ছোট্ট সোনা খুকু মানহা। তার বয়স এখন প্রায় তিন বছর। সে দাদুর চোখের মণি। দাদুকে ছাড়া মানহা একদম থাকতে পারে না। দাদুও তাই। দাদু মানহাকে অনেক আদর করেন। মানহার সাথে খেলা করেন। এক বছর বয়স থেকেই দাদু মানহার জন্য বই কেনা শুরু করেন। মানহার এখন অনেক বই। মানহা বই পড়তে খুব ভালোবাসে। মাত্র তিন বছর বয়সেই সে বইপোকা হয়ে উঠেছে। সকাল হতেই সে বই হাতে নিয়ে দাদুর কাছে চলে আসে। দাদুকে বলে,
– দাদু, এসো, লেখাপড়া করি। কোনও কারণে যদি দাদু তার দিকে একটু মনোযোগ দিতে দেরি করে তাহলে সে কান্নাকাটি শুরু করে। দাদুর কাছে মানহা আরবি বর্ণমালার ২৯টি হরফ শিখে ফেলেছে। প্রতিদিন সকালে মানহা আগে দাদুর কাছে আরবি পড়ে। তারপর বই পড়ে। গল্প শোনে। ছবি আঁকে। ছড়া শেখে। গান শেখে। স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই মানহা দাদুর কাছে অনেক কিছু শিখে ফেলেছে।
দাদু মানহাকে খুব আদর করেন। আর মাত্র পনেরো দিন পর মানহার জন্মদিন। দাদু তাই মানহার জন্য কিনে আনেন জামা, জুতো, বেলুন, খেলনা, বই আর মজার মজার ক্যান্ডি। এত কিছু একসাথে পেয়ে মানহা তো মহাখুশি। কিন্তু এতখুশি যেন মানহার ভাগ্যে সইলো না। দাদু হঠাৎ করোনা আক্রান্ত হলেন। করোনা মানহার জন্মদিনের সব আয়োজন পণ্ড করে দিলো। করোনা হচ্ছে একটি মহামারীর নাম। এটি একটি ভয়ঙ্কর রোগ। এ রোগ হলে আর রক্ষে নেই। তাই করোনা রোগীর কাছে থেকে সব সময় শিশু ও বৃদ্ধদের দূরে রাখতে হয়। মানহাকে মা তাই আর দাদুর কাছে যেতে দেন না। মানহা তো অতশতো বুঝে না। সে দাদুর কাছে যেতে চায়। দাদুর রুমের দরোজা বন্ধ। মানহা সেই দরোজার বাইরে দাঁড়িয়ে শুধু দাদু, দাদু বলে ডাকে। ছোট ছোট হাত দিয়ে দরোজা ধাক্কায় আর কাঁদে। বলে,
– দাদু, দরোজা খোলো। আমাকে কোলে নাও। আসো খেলা করি। আমাকে লেখাপড়া দেবে? লেখাপড়া? মানহা এতো মিষ্টি করে বলে যে, কেউ মানহাকে তখন কোলে না নিয়ে পারবে না। কিন্তু দাদু তবু দরোজা খোলেন না। মানহাকে কোলে তুলে নেন না। বুকে পাথর বেঁধে ঘরের ভেতর বসে থাকেন। একা ঘরে চুপিসারে চোখ মুছেন। দাদুর কাছে যাওয়ার জন্য মানহার কান্নাকাটি বেড়ে যায়। করোনা যেন দাদুকে পাষাণ করে দিয়েছে। দাদুকে না পেয়ে মানহা মায়ের কোলে থাকতে চায়। মাকে কাজ করতে দেয় না। বিরক্ত করে। সংসারের কাজে ব্যস্ত মা মানহাকে সময় দিতে পারে না। মানহাকে দেখাশোনার কেউ নেই। মানহা একা একা খেলতে গিয়ে শুধু পড়ে পড়ে ব্যথা পায়। দাদুর করোনা হওয়ায় মানহার জীবনে নেমে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ।
একদিন মা রান্নাঘরে রান্না করছিলেন। মানহা তখন ড্রইং রুমে একা একা খেলছিল। একটি প্লাস্টিকের কাপড়ের ক্লিপ পেয়ে মানহা ওটা নিয়ে খেলা করছিল। খেলতে খেলতে কাপড়ের ক্লিপটি নিজের ঠোঁটের মধ্যে চেপে ধরে। আর অমনি ওর মনে হয় যেন ডাইনোসারের দাঁত ওর ঠোঁট দুটো কামড়ে ধরেছে। মানহা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। চিৎকার শুনেও মা হাতের কাজ ফেলে আসতে পারে না। মায়ের আসতে একটু দেরি হয়ে যায়। মা এসে দেখেন মানহার ঠোঁট বেয়ে রক্ত পড়ছে। মা তাড়াতাড়ি ডেটল আর তুলা দিয়ে রক্ত মুছে ক্রিম লাগিয়ে দেন। তারপর সেই দিনই মা মানহাকে নানু বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
দুপুরে খালা এসে মানহাকে নানুর বাড়িতে নিয়ে যায়। আর কয়েকদিন পর মানহার জন্মদিন। মা তাই জন্মদিনের জামা, জুতো, খেলনাও সাথে দিয়ে দেন। করোনা এমন একটি অসুখ যে অসুখে শুধু বড়রাই কষ্ট পান না ছোটরাও অনেক কষ্ট পায়। বড়দের পাশাপাশি ছোটদেরও অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। মানহাকে তাই নিজের ঘর ছাড়তে হয়। মাকে ছাড়তে হয়। দাদুকে ছাড়তে হয়। নানুর বাড়িতে সবাই মানহাকে অনেক আদর করে। তবু ওখানে মানহার ভালো লাগে না। মানহা শুধু বলে, দাদু যাবো, দাদু যাবো। রাতে মানহা খালার সাথে ঘুমাতে গেলে মানহার তখন মায়ের কথা মনে পড়ে। মাম্মি যাবো মাম্মি যাবো বলে কাঁদে। খালা তখন বলে, এই যে আমি তোমার মাম্মি। মানহা তখন রেগে বলে, না, আমি এই মাম্মি চাই না। আমি টুম্পা মাম্মি চাই। মানহার মায়ের নাম টুম্পা। রাতে শোয়ার সময় মাকে তার খুব মনে পড়ে।
নানুর বাড়িতে নানা, নানু, খালার সাথে মানহা জন্মদিনের কেক কাটে। প্রতিবেশী অনেক শিশুও মানহার জন্মদিনে অংশ নেয়। আনন্দ করে। হাত তালি দেয়। গান গায়। বেলুন ফুটায়। কিন্তু মানহাকে কিছুতেই খুশি করতে পারে না। সবাই অনেক আনন্দ করে। কিন্তু মানহার মনে আনন্দ নেই। মানহার মুখটা কেমন যেন মলিন ফ্যাকাশে দেখায়। কেক কাটার সময় দাদু মানহাকে ভিডিও কল দেন। মানহা মানহা বলে ডাকেন। কিন্তু মানহা ফিরেও তাকায় না। ওর নিষ্পাপ মুখটা যেন কালো মেঘে ছেয়ে আছে। চোখ দুটো জলে টলমল করে। মানহার এ অবস্থা দেখে দাদু সহ্য করতে পারেন না। কোনো কথা না বলেই ফোনটা রেখে দেন। ফোন রেখে দাদু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদেন। অনেকক্ষণ কাঁদেন। কেঁদে কেঁদে বুকটা হালকা করেন। করোনা এমন একটা সাংঘাতিক অসুখ, যা কাছের মানুষকে দূরে সরিয়ে দেয়। ইচ্ছে হলেই দাদু মানহাকে আদর করতে পারবেন না। জড়িয়ে ধরতে পারবেন না। এটা যে কতটা কষ্টের তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। দাদু কাঁদেন আর ভাবেন, তার জন্যই তো মানহার আজ এত কষ্ট। এই অসুখটা যদি তার না হতো তবে তো মানহা সোনাকে আর মা ছাড়া বাড়ি ছাড়া হতে হতো না। দাদুর মনে এজন্য একটা অপরাধবোধ কাজ করে। এই অপরাধ থেকে মুক্তি পেতে দাদু একটু সুস্থ হতেই নিজে গিয়ে মানহাকে বাসায় নিয়ে আসেন।
বাসার সামনে গাড়িটা থামতেই মানহা দেখে, গেটের সামনে মা দাঁড়িয়ে আছে। মানহা গাড়ির জানালা দিয়ে মাকে বলে, হ্যালো মাম্মি, হাউ আর ইউ? মা গাড়ির দরোজা খুলে মানহাকে কোলে নেন। বুকে জড়িয়ে ধরেন। মানহাও খুশিতে মাকে জড়িয়ে ধরে। মা আর মেয়ের সে যে কী আনন্দ তা আর বলতে। একটি তাজা মাছ ডাঙায় তুলে রাখলে যে অবস্থা হয়, মানহার অবস্থাও হয়েছিল সেরূপ। তারপর মাছটিকে যখন পানিতে ছেড়ে দেয়া হয় তখন মাছটি যেমন খলবলিয়ে ওঠে তেমনি মাকে পেয়ে খুশিতে খলবলিয়ে ওঠে মানহাও।

Share.

মন্তব্য করুন