সেলিনা হোসেন বর্তমানে বাংলা একাডেমির সভাপতি। মজার বিষয় হলো, এই বাংলা একাডেমিতেই কেটেছে তার কর্মজীবন! তিনি বাংলা একাডেমির পরিচালক থেকে অবসর নিয়েছেন। কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৭০ সালে, বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে। শিশু-কিশোরদের জন্য একটি মাসিক পত্রিকা বের হয় বাংলা একাডেমি থেকে। পত্রিকাটির নাম ‘ধান শালিকের দেশ’। তিনি ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এ পত্রিকাটি সম্পাদনা করেছেন। ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমির প্রথম মহিলা পরিচালক তিনি। ২০০৪ সালের ১৪ জুন চাকরি থেকে অবসর নেন। তার মোট উপন্যাসের সংখ্যা ২১টি, গল্পগ্রন্থ ৭টি এবং প্রবন্ধের গ্রন্থ ৪টি। কবিতার বই: বর্ণমালার গল্প। তার জন্ম ১৪ জুন ১৯৪৭ সালে। কিশোর পাতার পক্ষে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাসান সাইদুল।

কেমন কেটেছে আপনার শৈশবের দিনগুলো?
শৈশব তো একধরনের স্বপ্নের মতো। এ সময় আমি প্রকৃতির প্রতি দুর্বল ছিলাম খুব। আমার সমবয়সীরা মিলে সারাক্ষণ নদী, ধানক্ষেত আর পুকুর পাড়ে ঘুরে বেড়াতাম। পেয়ারা গাছ থেকে পেয়ারা পেড়ে নিতাম। টুনটুনির বাসা থেকে ডিম নিয়ে আসতাম। শামুকের ডিম টিপে দেখতাম, ভেতরে কী আছে। এসব করতে আমার কি যে ভালো লাগতো! পেয়ারার গাছের মগডালে উঠতাম পাকা পেয়ারা পাড়ার জন্য। যখন দেখতাম আব্বা অফিস থেকে আসছে, সেখান থেকে লাফিয়ে পড়তাম মাটিতে। গিয়ে আব্বাকে জড়িয়ে ধরতাম। আব্বু বাসায় ফেরার সময় কিছু না কিছু হাতে করে নিয়ে আসতেন। আমি সেগুলোর একটা ভাগটা রেখে তারপর অন্যদের দিতাম। এমনই আনন্দের ছিলো আমার শৈশবকাল।
কিভাবে শুরু হলো লেখালেখি? আপনার প্রথম লেখা প্রকাশের অনুভূতির কথা জানতে চাই?
লেখালেখি আমার আনন্দের বিষয়। প্রথম লেখার আনন্দ ছিলো ১৯৬৪ সালে। ঘটনাটি হলো রাজশাহী ডিভিশনের একটা সাহিত্য সংঘ, একটি সাহিত্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। সে প্রতিযোগিতায় আমি অংশ নিয়েছিলাম। ফলে প্রতিযোগিতার জন্য লিখতে হলো গল্প। সে গল্পটিই ছিলো আমার জীবনের প্রথম লেখা গল্প। লিখে কি যে আনন্দ পেয়েছিলাম! মনে পড়ে আজও। কিন্তু দুঃখজনক হলো, সে গল্পটি অনেক খোঁজাখুজি করেও কোথাও পাইনি। গল্পের নামটাও আমার মনে নেই।

আমাদের সাহিত্য এবং শিশু-সাহিত্যের বর্তমান অবস্থা কেমন মনে হয় আপনার?
বাংলাদেশের সূচনা থেকে এ পর্যন্ত যে সাহিত্য এবং শিশুসাহিত্য চর্চা হয়েছে এবং হচ্ছে সেটাকে আমি অনেক ভালোই বলবো। আমাদের লেখকরা সময়ের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তারা বিশ্বের সমসাময়িক সাহিত্যকে ধরতে পারছেন। আমি সামগ্রিকভাবে ভালো মনে করি। শিল্প-সংস্কৃতির অনেক মাধ্যমে বেশ ভালো কাজ হচ্ছে। এখানে অনেক শিল্পসম্মত এবং উন্নতমানের নাটক তৈরি হচ্ছে। মঞ্চায়ন বা ফর্মের দিকেও বেশ পরিবর্তন এসেছে। এখানকার লেখকরা বিচিত্র বিষয় নিয়ে কাজ করছেন। তারা পিছিয়ে নেই। তবে এটি ঠিক, শিল্পের গুণগত মান বিচার করবে সময়।
জীবনের এমন কিছু ঘটনার কথা বলুন, যা না ঘটলে হয়তো লেখকই হতেন না?
সাহিত্যিক হবো, এরকম কোনো পরিকল্পনা আমার ছিলো না। লেখক হওয়ার জন্য ভেতরে তেমন তাগাদাও অনুভব করিনি। ৬৪ সালে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় একটি প্রতিযোগিতায় সাতটি বিষয়ে অংশগ্রহণ করে ছয়টিতে প্রথম হই। একটিতে তৃতীয় হয়েছিলাম। এখানে গল্প লিখে প্রথম হই। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সেখানকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা ‘উত্তর অন্বেষণ’, ‘পূর্বমেঘ’সহ আরও কিছু পত্রিকায় লিখতে শুরু করি। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিখ্যাত শিক্ষক এবং লেখকদের সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য হয়। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, অধ্যাপক মুস্তাফা নূরউল ইসলাম স্যার সবসময় লিখতে বলতেন। এখান থেকেই শুরু। আর প্রথম থেকেই সাধারণ মানুষের জীবন, তাদের অনুভূতি আবেগ-আকাক্সক্ষা নিয়ে লেখার কথা ভাবতাম এবং লিখতে ভালো লাগতো। ভালো লাগতো শিশু-কিশোরদের নিয়ে ভাবতে। সেই থেকে লেখালেখি করে আসছি আজ অবধি।

নিজের রচনায় শৈশবকে কেমন করে তুলে আনেন?
আগেই বলেছি, আমার ছিল আনন্দময় শৈশব। প্রকৃতি দেখে প্রকৃতির ভেতর বড় হয়েছি। ছোটবেলার স্মৃতি এখনও লেখায় সাহায্য করে। যখনই কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্য বা জীবনযাপনের বর্ণনা লিখি, ফিরে যাই শৈশবের স্মৃতির কাছে। সেখান থেকে রূপরস আহরণ করে আমার রচনাকে সজীব করে তুলি। মানব সম্পর্কের বিষয়গুলোও শৈশবের স্মৃতি থেকে আসে।

শৈশবের কোনো ঘটনা মনে পড়ে- যা আপনাকে এখনো ভাবায়?
এমন বেশ কিছু ঘটনা আছে। একটির কথাই বলি। একদিন সন্ধ্যায় বাবার এক কর্মচারীর বাড়িতে গিয়ে দেখি- মা সন্তানদের ছোলা খেতে দিয়েছে। ছেলেমেয়েগুলো চাঁদের আলোয় বসে তা খাচ্ছে। চাঁদের আলোয় দিয়েছে। কারণ- তাদের ঘরে বাতি জ্বালানোর মতো কোনো কেরোসিন তেল ছিলো না। আমার খুব খারাপ লেগেছিলো। দরিদ্র মানুষের জীবন কেমন খুব বুঝতে পারি আমি। আমার শৈশবেই এসব মনে দাগ কেটেছে। ঈদে নতুন জামা পায়নি বলে গরিব ছেলেমেয়ে কাঁদছে। আমরাও ওদের জড়িয়ে ধরে কাঁদতাম। যতটা সম্ভব সহযোগিতাও করতাম। ছেলেবেলার নানা স্মৃতি আমার কাছে অন্য অর্থ নিয়ে আরও গভীরভাবে উপস্থিত হয়। যা আমাকে ভাবায়, কাঁদায়। আমার লেখালেখির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়।
বিভিন্ন সামাজিক কাজের সাথে আপনি জড়িত আছেন বলে জানি, এ কারণে ব্যস্ত থাকেন অনেক। এতে লেখালেখির ক্ষতি হয় না?

আমার সাংসারিক দায়িত্বকে কখনোই আমি অবহেলা করিনি। আমার মেয়ে লারার বয়স যখন দু’মাস, তখন আমি বাংলা একাডেমির চাকরিটা পেয়েছি। বাসায় কাজের মেয়ের কাছে রেখে অফিস করেছি আবার বিকেলে বাসায় এসে তাদের আদর-যত্ন করেছি। সামাজিক কাজের সাথেও আমি সম্পৃক্ত। সবকিছু ঠিক রেখেই লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছি।
কখন এবং কেমন করে লেখেন?
প্রতিদিনই আমি লিখি। কখনও সকালে লিখি, কখনও বিকেলে। আমার লেখার জন্য নির্দিষ্ট সময় নাই। তবে প্রতিদিনই আমি সময় বের করি লেখার জন্য। লেখা ছাড়া আমার চলে না। এক হাতে আমার সংসার আরেক হাতে আমার লেখালেখি।
শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু বলুন।
শিশু-কিশোরেরা ভালো লেখাপড়া করবে। ভালো মানুষ হয়ে বেড়ে উঠবে। দেশের আদর্শ নাগরিক হবে। সুন্দর আচরণের অধিকারী হবে। পিতা-মাতার কথা মান্য করবে। সুন্দর চরিত্রের মানুষ হয়ে সমাজ ও দেশকে আলোকিত করবে। এটাই তো চাওয়া!
আপনাকে ধন্যবাদ।
তোমাকেও ধন্যবাদ।

Share.

মন্তব্য করুন