চলো আজ এক সুপারহিরোর গল্প শুনি। একের পর এক নানান দুঃখের খবর দেখতে দেখতে যখন আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা যখন মুখ থুবড়ে পড়েছে ঠিক সেই সময় কোথা থেকে যেন আলোর দ্যুতির মতো হাজির হলেন এক সুপারম্যান, ডাক্তার কামরুল ইসলাম। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বমোট তিন হাজার কিডনি প্রতিস্থাপিত হয়েছে এখন পর্যন্ত, তার এক হাজারই ডাক্তার কামরুলের হাতে!
আমাদের শরীর নিয়ে ছেলেখেলায় মাতে এমন ডাক্তারের সংখ্যা তো অহরহ। তোমরা নিশ্চয় সেই ডাক্তারের কথা শুনেছো পেটের ভেতর কাঁচি রেখে দিয়ে যে সেলাই করে দিয়েছে! আবার এমনও তো শুনেছো হয়তো ভুল চিকিৎসায় মরেই গেছে রোগী। অথবা তিন দিন আগে আইসিইউতে মরে পড়ে আছে রোগী, এখনো মরেনি বলে তিন দিনের বিল করে বসে আছে হাসপাতাল। সেখানে ডাক্তার কামরুলের মতো কেউ আসা খুব সহজ ব্যাপার না।
ডাক্তার কামরুল চেয়েছিলেন অন্য কিছু হতে, ভাগ্যক্রমে তাকে ডাক্তারই হতে হলো। সবচেয়ে জটিল অপারেশনের একটি হচ্ছে কিডনি অপারেশন, সেই কিডনিই হাতে নিলেন ডাক্তার কামরুল। কিডনি আমাদের শরীরের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যদি সেই অংশ দুর্বল হয়ে পড়ে তবে বাঁচা কঠিন। তোমরা নিশ্চয় এমনও শুনেছো কিডনির অভাবে বানরের কিডনি লাগাতে হয়েছে মানুষকে। আর কিডনি লাগানোর যে ঝক্কি-ঝামেলা তা কি সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে আছে? মোটেই না। সে বড় লোকদের ব্যাপার, কিন্তু সাধারণ মানুষেরা কী করবে? কিডনি সমস্যা কি বড়লোক-গরিব লোক দেখে দেখে আসে? সাধারণ লোকের কিডনি সমস্যা হলে তারা কোথায় যাবে? ড. কামরুল ইসলাম তার হাসপাতালে দেন বিনামূল্যে চিকিৎসা। একদম যে খরচটা না নিলেই নয় সেই খরচের বাইরে তিনি আর একটা টাকাও নিতে চান না, এমনকি নিজের পারিশ্রমিকটাও না।
কিডনির সমস্যাজনিত কারণে ভুগছে দেশের কত মানুষ ভাবলেই অবাক হবে। দুই কোটি লোক কিডনি সমস্যায় ভুগছে। ১৬ কোটি মানুষের দুই কোটিই একটি রোগে ভোগা করোনার চেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার না? কিন্তু কতজনের চিকিৎসার সুযোগ আছে বলো? একটি ভয়াবহ তথ্য জানিয়ে রাখি, ২০২০ সালে কিডনি জটিলতায় মারা গেছেন ২৮ হাজার ১৭ জন, যা ২০১৯ সালে ছিল ১০ হাজার ৬২২ জন। মানে প্রতি বছর জ্যামিতিকহারে বাড়ছে এই রোগীর মৃত্যু তালিকা। কিন্তু আমাদের দেশে তো অনেক ড. কামরুল ইসলাম নাই, তা হলে কিভাবে এত লোক চিকিৎসা পাবে? তুমিও একজন ড. কামরুল হতে চাও নাকি? তা চাইতেই পারো। কিন্তু আগে তো আমাদের কিডনিটা সুস্থ রাখতে হবে। জেনে নিই কিভাবে কিডনিকে ছুরির নিচে যাওয়া থেকে রক্ষা করবো আমরা।
কিডনি রোগের অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে, নেফ্রাইটিস বা প্রস্রাবের প্রদাহ, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ বা অতিমাত্রায় ব্যথানাশক ঔষধ প্রয়োগ করা এবং খাদ্যাভাস। হু! খাদ্যাভ্যাস একটা ভয়াবহ ব্যাপার কিন্তু, আমরা কি খাচ্ছি না খাচ্ছি, কখন খাচ্ছি কতটুকু খাচ্ছি এর উপর কিন্তু কিডনির বাঁচা-মরা নির্ভর করে। এই যে নানান ভেজাল খাবারের কথা শুনি, আমরা কিন্তু অত গুরুত্ব দিই না। বলি কী- সবসময় ভেজালই তো খাচ্ছি! না, এটা বলার দরকার নেই। যতটুকু বাঁচা যায় ততটুকু বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। ভাজাপোড়া থেকে থাকতে হবে একশো হাত দূরে থাকতে হবে। এই যে রমজানে-ঈদে বা তারপরও সারাবছর আমরা শখ করে বা ক্ষুধা লাগলেই হুট করে কিছু আজেবাজে জিনিস খেয়ে ফেলি- না, এমন যেন না হয়।
কিছু লক্ষণ কিডনি রোগের সঙ্কেত দেয়; ধরো তোমার প্রস্রাবের সময় যদি জ্বালাপোড়া করে, ঘন ঘন প্রস্রাব হয়, প্রস্রাব যদি লাল হয়ে থাকে দিনের পর দিন, যদি কোমরের দুই পাশে ও তলপেটে প্রচণ্ড ব্যথা হয়- তাহলে শিগগির ডাক্তার দেখাও। না হলে প্রতি বছর যে জ্যামিতির হিসাব হচ্ছে সেখানে তোমার নামটাও ঢুকে পড়তে পারে টুপ করে। ধূমপান, কোমল পানীয় এগুলোও কিডনি ড্যামেজের কারণ হতে পারে। তুমি ভাবতেই পারো, আমি তো আর ধূমপান করছি না- তাহলে তো সমস্যা নেই! না, সমস্যা আছে কিন্তু। প্রতি বছর প্রত্যক্ষ ধূমপানের চেয়ে পরোক্ষ ধূমপানে মৃত্যু ঘটে বেশি মানুষের, পরোক্ষ ধূমপান হচ্ছে আরেকজন সিগারেট খাচ্ছে আর তুমি আশপাশে আছো, এটাই। সিগারেট খাওয়া লোকদের কাছ থেকে দ্রুত সরে যেতে হবে যদি কিডনি সতেজ রাখতে চাও। কোমল পানীয়ও ছাড়তে হবে।
কিডনি রোগের আরেকটা প্রধান কারণ অতিমাত্রায় ব্যথানাশক ট্যাবলেট খাওয়া। এই যে আমাদের হালকা রোগ হলেই এন্টিবায়োটিক খেয়ে ফেলি- এটা একসময় ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। অসুখ হলে অবশ্যই সঠিক ডোজ খেতে হবে, ঠিক যতটুকু খাওয়ার জন্য ডাক্তার বলবে তার কমবেশি খাওয়া চলবে না। ধরো, তোমাকে ৭টা ট্যাবলেট খেতে বললো ডাক্তার, তিন দিনে তোমার অসুখ সেরে গেলো, এখন কী করবে? বাকি ট্যাবলেট রেখে দেবে? মোটেই না। পূর্ণ ডোজ খেতে হবে। আর এন্টিবায়োটিকের ব্যাপারে সাবধান, ওটা ভালোর চেয়ে ক্ষতিই বেশি ডেকে আনতে পারে, যদি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না দেন। আর নির্দিষ্ট বয়সে সে বয়স অনুযায়ী ওজন ধরে রাখতে হবে, অনেক বেশি বা কম ওজন হলেও শরীর ‘খেয়ে’ ফেলবে।
কিডনি রোগ থেকে এখনই নিজেদের ‘কিডনি সুরক্ষা বলয়ে’ ঢুকিয়ে ফেলতে চাইলে কী কী করতে হবে?
১. লিফটের বদলে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার অভ্যাস বাড়াতে হবে। ১ কিলোমিটারের কম দূরত্বে গাড়ি পরিহার করে হেঁটে যেতে হবে।
২. ঘরে যদি ব্লাড সুগার টেস্টের কিট থাকে মাঝে মাঝে চেক করতে হবে। না থাকলে সম্ভব হলে ডাক্তারের কাছে গিয়ে মাসে অন্তত একবার চেক করাতে হবে।
৩. রক্তচাপ ১৪০-৯০ এর বেশি হলে অবশ্যই ডাক্তার দেখাতে হবে। ব্লাড প্রেশারও চেক করতে হবে মাঝে মাঝে।
৪. প্রচুর ফলমূল-শাকসবজি খেতে হবে। আর লবণকে টাটা গুডবাই বলতে হবে। আমাদের যা লবণ প্রয়োজন তা তরকারিতেই থাকে, কিডনির উপর চাপ ফেলার দরকার কী?
৫. ভাতের আগে-পরে অল্প একটু পানি খেতে হবে, কিন্তু সারাদিনে বেশ কয়বার পানি খেয়ে ব্যালান্স করতে হবে, অন্তত ১০ গ্লাস তো খেতেই হবে।
৬. ধূমপায়ীদেরকে নিরুৎসাহিত করতে হবে, নিজে কোমল পানীয় বাদ দিতে হবে আর প্রতি বছর কিডনি চেক করানোর চেষ্টা করতে হবে, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, রাস্তার পাশে রাখা জুস-শরবত খাওয়া ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
বাংলাদেশে কিডনি রোগের ডাক্তার কত অপ্রতুল দেখো, ২ কোটি রোগীর জন্য সারাদেশে কিডনি চিকিৎসক কয়জন জানো? মাত্র ২০০। দুইশজন মানুষ কিভাবে ২ কোটি রোগীর চিকিৎসা দেবেন- তুমিই বলো। শিশুদের অবস্থা তো আরও খারাপ। দেশে বর্তমানে শিশু কিডনি রোগী সংখ্যা প্রায় ৪২ লাখ। অথচ এর বিপরীতে বিশেষজ্ঞ কিডনি চিকিৎসক আছেন মাত্র ৩৫ জন। অর্থাৎ কিডনিতে আক্রান্ত প্রতি সোয়া ১ লাখ শিশুর জন্য গড়ে ১ জন বিশেষজ্ঞ কিডনি চিকিৎসক রয়েছে দেশে। তুমি যদি আক্রান্ত হও তাহলে চিকিৎসা পাবে এমন কোনো নিশ্চয়তা আছে? কেন নিজের বিপদ ডেকে আনবে?
তো, আমরা আবার সুপারম্যান ডাক্তার কামরুল প্রসঙ্গে ফিরে যাই। তোমাদের জেনে ভালো লাগবে, চিকিৎসায় ব্যাপক অবদান রাখায় ২০২২ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে ডাক্তার কামরুল ইসলামকে। স্বাধীনতা পুরস্কার হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদক। চলো, ডাক্তার কামরুলের মতো দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ি একসাথে। একসাথে গড়ি আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ।

Share.

মন্তব্য করুন