও খুশি হলেন না এ কথায়। অপদার্থ লোকটির উপর ভীষণ বিরক্ত হলেন। তিনি রাগতকণ্ঠে বললেন,
অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে কোনো লাভ হয় না কোনো সময়। তোমাদের মাঝে এমন উদ্যমী সাহসী কেউ কি নেই, যে কাজটা সেরে ফেলতে পারে? অন্তত একটু চেষ্টা করে দেখতে পারে। অমন কেউ কী আছো এখানে? থাকলে সাড়া দাও দয়া করে।

তরুণ এক চাষি এগিয়ে আসে এ কথা শুনে। বেশ উদ্যমী ও আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে তাকে। তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা বিশেষ ভালো না। বলতে গেলে বেশ গরিবই তারা। এক বেলা খাবার জোটে তো অন্য বেলা অনিশ্চিত। কাজ খুঁজতে খুঁজতে সে হয়রান। শহরের অন্য সব লোকের চেয়ে সে একটু আলাদা ধরনের। আলসেমি মোটেও ভালো লাগে না তার। সে একাই ভারী গাছটা সরানোর কাজ শুরু করে দেয়। একা একা তার পক্ষে এমন কঠিন একটা কাজ করা প্রায় অসম্ভব। এটা জেনেও সে দমে যায় না। প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে। মনোবলের কোনো ঘাটতি নেই তার। শহর প্রধান সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছিলেন। তিনি দেখলেন, কেউই ওকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসছে না। বরং অবিশ্বাস ও তাচ্ছিল্যের চোখে চেয়ে আছে সবাই। শহর প্রধান তখন হুকুম দিলেন তার চাকরেরা যেন ওকে সাহায্য করে।

সম্মিলিত চেষ্টায় গাছ অপসারণ করা সম্ভব হলো শেষ পর্যন্ত। অনেকটা সময় লাগলো যদিও। কাজ শেষ। শহর প্রধান সেই সাহসী তরুণকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানালেন। গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর ওকে সঙ্গে নিয়ে সোজা চলে গেলেন গর্তের কাছে। যেখানে সোনার মোহরগুলো লুকানো আছে, ঠিক সেখানটায়। তিনি তরুণকে ওই গর্ত খোঁড়ার আদেশ দিলেন। খোঁড়ার কাজ শুরু করার ঠিক আগে তরুণকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করালেন যে, গর্তের ভেতর যা পাওয়া যাবে, সেটা তাকে নিতে হবে। এটা অনুরোধ নয়। রীতিমতো আদেশ।
তরুণ তাই করলো। আচমকা দশ দশটা সোনার মোহর পেয়ে সে মহাখুশি। এখানে যে সোনা পাওয়া যেতে পারে, সেটা কল্পনায়ও ছিল না তার। মনে মনে নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানায় সে।
শহর প্রধান তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন,
বাছা, এর সবই তোমার। তুমি অনেক পরিশ্রম করেছো। কঠিন কাজটা শেষ করতে সক্ষম হয়েছো। সে কারণে এখানকার সব মোহর তোমারই প্রাপ্য।
অলস নগরবাসীর উদ্দেশে তিনি বললেন,
এই যে ঘটনাটা ঘটলো, সেটা তোমাদের সবার জন্য শিক্ষণীয় একটা ব্যাপার। নিজের চোখেই তোমরা দেখলে কিভাবে কেমন করে সব ঘটলো। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো যে, আলসেমি করলে কখনোই ভালো কিছু পাওয়া যায় না। যে কঠিন পরিশ্রম করতে আগ্রহী, সমস্যা দেখে পিছপা হয় না, পুরস্কারটা শেষমেশ তার ভাগ্যেই জোটে।

Share.

মন্তব্য করুন