প্রকৃত মনের মননের কবি তিনি। স্বচ্ছ ও পবিত্র হৃদয়ের মানুষ। একইসাথে তিনি আমাদের জাতীয় কবি বিদ্রোহী কবি। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। উন্নত ও শ্রেষ্ঠ আদর্শ হৃদয়ে ধারণ করতেন কবি। এ কারণে শ্রেষ্ঠ ঈদের গান তার দ্বারাই রচনা করা সম্ভব হয়েছে।
বিশেষ করে তার সেই বিখ্যাত সঙ্গীত- ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশীর ঈদ’। এটা ছাড়া যেন ঈদ-আনন্দ পূর্ণতাই পায় না! এই শ্রেষ্ঠ গানটির জন্যই তাকে অনেক ঈদের গান লিখতে হয়েছে।
ঈদের কালজয়ী ওই গানটিতে আনন্দ-উচ্ছ্বাস উদ্বেলিত হয়। সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের মহত্ত্ব ফুটে ওঠে। ইসলামের মর্মার্থের প্রয়োজনীয়তা প্রকাশ হয়। বিকশিত হয় ঈদের তাৎপর্য। প্রস্ফুটিত হয় আনন্দ নামের সুবাসিত ফুলগুলো। ইসলামে মানব প্রেমের গুরুত্ব যে অপরিসীম, ওই বিষয়টিও দ্ব্যর্থহীনভাবে উচ্চারিত হয় ওই গানে। একটি জায়গায় নজরুল বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন এভাবে-
‘আজ ভুলে গিয়ে দোস্ত-দুশমন, হাত মেলাও হাতে
তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ’

অর্থাৎ ঈদের এই সানন্দ আনন্দক্ষণে সব শত্রুতা ভুলে যাও। সুখ বিতরণের মধ্য দিয়ে গোটা বিশ্বকে ইসলামের মুরিদ বানানোর পরামর্শও যেন দিয়েছেন কবি। ইসলামে উঁচু-নিচু-ধনী-গরিবে ভেদাভেদ নেই। আছে সাম্য-ভ্রাতৃত্ব এবং সামাজিক ন্যায়বিচার। সর্বোপরি শান্তিময় প্রেমের অমিয় বাণী উচ্চারিত হয়েছে। যেমন-
‘যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী
সেই গরিব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ
তোরে মারল ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট-পাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোল রে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ’।

নজরুল ‘ঈদ’ নাটিকায়ও তিনটি গান লিখেছেন। প্রথম গানে বলেছেন-
‘বিদায়-বেলায় সালাম লহ মাহে রমজানে রোজা
তোমার ফজিলতে হালকা হলো গুনাহের বোঝা
ক্ষুধার বদলে বেহেশতি ঈদের সুধা তুমি দিলে
খোদার সাধনার দুঃখে কি সুখ তুমি শিখাইলে
তুমি ইশরাতে খোদায় পাওয়ার পথ দেখালে সোজা।’

মানবতার এই কবি তার গানে অনুষ্ঠান সর্বস্বতার চেয়ে ঈদের মর্মার্থ ও গভীরতার দিকে বেশি দৃষ্টিপাত করেছেন। ‘ঈদ’ নাটিকার দ্বিতীয় গানে প্রায় শত বছর আগে নজরুল যে গভীরতর ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন, তা আজও যেন প্রাসঙ্গিক। কেননা এই বছর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ইত্যাদির কারণে অনেকেই ঈদের নতুন বসন-ভূষণ কিনতে পারবে না। এই দিকে খেয়াল রেখেই যেন কবি বলেছেন-
‘নাই হলো মা বসন ভূষণ এই ঈদে আমার
আছে আল্লা আমার মাথার মুকুট, রসুল গলার হার
নামাজ রোজার ওড়না শাড়ি
ওতেই আমায় মানায় ভারি
কলমা আমার কপালের টিপ
নাই তুলনা তার।’

এই নাটিকার তৃতীয় গানে ঈদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস ফুটে উঠেছে। এই উচ্ছ্বাস একটু একটু করে নয়, বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো! যেমন-
‘এলো ঈদুল-ফেতর এলো ঈদ ঈদ ঈদ
সারা বছর যে ঈদের আশায় ছিল না ক’ নিঁদ
দেখ হযরতের হাসির ছটা ঈদের চাঁদে জাগে
সেই চাঁদেরই রঙ যেন আজ সবার বুকে লাগে
এই দুনিয়াতেই মিটলো ঈদে বেহেশতি উমিদ।’

কতো বড় কবি হলে এই গানে এমন করে লেখতে পারেন! নবীর হাসিটাও এনেছেন ঈদের চাঁদে আর আনন্দকে বানিয়েছেন বেহেশত।

ঈদের অন্য একটি গানে হৃদয়-উপচানো আনন্দের বন্যা তুলে ধরেছেন নজরুল। তিনি বলেছেন-
‘ঈদের খুশির তুফানে আজ ডাকল কোটাল বান
এই তুফানে ডুবুডুবু জমিন ও আসমান
ঈদের চাঁদের পানসি ছেড়ে বেহেশ্ত হতে
কে পাঠাল এত খুশি দুখের জগতে
শোন ঈদগাহ্ হতে ভেসে আসে তাহারি আজান।’

এ ছাড়া নজরুলের আরও কয়েকটি ঈদের গান রয়েছে। এতো দুঃখের পৃথিবীতে সুখ আছে তাও তিনি দেখেছেন দেখিয়েছেন। লেখেছেন গেয়েছেন সুগভীর দৃষ্টিতে! যেমন-
‘ফিরদৌসের শিরনি এলো ঈদের চাঁদের তশতরিতে
লুট করে নে বনি আদম ফেরেশতা আর হুরপরীতে।’

কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদকে তুলে ধরেছেন বর্ণাঢ্য আঙ্গিকে। ঈদের গানে সকল মানুষের মঙ্গলের উৎসবে পরিণত করেছেন। শুধু কি আনন্দ উচ্ছ্বাস বা সাম্য ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা! ত্যাগেরও কথা অসংখ্যবার বলেছেন নজরুল। কেননা, ঈদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ত্যাগের মহিমাও। আর এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন তার ঈদ মুবারক কবিতার শেষাংশে এভাবে-
পথে পথে আজ হাঁকিব, বন্ধু, ঈদ-মোবারক! আসসালাম!
ঠোঁটে ঠোঁটে আজ বিলাব শিরনী ফুল-কালাম!
বিলিয়ে দেওয়ার আজিকে ঈদ।
আমার দানের অনুরাগে-রাঙা ঈদগা’ রে!
সকলের হাতে দিয়ে দিয়ে আজ আপনারে
দেহ নয়, দিল হবে শহীদ।

আনন্দ, উচ্ছ্বাস, ত্যাগ, মহিমা এবং ঈমানী চেতনা সবই তার গানে পাওয়া গেল। কিন্তু দুখীদের দুঃখের কথা- সেটা কি এই কবির হাত থেকে খসে যাবে! তা কখনোই হতে পারে না। কৃষকের দুঃখ-যন্ত্রণা দেখে নজরুলের হৃদয়েও দাগ কেটেছে। তাই তিনি লেখলেন কৃষকের কথা।

আসলে দেশ, জাতি, মাটি ও মানুষের জন্য কিংবা ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য নজরুল শুধু গানেই সীমাবদ্ধ থাকেননি! এই প্রয়োজনে কবিতাও লেখেছেন। ফলে নজরুলের ‘কৃষকের চাঁদ’ কবিতাটিও বাংলা সাহিত্যে ঈদের অন্যতম চিরস্মরণীয় কবিতা। যেমন-
‘বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিমে আসমানে,
লুকাইয়া আছ লজ্জায় কোন মরুর গোরস্তানে!
হেরো ঈদ্গাহে চলিছে কৃষক যেন প্রেত-কঙ্কাল
কশাইখানায় যাইতে দেখেছ শীর্ণ গোরুর পাল?
রোজা এফতার করেছে কৃষক অশ্রু-সলিলে হায়,
বেলাল! তোমার কণ্ঠে বুঝি গো আজান থামিয়া যায়!
থালা ঘটি বাটি বাধা দিয়ে হেরো চলিয়াছে ঈদ্গাহে,
তির-খাওয়া বুক, ঋণে-বাঁধা-শির, লুটাতে খোদার রাহে।

জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’

নজরুলের সময়ে মূর্খতার প্রভাব ছিল বেশি। সেই সময়ে কলম ধরার তেমন সাহস ছিল না অনেকেরই। আর ইসলামের পক্ষে! সে তো আরো জটিল। তখন শাসক-শোষকের রক্তচক্ষুও নজরুলকে থামাতে পারেনি। দ্বীন-ধর্মের সঠিক বুঝ আর সৎ সাহস ছিল বলেই তার হাতে ইসলামের আদর্শ বিকশিত হয়েছে। হয়েছে ঈদের শ্রেষ্ঠ গান আর কবিতাও!

Share.

মন্তব্য করুন