পরীর বয়স দশ বছর। দু’ বছর ধরে পরী তৃণাদের বাসায় কাজ করছে। তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়, আবার সহজও নয়।
রাত বারোটার পর ঘুমোতে যায় পরী- ঘুম থেকে উঠে ফুলগাছে পানি দেয়। সে কাজ শেষ করে সংসারের টুকিটাকি কাজে হাত লাগাতে হয়। ওই টুকিটাকি কাজগুলোই জিরোতে দেয় না পরীকে। এ বাসার কাজগুলো যেন শিকলের মতো সাজানো থাকে। একটা শেষ হতে না হতেই অন্য একটা কাজ সামনে এসে দাঁড়ায়। সে সব খুব গুছিয়ে শেষ করে পরী। কারো কোনো অভিযোগ শোনা যায় না পরীকে নিয়ে। তবে তৃণার ছোট মামার অভিযোগের অন্ত থাকে না। কোনো কাজ করেই পরী তাকে খুশি করতে পারে না। কেন যে সব কাজেই মামা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন, পরী তা ভেবে পায় না।
সকালে উঠেই মামা হাঁক ছাড়েন- পরী? চা দিয়ে যা।
মায়ের হাতের চা না হলে মামার চলে না। আর নাশ্তা বানানো শেষ না করে মা চা বানিয়েও দেন না। এতে চা পেতে মামার দেরি হয়। আর সে কারণে মামার মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়। মামা বলেন, চা নিয়ে আসতে এতো দেরি হলো কেন? জানিস না সকালে এক কাপ চা না খেলে আমার মেজাজ ঠিক থাকে না? যত্তসব ফাঁকিবাজ।
কলেজ থেকে ফিরে মামা নতুন করে ঝড় বইয়ে দেন। স্যান্ডেল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কেন, বিকেলের নাশ্তা তৈরি হয়নি কেন- এমন হাজারটা প্রশ্নের জবাব দিতে হয় পরীকে। কোনো প্রশ্নের জবাব যদি মামার মনের মতো না হয়, তো মামা বলেন পরী এক অকর্মা মেয়ে। শুধু খেতে আর ঘুমোতে জানে সে। ওকে তাড়িয়ে দিতে হবে।
মামা যখন তাড়িয়ে দেয়ার কথা বলেন পরীর বুকের ভেতর তখন মুচড়ে ওঠে। আশ্রয় হারাবার ভয়ে পরী কুঁকড়ে যায়। তবে মামা এ কথা শুধু মুখেই বলেন। বোনকে বলে পরীকে তাড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন না। কারণ মামা জানেন, পরীকে তাড়িয়ে দিলে রাতারাতি কোনো কাজের মেয়ে পাওয়া যাবে না। আর পাওয়া গেলেও সে হয়তো পরীর চেয়েও অপটু হবে।
এ বাড়ির সবাই ঘুমোতে যাবার পর পরী ঘুমোতে যায়। সে সময় ওর ক্লান্ত শরীর অসাড় হয়ে পড়ে থাকে। কিন্তু চোখে ঘুম আসে না। তখন পরী ওর বাবা-মায়ের কথা ভেবে চলে। গেন্ডারিয়ার ঘুন্টিঘর বস্তির এক ছাপরাঘরে পরী ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতো। রিকশাচালক বাবা মাঝরাতে ফিরে এসে পরীর হাতে লজেন্স নয়তো বিস্কুট তুলে দিতেন। কোনো কোনো দিন নিয়ে আসতেন পুঁতির মালা নয়তো কানের দুল- তা নিয়ে মায়ের অভিমানের অন্ত থাকতো না। মা বলতেন, এ দুনিয়ায় তোমার শুধু ওই একটা মেয়েই আছে- বউ নেই। সাত বছর ধরে সংসার করছি। একদিনও আমার জন্য কিছু নিয়ে এলে না!
বাবা বলতেন, পরীর চেয়ে সুন্দর আর দামি কিছু চোখে পড়ে না আমার। সেই পরীকে রেখেছি তোমার কাছে। তাই তোমার জন্য কিছু আনা হয় না।
পরীর মা বলতেন, ঠিক বলেছো। পরীর দিকে তাকালে আমি সব দুঃখ ভুলে যাই। পরী আমাদের অমূল্য ধন।
সেই মা যখন মারা যান পরী তখন বাবাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু একদিন বাবাও আর ফিরে আসেননি। পরী শুনেছে, ট্রাকের নিচে পড়ে তিনি মারা গেছেন। তারপর বস্তির রানুুর মা ওকে তৃণাদের বাসায় রেখে গেছে। সেই থেকে পরী এ বাসায় কাজ করছে।

দুই.

বিকেলে রান্নাঘরে কাজ করছিল পরী। সে সময় মামা এসে বললেন, ছাদ থেকে গেঞ্জি নিয়ে আয়।
লুচি বানাবার জন্য ময়দা ছানছিল পরী। সে কাজ বন্ধ রেখে গেঞ্জি আনার জন্য সে ছুটে গেল। কিন্তু ছাদের কোথাও মামার গেঞ্জি খুঁজে পেল না। এ কথা শুনে মামা রেগে আগুন হলেন। বললেন, আমি নিজে ওটা ছাদে রেখে এসেছি। যাবে কোথায়? যা, ভালো মতো খুঁজে দেখ্।
ভালো মতো খোঁজাখুঁজি করার পর গেঞ্জিটাকে পাশের বাড়ির হাউজ ড্রেনে পাওয়া গেল। ক্লিপ লাগানো হয়নি, তাই বাতাসে উড়ে সেখানে গিয়ে পড়েছে। এতে পরীর কোনো দোষ ছিল না। কিন্তু মামা বললেন, বাতাস বইবার আগেই যদি গেঞ্জিটাকে নামিয়ে আনতি, তাহলে আর এমন সর্বনাশ হতো না।
পরী ভয়ে ভয়ে বলল, বাতাস বইবার আগেই আনতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তখন ওটা শুকোয়নি। তাই রেখে এসেছি।
: সব মিথ্যে কথা। যা এখান থেকে।
এ কথা বলে মামা পরীর কান মলে দিলেন। তাতে পরীর কানের চেয়ে মনে বেশি ব্যথা পেল। বুকভরা ব্যথা দিয়ে পরী রান্নাঘরে গেল। সেখানে ওর জন্য থরে থরে কাজ সাজানো ছিল। সেই কাজে ডুবে গেল সে।
বিকেলের নাশ্তা বানানো শেষ করে পরী যখন মাত্র চুলোটা নিভিয়েছে, সে সময় তৃণার মা এসে বললেন, আমরা বেড়াতে যাচ্ছি। ফিরে আসতে রাত হবে। তুই সাবধানে থাকিস।

তিন.

বাসার সবাই চলে যাবার পর থেকে পরী একাই ছিল। বারান্দায় বসে সে আকাশ দেখেছে। পাখিদের সঙ্গে মনে মনে উড়ে বেড়িয়েছে। সময় কেটেছে হু হু করে। কিন্তু সন্ধ্যা হবার সঙ্গে সঙ্গে যখন বিদ্যুৎ চলে গেল, নিজেকে তখন পরীর ভীষণ একাকী মনে হলো। আর মনে হলো, ওর এখন আলো দরকার। আর সে আলো দিতে পারে একমাত্র চাঁদ।
চাঁদের আলো গায়ে মাখার জন্য পরী ছাদে উঠে গেল।
তৃণাদের ছাদে অনেক ফুল গাছ রয়েছে। নানা রঙের ফুল ফুটে আছে সে সব গাছে। চাঁদের আলোয় ফুলগুলোকে আরো সুন্দর দেখাচ্ছে। পরী তেমনি একটা ফুলগাছের পাশে গিয়ে বসলো। তারপর অপলক চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। সেই আকাশে আলো ঝলমল চাঁদ উঠেছে। সেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে পরী ওর বাবা-মায়ের কথা ভেবে চলল। সেসব ভাবতে ভাবতে যেই মাত্র পরীর চোখ থেকে একফোঁটা কান্না ঝরে পড়ল, অমনি পরী এক মিষ্টি কণ্ঠ শুনতে পেল- তোমার কি হয়েছে? এমন আলোঝরা রাতে তুমি কাঁদছো কেন?
সেই মিষ্টি কণ্ঠ শুনে পরী এদিক-ওদিক তাকালো। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। তখন অবাক হয়ে বলল, কে কথা বলছো? আমি তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না!
পরী এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই মিষ্টি কণ্ঠ ভেসে এলো- দেখতে পাচ্ছো, তবে বুঝতে পারছো না। তুমি যে গাছের পাশে বসে আছো, আমি সেই গাছের ফুল নয়নতারা।
: তুমি নয়নতারা? কি মিষ্টি নাম তোমার! আর কণ্ঠস্বরও খুব মিষ্টি!
পরী বলল। আর সে কথা শুনে নয়নতারা বলল, আমাকে সুন্দর বলার জন্য ধন্যবাদ। কিন্তু তুমি কাঁদছো কেন? কি এমন দুঃখ তোমার?
পরী বলল, অনেক দুঃখ। জানো তো আমি এক কাজের মেয়ে। দিনরাত শুধু কাজই করে যাই। একটুও জিরোবার সুযোগ পাই না। তার ওপর দোষ না করেও মামার কাছে শুধু বকুনি খেতে হয়। যখন-তখন মামা কান মলে দেন।
নয়নতারা বলল, আহা রে! সত্যি সত্যিই তোমার অনেক দুঃখ। তুমি একটু জিরোতেও পারো না।
পরী বলল, জিরোতে পারি না বলে দুঃখ নেই। আমার দুঃখ অন্য কারণে।
: কী কারণ? সেই কারণটাই বলো। আমি শুনবো।
পরী বলল, দু’ বছর ধরে আমি তৃণাদের বাসায় কাজ করছি। এতগুলো দিনের মধ্যে কেউ আমাকে জিজ্ঞেসও করেনি আমি কেমন আছি। কাজের কথা ছাড়া কেউ কোনো কথাই বলে না- এমনকি তৃণাও না। কিন্তু তৃণা তো আমারই মতো এক ছোট মেয়ে। সে তো আমার বন্ধু হতে পারে- পারে না?
নয়নতারা বলল, যে বন্ধু হয়নি, তার কথা ভেবে মন খারাপ কোরো না। যে বন্ধু হতে চায়- তাকে বন্ধু করে নাও।
: বুঝলাম। কিন্তু কে আমার মতো দুঃখী মেয়ের বন্ধু হতে চাইবে? নয়নতারা! তুমি আমার বন্ধু হবে?
দু’ চোখে অপার জিজ্ঞাসা নিয়ে পরী নয়নতারার দিকে তাকাল। নয়নতারা বলল, বন্ধু হবো কী! আমি তো তোমার বন্ধু হয়েই আছি। যাদের মন সুন্দর, নিজ থেকেই ফুলেরা তাদের বন্ধু করে নেয়।
নয়নতারার কথা শুনে পরীর বুকের ভেতর সুখের স্রোত বয়ে গেল। পরীর মনে হলো, এ পৃথিবীতে ওর চেয়ে সুখী আর কেউ নেই।
ভালো লাগার আনন্দে পরী কেঁদে ফেলল। তা দেখে নয়নতারা জিজ্ঞেস করল, আমি তোমার বন্ধু হয়েছি। তাহলে আর কাঁদছো কেন?
পরী বলল, আনন্দে। তবে আর কাঁদবো না। মন খারাপ হলে সোজা তোমার কাছে চলে আসবো।
নয়নতারা বলল, এসো। আমরা তোমার অপেক্ষায় থাকবো।

Share.

মন্তব্য করুন