মানুষ সামাজিক জীব। আদিকাল থেকেই মানুষ সুখে-দুঃখে বিপদাপদে অন্যজনের শরণাপন্ন হয়েছে। জীবনে চলার পথে মানুষ মানুষকেই উত্তম সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে। একজন সঙ্গী যেমন মানুষকে সুপথ দেখাতে পারে; তেমনি অনায়াসে ভ্রান্ত পথেও পরিচালনা করতে পারে। সে জন্য, বন্ধু নির্বাচন আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। বিশেষ করে কৈশোরে এসে যখন মানুষের শারীরিক গঠনের সাথে সাথে চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন ঘটে। আবেগে ভাসতে থাকা মন কোনো রকম যুক্তি তর্কের ধার ধারে না। ধার ধারে না শাসন ত্রাসনের। দু’চোখে থাকে কল্পনার রঙিন চশমা। এই সময়টা বড়বেশি ক্রিটিক্যাল। তাই অভিভাবকদের উচিত এই সময়টাতে তাদের পাশে বন্ধুর মতো দাঁড়ানো। তাদেরকে মানসিক সাপোর্ট দেয়া। গভীরভাবে তাদের মনের যত্ন নেয়া। মনের যত্ন! হুম, শুনতে একটু অদ্ভুত শোনালেও, শরীরের যতেœর চেয়ে মনের যত্ন এ সময়টাতে খুব বেশি জরুরি। আপনার সন্তান কী বলছে, কী বলতে চাইছে, কী করছে কিংবা করতে চাইছে তার চোখ মুখ দেখেই আপনাকে বুঝে নিতে হবে। তার আবেগ অনুভূতিগুলোর যথেষ্ট মূল্যায়ন করতে হবে। তার আবদারগুলো বুঝে নিতে হবে। সবসময় সব আবদার যেমন আমলে নেয়া যাবে না, তেমনি কোনটা তার জন্য কল্যাণকর সেটাও অভিভাবককে বুঝতে হবে। আপনার সন্তান কার সাথে চলছে, কার সাথে মিশছে সিরিয়াসলি সেসব পর্যবেক্ষণ করুন। এ সময় সঙ্গী নির্বাচন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া। কারণ, আবেগের এই বয়সটাতে সমবয়সী সঙ্গীর দ্বারাই মানুষ সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়। তাই এ সময় বন্ধুর মতো তার পাশে থেকে তাকে ঠিক এবং ভুল সম্পর্কে সচেতন করুন। এ সময়টাতে মানুষ স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি মাত্রায় আবেগপ্রবণ হয়। কারণে-অকারণে হাসে-কাঁদে, জেদ করে। সেগুলো নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ কিংবা অতি বেশি বিচলিত হয়ে পড়া কোনোটাই ঠিক নয়।

কৈশোরে পা রেখে একজন মানুষ নিজের সম্পর্কে কিছুটা কনফিউশনে পড়ে যায়, সে কি ছোটদের কাতারে রয়েছে নাকি বড়দের তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে। বিভিন্ন বিষয়ে তার কৌতূহল খানিকটা বেড়ে যায়। কখনো তাকে শুনতে হয়, ‘আর কত ভুল করবে, এখনো কি সেই ছোট্টটি আছ?’ আবার কখনো বা শুনতে হয়, ‘ছোট মানুষ সব ব্যাপারে এত পাকামো কেন?’
এ সময়টাতে চারপাশে ভুল ধরা মানুষগুলোর সংখ্যা বেড়ে যায় অথচ, সুন্দরভাবে ভুলগুলো সংশোধনে পরামর্শদাতার সংখ্যা সেই সাথে বাড়ে না। কিশোর-কিশোরী মন এই সময়টাতে খুব বিশ্বস্ত একজন বন্ধু খোঁজে, একটু ভালোবাসার, একটু সহানুভূতির পরশ খোঁজে। সমবয়সীদের সাথে সময় কাটাতে তার ভালো লাগে অথচ, সে প্রকৃত কল্যাণ ও অকল্যাণকারী সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে অজ্ঞ থাকে। একটু ভালোবাসা কিংবা সহানুভূতি পেলেই গলে যাওয়া এই মানুষগুলো যখন অভিভাবকদের পর্যাপ্ত কেয়ার থেকে বঞ্চিত হয়; তখন সে শূন্যস্থানটি পূরণ করে অন্য কোনো দুষ্টচক্র। ভালোবাসার আড়ালে কিছু কুচক্রী তখন তাদের ব্যাপারে সক্রিয় হয়ে ওঠে। কখনো তাদের ঠেলে দেয় মাদকের ভয়ঙ্কর ছোবলে আবার কখনোবা তাদেরকে অন্য কোনো খারাপ কাজে ব্যবহার করে। অভিভাবকদের একটু অসচেতনতার কারণে ঝরে যায় হাজারো প্রাণ।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাবা-মায়েরা জানেন না তাদের সন্তান কতটা তলিয়ে গেছে। এসব ক্ষেত্রে দোষ কি কেবলই তাদের? অভিভাবকদের কি কোনোই দায় নেই? মনে করে দেখুন তো, কখনো কি এমন হয়েছে যে, আপনার সন্তান একটু আপনাকে পাশে চেয়েছে অথচ, আপনি কাজের ব্যস্ততাকে বেশি প্রায়োরিটি দিয়েছেন, সে আপনার পাশে এসে আপনার গা ঘেঁষে বসেছে, আপনি বিরক্ত হয়েছেন। আপনার এই অবহেলায় সে অন্য কাউকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে। যে তার সমবয়সী, যে তার কথাগুলো খুব মনোযোগ সহকারে শোনে, যে তাকে হাসিমুখে সময় দেয়, সঙ্গ দেয়। এখন আর আপনার সঙ্গ তার ভালো লাগে না। অবহেলা পেতে পেতে সে এখন অবহেলা করতে শিখেছে। আপনি অবাক হয়ে ভাবছেন, তার জন্যই তো আপনি/আপনারা এত খাটাখাটুনি করে সম্পদ সঞ্চয় করেছেন, সব তো তারই জন্য। আপনার ভাবনা ভুল।

একজন সন্তানের সুস্থ ও সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে বাবা-মায়ের সম্পদ নয়, বাবা-মায়ের সাহচর্য প্রয়োজন। বাবা-মা দুজনেই যখন চাকরি কিংবা সোশ্যাল ওয়ার্কিংয়ে ব্যস্ত থাকেন তখন সন্তান তাদের সঙ্গ থেকে বঞ্চিত হয়। একটা সময় সে নিয়েই সে ঘাটতি পুষিয়ে নেয়। তখন বাবা-মাকে তার বিরক্তিকর মনে হতে থাকে। আপনার সন্তান আপনাকে বিরক্তিকর ভাবার সে সুযোগ না দিয়ে আগেই তার বন্ধু হয়ে যান। সে কাদের সাথে মিশছে সযত্নে সে বিষয়ে খেয়াল রাখুন।
আপনার কৈশোরে পদার্পণ করা সন্তানের মানসিক বিকাশে যত্নবান হোন। তার বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সুস্থ ও সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করুন। এখন সময়টা বড়ই ক্রিটিক্যাল। একটা অসুস্থ পরিবেশের মধ্যে দিয়ে দিনযাপন করতে হচ্ছে আমাদের। তাই অভিভাবকদের দায়িত্ব হলো কিশোর-কিশোরীদের বন্ধু নির্বাচনের ব্যাপারে সচেতন করা। তাদেরকে যতেœর সাথে সৎ পথ দেখিয়ে দেয়া, তাদের আবেগগুলোকে ভালো পথে কাজে লাগানো।

Share.

মন্তব্য করুন