বৃষ্টি কেনো হয়, বৃষ্টি কেনো পড়ে? ছোটোবেলার জিজ্ঞাসা এখনো অমলিন। মেঘ ডাকলে মনে হতো ঝড় আসলে সব উড়ে যাবে। আমাদের ঘর উড়ে গেলে আমরা কোথায় থাকবো!
পেঁজা তুলোর সাদাকালো দানবীয় মেঘ। একদিকে ভয় অন্যদিকে আনন্দ। সূর্যের আলো পড়ে মেঘ চিকচিক করে। কত শোভা যে মেঘের দেশে তা বোঝানো যাবে না। যখন আষাঢ়-শ্রাবণে প্রবল বৃষ্টি, অনেকের দুর্ভোগ হয় কিন্তু বৃষ্টি দরকার ফসলের জন্য। শুকিয়ে যাওয়া নদ-নদী খালবিলের জন্য। মাঝে মাঝে বৃষ্টি থামলে রঙধনু ওঠে। কি অনন্য! ঐ রঙধনু হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে মন চাইতো। লজেন্সের অনেক রংয়ের মতো। এতো যে বৃষ্টির গুণ কখনো তা ম্লান হয়ে যেতো কবি জসীমউদ্দীনের আসমানী কবিতা পড়ে।
আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,
রহীমুদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।
বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলে গড়িয়ে পড়ে পানি।
এরকম অসংখ্য আসমানী আছে আমাদের দেশে। বৃষ্টি খরায় কষ্ট পায়। না খেয়ে অপুষ্টিতে ভোগে। চিকিৎসা পায় না। আমাদের শিশুদের কোনো খেলার মাঠ নেই। ঘুড়ি উড়াবার জায়গা নেই। বৃষ্টিতে দৌড়ে মাঠে গিয়ে ভিজবার জায়গা নেই। আমাদের সবুজ গাছের খুব অভাব। যে গাছ বৃষ্টির জোগান দেয়, যে গাছ ফল দেয়, ফুল দেয়। বৃষ্টি না হলে কোনো গাছ বাড়ে না। শুকিয়ে যায়। আমরা যেমন বৃষ্টি ভালোবাসি গাছেরাও ভালোবাসে। এই গাছ কেটে ধ্বংস করে বনখেকো মানুষেরা। এদের বিরুদ্ধে সব সময় রুখে দাঁড়াতে হবে।
বাংলাদেশে তেরোশ নদী। এই নদী বৃষ্টির বড় উৎস। অনেকে নদীর পাড়ে মাটি ফেলে নদী ভরাট করে ফেলছে। আমরা নদীতে পলিথিন ফেলে নদীর স্রোত নষ্ট করছি। সবচে বড়- নদীতে বাঁধ দিয়ে নদীকে হত্যা করা হচ্ছে। এসব কারণে বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। প্রকৃতিবিজ্ঞানীরা বলছেন, এভাবে চললে আমাদের দেশ মরুভূমিতে রূপান্তরিত হবে। আমরা মরুভূমি চাই না। আমরা সুজলা সুফলা বাংলাদেশ চাই। আমরা অনেক বৃষ্টি চাই। রংধনু চাই।
বনখেকো, ভূমিদস্যুদের বিচার চাই।
আমরা গান গাইবো-
‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে
ধান দেবো মেপে।’
হাত ধরে ঘুরে ঘুরে গাইবো-
‘রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে
খেঁকশেয়ালের বিয়ে হচ্ছে।’

বৃষ্টি প্রকৃতির সবচে সুন্দর শিল্পকলা। আমরা ছবি আঁকলে একটা বাড়ি, গাছ, পাখি, নদী আঁকি। আর বাড়ির ছাদে বৃষ্টির ছবি আঁকি। রবীন্দ্রনাথ যে এতো বড় কবি। তার প্রথম কবিতা- জল পড়ে, পাতা নড়ে। যদিও লাইনটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। আরো ছড়া আমাদের মনে দোলা দেয়- ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এলো বান।’ এর মধ্যে আষাঢ়-শ্রাবণের রূপ আমরা দেখতে পাই। বৃষ্টি নিয়ে বিদেশে কত কবিতা, ছড়া, ফ্রেজ।
মুষলধারে বৃষ্টি বোঝাতে ইংরেজি প্রবচন- ক্যাটস অ্যান্ড ডগস। বাংলায়ও আছে- মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। মেঘবৃষ্টি নিয়ে পৃথিবীর বিখ্যাত সংস্কৃত কবি কালিদাসের ‘মেঘদূত’ মহাকাব্য। বৃষ্টি সবচে বেশি হয় ভারতের চেরাপুঞ্জিতে। মেঘবৃষ্টির সাথে আবার বজ্রপাত। বজ্রপাতে প্রতি বছর অসংখ্য লোক মারা যায়। এজন্য বড় বড় তালগাছ দরকার। বজ্রনিরোধক প্রযুক্তি প্রয়োজন। আমরা বড় আত্মঘাতী নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করে মৃত্যু ডেকে আনছি। ইট, কাঠ, লোহার শহর আমাদের মুক্ত আকাশ, মেঘমালা দেখতে দেয় না। ঘুড়ি উড়াবার জায়গা নেই। ফুটবল খেলার মাঠ নেই। আমরা কোথায় যাবো! আমাদের এখন দাঁড়াবার জায়গা নেই। জ্যৈষ্ঠমাসে ঝড়বৃষ্টিতে আমরা আম কুড়ানোর সুখ কোথায় পাবো? কে আমাদের বর্ষা হলে টইটম্বুর পদ্মদীঘি দেখাবে! ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে ইলিশ মাছ ভাজি আর খিচুড়ি আমরা কোথায় পাবো! ইলিশ কেনার সামর্থ্য কি আমাদের আছে? রবীন্দ্রনাথ নিষেধ করেছিলেন আষাঢ়ের বাদল দিনে বাইরে না যেতে কিন্তু সেই বিরামহীন বৃষ্টি কোথায়? শুধু রবীন্দ্রনাথের কবিতায় বৃষ্টি দেখি-
‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে
তিল ঠাঁই আর নাহিরে,
ওগো তোরা আজ যাসনে ঘরের বাহিরে।’

এই আহ্বানে এখন কে সাড়া দেবে মানুষের মনে দিনরাত্রি রুটিরুজির তাগাদা। প্রমথ চৌধুরীর বৃষ্টি নিয়ে একটা প্রবন্ধের কথা মনে পড়ে- এমন বাদল দিনে তারে বলা যায়। কারে বলা যায়? প্রিয় কোনো বন্ধুকে। আমরা বন্ধুরা মিলে বৃষ্টিতে ভিজে লেবুর বল খেলেছি। হা-ডু-ডু খেলেছি। এখন আর ছেলেমেয়েরা এসব চিন্তাও করে না। বৃষ্টির ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেয়াতেই তাদের আনন্দ। এখনো নজরুলের বিখ্যাত বৃষ্টির গান আমাদের আপ্লুত করে-
‘শাওন আসিল ফিরে, সে তো ফিরে এলো না।’ কিংবা
‘আজি এ শ্রাবণ নিশি কাটে কেমনে।’
নজরুলের আরেকটা গান আমি চল্লিশ বছর ধরে শুনছি-
‘শাওন রাতে যদি, স্মরণে আসে মোরে।
বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে।’

গানে, কবিতায়, ছবিতে, উপন্যাসে বৃষ্টি না থাকলে কোথাও বৃষ্টি না থাকলে বাংলাদেশ মনে হয় না। সমাজবাদী কবিরাও বর্ষাকে অবহেলা করেননি। কিশোর কবি সুকান্তসহ তিরিশের পাঁচ কবির প্রায় সকলেই লিখেছেন বৃষ্টির কথা। বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাস- ‘রাতভর বৃষ্টি’। সমর সেনের বিখ্যাত কবিতা- ‘বৃষ্টি’। অমিয় চক্রবর্তীর- ‘মেলাবেন তিনি মেলাবেন ঝড়ো হাওয়া বৃষ্টির সাথে মেলাবেন।’ বিষ্ণু দে ‘ঘোড়সওয়ার’ কবিতায় বৃষ্টির কথা বলতে ভোলেননি । জীবনানন্দ দাশ বাংলার রূপ আঁকতে গিয়ে বৃষ্টিকে ভোলেননি। কবি আল মাহমুদ সোনালী কাবিন কবতায় বলছেন-
‘আজো আমি ঘোরলাগা বর্ষণের মাঝে উবু হয়ে সবুজ ধানের চারা রুয়ে দিতে গিয়ে ভাবলাম এ মৃত্তিকা কিষাণী আমার।’ শামসুর রাহমানের বিখ্যাত কবিতা ‘রুপালি স্নান’। শহীদ কাদরীর ‘নগরে বৃষ্টি’ কবিতায় বলছেন হঠাৎ সন্ত্রাস ছুঁলো মাটি। এসব কেতাবি কথা। আসল কথা মাটির উপর প্রথম বৃষ্টি পড়লে একধরনের সোঁদা গন্ধে প্রাণ ভরে ওঠে। টিনের চালে গাছের পাতায় বৃষ্টি পড়ে ফোঁটায় ফোঁটায়। বৃষ্টি একেক জায়গায় পড়ে একেক রকম ছন্দ তোলে।
জসীমউদ্দীন নিমন্ত্রণ কবিতায় বাংলার রূপ দেখাতে গিয়ে বর্ষার রূপ দেখাতে ভোলেননি। রেললাইনের খাদে বৃষ্টির পানিতে ডানকানা মাছের কিলবিল করার দৃশ্যের ছবি এঁকেছেন তিনি। শৈশবে বৃষ্টিতে খালে মাছ ধরার আনন্দ অপরিসীম। বাংলাদেশের বৃষ্টির অনিন্দ্য রূপ বিশ্বের কারো সাথে মিলবে না।
এখনো বৃষ্টি এলে জানালায় বসে অবাক হয়ে ভাবি- বৃষ্টি কেনো হয়, বৃষ্টি কেনো পড়ে?
এক কবির বিখ্যাত দুটি লাইন আমি সারাজীবন হৃদয়ে গোপন রেখেছি-
এক বরষার বৃষ্টিতে যদি মুছে যায় নাম,
এতো পথ হেঁটে এতো জল ঘেঁটে
কি তবে পেলাম?

Share.

মন্তব্য করুন