যাচ্ছি তামিলনাড়ুর নীলগিরি জেলার সবচেয়ে নয়নাভিরাম শৈল শহর ‘উটি’তে যাকে বলা হয় Queen of hill city বা পাহাড়ের রানী। ১২-০৭-২০২২। এক রোদবৃষ্টির সকালে আমাদের চারজনের ভ্রমণদল মহিশুর (MYSORE) থেকে যাত্রা শুরু করে উটির উদ্দেশে।
বান্দিপুর ফরেস্টের ২৫ কিলোমিটার পথ পার হয়ে আবার মধুমালয়া ফরেস্ট। সিঁথির মতন কালো মসৃণ পথ গভীর ঘন সবুজ বনের ভিতর চলে গেছে। চলার পথের দৃশ্যমান একের পর এক বিস্ময়কর এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদেরকে স্তব্ধ ও অভিভূত করেছে প্রতিক্ষণ। কোথাও হরিণ বা বাইসনের দল, কোথাও ময়ূর, বানর মস্ত হাতি দলবেঁধে বা একাকী আপনমনে পথের ধারে কাছে হাঁটাহাঁটি করছে। যাবার পথে এক দাঁতওয়ালা বিশাল হাতি পথ আগলে দাঁড়ালো। সব গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। এখানে হর্ন বাজানো নিষেধ। ফরেস্ট বিভাগের লোকজন চলে এলো গাড়ি নিয়ে। কালো ধোঁয়া ছেড়ে অবশেষে সেই হাতি মহাশয়কে সরিয়ে রাস্তা যাতায়াতের জন্য খুলে দেয়া হলো। আমাদের উটি ভ্রমণের উত্তেজনা এখান থেকেই শুরু হয়ে গেল।

শুধু কি বন-অরণ্য! যেতে যেতে সবুজ অরণ্যের ফাঁকে বিস্তীর্ণ যে সূর্যমুখীর ক্ষেত, টলটলে পানির বিশাল হ্রদ, সুউচ্চ পাইন বনের ঘন সারি, পাহাড়ের গা ছুঁয়ে ধূমায়িত মেঘদল অথবা ঝরনার ছলাৎ ছলাৎ- এইসব কর্ণকুহর থেকে অন্তরঅলিন্দে প্রবেশ করিয়ে কখন যে পৌঁছে গেলাম নীলগিরি পাহাড়ের কোলে শুয়ে থাকা আদরের উটি শহরটিতে টেরই পেলাম না!
এদিকে উটির দিকে যেতে যেতে বাড়ছিল শীত ও বৃষ্টি। এর মাঝেই গাড়ি থামিয়ে ট্যুরিস্ট স্পট দেখা, পথের ধারের খাবারের স্বাদ নেয়া, কেনাকাটা, ছবি তোলা কোনো কিছুই বাদ যায়নি আমাদের।
একসময় পৌঁছে গেলাম আকাক্সিক্ষত গন্তব্যে।
উটি শহরে ঢোকার মুখে ‘কাবাব হাউজ’ নামের বেশ পরিচ্ছন্ন এক হোটেল দেখে ঢুকে যাই। আগে তো পেট পূজা! আমাদের ভ্রমণদল পণ করেছে সাউথ ইন্ডিয়ার সব খাবারের স্বাদ গ্রহণ করবে যতটুকু পারা যায়। আর সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে মাইসুর থেকে শুরু হয়েছে আমাদের ইদলি, দোসা, লুচিপরোটা, বাদাম খিচুরিসহ নানান খাবাতের স্বাদ নেয়া। এখানকার প্রায় সব খাবারেই নারিকেল দেয়া হয়। আমরা এই হোটেলে খেলাম হায়দরাবাদ বিরিয়ানি। বেশ মজা। খাবারের দাম অতিরিক্ত কিছু মনে হলো না।

ইচ্ছে করেই আমরা হোটেল বুকিং দেইনি আগে। ঘুরে ঘুরে খুঁজে খুঁজে বের করার একটা আনন্দ আছে। অনেক কিছু দেখা ও জানাও হয়ে যায়। দেখলাম এই পর্যটন নির্ভর শহরতলি জুড়ে অসংখ্য হোটেল, স্টে-হোম, লজ, মোটেল ইত্যাদি গড়ে উঠেছে।
সবুজ পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে লাল, গোলাপি, নীল, সবুজ রঙিন ছোট ছোট ঘর ছবির মতন করে সাজানো এই উটি। শহরের চারিদিকে ও মাঝের পথগুলি আঁকাবাঁকা। সবুজ বন, পাহাড় বেষ্টিত লজ। কি যে নান্দনিক এর রূপ! অনন্য জীববৈচিত্র্যের জন্য উটি শহর পৃথিবীর ১৪টি হটস্পটের মধ্যে একটি।
তবে চা-কফি, চকোলেট ও বিভিন্ন মশলার জন্য বিখ্যাত, প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, জনপ্রিয় পর্যটনের মাত্র প্রায় ৮৮০০০ জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ শহরটির ঘরবাড়ি, পথঘাট, দোকানপাট, জীবনযাপন সবকিছুতেই কেমন যেন অনুন্নয়ন ও দারিদ্র্যের ছাপ! এমনটা আশা করিনি। অন্যান্য পর্যটন স্থানের মতন জৌলুস নেই এখানে। এর কোনো রাজনৈতিক ব্যাখ্যা থাকলে থাকতেও পারে।
যাই হউক। তামিল ড্রাইভার কাম আমাদের গাইড পাভনাত কুমার নানান জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে রাতে থাকার ব্যবস্থা করতে। অবশেষে উটিলেকের ধারে লেকভিউ রিসোর্টে গেলাম। লাল টালির ছোট ছোট অসংখ্য কটেজ এক কমপ্লেক্সে। এটা পর্যটন মৌসুম নয়। বিশাল ছাড়ে সুন্দর এই জায়গাটা পেয়ে আমাদের আনন্দ যেন আরো বেড়ে গেল।

আনন্দে বাদ সাধলো কাঁপানো শীত আর অবিরাম বৃষ্টি । দেশে গরম, মাইসুরের আবহাওয়াও ভালো। কেউই তাই শীতবস্ত্র আনার কথা ভাবিনি। হোটেলের কাছাকাছি দেখি রাস্তার ধারে সার বেঁধে দোকান। মনে হচ্ছিল আমাদের বঙ্গমার্কেট। সেখান থেকেই কানটুপি ও চাদর কিনে আপাতত আমরা শীত থেকে রক্ষা পেলাম।
আর এই কেনাকাটার মাঝেই কোথা থেকে যেন মাংস কষানোর ঘ্রাণ ভেসে আসে। ভোজনপ্রেমী আমরা ছাতা মাথায় ঠিকঠাক পৌঁছে যাই সেই হোটেলটিতে।
যেখানে মহারাষ্ট্রের শতকরা ১২% মাত্র মুসলমান সেখানে গরুর মাংস পাওয়ার কথা ভাবিনি। উটিতে তা পাওয়া যাচ্ছে দেখে আমরা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে অর্ডার দিয়ে দিলাম। মচমচে ভাজা, তুলতুলে মাংস আর গরম পরোটা খেতে খেতে পরিকল্পনা চললো আগামীকাল উটির দর্শনীয় স্থানগুলো দেখবার।
নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ, অমৃতসম খাবারের ঘ্রাণ একাকার হয়ে মিশে যায় ভ্রমণ উত্তেজনার সাথে। ওদিকে রাতের বয়সের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৃষ্টি! রাত ১২টা নাগাদ কটেজে ফিরে ফ্রেশ হয়ে ঘুমাতে যাই।
ঘুম ভেঙে মনে হলো এ সত্যি না স্বপ্ন! সত্যিই আমরা আজ টয়ট্রেনে শাহরুখ খানের সেই ‘ছাইয়া ছাইয়া-’ নাচের শুটিংশহর উটিতে আছি! ছবির মতন এ শহর। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৬২৬ মিটার উঁচু ‘পাহাড়ের রানী’ নামে পরিচিত এ শৈল শহরটির রূপ অনেকটাই শিলং, সিকিম, ভুটান অথবা দার্জিলিংয়ের মতন। উটির আদি নাম উদাগমন্ডলম যার অর্থ house in mountain বা পাহাড়ের মধ্যে বাড়ি।
আমাদের উটি ভ্রমণের শেষ ও দ্বিতীয় দিনে শীতকাপড়বন্দী আমরা বেরিয়ে পড়ি সকাল আটটার মধ্যেই। শহরের কেন্দ্রস্থলে সরগরম এক রেস্তোরাঁয় সাউথইন্ডিয়ান খাবার দিয়ে নাস্তা সেরে শুরু হয় দর্শনীয় স্থান পরিভ্রমণ।
প্রথমে যাই উটি থেকে ৯ কিলোমিটার দূরে DODDABETTAতে। বাংলাদেশে যখন অসহ্য গরম তখন মানচিত্রেরই কাছাকাছি এক ভূখণ্ডে প্রচণ্ড শীত! কি বিচিত্র এই পৃথিবী! হ্যাঁ, বলছিলাম তামিলনাড়ুর নীলগিরি পর্বতমালার সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গ ডোড্ডাবেটার (DODDABETTA) গল্প।

Doddabetta অর্থ ইরম Big mountain বা বড় পাহাড়। পর্যটকদের কাছে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি স্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৬৩৭ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। আর এই পাহাড়ের শেষ চূড়া পর্যন্ত গাড়ি চলাচলের পথ থাকায় এখানে আসাও সহজ। পাহাড়ি ঢেউ খেলানো পুরো উটির সৌন্দর্য পর্যটকগণ এখান থেকে এক নজরে দেখতে পারেন।
যেমন কঠিন এই ডোড্ডাবেটা উচ্চারণ তেমনই কঠিন ছিল সেদিনের আবহাওয়া। মেঘে ঢাকা ধোঁয়াশা অন্ধকার চারিদিক। আমরা যেতেই শুরু হলো ঝড়ো বাতাস। তাপমাত্রা তখন ১৩-১৪ সে.। উঠে যাই মাঝখানের কাচঘেরা গোল দোতালা টেলিস্কোপ হাউজে। চারিদিক দেখি মুগ্ধ হয়ে । এই পাহাড়ের গা বেয়ে মনকাড়া সবুজ উদ্ভিদ উদ্যান তৈরি করা হয়েছে যাতে বিরল প্রজাতির অনেক উদ্ভিদ পাওয়া যায়।
এরপর রওনা হই চা ও চকোলেট ফ্যাক্টরির উদ্দেশে। এখানে এদের প্রস্তুত প্রণালি ও পরিবেশন দেখে চমৎকৃত না হয়ে পারা যায় না। তবে সবশেষে পর্যটকদের যে মশলা চা খাওয়ানো হলো এর স্বাদ নিতেই ইচ্ছে করছে আবারও যাই উটিতে।
উটিলেকে বোট রাইডিং বা নৌভ্রমণ নাকি জগদ্বিখ্যাত। কিন্তু ভারী বর্ষণের কারণে এই মৌসুমে তা বন্ধ। সময়ের অভাবে ৫৫ একর জমির উপর অত্যন্ত নয়নাভিরাম বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করতে হলো। এখানে রক্ষিত ২০ লক্ষ বছর আগের এক বৃক্ষের কাণ্ডের জীবাশ্ম রক্ষিত আছে।
এর পাশেই রোজ গার্ডেন। ঢুকে গেলাম। এর নাম জয়ললিতা রোজ গার্ডেন যা ২২০০ মিটার উঁচু পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তৈরি করা হয়েছে। বিশ্বের বিখ্যাত ১৫টি গোলাপ বাগানের একটি এটি। আছে প্রায় ৩৬০০ প্রজাতির গোলাপ। ৪০ রুপি এন্ট্রি ফি দিয়ে ভিতরে ঢুকে আমরা আশাহত হই। ফুলের সংখ্যাও যেমন কম, তেমনি বৃষ্টিতে সব চুপসানো। আমাদের মন ততোধিক চুপসে গেল।

চলতে থাকলো আমাদের উটি শহর চষে বেড়ানো। প্রকৃতির বিমাতাসুলভ আচরণকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দুপুরের খাবার শেষে ছুটলাম পাইন ফরেস্টের উদ্দেশে। কি যে সুন্দর! মসৃণ শরীরের ছিপছিপে সুউচ্চ সুন্দরী গাছগুলি পাহাড়ের গভীর খাদ থেকে উঠে আকাশ ফুঁড়ে দাঁড়িয়ে আছে। পর্যটকদের নামার জন্য আছে রাস্তা থেকে খাদ পর্যন্ত তিনশোরও বেশি সিঁড়ি। নেমে যাচ্ছে সিঁড়ি বেয়ে খাদে।
বয়সের কাছে হাতজোড় করে নেমে যাবার প্রবল ইচ্ছা নিয়ন্ত্রণ করি। পাইন বনের ধারের এক বেঞ্চে সূর্যাস্তপ্রায় আমি বসে থাকি। তখন অপরাহ্নের সোনারঙ চারিদিকে। বাতাসে পাইনের তিরতির পাতা নড়ার গল্প শুনি। আকাশ শামিয়ানায় গাছেরা মাথা ঠেকিয়ে পরস্পর যেন গভীর আলোচনায় মগ্ন। কি অদ্ভুত মাদকতা! বনের পাশে ও রাস্তার উপর কিছু ছবি তুলে উটির পাইনবন ভ্রমণ আপাতত সমাপ্ত করতে হলো আমাদের।
ফেরার পথে গেলাম তামিলনাড়ুর আরেক আকর্ষণ শুটিং পয়েন্টে। এখানে বিখ্যাত সব সিনেমার শুটিং হয় ও হয়েছে। ঘন সবুজ মসৃণ ঘাসের ভেলভেট চাদরে সুচালো পাহাড়। অন্যদিকে ঢাল বেয়ে চা বাগানের কার্পেট। কেউ কেউ উঠে যাচ্ছে শীর্ষে। ঘোড়ায় করেও যাওয়া যায়। সময় স্বল্পতায় সে ইচ্ছেও আমাদের অসম্পূর্ণ রয়ে গেল।

বেলা গড়িয়ে ৪টা বেজে গেছে। মাইসুর ফিরতে হবে। ৪-৫ ঘণ্টার পথ। আবারো দৃষ্টিনন্দন বনপথে আনন্দ যাত্রা। সারাদিন ঘুরেছি। প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর ভ্রামণিকদের তবু কোনো ক্লান্তি নেই। শুধুই ভালোলাগা আর ভালোলাগা। বিদায় পাহাড়ের রানী উটি।
গাড়ি ছুটছে কখনো ধীরে, কখনো দ্রুত। কিছুটা পথ পেরোনর পর গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়লো। জানতে পেলাম সামনে বিশাল পাহাড় ধস ঘটে রাস্তা পুরা বন্ধ। পিছনে গাড়ির লাইন বাড়ছেই। এপাড় ওপাড় প্রায় দীর্ঘ ৫ কিলোমিটার জ্যাম।
কিছুই করার নেই। কর্তৃপক্ষ শহর থেকে কখন আসবে রাস্তা ক্লিয়ার করতে কেউ বলতে পারে না। গাড়ি থেকে নেমে এদিক ওদিক কেউ কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে। বৃষ্টি বাড়লে দৌড়ে আবার গাড়িতে উঠে যাচ্ছে। সামনের ট্রাকে গাজরের বস্তা থেকে লুকিয়ে গাজর নিয়ে খাচ্ছে কেউ।
এক পাশে গভীর বন, অন্যপাশে উঁচু পাহাড়। ছোট ছোট জলপ্রপাত সাদা সাপের মতো পাহাড় থেকে নেমে যেন আমাদের দিকে তেড়ে আসছিল। বনের ভিতর থেকে যেকোনো সময় হাতির পাল আক্রমণ করতে পারে। বাইসনদের দল তারাও ঘোরাঘুরি করছে। রাত বাড়ছে। বাড়ছে বৃষ্টি আর পথে অনিশ্চিত আটকে থাকার আতঙ্ক। এই সময়টুকুর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাও কম সমৃদ্ধ নয়। সেটা না হয় থাকুক আজ।

সবশেষে বলি আমাদের দেশের বান্দরবান, খাগড়াছড়ি বা রাঙ্গামাটি ভ্রমণে কিছু অসুবিধা ছাড়া কম সুখকর নয় কিন্তু!

Share.

মন্তব্য করুন