বর্ষা! নামটা শুনলেই মনের মধ্যে ঝিরঝির হাওয়া বয়ে যায়। আর! এর সাথে যদি ফুলের বাহারী রঙ ও আকৃতি থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। মন তখন ঘরে বসতে চায় না। ছটফট করে তাদের কাছে যেতে। বৃষ্টিস্নাত সুরভীত ফুলের সৌরভে পাগল হয় মন। সব মিলে বর্ষার ফুলেরা হাতছানী দেয় স্নিগ্ধমায়ায়। স্নাত উজ্জীবিত হয় বলেই এমন আকর্ষনীয়। অনায়াসে বর্ষার ফুলের চিত্র ভেসে ওঠে মনের আঙ্গিনায়। ঝিরিঝিরি হাওয়া ও বৃষ্টিতে কদম ফুল দারুণ লাগে! কদম ফুলের সাদা বসনও তখন আনন্দে দোলখায়। এমনসময় যদি কাক বসে পাখনা ঝাড়ে তাহলে তো আরো মনোহর! আরো আকর্ষনীয়। একথাটা বলতে চাই এভাবে-

বৃষ্টি ঝরে-
সকাল দুপুর টাপুর টুপুর
টিনের ঘরের চালে
কাউয়া বসে-
শরীর নাড়ে পাখনা ঝাড়ে
কদম ফুলের ডালে।

আহা! কী দারুণ দৃশ্য তাই না! আসলে কদম ফুল ছাড়া বর্ষার সানন্দ সৌন্দর্য বুঝা যায় না। শুধু কী কদম! বর্ষার আরো অসংখ্য ফুল রয়েছে। এই বর্ষায়ও তারা হাসিমুখে স্বাগত জানাবে। তাদের অনেকেই গ্রামাঞ্চলে ফোটতে বেশি পছন্দ করে। আবার অনেকে শহরের মানুষকে পাগল করে। তাই তারা শহরের যত্নে বিকশিত হয়।
করোনা কালের স্থবরিতা কাটাতে বড় হয়েছে নাগরিক ছাদবাগানগুলো। এই বর্ষায়ও ফুটবে গোলাপ, জবা, হাসনাহেনা, রজনীগন্ধা, দোলনচাঁপা, জুঁই, লিলি, নয়নতারা, কামিনী, মোরগঝুঁটি, কলাবতী ও দোপাটিসহ কত না ফুল। এসব ফুল হাঁসফাঁস করতে থাকা নাগরিক মনে খানিকটা হলেও আনন্দ দেয়। একই সাথে রঙ ও ঘ্রাণ মুগ্ধ করে। অন্দরের ভেতর-বাহিরে মানুষ যেন পায় নবজীবন। প্রায় বৃষ্টিস্নাত সজীবতা।
আর হ্যাঁ- বর্ষায় খুব একটা পানি দেওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না। তবে খেয়াল রাখতে হয় টবে গাছের গোড়ায় যেন পানি না জমে। টবে পানি জমলে আশ্রয় নেয় এডিস মশা, যা মারাত্মক ডেঙ্গু রোগের কারণ।
৪১২ বছর বয়সী রমনা উদ্যান। এই দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় বর্ষার ফুলকেও সাদরে গ্রহণ করেছে সে। যদি কেউ রমনায় যায়, তাহলে তার বৃষ্টিভেজা ফুলের স্নিগ্ধতায় শিহরণ সুখানুভূতি জাগাবেই।
শাপলা-শালুক ও পদ্মের দেখা শহরে মিলে না! এর জন্যে যেতে হয় আবহমান বাংলার গ্রামাঞ্চলে। সব গ্রামে না থাকলেও হাওর সমৃদ্ধ ভাটি অঞ্চলে বেশি দেখা যায়।
জনমনে বোধোদয় আসুক বর্ষার ফুলের জন্য। দিন দিন বিস্তৃত হোক বর্ষার ফুলের হাসি। তাই বর্ষার ফুলের বিশেষ আলোচনা করছি এভাবে-

চালতা ফুল : এটির উচ্চতা প্রায় ২০ মিটার। কাণ্ড বেশি বড় নয়। শাখা-প্রশাখা এলোমেলো। ছায়াঘন প্রসারিত। বাকল লালচে ও মসৃণ। পাতা টিয়াসবুজ দীর্ঘ। পাতার শিরাবিন্যাস তীক্ষ্ণ আর খাজকাটা। এই আকৃতির কারণে চালতাকে রূপসী গাছ বলে। ফুল আকারে বেশ বড়। শ্বেতবর্ণের ও সুগন্ধিযুক্ত। বৈজ্ঞানিক নাম উরষষবহরধ রহফরপধ। ফুলের দুধসাদা পাপড়ির ঔজ্জ্বল্য আকর্ষণীয়। ফোটার দিনই তা ঝরে পড়ে।

কলাবতী : অনন্য এই ফুল কলাবতী ফোটে বর্ষায়। এর আরেক নাম সর্বজয়া। গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে বর্ষার বৃষ্টি পেয়েই ফোটে। ফোটে শহরেও। বিলাসী বাগানে লাল-হলুদ মেশানো কলাবতী ফুল পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর ৫৫টি প্রজাতি রয়েছে। এই ফুলগুলো Cannaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। দেখতে সরু, লম্বায় ৩ থেকে ৫ ফুট, পাতা দুই প্রান্তের দিকে চাপা, মাঝখানে প্রশস্ত। তিনটি বৃন্তযুক্ত এই ফুলে ৫টি পাপড়ি রয়েছে। এগুলো একবীজপত্রী উদ্ভিদ।

চন্দ্রপ্রভা : ঘণ্টা আকৃতির স্বর্ণাভ হলুদ রঙা গন্ধহীন অসম্ভব সুন্দর চন্দ্রপ্রভা ফুল। এ ফুলকে কেউ কেউ সোনাপাতি নামেও ডাকে। ডালের আগায় বড় বড় থোকায় দেখা যায় এই ফুল। এটি Bignoniaceae পরিবারের উদ্ভিদ। বৈজ্ঞানিক নাম Tecoma stans । স্থানীয় নামের মধ্যে Yellow bells, Yellow trumpet, Yellow-Elder উল্লেখযোগ্য। চন্দ্রপ্রভা ফুলের গাছ চিরসবুজ। মাথা কিছুটা ছড়ানো। ৩-৪ সে.মি চওড়া। ১২-২০ সেমি. লম্বা। বীজ আকারে ছোট। বীজ ও কলমে চাষ হয়। ডালের আগায় থোকায় থোকায় বড় বড় হলুদ রঙের ফুল ফোটে। এর আরেকটি প্রজাতি আছে যেটা সারা বছর ফুল ফুটে।

বকুল : ফুলটি দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি গন্ধশ্রাবী। এ গাছটির উচ্চতা ১০ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। বকুল ফুল শুকিয়ে গেলেও এর সুবাস অনেক দিন থাকে। এর পাঁচ বৃন্তের অসংখ্য পাপড়ি থাকে।

রঙ্গন : এরা চিরসবুজ! গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ। আদি নিবাস সিঙ্গাপুরে। আমাদের দেশে শোভাবর্ধনকারী উদ্ভিদ হিসেবে জনপ্রিয়। বর্ষা মওসুমে রঙ্গনগাছে থোকা থোকা ফুল ফোটে। আমাদের দেশে সাদা ও লাল আকৃতির রঙ্গন দেখা যায়।

গুল নার্গিস : বর্ষা মওসুমে এটি বেশি চোখে পড়ে। আদি নিবাস ইউরোপে। এ ফুলের পাপড়িগুলো ৪ থেকে ৮ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। কমলা ও হলুদ রঙের এ ফুলটি শোভাবর্ধনকারী ফুল হিসেবে পরিচিত। সাধারণত গ্রীষ্মের মাঝামাঝিতেও ফোটে। তবে বর্ষা মওসুমেই বেশি ফোটে।

সুখদর্শন : লাল ও সাদা রঙের এ ফুলটি টবে বেশ মানানসই। ফুলগুলো আকারে বড়। টাইগার লিলি নামেও পরিচিত। সুখদর্শন গাছের পাতাগুলো বেশ চওড়া হয়ে থাকে। গুচ্ছবদ্ধভাবে ফুল ফোটে। এ ফুলটি টবে লাগালে দেখতে চমৎকার হয়।

ঘাসফুল : এটি চমৎকার একটি বর্ষার ফুল। এর আরেক নাম জেফির লিলি। এর পাতাগুলো চিকন, লম্বা আকৃতির। সাদা, গোলাপি, হলুদ, লাল রঙের ঘাসফুল সমতল ভূমিতে ফোটে। প্রায় সব জায়গায় এ ফুল লাগানো সম্ভব। টবে লাগালে সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠে।

দোপাটি : এর ফুলগুলো একক অথবা জোড়ায় জোড়ায় হয়। গোলাপি, লাল, বেগুনি, আকাশী, নীল, সাদাসহ আরো কয়েক রঙের দোপাটি ফুল দেখা যায়। হাইব্রিড জাতের দোপাটি ফুল ঘরের ভেতরেও টবে লাগানো যায়। বর্ষায় এ ফুলটি বেশ আকর্ষণীয়। বৈজ্ঞানিক নাম Impatiens balsamina.
.

কামিনী : এ ফুলের মধুর মিষ্টি গন্ধ অনেক দূর পর্যন্ত ম ম করে। ঘন সবুজ পাতার ফাঁকে প্রতি গুচ্ছে অসংখ্য ফুল থাকে। মে থেকে জুলাই পর্যন্ত গাছে ফুল দেখা যায়। গাছটি ঝোপের মতো ৩ থেকে ৫ মিটার লম্বা হয়।

অলকানন্দ : এটি Apocznaceae পরিবারের অন্তর্গত। গুল্মজাতীয় ফুলগাছ। সোনার ঘণ্টার মতো দেখতে তাই বাংলাদেশ ঘণ্টাফুল বা অ্যালমন্ডা নামেও পরিচিত। বর্ষার শুরুতে ফুলে ফুলে ভরে যায় গাছ। জাতভেদে ফুলের রঙ সোনালি, হলুদ, লাল ও গোলাপি হয়ে থাকে। বৈজ্ঞানিক নাম Allamanda nerifolia।
আবহমান কাল ধরেই আমাদের বর্ষার ফুল ¯িœগ্ধতায় জেগে থাকে। জাগবে এই বর্ষায়ও। বর্ষার ফুলগুলো স্বতন্ত্র সৌন্দর্যে সৌরভ ছড়ায় পরম উদারতায়। আসলে বর্ষা ও তার ফুল যেন বাংলার প্রকৃতির আত্মা।

Share.

মন্তব্য করুন