ছোট, মাঝারি ও বড় এই তিন বয়সের মানুষের গানের ক্লাসের সাথেই আমার সখ্য ছিল। তবে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করতাম ছোটদের গানের ক্লাসে। এদেরকে কেন যেন পরিবারের সদস্য মনে হতো। অভিজ্ঞতার আলোকে আজ ছোটদের গানের ক্লাস বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।
গান গুরুমুখী বিদ্যা। সরাসরি গান শোনায়ে বা দু’লাইন করে গেয়ে শিক্ষার্থীর কণ্ঠে হয়তো গান তোলা যাবে কিন্তু সেটি হবে অবৈজ্ঞানিক, যা নীরস ও স্বল্পস্থায়ী। গান হচ্ছে মননশীল বিষয়। এখানে মনের সাবলীল উচ্ছ্বাস জরুরি। তাই ছোটদের গান শেখাতে ধারাবাহিক ও ফলপ্রসূ প্রক্রিয়ায় এগোতে হয়।
প্রথমে গানের বিষয় সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা। যেমন, গানটি দেশাত্মবোধক, ছড়াগান, হামদ-নাত, পল্লী, কাওয়ালী, শিশুতোষ- যে বিষয়ের হবে সে বিষয় সম্পর্কে ধারণা দেয়া এবং সুনির্দিষ্টভাবে গানটির বিষয়ের উপর কথা বলা।
কথাগুলো শিশু উপযোগী হওয়া উচিত। কথাগুলো ছোটরা অনুধাবন করতে পারলো কি না প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে খানিকটা যাচাই করা। তাদেরকে প্রশিক্ষকের প্রতি প্রশ্ন ছুঁড়তে বলা। এভাবে মিথস্ক্রিয়া প্রক্রিয়ায় ক্লাসকে সরস রাখা। আমার মনে পড়ছে ৩৫ বছর আগের কথা- এভাবে প্রশ্নোত্তর পর্ব চলার সময় শিক্ষার্থীদের মাঝে দারুণ উচ্ছ্বাস কাজ করে দ্রুত উত্তর দেয়ার জন্য।
গানের বিষয় সম্পর্কে ধারণা দেয়ার পর গানের কথাগুলো তাল রেখে আবৃত্তি করানোর পালা। আবৃত্তি শুরুর আগে গানের অন্ত্যমিলসমৃদ্ধ শব্দগুলো (জুঃযবসরপ ডড়ৎফং) ধারাবাহিকভাবে দুটো দুটো করে উচ্চারণ করে শোনাতে হবে। ধরা যাক, স্বরবর্ণের এই গানটি শেখানো হবে-
স্বর অ তে অজগর, স্বর আ তে আম
হ্রস ই তে ইলিশ খাঁটি হাপুস-হুপুস কাম।

দীর্ঘ ঈ তে ঈগল পাখি, হ্রস উ তে দেয় যে উঁকি
দীর্ঘ ঊ তে ঊষা হাসে, ঋ তে ঋতু আনচান।

এ তে হয় এক্কা গাড়ি, ঐ তে ঐক্য আমরা গড়ি
ও তে ওল, নেই কোন বোল ঔ তে ঔষুধ খান।
গানটির অন্ত্যমিলসমৃদ্ধ শব্দগুলো উচ্চারণ করে শোনাতে হবে। যেমন- আম-কাম, পাখি-উঁকি, আনচান-হুপুস কাম, গাড়ি-গড়ি, ওল-বোল, খান-কাম। এভাবে বুঝিয়ে দেয়ার পর আবারো মিথস্ক্রিয়া প্রক্রিয়ায় কতটুকু ধারণ করলো তা যাচাই করে নেয়া।
এবার প্রশিক্ষক তাল রেখে গীতি কবিতাটি আবৃত্তি করবেন শুদ্ধ উচ্চারণে। তাল যাতে ছুটে না যায় সেজন্য হাতে তালি দিয়ে বা টেবিলে টোকা দিয়ে তাল রক্ষা করতে হবে। এই অবস্থায় তালের বিশদ ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন নেই। তবে শিক্ষার্থীরা আগে বেশ ক্লাস পেয়ে থাকলে তবে তালের প্রাথমিক পরিচয় (দাদরা/কাহার্বা/ঝুমুর) দেয়া যায়। এই ক্ষেত্রে প্রশিক্ষককে মনে রাখতে হবে- গানটি যে তালের, আবৃত্তি সেই তালে করতে হবে। নতুবা গানের সময় সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। আবৃত্তি যথার্থ হলে গানের সুরে তাল কাটে না। তাই গানের শরীরের অঙ্গভিত্তিক আবৃত্তি করাতে হবে। অর্থাৎ স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী (যদি থাকে), আভোগ- এই চারটি অংশ ক্রমান্বয়ে আবৃত্তি করাতে হয়। সাথে সাথে গানের শরীরের অংশগুলোর নামও শেখানো যায়। ধরা যাক, শিল্পী আবদুর রহমান বয়াতীর সেই বহুল গায়িত গান- ‘দে দে পাল তুলে দে’-
দে দে পাল তুলে দে মাঝি হেলা করিস না
ছেড়ে দে নৌকা আমি যাব মদিনা। [স্থায়ী]

দুনিয়ায় নবী এলো মা আমিনার ঘরে
হাসিতে হাজার মানিক কাঁদিলে মুক্তো ঝরে
(ও) দয়াল মুর্শিদ যার সখা তার কিসের ভাবনা
(আমার) হৃদয় মাঝে কাবা নয়নে মদিনা। [অন্তরা]

ও নূরের রৌশনীতে দুনিয়া গেছে ভরে
সে নূরের বাতি জ্বলে মদিনার ঘরে ঘরে
দয়াল মুর্শিদ যার সখা তার কিসের ভাবনা
(আমার) হৃদয় মাঝে কাবা নয়নে মদিনা। [আভোগ]
অন্ত্যমিলসমৃদ্ধ শব্দ, জটিল শব্দ, যুক্ত শব্দগুলো যথাযথ উচ্চারণ এবং তাল রেখে গানটি (গীতি কবিতাটি) আবৃত্তি শিখন শেষে মূল কাজে অর্থাৎ গান ছোটদের কণ্ঠে তোলার কাজে অগ্রসর হতে হয়।
ছোটদের কণ্ঠে গান যথাযথভাবে তোলার জন্য ধৈর্যের সাথে বিভিন্ন ধাপগুলো ক্রমান্বয়ে অনুসরণ করতে হয়। কণ্ঠে গান তোলার জন্য ছোটদের ক্ষেত্রে শুরুতে যন্ত্র/হারমোনিয়াম ব্যবহার না করার ব্যাপারে অনেক সঙ্গীতজ্ঞ পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ- আগে কণ্ঠসঙ্গীত, এরপর যন্ত্রসঙ্গীত। সঙ্গীতে যন্ত্রের ব্যবহার কণ্ঠে গান উঠার হাজার হাজার বছর পর। কণ্ঠে গান উঠে গেলে এরপর যন্ত্রের প্রয়োজনীয় প্রয়োগ করা যায়। শুরুতে হারমোনিয়ামসহ কণ্ঠে গান তোলার ক্ষেত্রে সুরের সূক্ষ্ম কাজগুলো কণ্ঠে তুলে আনতে সমস্যা হয়। কারণ হারমেনিয়ামে সাত স্বর যথাযথ কাজ করলেও বাইশ শ্রুতির সূক্ষ্ম সুর লাগে না। তাই বহুল ব্যবহৃত হারমোনিয়ামকে অবৈজ্ঞানিক বলে উপমহাদেশে বাতিল করা হয়েছিল। তবে গানের স্কেল নির্ধারণের জন্য সহযোগিতা নেয়া যায়। কিংবা গানের পিক অংশ সাবলীলভাবে যতটুকু উঁচায় গাওয়া যায় সেটাকে ভিত্তি করে স্কেল নির্ধারণ করা যায়। তবে কণ্ঠ অনুশীলনের ক্ষেত্রে ভিন্ন কথা।
কণ্ঠে গান তোলার কাজ শুরু করার পূর্বে হারমোনিয়াম দিয়ে বা খালি কণ্ঠে অন্তত পাঁচ/ছয়টি সারগাম পাঠ অনুশীলন করা শ্রেয়। এতে গলার খুশ খুশ ভাব পরিষ্কার হয় এবং গান তোলার জন্য কণ্ঠ প্রস্তুত হয়। কিছু সারগাম অনুশীলন শেষে প্রশিক্ষক প্রথমে পুরো গানটা একবার গেয়ে শোনাবেন। এসময় শিক্ষার্থীদের প্রতি নির্দেশনা থাকবে- কান খোলা রেখে, চোখ বন্ধ করে মন দিয়ে গানটা শোনবে। এরপর শুরু হবে মূল প্রশিক্ষণ। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে গান শেখানোর সময় নিচের পদ্ধতিটি তুলনামূলকভাবে ফলপ্রসূ-
স্থায়ীর প্রথম লাইন : প্রশিক্ষক ১ বার, শিক্ষার্থীরা ১ বার
স্থায়ীর ২য় লাইন : প্রশিক্ষক ১ বার, শিক্ষার্থীরা ১ বার
[এভাবে ৩ বার]
স্থায়ীর ১ম ও ২য় লাইন একসাথে একই প্রক্রিয়ায়।
অন্তরার ১ম দু’লাইন : প্রশিক্ষক ১ বার, শিক্ষার্থীরা ১ বার
অন্তরার ২য় দুলাইন : প্রশিক্ষক ১ বার, শিক্ষার্থীরা ১ বার
[এভাবে ৩ বার]
পুরো অন্তরা+স্থায়ীর ১ম/২য় লাইন : ১বার+১ বার
একই প্রক্রিয়ায় সঞ্চারী ও আভোগের প্রশিক্ষণ চলবে।

এভাবে প্রতিটি গান শেখানের পেছনে পর্যাপ্ত সময় দিয়ে স্তরে স্তরে শেখাতে হয়। মনে রাখতে হবে, প্রথম শেখানোর মধ্যে যদি উচ্চারণ, তাল, লয়, সুরে কোন ভুল থাকে তা পরবর্তীতে শোধরানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। গানের ক্লাসকে আনন্দদায়ক করতে প্রশিক্ষককে গানটি ভালো করে ধারণ করতে হবে, উৎফুল্ল থাকতে হবে, উপস্থাপনায় যথার্থ বডি ল্যাঙ্গুয়েজ ব্যবহার করতে হবে। ছোটদের গান উপস্থাপনার সময় গানের বক্তব্যের সাথে দেহ এবং মনও সক্রিয় থাকতে হবে। গান শেখার ক্লাসে মনোযোগ ধরে রাখার জন্য এখানেও মিথস্ক্রিয়া পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। গানের সুর সঠিকভাবে ধারণের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে বারবার শোনা। এই ক্ষেত্রে শোনা এবং বলার অনুপাত হচ্ছে ২ঃ১। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় উল্টো চিত্র। ছোটদের গান নির্বাচনও এই ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এ ব্যাপারে সবিতা চৌধুরী (যিনি উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক সলিল চৌধুরীর সহধর্মিণী এবং নিজেও সঙ্গীতজ্ঞ, সংগীত প্রশিক্ষক) বলেন, ‘ছোটদেরকে ছোটদের মতো থাকতে দেয়া উচিত। তাদের উপর বড়দের ভাবনা চাপিয়ে সেটা উপস্থাপন করার কোন দরকার নেই। আজকাল বিভিন্ন রিয়্যালিটি শো-তে নিয়ে বাবা-মায়েরাও বাচ্চাদের শৈশব নষ্ট করে দিচ্ছেন। বিষয়টি চিন্তার। ইদানীং বাচ্চাদের দিয়ে আইটেম সং গাওয়ানো হচ্ছে। অথচ তাদের মৌলিক বিষয়গুলো শেখানো হচ্ছে না। দু-একটি ফিল্মি গান শেখায়ে রিয়্যালিটি শো স্টেজে পাঠিয়ে দিয়ে সাময়িক বাহবা পাচ্ছে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হচ্ছে। এই শিশু শিল্পী হিসাবে গড়ে উঠছে না। এজন্য ইদানীং আমরা প্রচুর শিশুস্টার পাচ্ছি কিন্তু শিশুশিল্পী পাচ্ছি না। ছোটদের শিশু উপযোগী গান শেখানো এবং শিখতে আগ্রহী করতে প্রশিক্ষককে অভিজ্ঞ হতে হবে, অত্যন্ত ধৈর্য, যত্ন ও আনন্দের সাথে গান শেখাতে হবে এবং উপযোগী স্টেজ পারফরম্যান্সের ব্যবস্থা রাখতে হবে। দুঃখজনক হচ্ছে- এই ধৈর্য, যত্ন, আনন্দ এখন আর ছোটদের গানের ক্লাসে খুব একটা দেখা যায় না। সবাই অস্থির এবং বাণিজ্যক ভাবনায় আবিষ্ট। যেনতেন করে শেখায়ে ক্ষতি করার চেয়ে না শেখানো ভালো। এতে ছোটদের কাছে গান কিছুদিন যেতে না যেতেই আনন্দ-বিনোদনের পরিবর্তে বিরক্তির কারণ হয়ে উঠবে।

Share.

মন্তব্য করুন