ফেলে আসা দিনগুলোর কথা যখন ভাবনায় আসে তখন মনে হয় পুরনো দিন আর সন্ধ্যেরাতগুলো বড় স্বপ্নমাখা ছিল। সত্যিই তাই, কি করে হারিয়ে গেল সেই স্বপ্নমাখা দিন?
বিকেল ফুরিয়ে গেলেই চলে আসত মনমরা সন্ধ্যা। গোল্লাছুট-লুকোচুরি খেলা শেষ করে এবার ঘরে ফেরার পালা। ঠিক সময় মতো না ফিরলে কপালে জুটত বড়দের বকুনি।
বই খুলে পড়তে বসতে না বসতেই সব খোকা-খুকুদের চোখে নেমে আসত মুঠো মুঠো ঘুম। মায়েরা তাড়াহুড়ো করে এক থালায় ভাত মেখে সবার মুখে ভাত তুলে দিতে দিতে হিমশিম খেতেন।
তারপর বিছানায় শুয়ে মা কিংবা দাদী-নানীর পাশে শুয়ে গল্প শোনার পালা। সে ছিল এক মধুর সময়। দু’চোখ থেকে ঘুম পালিয়ে যেত। রূপকথার গল্পে থাকত রাজা-রাণী, তেপান্তরের মাঠ, রাক্ষস-খোক্কস, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর কথা। পশু-পাখির গল্পও শোনাতেন ঠাকুমা-দিদিমা ওঁরা। সেই সব গল্পের শেষে একটি নীতিকথা থাকত, যা সত্যিই ছোটদের মনে ছাপ রেখে যেত।
সেই সব দিনগুলোর কথা একবার ভাবো তো, তখন টেলিভিশন ছিল না, মোবাইল তো ছিলই না, শুধু গল্পের বই থেকে ছোটরা মনের খোরাক পেয়ে যেত। স্কুলের পড়ার বই ছাড়া গল্প পড়া ও গল্প শোনা খুব আনন্দের ব্যাপার ছিল ছোটদের কাছে।
এখন তোমাদের গল্প শোনায় টেলিভিশন। শুধু শোনায় বললে ভুল হবে, টিভি দেখায় নানা ধরনের কার্টুন ফিল্ম। নানা ধরনের গল্পে থাকে যুদ্ধ, হানাহানি, মারামারি, শত্রুতা; তোমরাই বলো-এসব কি ভালো?
মোটেও ভালো নয়। বরং ঠাকুরমার ঝুলি কিংবা অন্যান্য রূপকথার গল্প পড়ে দেখ, ভালো লাগবে তোমাদের। অনেক গল্পে রয়েছে নীতিকথা। জীবনের ভালো দিক, মন্দ দিক রয়েছে অনেক গল্পের মাঝে, তা পড়লে বা শুনলে তোমরা নিজেরাই বুঝতে পারবে ভালো কী এবং মন্দটাই বা কী।
এ ধরনের গল্পের রচয়িতার নাম ঈশপ-অবংড়ঢ় (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৬২০-এ তার জন্ম হয়)। তার গল্পের মজা এই যে, এগুলো খুব ছোট। সেগুলো পড়েও তোমরা আনন্দ পাবে। কারো মুখে শুনলেও ভালো লাগবে।
ঈশপ হলেন গল্পের রাজা। বড়রা তোমাদের জন্মদিনে নানা কমিকস-ম্যানড্রেক, সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান তুলে দেন, এগুলোও পড়তে হবে ছোটদের। এখনকার সময়ের সাথে তোমাদের তাল মিলিয়ে চলতে হবে তো! কিন্তু এর সাথে যদি তোমরা ঈশপের বইগুলো হাতে পাও তাহলে নিশ্চয়ই খুব আনন্দ পাবে।
তার গল্প একটু পরেই জানতে পারবে। এবার তাহলে গল্প-লেখকের জীবনের কথা আমরা জেনে নিই।
ঈশপ ছিলেন মিসরের ফারাও বাদশাহ আমাসিসের সময়কার লোক। তিনি বসবাস করতেন সামস দ্বীপে। তিনি ছিলেন কৃষ্ণকায় সম্প্রদায়ের লোক। ইয়াডমন নামের এক নাগরিকের ক্রীতদাস ছিলেন তিনি। চেহারা তার মোটেও ভালো ছিল না তবে তার নজর ছিল খুব তীক্ষè মানুষটি ছিল বুদ্ধি ও হাস্যরসে ভরপুর। হাত-পা ঝেড়ে অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে মানুষকে তার গল্পগুলো ফুটিয়ে তুলতেন।
খুব সুন্দরভাবে গল্পগুলো সহজ করে ফুটিয়ে তোলার অপূর্ব ক্ষমতা তার ছিল। সহজ ভাষায় বিভিন্ন জীবজন্তু ও প্রাণীকে নিয়ে উপদেশমূলক গল্প লিখেছেন ঈশপ। মজার মজার সেই গল্পগুলো আমাদের সময়ের ছোটদের রাতগুলোকে রাঙিয়ে দিয়ে যেত।
তোমরা হয়তো এতক্ষণে ভাবছ গল্প কোথায়? শুধু তো গল্পের রাজা ঈশপের কথাই বলছ। হ্যাঁ, তা ঠিক মজার মজার গল্পগুলো ধীরে ধীরে চলে আসবে। তোমরা পড়তে পারবে, আর যারা পড়তে পার না তারা বড়দের কাছে শুয়ে শুনতে পাবে।
তবে তার আগে গল্প লিখিয়ের জীবনের কথা তো আমাদের জানতে হবে, তাই না?
ঈশপ এমনই ভালো গল্প কথক ছিলেন যে, বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস থেকে শুরু করে সব শ্রেণীর মানুষ ছিলেন তার গল্পের ভক্ত। তার গল্পগুলো সব ধরনের মানুষের কাছে এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে গ্রিসের দার্শনিক জিমট্রিয়াস তার ছোট্ট সুন্দর নীতিকথায় গল্পগুলো সযতেœ সংগ্রহ করে রাখেন।
ঈশপের গল্প আজ সারা বিশে^র অমূল্য সম্পদ।
এখনও মানুষের মনের অপার কৌতূহল, কে এই মহান ঈশপ? কে এই মনোমুগ্ধকর অগুনতি গল্পের স্রষ্টা? আসলেই কি এই নামে কেউ ছিলেন? নাকি শুধুই মানুষের কল্পনায় গড়ে উঠেছে এই চরিত্রটি?
সত্যি, গল্পের এই রাজাকে নিয়ে রয়েছে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। গল্পের রচয়িতাকে নিয়ে রয়েছে নানা মতপার্থক্য। একজনের সঙ্গে অন্য জনের ভাবনার কোনো মিল নেই।
কোনো কোনো ইতিহাসবিদ ভাবেন, ঈশপ নেহাতই একটি কাল্পনিক চরিত্র। কোনো গল্পকারের বেশ কিছু লেখা হয়তো মানুষের মাঝে এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, এ প্যাটার্নের অনেক গল্প তার নামের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে।
তবে এই যুক্তিটি সবাই মেনে নিতে পারেন না। আংশিকভাবে তারা এই ধারণার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। ধারণটি মেনে না নেয়ার গ্রহণযোগ্য কারণও রয়েছে। গ্রিসের ইতিহাসের পর্যালোচনা করে দেখা সত্যি সত্যি ঈশপ নামের একজনের নানা তথ্য পাওয়া যায়। বিচ্ছিন্ন ও টুকরো টুকরোভাবে অনেক কিছু জানা যায় মানুষটি সম্পর্কে।
গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটলের ধারণা, এই গল্পকারের জন্মস্থান ব্ল্যাক সি-এর উপকূল ঘেঁষে থ্রেস নামক একটি জায়গায়। পরবর্তীতে এই জায়গাটি মেসেবব্রিয়া নামক শহরে রূপান্তরিত করা হয়। আবার রোমান সাম্রাজের কিছু চিঠিপত্রে তার জন্মস্থান হিসাবে ফ্রিজিয়ার নাম উল্লেখ করা হয়।
ঈশপের জন্মস্থান নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও পরবর্তী জীবন নিয়ে তেমন কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্বের উল্লেখ নেই। গ্রিক কবি কালিমাকাস কোনো এক লেখালেখিতে তাকে ‘অবংড়ঢ় ড়ভ ঝধৎফরং’ বা সাদির ঈশপ হিসাবে উল্লেখ করেছেন।
তবে একটি জায়গায় সবাই এসে ঐক্যমতে পৌঁছেছেন যে, তিনি ক্রীতদাস ছিলেন। মুক্ত হওয়ার পর তিনি এসে উপস্থিত হয়েছিলেন রাজা ক্রোইসাসের দরবারে। ঈশপের বুদ্ধি-হাস্যরসের ক্ষমতা ও বিচক্ষণতা দেখে রাজা অবাক হয়ে যান। এ কারণেই তিনি তাকে রাজ দরবারে রাখা স্থির করেন। এরপর বিভিন্ন সময় রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ঈশপকে তার নীতিকথাপূর্ণ ও সৎ উপদেশে ভরা গল্পগুলো প্রচারের জন্য পাঠান।
তার জন্মস্থান নিয়ে নানা মতপার্থক্য থাকলেও গল্পকার ঈশপ-এর অস্তিত্বকে কেউ অস্বীকার করতে পারেননি। এই কথক ও গল্পকার ছিলেন, আছেন ও থাকবেন। তিনি চিরজীবী।
গ্রিক উপকথার জনক তিনি। গল্পগুলো নিত্য পাঠের উপযোগী। পশু-পাখি পতঙ্গের সার্থক রূপায়ণে গল্পগুলোকে তিনি শুধু আকর্ষণীয় নয়, শিক্ষণীয় করে তুলেছেন।
হয়তো তার চোখের দৃষ্টি ছিল সুন্দর, স্বচ্ছ ও তীক্ষè। তাই তো চারপাশের মানুষকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। তিনি মানুষের সুন্দর ও কুৎসিত দিক যেমন দেখেছেন তেমনই ক্রীতদাস থাকাকালীন সময়ের দুঃখ-কষ্টও দেখেছেন, আবার মুক্তির আনন্দও সারা মন প্রাণ দিয়ে উপভোগ করেছেন।
তার গল্পে গুটি গুটি পায়ে সবাই এসে হাজির হয়েছে। সাপ, ব্যাঙ, গাধা, ঈঁদুর, হাঁস, পিঁপড়ে, ঘুঘু, কচ্ছপ, সারস পাখি, শেয়াল-কুকুর, নেকড়ে, কাঁকড়া, গোলাপ, ঘাসফুল-মিছিলের মতো এসেছে একের পর এক। অবহেলিত পশু-পাখি-পতঙ্গ-ফুল-লতাপাতা কেউ যেন অভিমান করে বলতে না পারে, -হ্যালো মি. ঈশপ, হ্যালো স্টোরি-টেলার, তোমার গল্পে আমরা নেই কেন গো?
প্রথমে গাধার গল্পটি শোনা যাক।
একটি গাধা সব সময় পিঠে বোঝা নিয়ে নদী পার হতো। একবার ও লবণের বোঝা নিয়ে যাবার সময় হোঁচট খেয়ে নদীতে পড়ে যায়। এর ফলে সব লবণ পড়ে নদীর জলে মিশে গেল, এতে তার পিঠের বোঝা একেবারেই হালকা হয়ে গেল। গাধাটি বোকা তো, ভাবল ভারী বোঝা নিয়ে নদী পার হওয়ার সময় ইচ্ছে করেই হোঁচট খাব, এতে আমার পিঠের বোঝাটি হালকা হয়ে যাবে।
একদিন এভাবে বোঝা নিয়ে নদী পার হবার সময় গাধাটি ইচ্ছে করেই হোঁচট খেল। সেদিন ওর পিঠে ছিল তুলোর বস্তা। তোমরা জানো, তুলো জলে ভিজে গেলে ভারী হয়ে যায়। ফলে বোঝার চাপে গাধাটি মারা যায়।
অতি বুদ্ধিতে যে গলায় দড়ি পড়ে তার প্রমাণ এই গাধাটি।
ভেড়া ও নেকড়ের গল্প এবারে শুনি।
গহিন বনে এক নেকড়ে বাস করত। সারাজীবন মানুষ আর পশু শিকার করে সে তার খাবারের জোগাড় করত। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীর তার স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল হয়ে পড়ে। নিয়মিত বাঘটি খাবারের জোগাড় করতে পারছিল না। এতে সে চিন্তিত হয়ে পড়ে।
দূরে এক ভেড়া পায়চারি করছিল। ওকে দেখে বাঘের মাথায় দারুণ এক বুদ্ধির উদয় হয়। মনে মনে সে ফন্দি আঁটতে থাকে। বাঘটি গর গর স্বরে ডেকে ভেড়াকে বলল, আমার শরীরটা আজকাল ভীষণ খারাপ যাচ্ছে, ঐ যে দূরে দেখা যাচ্ছে এক ঝরনা তা থেকে কি তুমি আমাকে এক আঁজলা পানি এনে দেবে? মাংসের ব্যবস্থা আমি নিজেই করে নেব, তুমি এনে দিলে আমার খুব উপকার হয়।
ভেড়াটি ছিল দারুণ বুদ্ধিমান। সে বাঘের গোপন ফন্দি আঁচ করতে পেরে বলে, আমি তোমাকে পানি এনে দেব আর তুমি আমাকে দিয়েই মাংসের ব্যবস্থাটা করবে- তাইতো?
ফন্দিটি কাজে না লাগায় নেকড়ের ভারী খারাপ মন হয়ে যায়।
এই গল্প থেকে কী শিখলাম বলো তো?
বুদ্ধিমানের কাছে চালাকি করে কোনো লাভ হয় না।
অতি ক্ষুদ্র প্রাণী বা কীটপতঙ্গও যে আমাদের উপকারে আসতে পারে তার উদাহরণ রয়েছে ঈশপের অনেক গল্পে। এমন একটি গল্প এবারে শুনি তাহলে।
একটি পিঁপড়ে পিপাসায় বড় কাতর হয়ে পড়ে। নদীর জলে মুখ দিতে গিয়ে সে নদীতে পড়ে যায়। অসহায় পিঁপড়েকে দেখে একটি ঘুঘু পাখির খুব দয়া হলো। সে পিঁপড়ের সামনে গাছের একটি পাতা ফেলে দেয়। পাতাটিতে উঠে পিঁপড়েটি তার জীবন রক্ষা করে। সে কিন্তু ঘুঘুর এই উপকারের কথা ভোলেনি। পিঁপড়েটি একদিন দেখে একজন শিকারি ঘুঘুটির দিকে তীর নিক্ষেপ করতে চাইছে।
পিঁপড়েটি অকৃতজ্ঞ নয়, সে তীর ছোঁড়ার আগেই শিকারির পায়ে কুট করে কামড় বসায়, এর ফল শিকারি তার লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হয়। এভাবেই ঘুঘুটির প্রাণ রক্ষা পায়। ছোট হলেও কাউকে অবহেলা করতে নেই।
এও বলা যায়, উপকারির উপকার ভোলা উচিত নয়।
নেকড়ে আর কুকুরের গল্প এবার বলি।
একপাল নেকড়ে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। একদল পোষা কুকুরের সাথে ওদের দেখা হয়ে যায়। হালুম-হুলুম করে নেকড়েরা বলল, কেমন আছ ভায়া?
কুকুরের দল খুশি গলায় ঘেউ ঘেউ করে জবাব দেয়, খাসা আছি। মালিকের জান-মালের পাহারা দেই, মজাদার খাবার খাই-আর কি চাই?
নেকড়েরা জোরে জোরে হেসে ওঠে। বলে, এ কি কোনো সুখ হলো? তোমরা পরের অধীন। গলায় পরেছ লোহার শিকল। তোমরা পাহারা দাও আর মালিক নিশ্চিন্তে ঘুমোয়। খেয়ে-দেয়ে বাড়তি যা কিছু থাকে তাই তোমাদের খেতে দেয়। তোমরা বোকা তো, মনের আনন্দে তাই চেটেপুটে খাও, এতেই তোমাদের এত আনন্দ!
কুকুরের দল নেকড়েদের কথায় চমকে ওঠে। সত্যিই তো, এমন ভাবনা তো আমাদের মনে আসেনি। ওরা বুদ্ধিমান নেকড়েদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কী করব আমরা বলো।
নেকড়ের দল বলে, তোমরা সচেতন হয়ে ওঠো। নিজেদের কথা ভাবো। মালিকের নিপীড়ন আর সহ্য করো না। রুখে দাঁড়াও তোমরা, উচিত শিক্ষা দাও ওদের। তোমাদের পাশে আমরা আছি, ভয় কি তোমাদের? বুড়ো কুকুরটি বলে, ঠিক আছে, আমরা তোমাদের কথা শুনব, এবার বলো কী করতে হবে আমাদের।
– ভেবে দ্যাখো, তোমরা কি বোকা! পরের গরু-ভেড়া, ওদের ওপর রাত জেগে এতদিন নজরদারি করেছ। এবার থেকে আমাদের কাছে ওদেরকে তুলে দেবে। আমরা সবাই মিলে মজা করে খাব।
খুশি হয়ে ওঠে এত দিনকার পোষা কুকুরের দল। নিঝুম রাত। কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই। এক সময় রাত গভীর হলো। কুকুরের মালিকরা নিশ্চিত মনে ঘুমোচ্ছেন। বিশ^াসী প্রহরী কুকুর তো আছেই, ভাবনা কি!
এদিকে কুকুরের দল অন্ধকারে নেকড়ের দলকে চুপি চুপি গরু আর ভেড়ার খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দেয়।
খুশিতে নেকড়ের চোখ চকচক করে ওঠে। তারপর ওদের হিংস্র দাঁতের সারি বের করে প্রথমে কুকুরদের ঘাড় মটকে দেয়। এবার নিশ্চিন্তে গরু-ছাগল আর ভেড়া নিয়ে বনের পথে এগিয়ে যায় নেকড়ের দল।
কী শিক্ষা পেলাম আমরা এই গল্প থেকে?
বিশ^াসঘাতকতা করলে এর ফল ভালো হয় না।

এবারের গল্পটি ফুলকে নিয়ে। গোলাপ আর ঘাসফুল পাশাপাশি থাকে। গোলাপের সুন্দর পাপড়ি আর মিষ্টি গন্ধে ঘাসফুল বিভোর হয়ে বলে, ভাই গোলাপ, তুমি ফুলের জগতের রাণী। রূপ-গুণের তুলনা নেই তোমার। খোঁপা আর ফুলদানিতে রাখলে কি ভালোই না লাগে দেখতে। তোমাকে ছাড়া সুন্দর মালা গাঁথা হয় না। তোড়া সাজাতেও তোমার দরকার পড়ে। আর আমাকে দ্যাখো, কেউ আমার দিকে তাকিয়েও দেখে না।
দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলে গোলাপ আক্ষেপ করে বলে, ভাই তুমি সত্যি বলেছ। কিন্তু জানো, আমার জীবনের আয়ু বড় কম।
সত্যি ফুলের মালা, তোড়া, ফুলদানি ও খোঁপায় আমাকে সাজিয়ে রাখে। তবু জানো, আমার পাপড়িগুলো অল্প সময়েই ঝরে পড়ে। তোমার দুঃখ, তোমাকে কেউ দেখে না, তবু তুমি বেশিদিন বেঁচে থাকতে পার। তোমাকে কেউ ছিঁড়ে না। বাগানের এককোণে তরতাজা হয়ে তুমি বহুদিন বেঁচে থাকতে পার। হে প্রিয় ঘাসফুল, বেঁচে থাকতেই তো আনন্দ।
অল্পদিন বেঁচে থাকার চাইতে বেশিদিন বেঁচে থাকা অনেক আনন্দের।
এবারে শোনা যাক মেঠো ইঁদুর আর শহুরে ঈঁদুরের গল্প। শহুরে ইঁদুর একবার বেড়াতে এল মেঠো ইঁদুরের বাড়িতে। মেঠো ইঁদুর শহুরে ইঁদুরকে খেতে দিল চাল-ডাল আর বালি। শহুরে ইঁদুর বন্ধুর এই দশা দেখে বলে, আহা বেচারি, তেমন কিছুই খেতে পায় না।
বিদায়বেলা শহুরে ইঁদুর মেঠো ইঁদুরকে নিমন্ত্রণ জানায়। মেঠো ইঁদুর বন্ধুর বাড়ি গিয়ে হতবাক হয়ে যায়। কতো কী খাবার! পোলাও-কোর্মা, রুটি-মাখন কিছুরই অভাব নেই। আয়েশ করে মেঠো ঈঁদুর যেই না খাবার মুখে তুলতে যাবে, তখনই দরজায় টোকা পড়ে। মেঠো ইঁদুরটি সুড়–ত করে গর্তে লুকিয়ে পড়ে। শহুরে ইঁদুর অভয় দেয়, ভয় পাচ্ছ কেন বন্ধু, এ তো কালবোশেখি হাওয়া।
দুজন আবার খেতে বসে। সেই সময় দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে ইয়া বড় এক হুলো বিড়াল। মেঠো ইঁদুর ছুটে পালাতে থাকে, আমার মজাদার খাবারের কাজ নেই। এখানে এসে যে মরতে বসেছি ভাই। সারাক্ষণ ভয়ের মাঝে থেকে যদি শাহি খাবার খেতে হয়, এমন ভালো খাবারের আমার দরকার নেই। গাঁয়ে আমি ডাল-ভাত খাই সত্যি, তবু আমি খুব শান্তিতে থাকি।
সহজ-সরল জীবনে যে শান্তি আছে এ গল্পটিতে তারই ছবি আমরা দেখতে পাই।
ঈশপ এমনই এক প্রতিভাবান লেখক ছিলেন, পশু-পাখি-কীট-পতঙ্গ নিয়ে সাধারণ গল্প তৈরি করেছেন একের পর এক। এত বিচিত্র ভা-ার তার গল্পের একটির সঙ্গে আরেকটি গল্পের এতটুকু মিল নেই। সব গল্প নতুন ভাবনার ফসল গল্পগুলোর প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, এসব শিশু-কিশোর উপযোগী এবং শিক্ষণীয়।
প্রত্যেক লেখকের গল্পের পেছনের কোনো কাহিনী থাকে। এ কারণে আমরা বলে থাকি গল্প লেখার গল্প। ঈশপের একটি বহুপ্রচলিত গল্প আছে যা আমাদের সবারই জানা।
একটি হাঁস রোজ এক সোনার ডিম পাড়ত। হাঁসটির মালিক ছিল ভীষণ লোভী। সে মনে করল। হাঁসটির পেটে নিশ্চয়ই অজস্র সোনার ডিম রয়েছে। লোকটি ভাবল, রোজ আমি একটি একটি করে ডিম পাবো কেন? হাঁসটির পেট কাটলে অনেকগুলো ডিম একসঙ্গে পেতে পারি। ভাবনা মতই কাজ করল সে। লোভী লোকটি হাঁসটি হারালো, সোনার ডিমও হারালো।
অতি লোভ যে ভালো নয়, এ গল্পে এ কথাটিই ফুটে উঠেছে।
সংসারের কিছু বাস্তব চরিত্র দেখে এ গল্পটি তৈরি করেছেন লেখক।
একবার তার প্রভু রাজা ক্রোসাস ঈশপকে কিছু টাকা দিয়ে ডেলফিতে পাঠান। সেখানকার লোকগুলো ঐ টাকাগুলো পেয়ে আরও পাবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। অর্থলোভী মানুষদের লোভাতুর চোখ দেখে মনে মনে গল্পটি সাজিয়ে ফেলেন তিনি। লোভীদের পরিণতি যে কী মর্মান্তিক হতে পারে, কী করুণ হতে পারে তাও তিনি গল্পের শেষে বলে দিলেন।
লোভের যে কী ভয়ঙ্কর পরিণতি হয়, তার প্রচুর গল্পে এ কথাটি উঠে এসেছে।
একটি কুকুর মাংসখ- মুখে নিয়ে নদী পার হচ্ছিল। নদীতে তার প্রতিবিম্ব দেখে ঐ মাংসটি কেড়ে নেয়ার জন্য সে ব্যাকুল হয়ে উঠল। ভাবনা মতই সে হাঁ করে জলের মাঝের সেই মাংসখ-টি কেড়ে নেওয়ার জন্য ঘেউ ঘেউ করে উঠল। এতে বাড়তি মাংসখ- তো পেলোই না নিজের মুখের মাংসখ-টিও হারাল। মুখের মাংসখ- নদীতে হারিয়ে গেল।
চমৎকার সব নীতিকথা গল্পের মাধ্যমে তিনি সুচারুভাবে তুলে ধরেছেন।
একবার বনের রাজা সিংহ ও এক বুনো শুয়োরের খুব পিপাসা পেয়েছে। কাছে কোথাও নদী-পুকুর-খাল-বিল কিছুই নেই। ক্লান্ত হয়ে পড়ে দুজনেই দেখতে পায়, দূর পাহাড়ের গায়ে ঝরনা ধারা বইছে। এ দেখেই কে আগে জল খাবে তা নিয়ে দুজনেই ঝগড়া শুরু করে দেয়। তুমুল ঝগড়া করতে করতে পিপাসার কথা ওরা বেমালুম ভুলে যায়।
এই ঝগড়া ও মারামারিতে একজন জিতবে ও একজন মরবে, ওদের চারপাশে তাই অজস্র শকুন ভিড় করতে থাকে। কখন ওরা মরবে- এই আশায় ওরা উৎসব শুরু করে দেয়। অনেকটা সময় মারামারি করে বিশ্রাম নিতে গিয়ে দুজনেই বুঝতে পারে, ঝগড়া করে মরে গিয়ে শকুনের ভোজের উপকরণ হওয়ার দরকার নেই বরং দুজনে মিলেমিশে থাকাই ভালো। এই ভেবে দু’জনেই ভাব করে নেয়।
মিলেমিশে থাকাটাই সবার জন্য সুখের ও আনন্দের। ঈশপের গল্প শিশু-কিশোরদের যেমন শিক্ষণীয় তেমনই তরুণ ও পরিণত বয়সের মানুষদের কাছেও সেসব গ্রহণযোগ্য। প্রতিটি গল্পে তিনি পরিবার ও সমাজের মানুষের কথা বলে গেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই অমূল্য রত্নগুলো আজ নবীন প্রজন্মের কাছে অপরিচয়ের অন্ধকারে ঢাকা। কার্টুনের চরিত্রগুলো ওদের মুখস্থ, হামটি-ডামটি ওরা অনায়াসে আবৃত্তি করতে পারে। শিক্ষণীয় ঈশপের গল্পগুলো অজানা রয়ে গেছে ওদের কাছে।
তার প্রতিটি গল্পেই দয়া-মায়া-মমতার কথা ফুটে উঠেছে। লোভ-হিংসা-যুদ্ধ এসবের পরিণাম যে ভালো নয়, গল্পের মাধ্যমে এ কথাটি তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। নিজে ক্রীতদাস ছিলেন বলেই দুঃখ-কষ্ট-অভাব ও পরাধীনতার জ¦ালা হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন। তাই তো তার গল্পে তিনি যা বলতে চেয়েছেন, তা কাচের মতো স্বচ্ছ হয়ে ফুটে উঠেছে।
চারদিকে এখন লোভ-স্বার্থপরতা ও হিংস্রতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। শান্তি নয়, ¯িœগ্ধতা নয়, পরম সুখ নয়, মানুষের মাঝে এখন আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতা। এই ক্রান্তিকালে ঈশপের নীতি গল্পের প্রয়োজনীয়তা প্রতিটি বিবেকবান মানুষ অনুভব করবেন।
অপ্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা ঘরে ঘরে। শপিংমলের ঝাঁ চকচকে জিনিসের ঔজ্জ্বল্যে কিশোর-তরুণদের চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। উদ্ধত দুর্বিনীত হয়ে উঠছে সন্তানরা। এখন অভিভাবকরা আগের মতো সন্তানদের বলেন না সেই পুরনো কবিতার পঙক্তিটি-
‘বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে’।
এছাড়া ‘অতি লোভ ভালো নয়’।
‘মিথ্যা কথা বলা মহাপাপ’-এসব নীতিবাক্যগুলো এখন আর শুনতে পাই না। তবে ঈশপের প্রতিটি গল্পের শেষে শিক্ষণীয় নীতিবাক্যগুলো ছড়িয়ে রয়েছে। তাই এসব গল্পের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করার উপায় নেই। চরিত্রে গঠনে, সুস্থ মানুষ হয়ে ওঠার জন্য কিংবা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গল্পগুলোর অবদান অনস্বীকার্য।
তাই ঈশপের অজানা অজস্র গল্পগুলোর সঙ্গে ছোটদের পরিচয় করিয়ে দেবার দায়িত্ব বড়দের। তার কালজয়ী লেখাগুলো সাহিত্যভুবনে এক অমূল্য সম্পদ। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কাছে যুগ যুগ ধরে ঈশপ বেঁচে থাকবেন তার বিচিত্র লেখাগুলোর জন্য। কারণ ঈশপ যে সত্যিই গল্পের রাজা।

Share.

মন্তব্য করুন