নিজের নামের আগে ড. না লিখলে এখন আর নিজেকেই যেন চিনতে কষ্ট হয়। কেমন যেন খালি খালি লাগে। আগে এমনটা হতো না। তখন নির্ভার ছিলাম। তখন নামের আগে ড. বসানোর সুযোগও ছিলো না, সে ক্ষমতাও জুটানো সম্ভব হয়নি। যখন জুটে গেলো, প্রথম প্রথম নিজেকে একটা কেউকেটা মনে হতো। এখন ঠিক উল্টোটা মনে হয়। কারণ ওই ড. কে সান্ত¡না দেবার মতো কোনো রচনা নির্মাণ করতে পারছি না। ফলে কষ্ট নিয়ে বেঁচে আছি এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে।
মাত্র মাস দুয়েক হবে আমাদের প্রতি সপ্তাহে লটবহর নিয়ে বেড়ানোর শুভসূচনা। একটা ছোটো অভ্যাস দানা বাঁধছে টের পাই। যখন শুনতে পাই, নাহ! এ-সপ্তাহে আর যাওয়া হচ্ছে না কোথাও। তখন মনে হয় সত্যি সত্যিই বিদেশ-বিভুঁইয়ে আছি এবং কষ্ট পেতেই যেন থাকি। সে কষ্টটা ওই ড.-এর মতোই কষ্ট। নিসর্গ-প্রকৃতি ও তার রূপ দেখবার জন্য আল্লাহ আমাদের যে দুটো চোখ দিয়েছেন, সবুজ আলোর নরম ঘ্রাণ শুঁকবার জন্য নাক দিয়েছেন আর কান দিয়েছেন সেই প্রকৃতির ডাক শোনার জন্য। কিন্তু এসবের কোনোটারই সদ্ব্যবহার করতে পারছি না আমি।
সাধারণত দুপুরে আমি ভাত খাই না। তবে আজ ২৪ অক্টোবর ২০২০, শনিবার, কয়েক লোকমা খেলাম। যেহেতু কোথায়ও যাওয়া হবে না, তাই ছোটো একটা ‘ন্যাপ’ নিয়ে সন্ধ্যায় হাঁটতে বেরুবো- সেই চিন্তা মাথার ভাঁজে রেখে শুয়ে পড়লাম। চোখটা কেবল ধরে আসছে ঘুমের নেশাখোর জুমিংয়ে, বেজে উঠলো সেলফোন। ধরলাম।
‘পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি হয়ে নিচে নামুন প্লিজ’।
কাজী জহিরের গলা।
‘আমরা আসছি এর মধ্যেই’।
আচ্ছা বলে ফোন রাখলাম। না, নামলাম না। মাথায় বাজতে থাকলো আজকে তো বাইরে হাঁটতে যাওয়ার কথা না; কোনো পার্কেও বেড়ানো হবে না বলেই জানি। বেড়াতে গেলে আগের রাতে তো বলতো। নিদেনপক্ষে আজ সকালেও বলতে পারতো। না, কোনো কিছুই না। পোকোনো মাউন্টেইনে যাওয়ার প্রোগ্রাম আমরা করেছি ১৫দিন আগে। স্থানীয় পার্কে যেতে হলেও তো মনে মনে তৈরি হয়ে থাকতাম। কিন্তু এই সুযোগ তো অ্যাভয়েড করা ঠিক না।
ঝটপট উঠে গেলাম।
হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় পরে রেডি হতে মিনিট তিনেক সময় লাগলো। আর দুই মিনিট শুয়ে কাটিয়েছি। ফলে বরাদ্দ পাঁচ মিনিট শেষ। কই জহির তো ফোন করছে না।
নেমে এলাম বাইরে। অন্তত এসে দেখুক, আমি সময় অপচয়কারী নই। আরো চার মিনিট পড়ে এলো হোন্ডা অডিসি। আমি উঠে গেলাম সামনের আসনে। ভাবী পেছনে নভো আর সারাফের পাশে বসলেন।
বললাম কোথায় যাচ্ছি?
করোনা পার্কে।
মনে পড়লো করোনা নামে নিউ ইয়র্কে একটি জায়গা আছে। কোনো কথা না বলে ভাব নিলাম যেন ওই পার্ক আমি চিনি।
মন্জু ভাই আর কামরুন ভাবীকে তুলে ভ্যানউইক এক্সপ্রেসওয়ে ধরে আমরা এগুলাম। মিনিট কুড়ির মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম কুইন্সের ওই বিখ্যাত পার্কের দোরগোড়ায়। প্রথমে চোখে পড়লো কুইন্স মিউজিয়াম। তার পাশে ন্যাশনাল টেনিস কোর্ট কমপ্লেক্স। এই দুই প্রতিষ্ঠানের মাঝে আমাদের গাড়ি পার্কের জন্য আমরা ৯ই এক্সিট ধরে এগোলাম। এবং পেয়ে গেলাম পার্কিও। পা রাখতে রাখতে ৪:৫৫-তে দেখলাম বেজে গেছে। আমাদের হাতে আছে বেলা ডোবার আগে একটি কণ্টা। মুক্তি ভাবী এ পার্কে বহুবারই এসেছেন বলে মনে হলো। তার গাইডেন্সে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। মনজু ভাই বেশি কথা বলেন না। তারপরও তিনি, মনি ভাবী, মুক্তি ভাবী আর জহিরের সম্মিলিত আলোচনায় জেনে গেছি গাড়িতেই যে ফ্লাসিংয়ের মিডওয়ের করোনা পার্কের আকার অনেক বড়। সেটা টেরও পাচ্ছি এখন।
মিউজিয়ামের পাশ দিয়ে ঢুকে পড়লাম। মুক্তি ভাবী সবার আগে যাচ্ছেন। তিনি বেশ গতিতে হঁােটন। তার পাশে মনি ভাবী ও নভো ও সারাফ। পেছনে আমি। আমরা সামনে কাজী জহির। আজ কাজী ফৌজিয়া আসেননি। তিনি তার ড্রাম উবংরং জরংরহম টঢ় ্ গড়ারহম –এর কলিগদের জন্য রান্নায় ব্যস্ত। তারা আসবেন রোববার দিনের বেলায়। আর আমাদের দাওয়াত তিনি দিয়েছেন সন্ধ্যারাতে। তিনি আগে কখনো এই পার্কে বেড়াতে আসেননি, এটা আমার পক্ষে অবিশ্বাস করা কঠিন। বরং বলা উচিত বাড়ির কাছে এতো বড় একটি আরশিনগর, এই পার্ক, এতদিন কেন আমার কাছে কেউ বলেননি? অবশ্য আমি যে একজন ভ্রমণপিপাসু, সেটা ঘরোয়া বৈঠকে এখন জানালেও আগে কখনোই নিজের অভিলাষ জানাতাম না। কিছুটা মুখচোরা স্বভাব আমার। বেড়াতে ওস্তাদ প্রিয়ভাজন আহমাদ মাযহার। এবং অবশ্যই নশরত শাহ আজাদ। এ দুজনের সুবাদে আমি মেট্রোপলিটান মিউজিয়াম, গুগেনহাইম মিউজিয়াম ও ব্রুকলিন মিউজিয়াম ঘুরেছি, দেখেছি এবং সত্যিকার উপভোগ সেটা করেছি। আমার কাছে এ তিনটি মিউজিয়ামেরই ফোল্ডার আছে, ছবিও আছে, ঠিক একদিন লিখে ফেলবো।
কত বড় এই পার্ক যে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে গেলাম, কিন্তু ফুরানো দূরে থাক, মনে হলো এক কোনাও হাঁটিনি। ভেতরে কেবল হাঁটার রাস্তা নয়, বাচ্চাদের স্কেটিং ফিল্ড, বড়দের জন্য ফুটবল মাঠ, হ্যান্ডবল, ভলিবল, বেস বল, ডিসঅ্যাবলদের জন্য বা বয়স্কদের ভ্যান-সাইকেল, বাঁধানো পণ্ড, পাখিদের জন্য জলাশয়, গ্লোবসহ কি নেই সেখানে?
উইকিপিডিয়া লিখেছে ফ্লাসিং রিভার এই পার্কের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে। দুটো বড় লেক আছে এখানে। একটির নাম মিডো অন্যটি উইলো। এটির অবস্থান কুইন্স বরোর উত্তরাংশে। এই পাবলিক পার্কের পূর্ব পাশে ভ্যানউইক এক্সপ্রেসওয়ে। আর গ্রান্ড সেন্ট্রাল পার্কওয়ে পার্কের পশ্চিম দিয়ে গেছে। পার্কের উত্তরে ফ্লাসিং বে, আর ইউনিয়ন টার্নপাইক দক্ষিণে। ফ্লাসিং মিডো করোনা পার্ক এই মহানগরীর বড় পার্কগুলোর মধ্যে চার নম্বরে। এটি ৮৯৭ একর জমির ওপর নির্মিত হয়েছে ১৯৩৯ সালে। ওই বছরই এখানে নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ডস ফেয়ার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। পরে ১৯৬৪ সালেও এই উদ্যানেই দ্বিতীয়বার ওয়ার্ল্ডস ফেয়ার। বিশ শতকের গোড়ার দিকেই নিউ ইয়র্ক সিটি পার্কস কমিশনার রবার্ট মোসেস প্রথম ভেবেছিলেন যে এই নিচু জলমগ্ন ভূমিতে পার্ক করা যায়। এ-জায়গাটি ফ্লাসিং রিভারের প্রভারে সব সময়ই জলময় থাকতো। ১৯৬৪ সালের বিশ্ব ফেয়ারের পর পার্কের অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। পরে এর উন্নয়নের প্রয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে।
এই পার্কের বাউন্ডারির ভেতরে কুইন্স মিউজিয়াম, যেখানে সংরক্ষিত আছে চাঁদের মাটি। অনেক মানুষই এখানে আসে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে। পাকে ঘোরা আর কুইন্স মিউজিয়াম দেখা শেষ করেই তারা ফেরেন। রথ দেখা আর কলা বেচার প্রবাদটিও এখানে যুক্তিসঙ্গত বলে মনে হয়। আমার অনেক দেরিতে গেছি বলে মিউজিয়ামে ঢুকতে পারিনি। সময় ফুরিয়ে গেছিলো। এই করোনা পার্কে ঘোরাঘুরির সাথে সাথে আমাদের সেলফোনগুলো তুলছিলো সব স্মরণীয় ছবি। সেগুলো আমরা হন্টস ক্লাবে রেখেছি। এবং আরো একটি ক্লোজ ফেন্ড গ্রুপে রেখেছি। কাজটা কাজী জহিরের। তিনি এসব ব্যাপারে বেশ পটু মানুষ।
হাঁটার পর বেঞ্চে বসে রেস্ট নিলাম কতক্ষণ। বেলাও ডুবে গেছে তখন। আমরা ফেরার পথ ধরলাম। এবার আকাকে জহির দয়া করে নামালেন সবার পরে। না না, তার ফ্যামিলিই নেমেছে সবার পরে।
নেক্সট বেড়ানোর ভেন্যু খোঁজা হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন ধারে কাছে যাবো। কেউ কেউ প্রস্তাব করেছেন মনটাকে যাওয়ার। মন্দ নয় মনটাক। আমি যেহেতু যাইনি, গেলে আরো একটি শীর্ষ ভেন্যুতে পা রাখা হবে।
দেখা যাক।

Share.

মন্তব্য করুন