গুলশান লেকের পশ্চিম পাশ ধরে বৈকালীন পরিবেশে হাঁটছে সুহা সাথে তার নানা। নানা দুই দিন আগে গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছেন। নানা বছরে দু’তিন১২৪০বার সুহাদের বাসায় বেড়াতে আসেন। তিন দিন পার হলেই যাই যাই করে ফিরে যান। নানান রকম অজুহাত নানার। শহরের রাস্তার দু’পাশে ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়ানো দালানগুলো যেন তার মহাশত্রু। নানা বলেন, ‘দম বন্ধ হয়ে আসে, আকাশ দেখা যায় না, বাতাস জমাট বেঁধে বিষাক্ত হয়ে থাকে।’ খোলামেলা গ্রামের বাড়িতেই নাকি তার শান্তি, ঘরের বের হলেই গাছের সবুজের ফাঁকে ফাঁকে ধানক্ষেত, সবজি ক্ষেত; এ বাড়ি ও বাড়ি দেখা যায়। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বলেন, ‘আল্লাহ-এ আকাশ, এ বাতাস, এ প্রকৃতি, সবই তোমার দান।’
সুহার আম্মু সব বুঝতে পেরে বললেন, ‘যাওতো সুহা তোমার নানাকে নিয়ে লেকপাড় ঘুরে আস। আমি পিঠা তৈরি করছি- এসে দু’জনে খাবে।’
‘কী পিঠা বানাবে আম্মু’?
‘এখন বলবো না, তবে তোমার নানার পছন্দের পিঠাই বানাবো।’
ঠিক আছে দেখবো আজ নানার পছন্দের পিঠা কোন্টি! আমিও মজা করে খাবো।’
বাসা থেকে বের হতেই নানা বললেন, ‘দেখ, দেখ, সারা রাস্তায় বিদ্যুৎ টেলিফোনের খাম্বায় কেমন করে তার আর তার প্যাঁচানো। কোথাও পেঁচিয়ে রেখেছে, কোথাও ছিঁড়ে পড়ে আছে তারের মাথাগুলো, কোথাও দেখ কেমন ফাঁসের মতো গোল হয়ে মাথার কাছে ঝুলছে। যেন ফাঁদ পেতে রেখেছে মানুষ ধরার জন্য।’
সুহা বলে, ‘তাইতো বাবা সাবধান করে দিয়েছেন এসব ছেঁড়া তার এড়িয়ে যেতে। কোন্টা ইন্টারনেট, কোন্টা ডিস, কোন্টা টেলিফোন! কারেন্টের ছেঁড়া তারও থাকতে পারে।’
সুহা হাসতে হাসতে বলে, ‘খাম্বাগুলো যেন একেকটা কার্টুনের জটাবুড়ি। মাথার জটাচুল দিয়ে পুরো শহরটা যেন পেঁচিয়ে ধরেছে।’ নানা তার মাত্র চারটে দাঁত বের করে হেসে বলেন, ‘ঠিকই বলেছ সুহা, একদিন এর জটাজালে তোমরাও আটকে যাবে, তারচেয়ে চলো নানাবাড়ি, কোনো জাল-জটা নেই। খোলামেলা আকাশ, শান্ত প্রকৃতি। নিজের শ্বাসের ধ্বনিও শুনতে পাবে।’
‘যেতে তো চাই, এখনতো আমাদের স্কুল ছুটি। আব্বুকে বলবো, অফিস থেকে লম্বা করে ছুটি নিতে’।
তোমাদের রাস্তাগুলোও কেমন। দেখ ভ্যান, রিকশা, মোটরসাইকেল গাড়িগুলো ফ্যাত ফ্যাত… সুহা কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে বলে, ‘কী বললে? আমাদের রাস্তা? রাস্তা আমাদের হবে কেন? রাস্তাতো…’
‘বুঝেছি, বলবে রাস্তা সরকারের। আমরা গ্রামের মানুষতো, গ্রামের সব রাস্তাকে নিজের মনে করি, ভালো লাগে- ভালোবাসি, আপন ভেবে বলি আমাদের রাস্তা, হি হি হি, নানার হাসি। লেকের পাড়ে এসে নানা-নাতিন খুব খুশি। লেকের পশ্চিমপাশ থেকে আকাশ দেখা যায়। টলমলে লেকের জল বাতাসে থির থির কাঁপছে। নানা আকাশে তাকিয়ে বলেন, ‘দেখ দেখ এক ঝাঁক বক কেমন করে উড়ে যাচ্ছে। ঐ দেখ আরেক ঝাঁক হাঁস, কেমন যেন একটা বাঁকানো ধনুক রেখা ওদের ওড়ার ছন্দে।’
‘তীরের ফলাও বলতে পার। কি সুন্দর ছন্দময় গতি যেন নীল আকাশের চলমান অলঙ্কার-’
‘সত্যিইতো নানু, আসলে কখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি না। দেখবো কোথায়! আকাশওতো ‘আমাদের না’ ওর কণ্ঠে অভিমান।
‘আকাশে, যে হাঁস উড়তে পারে কোনোদিন শুনিনি, তাই তো ওরা যে অতিথি পাখি। হাজার মাইল দূর থেকে উড়ে এসেছে, বইয়ে পড়েছি। ওরা আরেকটু এগিয়ে যায়। দাদু লেকের পাড়ে সাজনা গাছটার পেছনে থমকে যায়। ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে আস্তে করে বলেন, ‘সুহা চুপ, দেখ ঐ দিকে দেখ’
‘কী দেখেছো নানা, আমিতো কিছুই দেখছি না। কি দেখাবে তাইতো বল-’
‘একটা কানি বক।’
‘সেটা আবার কী’
‘ঐ যে লেকের পাড়ে খয়েরি ধরনের একগুচ্ছ পানা ভাসছে, তার ওপর দেখ কানি বকটা কেমন ঘাপটি মেরে আছে পুঁটি মাছের আশায়-’
‘কানি বকের ছাও…;’ হেসে ওঠে সুহা। নানা ‘চুপ’ বলে থামিয়ে দেন। ‘কথা বললে উড়ে যাবে। তুমি দেখছ?’
‘না দেখি নাইতো। হ্যাঁ হ্যাঁ এবার দেখেছি।’
‘এবার খেয়াল কর, ভাসমান পানার খয়েরি রঙের সাথে বকের গায়ের রং কেমন মিশে আছে। দুটোর রঙই এক রকম। আবার দেখ, ভালো করে তাকাও বকটার এক হাত সামনে একটা মেনি মাছ পানিতে ডুবে আছে। নট নড়ন চড়ন-
‘মেনি মাছ কি নানা?’
‘পরে বলবো, আগে দেখে যাও। একটা গাছের ডাল পড়ে আছে পানিতে দেখেছ?’
দেখেছি নানা ঐ যে ঐটাতো? কিন্তু মেনি মাছ কোথায়?
‘ডালটার নিচে দুটো পচা আম পাতা পানিতে ডুবে আছে।’
পাতা দুটো পচে কালচে হয়ে আছে
হ্যাঁ হ্যাঁ দেখেছি কিন্তু মেনি মাছ কোথায়?’
এবার মজা করে দেখ, দেখতো দুটোই পচা আমপাতা মনে হয়, আসলে একটা আমপাতা আরেকটি মেনি মাছ-
‘কি করে বুঝলে?’
লক্ষ্য করো ভালোভাবে। মাছটি পাতার মতোই স্থির কিন্তু তার লেজ হালকা নড়ছে। নড়ছে মানে তার দেহের স্থিরতা আর ভারসাম্য রক্ষা করছে।’
এবার কি বুঝলে?
‘বুঝলাম, পাতার রঙের সাথে মিশে মাছটি, শিকারির দৃষ্টির আড়ালে থাকছে, ঐদিকে আবার কানা বগী, সরি বকটি পানার রঙের সাথে মিশে শিকারকে ধোঁকা দিচ্ছে।’
‘ধোঁকা নয় সুহামণি, এটা তার আহার সংগ্রহের কৌশল। প্রকৃতির দিকে ভালো করে তাকালে সৃষ্টির রহস্য এমনিভাবে জানতে পারবে। প্রতিটি প্রাণের মধ্যেই রহস্য রয়েছে নিজেকে বাঁচানোর জন্য, আবার খাবার সংগ্রহের জন্য।’
‘সত্যি দাদু, বকটার কি শিকারি বুদ্ধি, এদিকে মাছের, প্রাণ বাঁচানোর কৌশল ভাবতেই আশ্চর্য লাগে। আমিতো এতোসব ভাবিনি কখনো।’
‘আসলে সৃষ্টিকর্তার রহস্য জানার চেষ্টা করলে অনেক কিছু জানতে পারবে। এবার ফিরে যাওয়া যাক, তোমার মায়ের পানপিঠা এরই মধ্যে নিশ্চয় তৈরি হয়ে গেছে।’ নানা ঘরে ঢুকেই বলেন, ‘শাহান কোথায়? ওকে তো দেখছি না-’ সুহার আম্মু বলেন, ‘বাবা ওতো ঘুমিয়ে, উঠে যাবে এখুনি আপনি পিঠা খান। পানপিঠা আপনার পছন্দের। সুহাতো একটু অভিমানি স্বরে বলে, ‘আমিওতো পছন্দ করি।’
‘বেশতো খাও’ বলে সুহার আম্মু এক কাপ চা এনে বাবার হাতে দিয়ে মিটি মিটি হাসে। শাড়ির আঁচলটা কাঁধে টেনে বলে, ‘সুহা তুমি শুনো না আমরা বাপ-বেটি এখন কথা বলবো। সুহার নানা চায়ের কাপ ঠোঁটে তুলে নামিয়ে নেন। সুহা মন খারাপ করে উঠে যায়। সুহার আম্মু হেসে ওঠে বলেন, ‘হয়েছে মামণি যেতে হবে না। তোমার আব্বু রাজি হয়েছেন, এক সপ্তাহ পরেই আমরা তোমার নানা বাড়ি আর আমার বাবার বাড়ি যাব।’
সুহা, ‘হুররে’ বলে মাকে জড়িয়ে ধরে একদম কোলে বসে যায়। যেমনটি ছোট্টকালের সুহাটি। সুহার নানা হাসতে হাসতে বলেন, ‘তা হলে এত দিনে তোমরা রাজি হলে? আমি কালই ফিরে যাব। দেশে তোমাদের জন্য এটা-সেটা ব্যবস্থা করতে হবে না? আরেকটি কথা, ইজানের আব্বুকে রাজি করিয়ে এক সাথে চলে এসো। খুব মজার সময় কাটবে আমাদের।’
সুহা যেন হাওয়াই মিষ্টি চটচট করে খেতে খেতে বলে, ‘খুব মজা হবে তাই না নানা।’

Share.

মন্তব্য করুন