সাতসকালে ঘুম ভাঙার পর মুরগিগুলোর কিচকিচ, কক্ কক্, কুকরুকু, কুকরুসকু কলরবে উঠোনটায় মুরগিজট লেগে যায়। ভোরের আজানের আগে ও পরে মোরগের ডাক, সকালের সৌন্দর্যটা বাড়িয়ে দেয়, কিন্তু সকালে যখন হুলুস্থুল লাগায়, তখন বাবার কপালের ভাঁজ ধীরে ধীরে কুঞ্চিত হতে থাকে। মুখে একটা গম্ভীর বিস্ফোরণের মতো তৈরি হয়। ঘর থেকে বেরিয়ে বড় ভাই দাঁত খিঁচিয়ে মুরগিগুলোর উপরে রাগ ঝাড়েন। মা কিন্তু কিছুই বলেন না, খাবার খাইয়ে, বাইরে তাড়িয়ে দেন।
তাড়িয়ে দিলে হবে কি, তার আগেই কম্ম সারা। তার মানে মুরগিগুলো বিষ্টাবর্ষণ করে উঠোনটা ভরিয়ে ফেলে। সেগুলো কিছুক্ষণ পর কাঠের গুঁড়ো দিয়ে ঢেকে দেয় শানুর মা এবং পরে পরিষ্কার করে ফেলে। দিনে দিনে মুরগিগুলো হয়ে উঠলো বাবার আর বড় ভাইয়ের চোখের বিষ। খুব বেশি না আট দশটা মোরগ মুরগি তাও।
আমাদের কিন্তু ভালোই লাগে। বিশেষ করে আমার আর বড় আপার। আমরা মুরগিগুলোকে খাওয়াই, যত্ন করি। আমাদের বাড়ির দুই পাশে দুই টিনের ঘর মধ্যে এক চিলতে উঠোন, তার একধারে রান্নাঘর, অন্য ধারে মুরগির খাঁচা।
মাঝে মধ্যে হঠাৎ মেহমান এসে পড়লে, পাড়ার ছেলেদের নিয়ে মুরগি ধরার কাজ পড়ে। শুরু হয় এক মজার যুদ্ধ। মুরগি ধরার জন্য ধাওয়া করা হয়, ধাওয়া খেয়ে মুরগিগুলো একবার খাটের তলায়, আরেকবার কচুক্ষেতে, আবার কখনো ঝোপ জঙ্গলে, হলদি ক্ষেতের মধ্যে। আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে যখন মুরগি ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন একটা অথবা দুটো খপ করে ধরে ফেলি। তারপর জবাই করে মেহমানদের ভোজনের ব্যবস্থা হয়। এদিন কিন্তু বড় ভাই আর বাবা খুব খুশি থাকেন। কেননা মেহমানদের উসিলায় সবারই ভোজন হয় মায়ের মুরগিতে। আসল কথা হলো, ভোজনও হলো মুরগিও কমলো। তার মানে বাবা আর বড় ভাইয়ের ইচ্ছে মুরগিগুলো ভোজন করে পেটের স্বাদ মেটানো। মা আগেই বুঝে গিয়েছিলেন তাদের জিভ লকলকে মতলব।
একটা মুরগি যখন ডিম পাড়া শেষ করে, তখন সেই ডিমগুলো থেকে বাচ্চা ফোটানোর আয়োজন করেন মা। মুরগিটাকে ডিমগুলোর উপর বসিয়ে দেন, আর মুরগিটাও বাচ্চা ফোটানোর জন্য তা দিতে বসে পড়ে। দিন রাত ডিমে তা দেয় আর কুক কুক করে, খাবার খেয়ে যায়।
প্রয়োজনে মুরগিগুলোর চিকিৎসাও হয়। কোন মুরগির পাখা ভাঙলে, কোন বাচ্চাকে চিলে অথবা কাকে আহত করে গেলে, মা সেখানে হলুদ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দেন, এসব দেখে আমরা হাসাহাসিই করি। কোন বাচ্চার মাথায় ঘূর্ণিরোগ হলে, মা একটা বেতের তৈরি পাত্রের তলায় রেখে, উপরে একটা ছড়ি দিয়ে ঢপ ঢপ করে আঘাত করেন আশ্চর্য ব্যাপার, বাচ্চাটার মাথা ঘূর্ণিরোগ সেরে উঠে। স্বজ্ঞানে সেটা আবার উঠে দাঁড়ায়।
তাছাড়া তিন মাস পর পর ইঞ্জেকশন। আর বাচ্চা ফুটলে চোখে ওষুধের ফোটা। যেদিন ইনজেকশন দেওয়া হবে, সেদিন পশু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া আমার উপর ন্যস্ত। পাড়ার অনেকেই মুরগির ইনজেকশন দিতে যায়। হাসপাতাল খুব বেশি দূরে নয়, আমরা সবাই মুরগিগুলোর পা বেঁধে, পাখা মুচড়ে, ঝাঁকায় করে, চলে যেতাম। বাবা একটা চিরকুট লিখে দিতেন। ডাক্তার নাকি বাবার পরিচিত। চিরকুটে লেখা থাকতো, ডাক্তার ভাই, আমার ছেলেকে পাঠালাম মুরগিগুলোর ইনজেকশন দিয়ে দেবেন। সেই চিঠি গিয়ে ডাক্তারকে দিতাম। চিঠি পড়ে ডাক্তার বলতো লাইনে দাঁড়াও, চিরকুট লিখে তেমন কোন সুবিধা ছিল না। সবাই যেমন লাইনে দাঁড়ায় আমিও তেমন লাইনে। তার মধ্যে যদি কারো মুরগি ছুটে যেত, তাহলে হুলুস্থুল অবস্থা। মুরগি ধরার জন্য সবাই মিলে ‘দশে মিলি করি কাজ’ বলে মুরগিটা ধরে ফেলি। এভাবেই চলছে মায়ের মুরগি পোষা।
একদিন মুরগির বাচ্চা ফুটে গেল। মুরগি কক্ কক্ করে বাচ্চাগুলো সামলাতে ব্যস্ত, আর বাচ্চাগুলো চিক্চি ক্ করে মুরগি মায়ের আদর খেতে পাখার তলায়। তখন বাবার মেজাজ আরও খারাপ হয়। এমনি তো আট দশটা মুরগি তারপর আবারও বাচ্চা তোলা হচ্ছে? যাহোক বাচ্চাগুলোর বয়স সপ্তাহ পার হলে, যখন একটু হাঁটাহাঁটি চলাফেরা করতে শিখল। মা সেগুলোকে খলুয়ে ভরে বললেন, যা চোখে ফোঁটা দিয়ে আয়। আমিও যেতাম চোখে ফোঁটা দিতে। এইভাবে মায়ের সাথে মুরগিগুলোর প্রতি আমিও ছিলাম সমব্যথী।
একদিন সকালে কি যে হলো মুরগিগুলোর ঝিম ধরে থাকলো, সাথে চুনো বিষ্ঠা।
মায়ের আদেশে চললাম ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার ওষুধ দিলেন, মা সেই ওষুধ হলুদের সাথে মিশিয়ে খাওয়ালেন। তবু ঝিম ধরা কাটলো না। মা নিজের ডাক্তারিতে খাওয়ালেন প্যারাসিটামল, ফ্লাজিল। কিন্তু কোন কাজ হলো না। পাড়ার দাদু একদিন চা খেতে এসে বললেন, মুরগিগুলো এখনো জবাই করে খাওয়া যাবে, অসুখ ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে না। এ কথা শুনে বড় ভাই আর বাবার চোখ চকচক্ করে উঠলো। মা আরো চেষ্টা করলেন, কিন্তু কোনো ফল হলো না। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন জবাই করে রান্না করার।
তারপর আর কী হবে, মুরগিগুলো একে একে আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য হয়ে গেল। বাবা আর বগ ভাই গোশত দিয়ে মজা করে খান আর মায়ের প্রশংসা করেন, কিন্তু মা সে মুরগিগুলোর গোশত খেলেন না। দিনে দিনে বাড়ির উঠানটা মুরগি শূন্য হলো। সবাই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সকালের আযানের আগে পরে কুকরুসকু ডাক বন্ধ হয়ে গেল।
এক সপ্তাহ দুই সপ্তাহ গেল, আমাদেরও যেন আর ভালো লাগে না, বাবা কিছুই বলেন না, বড় ভাই সকালে বিরক্ত বোধ করেন না, কিন্তু তাদের মধ্যে কি যেন একটা নেই, নেই ভাব। সকালে মোরগের ডাকটা যেন আমাদের বাড়ির সাথে একাত্ম হয়ে ছিল।
আমারও কাজ কমে গেল, আর মুরগি মাথায় করে পশু হাসপাতালে যেতে হবে না। তারপরও মনে হলো মুরগিগুলোর চিকিৎসা করতে যাওয়াতেই যেন মজা ছিল।
প্রতিবেশী এক খালা ছিলেন তার অনেক মুরগি। তিনি আমাদের বাড়িতে এসে মার সঙ্গে মুরগির গল্প করেন। মা শুনেন আর মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। সেই ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি মায়ের মুরগি পোষা। শানুর মাকে নিয়ে বাড়ির সব কাজের সাথে মুরগিগুলোও দেখাশোনা করতেন। কিন্তু এখন তিনি কী করবেন, ভেবে পান না। আমার বন্ধুরা এখনো তাদের মুরগিগুলো ইঞ্জেকশন দিতে নিয়ে যায়, সে গল্প স্কুলেও হয়। আমি সেসব মজার গল্প শুনি আর হাসি।
এভাবে চলে গেল আরো কটা দিন। আমার মনে হয়, মা তার মুরগিগুলোর কথা ভাবেন আর কষ্ট পান। মুরগি না থাকলেও মুরগির খাঁচাটা ঠিকই আছে। সেটা কেউ ভেঙে ফেলার কথা অথবা সরিয়ে ফেলার কথা বলে না। একদিন দেখলাম মা শানুর মাকে দিয়ে খাঁচা পরিষ্কার করে রেখে দিলেন। কেন পরিষ্কার করালেন সে বিষয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন করলো না।
সন্ধ্যেবেলায় যখন খেলার মাঠ থেকে ফিরছিলাম, তখন দেখলাম, মা পাশের বাড়ির খালার সাথে হেসে হেসে গল্প করছেন। ঘরে ঢুকে নিয়ম মতো পড়তে বসে গেলাম। কিছুক্ষণ পড়ার পর মা এসে বললেন, সকালে স্কুল ঘুমিয়ে পড়।
ভোররাতের আজানের সময় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল, শুনতে পেলাম মোরগের কুকরুস কুক ডাক। খালার বাড়িতে ডাকছে, তাই ঘুমিয়ে গেলাম। সকালে মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। উঠোনে চোখ পড়তেই আমার চোখ তো ছানাবড়া। শানুর মা দুটো মুরগি আর একটা মোরগকে খাবার দিচ্ছে। আমি তো হতবাক। মার দিকে একবার, বাবার দিকে একবার দেখলাম। মার মুখে হাসি, বাবার মধ্যেও কোন বিরক্তি নেই, রাগ নেই। তিনি বারান্দার চৌকিতে বসে কি যেন লিখছেন।
বড় ভাই ঘুম থেকে উঠে বের হতেই চমকে উঠলেন, তারপর হাসি হাসি মুখে শানুর মাকে বললেন, মুরগিগুলোর খাওয়া হলে তাড়িয়ে দিও। আর উঠোনটা পরিষ্কার করে ফেলবে। এ কথা বলে বড় ভাই হেসে ব্রাশ করতে চলে গেলেন।
আমি মার দিকে তাকাতেই দেখলাম, মায়ের মুখে বিজয়ের হাসি।

Share.

মন্তব্য করুন