সকাল ৭টা বাজে। সিয়াম স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। মা স্কুল ব্যাগে ওর টিফিন বক্স আর বোতল খুব যত্ন করে ভরে দিচ্ছেন। বাবা জুতা পরতে সাহায্য করছেন। সিয়ামের বাবা সেলিম সাহেব সারা দিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকেন। সিয়াম তাকে একান্তভাবে কাছে এই সকালবেলায় স্কুলে যাওয়ার সময়টাতেই পায়। তিনি এক সাথে ছেলেকে সাথে করে নিয়ে বের হন। অফিসে যাওয়ার পথে সিয়ামকে স্কুল গেটে নামিয়ে দিয়ে অফিসে চলে যান। যাওয়ার পথে গাড়িতে ছেলের সাথে গল্প করেন। সিয়াম বড় হয়ে কি হতে চায় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার না কি তার মতো ব্যবসায়ী?
স্কুল থেকে নেয়ার কাজটা সাধারণত সিয়ামের মা রাজিয়া বেগমই বেশি করেন। তবে তিনি যেদিন বেশি ব্যস্ত থাকেন, সেদিন বাবা গাড়িসহ ড্রাইভার আংকেলকে পাঠিয়ে দেন। বাবার বাইরে কাজ থাকলে বাসার দারোয়ান আংকেল সিয়ামকে স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে আসে। সিয়ামের বাবা কোন চাকরি করেন না। ব্যবসা করেন। নিজের অফিস। কিন্তু খুবই সিরিয়াস। ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় সময় মতো অফিস করেন। অফিসে হাজির হয়ে প্রতিদিনের কর্মসূচি দেখে রুটিন কাজ শেষ করেন। অফিসের বাইরে কোন কাজ থাকলে তারপর বের হন। যেদিন বাইরে কাজ না থাকে সেদিন সিয়ামের কোনো সুবিধা হয় না। কারণ তার বাবা ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়ি পাঠিয়ে দেন। সিয়ামের মা কোনো চাকরি করেন না। তবে সংসারের কাজের ফাঁকে তিনি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনকে সময় দেন। তার কোন মিটিং-সিটিং না থাকলে তিনি স্কুলে যান সিয়ামকে আনতে। গাড়ি এবং মা দু’টিই যেদিন সিয়াম পায় সেদিন তার খুব ভালো লাগে। শুধু ড্রাইভার কিংবা দারোয়ান আংকেলদের সাথে যেদিন আসতে হয়, সেদিন তার একটুও ভালো লাগে না। নিজেকে খুব একা মনে হয়। সেদিন টেলিভিশনে একটি খবর দেখার পর থেকে তার মনটা আরো বেশি খারাপ থাকে মা-বাবা কাউকে না পেলে। টাকার জন্য একজন ড্রাইভার আংকেল একটি সুন্দর বাচ্চাকে মেরে ফেলেছে। এ কথাটি মনে হলেই রাজ্যের ভয় এসে সিয়ামের ওপর ভর করে। কিন্তু এ কথা সে কাউকে বলে না। কারণ তাদের দারোয়ান এবং ড্রাইভার আংকেল খুব ভালো। সিয়ামকে খুব আদর করে। স্কুল ব্যাগটাও ওর কাছে দেয় না, তারা নিজেরাই বয়ে আনে। আইসক্রিম কিনে দেয়। তারপরও সিয়ামের ভয় কাটে না।
সিয়াম ভাবে তার যদি একটা বড় ভাই থাকতো, কতই না ভালো হতো। ওর অনেক বন্ধুরই আছে। যাদের ভাই নেই তাদের দাদা, দাদী, নানা-নানী, চাচা নয় তো মামা আছে। এক সাথে এক বাসায় থাকেন। বাবা-মা ব্যস্ত থাকলে তারা যান স্কুলে। কিন্তু সিয়ামের দাদা-দাদী নেই। নানা-নানী থাকেন গ্রামে। চাচার বাসা উত্তরা আর ওরা থাকে মালিবাগ। চাচাতা ভাইও আছে। সে সিয়ামের চেয়ে অনেক বড়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। সিয়ামের চাচাতো ভাইয়ের নাম সাজিদ। ভাইয়া খুব ভালো সিয়ামকে খুব আদর করে। ওদের বাসায় আসার সময় ওর প্রিয় চকোলেট নিয়ে আসে। ঘুরতে বের হয়। ভাইয়ার সাথে ঘুরতে ওর খুব ভালো লাগে। একটুও ভয় করে না। সিয়াম মনে মনে ভাবে ভাইয়া উত্তরা থেকে একাই ওদের বাসায় আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়। আরো কত বন্ধুদের বাসায় যায়। কেউ কিচ্ছু বলে না, কত মজা। এই ভাবনা ভাবতে ভাবতে সিয়ামের মুখে হাসি ফুটে।
সে ফিক করে হেসে নিজে নিজেই বলে: ‘আমি কত বোকা! সাজিদ ভাইয়া কত্ত বড়, সে কখনো হারিয়ে যাবে না, তাই সে একা একা বের হলে তাকে কেউ কিচ্ছু বলে না। আমি তো ছোট হারিয়ে যাবো, নয় তো দুষ্ট ছেলেধরারা ধরে নিয়ে যাবে।’
ছেলেধরার কথা মনে পড়তেই ওর হাসি মিলিয়ে যায়। ছেলেধরাদের সিয়াম খুব ভয় পায়। সে ওর বন্ধু তমালের কাছে শুনেছে, ছেলেধরারা ছোট বাচ্চাদের ধরে নিয়ে পঙ্গু নয় তো অন্ধ করে ভিক্ষুক বানায়, আফিম খাওয়ায়ে স্মৃতিশক্তি ভুলিয়ে ভিক্ষুকের সহকারী বানায়। আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো ওরা নাকি বিদেশে পাচার করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও বিক্রি করে। আরো কত কী? সিয়াম আর ভাবতে পারে না। সে নিজেকে স্বাভাবিক করতে আবার সাজিদ ভাইয়ার কথা ভাবতে থাকে। সাজিদ ভাইকে তার হিরো মনে মনে হয়।
আজ শুক্রবার। সবার ঘুম ভাঙে একটু দেরিতে। অবশ্য সিয়াম সকাল বেলার পাখি। আজানের সুমধুর সুরে তার ঘুম ভাঙে। তার খুব ইচ্ছে করে ভোরের আকাশ দেখতে। ভোরের আজানের পর মসজিদে নামাজ পড়ে হাঁটতে হাঁটতে পার্কে গিয়ে ভোরের পাখির গান শুনতে। কিন্তু কে তাকে নিয়ে যাবে? বাবা অনেক রাতে অফিস থেকে ফিরেন, মা বাবার জন্য জেগে থাকেন। সিয়ামকে রাত ১১টার মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে দেন। তারপর বাবা-মা কত রাতে ঘুমান তা সে বুঝতেই পারে না। সকালে যখন সিয়ামের ঘুম ভাঙে বাবা-মা তখন নাক ডেকে ঘুমান। অন্য দিন ভোরে উঠলেও শুক্রবারে বাবা ওঠেন জুমার নামাজের আজানের কয়েক ঘণ্টা আগে। ব্যস্ত হয়ে পড়েন জুমার নামাজের প্রস্তুতি নিতে। মাঝে মাঝে সিয়ামকে সাথে নিয়ে যান। ওর মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়তে খুব ভালো লাগে। ইমাম সাহেব সুন্দর সুন্দর কথা বলেন। ইমাম সাহেবের কাছ থেকেই সিয়াম জেনেছে জুমার নামাজই শুধু নামাজ না, প্রত্যেক দিন মসজিদে পাঁচবার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আজান হয়। প্রত্যেক মুসলমানকে সময় মতো পাঁচবার নামাজ পড়তে হয়। অবশ্যই পড়তে হবে, না পড়লে মানুষ শয়তানের কথা শুনে পাপী হয়। তার মনে প্রশ্ন জাগে তাহলে বাবা কেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন না? জুমার নামাজ, ঈদের নামাজের জন্য বাবা যেমন ব্যস্ত হয়ে পড়েন, অন্য সময় কেন হন না। বাবাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু পারে না। যদি বাবা রাগ করেন। মায়ের কাছে একবার সাহস করে সিয়াম জানতে চেয়েছিল। তিনি বলেছেন, ‘তুমি এসব বুঝবে না। বড় হও একাই সব জানতে পারবে।’ সিয়াম ভাবে বিষয়টি কি এতই সহজ যে, একাই আমি জানতে পারবো। হয়তো বা সহজ, না হলে মা কেন এমন কথা বলবেন।
আজ সিয়ামের ঘুম ভেঙেছে অনেক আগেই। সে এপাশ ওপাশ করছে। কিন্তু মা-বাবা দুইজনই নাক ডাকছেন। তাই সে উঠতে পারছে না।
কিং কিং কিং। কলিং বেল বাজছে। বেলের শব্দে প্রথমে সিয়ামের বাবার ঘুম ভাঙে। তিনি সিয়ামের মাকে বলেন: ‘এত সকালে কে এলো, দেখতো?’ ওর মা দরজার খুলে অবাক। সিয়ামের চাচা-চাচী এসেছেন। চাচা-চাচীর কথা শুনে সিয়ামের আর বিছানায় থাকতে ইচ্ছে করে না। দ্রুত ওঠে পড়ে। কিন্তু অন্য দিনের মতো চাচা-চাচীর হাসি মুখে ওকে জড়িয়ে ধরেন না। তাদের মন খারাপ। তারা তার বাবার না ধরে ডাকছে: ‘রেজা, রেজা।’ সিয়াম জানে তার বাবার নাম সেলিম রেজা। চাচা-চাচী, দাদা-দাদীরা তাকে রেজা বলে ডাকেন।
সেলিম সাহেব দ্রুত ওঠে ভাই-ভাবীকে সালাম দিয়ে জানতে চান: ‘কী ব্যাপার ভাইয়া। তোমাদের মন খারাপ মনে হচ্ছে? কী ব্যাপার কী হয়েছে? এতো সকালে…’ কথা শেষ হওয়ার আগেই সিয়ামের চাচী কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘ভাই আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমাদের ছেলেটা এভাবে হারিয়ে যাবে, আমরা ভাবতেও পারিনি।’ সাজিদের বকে যাওয়ার কথা সেলিম সাহেব আগেই কিছুটা এর ওর মুখ থেকে শুনেছেন, তাই অবাক হলেন না।
ভাই-ভাবীকে সান্ত¡না দিয়ে বললেন, ‘এত ভেঙে পড়বেন না। এখন সব কিছুরই চিকিৎসা আছে।’
: তুমি তো এখন বলছো, সব কিছুরই চিকিৎসা আছে। আমাদের একমাত্র ছেলে। কত মেধাবী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। তার এমন অবস্থা হবে আমরা কখনো ভাবিনি। তাহলে এভাবে হারিয়ে যেতে দিতাম না।’ সিয়াম তাদের কথার আগা-মাথা কিছু বুঝতে পারছে না। সাজিদ ভাই কি করে হারিয়ে যাবে, এই ঢাকা শহর শুধু না গোটা বাংলাদেশটা তার চেনা। সে এতটাই মেধাবী যে বিশ্বভ্রমণে বের হলেও হারানোর কথা নয়, তাহলে আসলে হয়েছেটা কী? আবার বাবা বলছেন, সব কিছুরই চিকিৎসা আছে। কারো অসুখ হলে না, চিকিৎসা করতে হয়। হারিয়ে গেলে আবার চিকিৎসা কী? সিয়ামের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। সে কাঁদো কাঁদো গলায় জানতে চায়: ‘সাজিদ ভাইয়ার কি হয়েছে, সে কোথায় হারিয়ে গেছে।’
সিয়ামের মা ওকে ডেকে দূরে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু ওর চাচা বাধা দেন।
তিনি বলেন, ‘ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?’
ওর মা বলেন, ‘ভাইয়া, সিয়াম বাচ্চা মানুষ ওসব বুঝবে না, বড় হলে একাই জানতে পারবে।’
সিয়ামের চাচা বলেন, ‘ওকে আমরা হারিয়ে যেতে দিতে চাই না। তাই যতটুকু বুঝে এখনই বুঝাতে হবে।’ তারপরও সিয়ামকে কাছে টেনে নিয়ে বলেন, ‘বাবা তোমার ভাইয়া হারিয়ে যাইনি। যে খারাপ ছেলেদের সাথে মিশে নষ্ট হয়ে গেছে। মদ, হেরোইন, গাঁজার নাম জানো।’
সিয়াম বলে, ‘টিভির খবরে দেখেছি। এগুলো খারাপ। যারা এসব খায় বিক্রি করে পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে যায়।’
চাচা বলেন, ‘ঠিক বলছো, বাবা। তোমার সাজিদ ভাইয়া দুষ্ট ছেলের সাথে মিশে এই সব …’
সেলিম সাহেব বাধা দেন, ‘আর বলতে হবে না ভাইয়া।’
সিয়াম বিজ্ঞের মতো বলে, ‘হ্যাঁ চাচ্চু। আর বলতে হবে না। আমি গত শুক্রবার মসজিদে গিয়েছিলাম। নামাজের আগে ইমাম সাহেব বলেছেন, ‘ওসব খাওয়া হারাম, পাপ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ না পড়াও পাপ। আমার বন্ধুরা স্কুল শেষে মসজিদে গিয়ে কোরআন পড়া শিখছে, নামাজ শিখছে। আমাকে তো তোমরা পাঠাও না। সাজিদ ভাইয়াকেও পাঠাওনি। তোমরাও শুধু জুমা আর ঈদের নামাজ পড়ো। তোমরাও আবার হারিয়ে যাবে না তো?’
সিয়ামের কথা শুনে সবার চোখ অশ্রুসিক্ত ওঠে। সিয়ামের বাবা বলেন, ‘না, বাবা। আমরা হারিয়ে যাবো না। তোমাকেও হারিয়ে যেতে দিবো না। আজ থেকেই তুমি মসজিদে গিয়ে কোরআন পড়া এবং নামাজ শিখবে। আমরাও ইসলামের সব বিধান মেনে চলার চেষ্টা করব।

Share.

মন্তব্য করুন