শ্যাওলাপুরের কাছে জঙ্গলে একটা পুরনো বটগাছ। এই গাছে একটি কাক বাস করে। কাকটি অত্যন্ত ধূর্ত, একটু উদ্ধত এবং ঝগড়াটে প্রকৃতির। তার কণ্ঠস্বর খুব কর্কশ। পাশাপাশি সে দুর্দান্ত চালাকও। এ কারণে এই গাছে অন্য পাখি বাসা বাঁধতে পছন্দ করে না। কাকের অজান্তে একটা নতুন পাখিও যদি সেখানে বাস করতে আসে, চারদিনের মধ্যেই পালিয়ে যায়।
একদিন এক জোড়া রাজহাঁস বটগাছে আশ্রয় নিতে গেল। তারা দক্ষিণ দিক থেকে এসে তাদের আবাসে ফিরে আসছে। রাজহাঁসটি যতটা ধৈর্যশীল প্রকৃতির, তত বেশি কৌতুকপূর্ণ। রাজহাঁস জোড়া যখন এলো তখন কাক ছিল না, নাহলে সে রাজহাঁসদের সেখানে থাকতে দিত না। বিকালে তার বটগাছে রাজহাঁস দেখে কাক অবাক হয়ে গেল। সে প্রথম একটি রাজহাঁস দেখতে পেল। সে ভাবল, এই সাদা-সাদা রঙের লম্বা গলার পাখিগুলো কারা?
কাক রাজহাঁসগুলোর কাছে ঘুরে ঘুরে বললো, আরে! তোমরা কারা? তোমরা কি জানো না যে এই বটগাছটি আমার বাড়ি? তোমরা আমার অনুমতি ছাড়া আমার বাড়িতে কিভাবে এলে?
রাজহাঁস কাকের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বলল, বন্ধু! আমি রাজহাঁস আর এটা আমার স্ত্রী রাজহাঁসিনী। আমরা দূর দেশ থেকে আসছি, আমরা দু’জনেই ক্লান্ত এবং সন্ধ্যাও হয়ে গেছে। তাই আমরা এখানে রাতের বিশ্রামের জন্য এসেছি। এই বট তোমার, নাহলে তোমাকে জিজ্ঞেস করেই আমরা এখানে থাকতাম।
কাক হাঁসিনীর দিকে তাকাল, তার বিষণœ, ক্লান্ত ও শুষ্ক মুখ দেখে তার মায়া হলো। একটু উদারতা দেখিয়ে বলল, তোমরা দূর দেশের বাসিন্দা, আজ তোমরা দু’জনেই আমার অতিথি। তোমরা এখানে আরামের সঙ্গে রাতের বিশ্রাম নিয়ে আমার আতিথেয়তা গ্রহণ করো।
এই বলে কাক তার ঝুপড়ি থেকে কিছু ফল তাদের খেতে দিল। রাজহাঁস কাকের উদারতা এবং আতিথেয়তার গুণাবলির প্রশংসা করল।
কাকের চোখ রাজহাঁসের প্রতিটি নাড়াচাড়ার দিকে। সে তাকাল এবং বুঝতে পারল সম্ভবত রাজহাঁসিনী তার রাজহাঁসের উপর একটু রাগান্বিত। সে তার দিকে লেজ নিয়ে বসে আছে এবং তার কথা উপেক্ষা করছে। কাক ভাবল যদি সে চেষ্টা করে, তবে এই সুন্দর রাজহাঁসটি তার বন্ধু হতে পারে। সে চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিলো। কারণ সে শুনেছে যে কোনো কাজ নিছক চিন্তা-চেতনা দ্বারা সম্পন্ন হয় না। হরিণ নিজেরাও ঘুমন্ত সিংহের মুখে ঢোকে না। যখন রাজহাঁসিনী প্রশংসার পরও মানল না, তখন রাজহাঁস ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। এবার কাক এই সুযোগ পেল রাজহাঁসিনীকে মুগ্ধ করার।
রাজহাঁসিনী কাকের মতলব খুঁজে পেল। কিভাবে সে তার বন্ধু হবে? তবুও এটি তার জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ। সে রাজহাঁসকে একটি উচিত শিক্ষা দিতে পারবে। তাই সে সেই ভঙ্গি দেখাল যে, কাকটি নিশ্চিত হলো রাজহাঁসিনীও তার উপর সন্তুষ্ট।
সকাল হয়ে গেল। রাজহাঁস আতিথেয়তার জন্য কাককে ধন্যবাদ জানাল। তারপর রাজহাঁসিনীকে বলল, বন্ধু! এখন আমাদের উড়তে হবে!
কাক বলল, ও রাজহাঁস! আমার বন্ধুকে যারা বন্ধু বলে ডাকে তাদের লজ্জা করে না!
রাজহাঁস হেসে ফেলল। সর্বোপরি, তার নগ্ন তীরগুলো লক্ষ্যবস্তুতে প্রবেশ করল। রাজহাঁস বলল, কাক ভাই! এসব কী বলছো? এই রাজহাঁসিনী আমার বন্ধু, যাকে বলছো তোমার।
কাক বলল, ওরে রাজহাঁস! তুমি একেবারেই অকৃতজ্ঞ। আরে আমি তোমাকে আমার গৃহে থাকতে দিয়েছি। তোমাকে স্বাগত জানানো হয়েছে। এখন তুমি আমার বন্ধু রাজহাঁসিনীকে তোমার বলে বলছো! হায় মূর্খ রাজহাঁস! এক্ষুনি আমার বাসা থেকে বের হয়ে যাও নাহলে তোমাকে মেরে ফেলব।
কাকের অযৌক্তিক কথা রাজহাঁসের পালককে নাড়িয়ে দিল। এখানে অবস্থান করার ফলে তার জন্য যে এত বিপজ্জনক হবে, তা সে ভাবেনি। সে স্পষ্টতই বলল, কাক ভাই! এটা হাসি তামাশার বিষয় নয়। তুমি একটি কাক এবং আমরা রাজহাঁস। আমাদের উভয়েই আলাদা প্রজাতি। তাই কাক এবং রাজহাঁসের বন্ধু অসম্ভব।
কাক বলল, ধূর্ত রাজহাঁস! এটা ঠিক যে আমাদের প্রজাতি আলাদা, কিন্তু বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে বন্ধুত্ব হতে পারে।
বিষয়টি আরও বাড়ল। আশপাশের পাখিরা, যারা শস্য তুলতে চলে যাচ্ছে, তারা সেখানেই দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখতে লাগল। জুটি বেঁধে থাকলেও রাজহাঁসিনী যখন কাকের বন্ধু হয়ে উঠতে প্রস্তুত, তখন কেউ কী করতে পারে? একটি বুড়ো পাখি তাদের দুইজনকে বলল, এভাবে মারামারি করে শক্তি নষ্ট করো না। একটি পাখি সহজেই তোমাদের দুইজনকেই ধরে ফেলবে। তাই তোমরা উভয়ে একই সঙ্গে আদালতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নাও এই রাজহাঁসিনী কার বন্ধু? বিচারকের সিদ্ধান্তই সর্বজনীন। তাই তোমাদের উভয়ের বিরোধ আদালতেই মীমাংসা করা যেতে পারে।
দু’জনেই ব্যাপারটা বুঝতে পারল। রাজহাঁসিনী কাকের সাহস ও চতুরতায় বিশ্বাসী হলো। এভাবে দিবালোকে অন্যের বন্ধুকে বন্ধু বলাটা কোনো ঠাট্টা বা খেলা নয়।
রাজহাঁস আর কাক মারামারি করে কোর্টে পৌঁছেছে। আদালত শেষ হয়ে গেল। মারামারি এবং ক্ষতিগ্রস্ত পশু-পাখিদের একটি বিশাল ভিড়। রাজহাঁস এবং কাক তাদের পালার জন্য অপেক্ষা করছে। রাজহাঁস নতুন, সে এই প্রথম আদালতে এসেছে। যেখানে কাক পঞ্চাশবার এসেছে। সে জায়গার স্বর সম্পর্কে অবগত। তাই সুযোগ পাওয়া মাত্রই সে বিচারকের কাছে গিয়ে কানে কানে গোপনে বলল, আপনি যদি আমার পক্ষে রায় দেন তাহলে আপনার পূর্বপুরুষদের সবাইকে একত্রে দেখা করাব।
বিচারক শুধু তার বাবা-মাকে দেখেছে। সে যখন ছোট ছিল, তখন তার দাদা-দাদী হাতির পালকে পদদলিত ও পিষ্ট হয়ে মারা গেছে। তার পূর্বপুরুষদের প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা, সেজন্যই সে মনে করল পূর্বপুরুষদের দর্শন থেকে উপকৃত হওয়ার এটাই সুবর্ণ সুযোগ। এটা ছেড়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এভাবে সে প্রলুব্ধ হলো। কিছুক্ষণ পর রাজহাঁস ও কাকের পালা এলো। মামলার শুনানি শুরু হয়েছে।
ন্যায়াসনে রাজহাঁসের অগাধ ও পূর্ণ বিশ্বাস। সে শুনেছে বিচারক ন্যায়বিচার করেন। কিন্তু কাক যে কৌশল করেছে সে সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ অজানা।
বিচারক কাককে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কাক আর তোমার বন্ধু রাজহাঁসিনী। এটা কি আশ্চর্যের বিষয় নয়?
কাক বলল, না, মোটেও না! বিচারক সাহেব, আসলে আমাদের বন্ধুত্ব অনেক পুরনো। এ ধরনের বন্ধুত্বে কোনো আইনি বাধা নেই।
না, মোটেই না। এখানে সমস্ত পশু-পাখির তাদের ইচ্ছানুযায়ী জোড়া বানানোর অধিকার আছে। তুমি স্বেচ্ছায় রাজহাঁসিনীকে তোমার বন্ধু বানিয়েছ আর রাজহাঁসিনী তোমাকে তোমার বন্ধু বানিয়েছ, তাহলে এতে আইন কী করতে পারে?
রাজহাঁসিনী এখনও সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। সে দেখতে চাচ্ছে যে রাজহাঁসের বন্ধুত্ব জোরালো হয়েছে নাকি সে এখনও আইন ও ন্যায়বিচারের জন্য আনুগত হয়ে থাকতে চায়। এমন বশ্যতা না করে সে দাপুটে কাকের বন্ধু হতেই পছন্দ করবে। মামলার রায় আগেই লেখা হয়ে গেছে, যা চলছে তা শুনানির নাটকীয়তা।
শেষ পর্যন্ত বিচারক রায় দেয়- সকল সাক্ষী ও সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এই আদালত এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, রাজহাঁসিনীর ওপর রাজহাঁসের বন্ধুত্বের দাবি ভিত্তিহীন। এই রাজহাঁসিনী বাদি কাকের বন্ধু। সেখানে কোনো অভিযোগ নেই। তাই কাক ও রাজহাঁসিনীর ইচ্ছামতো তার সঙ্গে থাকার অধিকার আছে। রাজহাঁস যদি আদালতের সিদ্ধান্ত না মানে, তাহলে তার পা শক্ত করে বেঁধে তাকে কুমিরে ভরা খালে ফেলে দাও!
আদালতের সিদ্ধান্ত শুনে রাজহাঁসের প্রাণ যেন তোতাপাখির মতো উড়ে গেল। সে ভাবল, এই বন দেখতে যেমন অদ্ভুত, এখানকার আইনও অদ্ভুত, তার চেয়েও অদ্ভুত এখানকার বিচারকরা। এই মুহূর্তে হাত থেকে বন্ধু চলে গেছে, যদি এখানে কিছুক্ষণ থাকে তাহলে তার জীবনও চলে যেতে সময় লাগবে না। তাই এখান থেকে পালিয়ে যাওয়াই ভালো। এরকম ভাবতে ভাবতে রাজহাঁসটি উড়ে গিয়ে সবার চোখ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। রাজহাঁসিনীর চোখ পানিতে ভরে গেল। কাকের সাহস ও চতুরতায় সে বিস্মিত হলো তার থেকেও বেশি রাগ হলো তার নিজের এবং রাজহাঁসের বোকামি ও চাতুরীতে।
বিচারক আসন থেকে নেমে সোজা কাকের কাছে এসে বলল, কাক মিয়া! এখন তোমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার পালা। আমাকে দেখাও! আমার পূর্বপুরুষরা কোথায় এবং কী অবস্থায় আছে। জলদি দেখাও! আমি জলদি বলছি। আমার পূর্বপুরুষদের দেখার জন্য আমি অস্থির হয়ে আছি।
কাক বলল, আসুন! আমাকে অনুসরণ করুন! আমি আপনাকে সেই জায়গায় নিয়ে যাবো যেখানে আপনার পূর্বপুরুষরা আছেন।
এই বলে কাকটা উড়ে গেল। বিচারক তার সঙ্গে হাঁটা দিল। রাজহাঁসিনীও উড়ে গেল কাকের পেছনে। সে দেখতে চায় যে এই কাকটি রাজহাঁসকে ইতোমধ্যে পেঁচায় পরিণত করেছে, এখন বিচারকের সঙ্গে কেমন আচরণ করছে।
কাকটি বিচারককে প্রদক্ষিণ করে একটি বড় গর্তে নিয়ে গিয়ে বলল, হে বনের বিচারক! দেখুন আপনার পূর্বপুরুষরা এখানে এই গর্তে উপস্থিত আছেন।
বিচারক গর্তে তাকাল। এতে অনেক পোকামাকড় গুঞ্জন করছে। সে বিশ্বাস করতে না পেরে বলল, এরা সব কীটপতঙ্গ! আমার পূর্বপুরুষরা কোথায়?
কাক বলল, বিচারক সাহেব! এই পোকাগুলো কি আপনার পূর্বপুরুষ?
বিচারক বলল, এটা কিভাবে হতে পারে? আমার পূর্বপুরুষরা কিভাবে পোকা হতে পারে?
কাক বলল, কোন বংশে তোমার মতো লোভী ও ঘুষখোর বিচারক জন্মেছে আর যে বিচারের নামে বিচারের ঠাট্টা করে। তার পূর্বপুরুষরা যদি পোকামাকড় না হয়ে যায়, তাহলে আর কি হবে?
কাকের উত্তরে বিচারকের মুখ বন্ধ হয়ে যায়। সে নিজের মুখ বন্ধ করেই থাকল।
শেষ পর্যন্ত কাকটি রাজহাঁসিনীকে বলল, হে রাজহাঁসিনী! আমি তোমাকে আমার দেশের আইন-কানুন ও বিচার ব্যবস্থা বিদেশীদের কাছে দেখাতে চেয়েছিলাম, সেজন্যই আমি এই সব করেছি। তুমি রাজহাঁসের বন্ধু। তাকে তোমার প্রয়োজন বেশি। কিন্তু আমি যখন তোমাকে আমার বন্ধু বলেছিলাম তখনই রাজহাঁসের আমাকে আক্রমণ করা উচিত ছিল, কিন্তু সে বিষয়টি আদালতে নিয়ে গেল। ফলে সে মামলায় হেরে গেল।
প্রয়োজনের সময় রাজহাঁসের কঠোর হতে হবে। তোমার রাজহাঁসকে এটি ব্যাখ্যা করো। তুমি দ্রুত চলে যাও। তোমার রাজহাঁস এখনও বেশি দূর যেতে পারেনি।
রাজহাঁসিনী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কাককে ধন্যবাদ জানিয়ে সঙ্গে সঙ্গে যেদিকে রাজহাঁস গিয়েছে সেদিকে লম্বা ডানা মেলে উড়াল দিল।

Share.

মন্তব্য করুন