হঠাৎ যদি তোমাকে কেউ প্রশ্ন করে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী কোনটি? তুমি হয়তো বিনা দ্বিধায় উত্তর দেবে, তিমি। বর্তমান পৃথিবীর প্রাণীদের মধ্যে এটিই সঠিক উত্তর। কিন্তু এখন তুমি যে প্রাণীটির কথা জেনে অবাক হবে এই তিমিও এককালে সেই সামুদ্রিক দানবের জলখাবার ছিলো। ভাবতেই অবাক লাগে, এত বড় প্রাণী কেউ কখনো দেখেনি আজকের এই পৃথিবীতে। তারা বসবাস করতো ঐ সমুদ্রের বুকে। যদিও প্রায় ৩০ লাখ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে সামুদ্রিক এই প্রাণীটি। বিরাট দৈত্যাকার হাঙ্গর। তাদেরই রাজত্ব ছিল তখন সাগরে। এই দৈত্যাকার হাঙ্গরগুলো গহিন সাগরের তলদেশে বিচরণ করত। মাঝে মধ্যে তারা খাবারের অন্বেষণে সৈকতের কাছাকাছি উঠে আসত ও বড় বড় উভচর ডাইনোসরদের ধরে ধরে খেত। উল্লেখ্য, দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হাজারো দ্বীপ। এর মধ্যে একগুচ্ছ দ্বীপ রয়েছে যেগুলো পলিনেশিয়া নামে পরিচিত। এখানকার মানুষেরা বাইরের দুনিয়া থেকে একটু আলাদা। তাদের ভাষা, রীতিনীতি, এমনকি ধর্ম-সংস্কৃতি-উপকথা নিজেদের মতো গড়ে উঠেছে। তাদের জীবন-জীবিকা সবকিছু সমুদ্রকেন্দ্রিক। সুতরাং তাদের গল্প-উপকথার বড় অংশ দখল করে রেখেছে বিশাল কূল-কিনারাবিহীন রহস্যময় সমুদ্র। সন্ধ্যা নেমে এলে সব কাজ সেরে যখন বিশ্রাম নেয়ার সময় হয়, আজও ওরা একটি গল্প বলে, ভয়ানক এক প্রাণীর কথা, সমুদ্রের এক দানবের কথা। প্রাণীটি আর কেউ নয়, ডাইনোসর বিলুপ্তির পর পৃথিবীর সমুদ্র-জগৎ শাসন করা একমাত্র ডন ‘মেগালোডন’। আজ থেকে প্রায় ২৩ মিলিয়ন বছর আগে সাগরের অতলে বাস করা এই মেগালোডনের বৈজ্ঞানিক নাম কারচারোকলস মেগালোডন (Carcharocles megalodon), আর যার ডাকনাম ‘দ্য মেগ’। মেগালোডনদের বিচরণ ছিল প্রায় পুরো পৃথিবী জুড়েই। ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে এর জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। এমনকি মারিয়ানা ট্রেঞ্চ থেকেও তাদের দেহাংশ উদ্ধার হয়েছে। আবার ভারতীয় উপমহাদেশও বঞ্চিত হয়নি মেগালোডনের খপ্পর থেকে। উপকূল থেকে গভীর সমুদ্র সব জায়গাতেই নিজেদের মানিয়ে নিয়েছিলো তারা। যদিও শিশু মেগালোডনরা মূলত উপকূলবর্তী এলাকাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো। মেগালোডন কত বড় ছিল তার উত্তর পাওয়া যায় তার দাঁত দেখেই। এদের সবচেয়ে বড় যে দাঁতটি পাওয়া গেছে সেটি লম্বায় সাত ইঞ্চি আর চওড়াও কম নয়। যেখানে বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক হোয়াইট শার্কের দাঁতও তিন ইঞ্চি হয় কদাচিৎ। তবে দাঁত এবং কশেরুকা ছাড়া মেগালোডনের আর কোনো নমুনা পাওয়া যায়নি।

তাই এদের নিকটতম আত্মীয় হোয়াইট শার্কের সাথে তুলনা করে এবং ফসিল পুনঃবিন্যাস করে বিজ্ঞানীরা এদের ব্যাপারে আমাদের মোটামুটি একটি ধারণা দিয়েছেন। একটি হিসাব মতে, মেগালোডন লম্বায় গড়ে প্রায় ১০ মিটার থেকে শুরু হয়ে ১৮ মিটারের কাছাকাছি (Natural History Museum)। আবার অনেকের মতে, মেগালোডন লম্বায় পঁচিশ মিটারের কাছাকাছি। ওজনের ব্যাপারে মেগালোডনদের লিঙ্গভেদে অনেক পার্থক্য ছিল। স্ত্রী মেগালোডনের ওজন যেখানে ২৭.৪ থেকে ৫৯.৪ মেট্রিক টন, সেখানে পুরুষদের ওজন মাত্র ১২.৬ থেকে ৩৩.৯ মেট্রিক টন। ধারণা করা হয়, উপযুক্ত পরিবেশ এবং পর্যাপ্ত খাবার পাবার কারণেই এরা এমন বিপুল আকৃতির হতো। আর অতিকায় গ্রীবার কারণে তাদের কামড়ে জোরের পরিমাণও ছিল খুব বেশি। হোয়াইট শার্কের যেখানে ১৮,০০০ নিউটন বল প্রয়োগ করে, সেখানে মেগালোডনদের কামড়ে থাকে ১১০,০০০ থেকে ১৮০,০০০ নিউটন। ফলে শিকারিদের মধ্যে সবার উপরের নামটিই ছিল মেগালোডনদের। বিশাল দাঁত দিয়ে সাগরে একচ্ছত্র রাজত্ব করে গেছে তারা। ছোট মাছ থেকে শুরু করে সিল, সামুদ্রিক কচ্ছপ দিয়ে হরহামেশাই উদর পূর্তি করতো। তালিকা থেকে বাদ যেত না ডলফিন বা স্বগোত্রীয় অন্য ছোট হাঙ্গরেরাও। এমনকি তিমিরা তাদের প্রকাণ্ড শরীর নিয়েও মাফ পায়নি এই দানবদের থেকে। তাদের শিকারের কৌশল ছিল খুবই জটিল। শিকারের সাইজ অনুযায়ী এরা তাদের কৌশল নির্ধারণ করতো। অধিকাংশ সময় এরা শিকারের হৃৎপিণ্ড এবং ফুসফুস লক্ষ্য করেই অ্যাটাক করতো। আর বড় শিকার করার সময় অনেকটা বর্তমান হোয়াইট শার্কের অনুকরণেই শিকার করতো। মেগালোডনরা ছিল উষ্ণ রক্তের প্রাণী। এটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো তাদের জন্য। আজ থেকে পঁয়ত্রিশ মিলিয়ন বছর পূর্বে পৃথিবীর তাপমাত্রা হঠাৎ ঠাণ্ডা হওয়া শুরু করে। ফলে তারা যে খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল তারাও খাদ্যের অভাবের কমে যেতে থাকে এবং বরফ যুগ শুরু হওয়ার সাথে সাথে অনেক প্রাণী মেরু অঞ্চলে চলে যায়। মেগালোডনের পক্ষে তাদের পিছু নেয়া সম্ভব ছিল না। তাদের শরীরকে উষ্ণ রাখার জন্য তারা উষ্ণ জলের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তাছাড়া বরফ যুগের আগমনের সাথে সাথে সমুদ্রতলের উচ্চতা কমে যাওয়ায় তাদের চারণক্ষেত্রও কমে যেতে থাকে। এছাড়া এসময় খবারের জন্য খুনে তিমিসহ আরো কিছু শিকারি প্রাণীও তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে আসে। খাবার কমে যাওয়ায় এদের লড়াই করতে হতো অন্যান্য মেগালোডনদের সাথে। আর শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্যই নয়, সাগরের তাপমাত্রার সাথে নিজের শরীরের তাপমাত্রা মানানসই করে রাখার জন্যও তাদের বিপুল পরিমাণে খাবারের প্রয়োজন ছিল। আর এভাবেই আস্তে আস্তে বৃহদাকার মেগালোডন হারিয়ে যায় পৃথিবীর বুক থেকে। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া হয়েছে, মেগালোডনেরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। এসময় তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা দেয় খুনে তিমিসহ আরো কিছু শিকারি প্রাণী। এভাবে আস্তে আস্তে মেগালোডন হারিয়ে যায় পৃথিবীর বুক থেকে। তবে কল্পনাপ্রিয় মানুষেরা মেগালোডনের টিকে থাকার গল্পকেই সত্য বিশ্বাস করতে ভালোবাসে, তারা বিশ্বাস করে, সমুদ্রের তলে আজও হয়তো টিকে আছে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে খুনে প্রাণীদের কয়েকটি- আমাদের অগোচরে, আমাদের অলক্ষ্যে! ফলে প্রাণিজগতের বিস্ময় মেগালোডনের বিলুপ্তি সত্যিকার অর্থেই অনেককাল ধরে প্রাণিজগতে বেশ প্রভাব ফেলেছিল।

Share.

মন্তব্য করুন