ছোটনের আকাশ দেখার খুব শখ। আসলে ঠিক আকাশ নয়, সে দেখে আকাশের তারা। তারা নিয়ে অল্পস্বল্প লেখাপড়াও করেছে সে। কিন্তু তাতে তেমন কাজ হয়নি। সন্ধ্যার আকাশে কোনটা সন্ধ্যাতারা আর কোনটা ধ্রুবতারা, কোনটাইবা কালপুরুষ ঠিক ঠাহর করতে পারেনি সে। আসলে তারাগুলোর অবস্থান ঠিকমতো নির্ণয় করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সে জানে তারা ঠিকমতো চিনতে পারছে না। তারপরও কিন্তু তার আকাশ দেখার বিরাম নেই, বিরাম নেই তারা দেখার। বিকাল হলেই সে তারার বই হাতে ছুটে যায় ছাদে। বইয়ের সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করে কোথায় ফুটবে সন্ধ্যাতারা, অরুন্ধতি, স্বাতী, সপ্তর্ষিমণ্ডল। যদিও আকাশে তখন তারা থাকে না, তারপরও বইয়ের সাথে মিলিয়ে লোকেশনগুলো ঠিক রাখার চেষ্টা করে। কারণ একটু পরে আঁধার নেমে এলে বইয়ের কালো কালো অক্ষরগুলো সে আঁধারে ঢেকে যাবে। তা ভালোই জানে ছোটন তাইতো এতো তড়িঘড়ি।
কোন কোন দিন তারা দেখতে দেখতে বেশ রাত হয়ে যায়। তারা খোঁজার নেশায় বিভোর হয়ে যায় ছোটন। মা ডেকে ডেকে ক্লান্ত হন। একসময় নিজেই উঠে আসেন ছাদে। ছোটন নামতে চায় না। মা কখনও বকে ঝকে, কখনও আদর করে নামিয়ে নেন তাকে। আবার কোন কোন দিন তারা দেখতে দেখতে ছাদেই ঘুমিয়ে পড়ে ছোটন।
মায়ের তাই ছোটনকে নিয়ে বড় জ্বালা। তার এই ছেলেটা অন্য দশটা ছেলের মতো না। অতোটুকুন ছেলে তার মাথায় কি এক তারা দেখার বাতিক!
তা সেদিন, অনেক দিন পর ছোট চাচা এলেন বাড়িতে। বিয়ে থা করেননি। হৈ হৈ করে ঘুরে বেড়ান পৃথিবীব্যাপী। ছোটনরা তাকে ‘ছোটকা’ বলে ডাকে। বাড়িতে এসে বিকেলের চা খেতে খেতে লুচিতে একটা কামড় দিয়ে ছোটকা মার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সত্যি ভাবি, তোমার হাতের লুচির কোন তুলনা নেই। ডেলিশিয়াস! যেখানেই যাই সেখানেই তোমার লুচির প্রশংসা করি।’
ছোটনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তা ছোটনবাবু কেমন চলছে, সব কুশল তো?’
ছোটন লাজুক হাসল। ছোটকা এমনই। এমন করে কথা বলে, এমন করে প্রশ্ন করে- মনে হয় যেন ছোটন কত বড় একটা মানুষ।
মা বললেন, ‘ছোটন বাবু আছেন তার তারা দেখা নিয়ে। সন্ধ্যে হলো তো হাওয়া। না পড়ালেখা না খাওয়া দাওয়া। আমার হয়েছে যতো জ্বালা!’
‘ওহ, এখনও সেই তারা দেখা চলছে! বাহ বেশ! ওহ হ্যাঁ ভালো কথা, ঢাকাতে নাকি একটা নভোথিয়েটার হয়েছে। দারুণ নাকি বানিয়েছে? ভাবছি কাল সবাইকে নিয়ে যাবো। কি ছোটনবাবু যাবে তো? খুব মজা তাই না?’
‘আমি যাবো না।’
‘তা যাবে কেন। বলত এখন কোন খেলা দেখতে যাবার কথা, দৌড়ে চলে যেতে। বলছেন নভোথিয়েটারে যেতে। এতো ভালো একটা জিনিস দেখতে নিয়ে যেতে চাইছে তা যাবি না কেন? তারা তারা করিস ওটাতো তারারই ব্যাপার স্যাপার, তারারই রাজ্যপাট।’
মা বললেন। ছোটন বিস্মিত!
‘তাই নাকি! কিন্তু ওটাতো গোলাকৃতি একটা ঘর। ঘরের ভিতর আকাশই বা আসবে কী করে, তারাই বা দেখা যাবে কী করে?’
‘হে হে ভাস্তে ওখানেই তো মজা!’
‘তারা যদি হয় আমি যাবো।’
পরদিন ছোটকার সাথে নভোথিয়েটারের উদ্দেশ্যে রওনা হলো ছোটন। মাও আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ছোটকা বেশ কিছু খাবারের বায়না ধরলেন। নভোথিয়েটার দেখতে গেলে ছোটকার ওই পছন্দের খাবারগুলো বানানো হয় না। মা তাই বললেন, ‘আমি না হয় আজ নাই গেলাম। তোরা দেখে আয়। আমি পরে একসময় দেখে নেব খন।’
যেন ইচ্ছে করলেই মা কতো কিছু দেখে নেয় আর দেখে নিতে পারে। ছোটনের মনে মনে ছোটকার উপর বেশ রাগ হলো। কী হতো ওই খাবারগুলোর ফরমায়েশ না দিলে। তাহলে তো মা আসতে পারতো। পরমুহূর্তে ছোটকাকে মাফ করে দিল এই ভেবে যে, ভবঘুরে মানুষ কদিনইবা তাদের কাছে থাকে। অতো বুঝেশুনে হিসাব-নিকাশ কষে কাজ সে করতে পারে না। ছোটন ছোট, কিন্তু এটুকু সে বোঝে অন্য দশটা মানুষের মতো না তার ছোটকা।
নভোথিয়েটারের সামনে বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট কিনলো ছোটকা। তারপর লাইনের মানুষগুলো ধীরে ধীরে ভিতরে ঢুকল। ভিতরে অনেকটা খোলা জায়গা। সেখানে পৃথিবী বিখ্যাত জ্যোতির্বিদদের স্ট্যাচু। নিকোলাস কোপার্নিকাস আর জোহান কেপলার মূর্তিটা খুব বেশি টানলো ছোটনকে। অক্ষগোলক দেখে তো ছোটন রীতিমতো অবাক! পৃথিবী সূর্যের চারদিক ঘোরে আর পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে ঘোরে চাঁদ এ কথা ভূগোল বইতে পড়েছে ছোটন। কিন্তু বিশাল একটা যন্ত্র বসানো হয়েছে সেখানে। একটা সুইচ টেপামাত্র সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে লাগল পৃথিবী আর পৃথিবীকে চাঁদ। হাঁ হয়ে দেখল ছোটন। কী এক অপার আশ্চর্য বিস্ময়ের জগতে সে এসে পড়েছে। তারপর অনেক রকম টেলিস্কোপ দেখল ছোটন। তার বিস্ময় উত্তরোত্তর বাড়ছে। বাইরেই এতো কিছু নভোথিয়েটারের মধ্যে না জানি কী আছে। এক সময় বাইরের পর্ব শেষ হলো। ঘণ্টা বাজল। দু’চোখে অপার বিস্ময়ের অঞ্জন মেখে ছোটকার পেছন পেছন ছোটন ঢুকল নভোথিয়েটারে। ঢোকার সময় ছোটন ভাবছিল, বোধহয় কোন সিনেমা হলের মতো হবে। কিন্তু ঢুকে দেখল এই নভোথিয়েটারের সাথে সিনেমা হলের কোনোই মিল নেই। থিয়েটার হলটা অনেকটা গ্যালারির মতো। আর হলের সামনে পেছনে উপরে পুরোটা জুড়েই পর্দা। প্রথমে সে পর্দায় ফুটে উঠল হলের যন্ত্রপাতির ছবি। মাঝখানে রয়েছে একটা বিশাল লেজার। কোন যন্ত্রপাতি কী কাজ করে তাও ধারা বর্ণনায় এলো। এরপর ছোটনের মনে হলো, সে এক খোলা আকাশের নিচে বসে আছে। সে আকাশে মেঘের লেশমাত্র নেই। আকাশ জুড়ে অজস্র তারা। হাত বাড়ালেই যেন ধরা যাবে।
শুরু হলো মহাকাশের চিত্র। ছোটন অপার বিস্ময় নিয়ে দেখতে থাকল। তার ইচ্ছে হলো অনেক কিছু নোট করার। কিন্তু অন্ধকারে সেটা সম্ভব হলো না। তাই যতদূর সম্ভব মনোযোগ দিয়ে দেখতে চেষ্টা করল সে। আর চেষ্টা করল মনে গেঁথে নিতে। এক একটা তারার ছবি ভেসে আসে পর্দায় আর সাথে শুরু হয় তারার পরিচিতি। প্রত্যেকটা তারার পেছনে আছে কোন না কোন মিথ। তারাগুলোরও আছে নিজস্ব আকৃতি যাতে সহজেই অন্য তারা থেকে আলাদা করা যায়।
নভোথিয়েটারের শো শেষ হওয়ার পরও ছোটনের মনে খেলা করছিল দক্ষিণ আকাশের লুব্ধক যা সপ্তর্ষিমণ্ডলে সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। কিছুতেই সে ভুলতে পারছিল না উত্তর আকাশের ধ্রুবতারকে। ভুলতে পারছিল না দক্ষিণের কালপুরুষ বা অরিয়নকে- যার নিচে অনেকগুলো তারা নিয়ে কখনও কখনও একটা তরবারির মতো দেখায়। বিভিন্ন রাশিচক্রের অবস্থানও বারবার ভেসে উঠছিল ছোটনের মনের আকাশে। সিংহ রাশির অবস্থান উত্তর আকাশে যেটা সৃষ্টি হয়েছে একটা ত্রিভুজ আর একটা প্রশ্নবোধক দিয়ে। যার মধ্যে চারটি তারা উল্টো প্রশ্নবোধক আর তিনটা নিয়ে ত্রিভুজ। তারা ছাড়াও অন্য গ্যালাক্সি যেমন এ্যান্ড্রোমিডা ক্যাসিওপিয়ার কথাও ছোটনের মাথায় ঘুরপাক খায়। মাথায় অসংখ্য তারার অবস্থান নিয়ে ছোটকার সাথে বাড়িতে ফেরে ছোটন।
তখন দুপুর। খাওয়ার সময়। ছোটনের খাওয়ার কথা মনে পড়ে না। গোসল করতে ভুলে যায়। মা খেতে ডাকতে এসে অবাক হয়ে দেখেন, ছোটন একটা কাগজের উপর আকাশের ম্যাপ আঁকছে। মার ডাক ছোটনের কানে পৌঁছায় না। দু’তিনবার ডাকার পর ছোটনের সাড়া না পেয়ে মা ঝুঁকে পড়ে ছোটনের মানচিত্র আঁকা দেখতে থাকেন। মার মন ভালো লাগায় ছেয়ে যায়। তার এত্তোটুকু ছোটন আকাশের এমন নিখুঁত চিত্র ফুটিয়ে তুলেছে কাগজে! মার মনে হয় ছোটন যে তার কাছে মাঝে মাঝে টেলিস্কোপের বায়না ধরে আর তিনি ছোট বলে ছোটনকে কিনে দিতে চান না তা ঠিক না। ছোটনকে টেলিস্কোপ সত্যিই কিনে দেয়া যায়। এবার চাওয়ার আগেই টেলিস্কোপ কিনে দেবেন বলে মনস্থির করেন। মা ওকে বিরক্ত না করে চলে যান। ভাবেন, একদিন একটু দেরিতে খেলে এমন কী ক্ষতি।
ছোটন ছবি আঁকা শেষ করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হতাশ হয়। মাত্র তিনটে। এখনও যে সন্ধ্যে হতে অনেক দেরি। ছোটন যা দেখে এসেছে নভোথিয়েটারে আজ আকাশে সে তা চাক্ষুষ দেখতে চায়। তাই তো ছোটনের প্রতীক্ষা। ঘড়ির কাঁটা একটু একটু করে এগোয়। ছোটনের সহ্য হয় না। ওর ইচ্ছে হয় ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে দিয়ে সন্ধ্যে নামিয়ে ফেলতে। পাঁচটা বাজার পর আর ধৈর্য ধরতে পারে না ছোটন। সে ম্যাপ হাতে ছোটে ছাদে। রেলিংয়ে বসে ঊর্ধ্বশ্বাসে আকাশের দিকে তাকায়। এই তাকাতে তাকাতেই একসময় আকাশে ভেসে ওঠে তারার মেলা।

Share.

মন্তব্য করুন