যখন হাতে কাজ ওঠে না অথচ জমে থাকা কাজের স্তূপ শেষ করতেই হবে, এরকম সময়গুলোতে আমি সাধারণত ধর্মীয় আলোচনা, টেডটক বা পডক্যাস্ট বেছে নিই। শুনতে শুনতে কখন কাজগুলো ফুরিয়ে যাবে অথচ আমি টেরও পাবো না উদ্দেশ্য এমন। ওয়ান ফাইন মর্নিং হাজার হাজার শব্দের প্রুফ দেখার সময় আসেনা তাহিরকে পেয়ে যাই একটা পডক্যাস্টে। একজন কিশোরী। বাড়ি তার চীন দেশে; শিংজিয়ানের উরুমচিতে। শিংজিয়ানের উত্তর-পশ্চিমের উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের রাজধানী হলো এই উরুমচি। তবে মেয়েটির ভাষা চায়নিজ না। তুর্কি শেকড় থেকে আসা উইঘুরে সে কথা বলে, অর্থাৎ উইঘুর তার মাতৃভাষা।
আসেনা তাহিরের নিজেকে দাদীমা মনে হয়। একটি কিশোরী কেন নিজেকে এতটা অভিজ্ঞতালব্ধ পরিপক্ব ভেবে নেবে- এই পর্যায়ে এসে মনোযোগকে তীক্ষè করে নিলাম। আজকালকার কিশোর-কিশোরীদের একটা বড় অংশ যখন ফ্যাশন, কাপড়-জামা, টিকটক নিয়ে মশগুল তখন মেয়েটা কেন উল্টো পথে যাত্রা করলো জেনে নিতে ইচ্ছে হলো।
চীন সরকার তো বছরের পর বছর ধরে তারই জনগণকে নিপীড়ন করে আসছে, বন্দী করছে ক্যাম্পের নরক আঁধারে, কিন্তু খুব অল্পসংখ্যক মানুষই পালিয়ে বাঁচতে পেরেছে। পৃথিবীকে জানাতে পেরেছে আরেক সমান্তরাল পৃথিবীর গল্প। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দ্য এক্সপেরিমেন্টে; গণহত্যা থেকে বাঁচতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যাওয়ার, নতুন জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার, শরণার্থী হওয়ার শোক এবং অপরাধবোধের সঙ্গে মোকাবেলা করার আপ্রাণ চেষ্টার গল্প বলছিল আসেনা তাহির।

পডক্যাস্টে পজ দিলাম একটু। শরণার্থী জীবনটা আসলে অদ্ভুত রকমের শোকেরও। গ্রাস করে সেখানে তীব্র অপরাধবোধ। আমি জার্মানিতে থাকি। এ দেশে যেহেতু সিরিয়া, ফিলিস্তিন, ইরাকসহ বিভিন্ন দেশের প্রচুর শরণার্থী বাস করে তাই কাছ থেকে দেখা হয়েছে তাদের জীবন, শোনা হয়েছে তাদের সংগ্রামের গল্প। অপরাধবোধের এমন অনুভূতির সাথে কিছু পরিচয় তাই আছে। প্রাণ বাঁচাতে প্রাণেরই জন্মভূমি ছেড়ে আসা কি খুব সহজ? অযুত নিযুত ঝড় পেরিয়ে অন্যের শহরে এসে শূন্য থেকে জীবন শুরু করার অনিশ্চয়তা- সঙ্গে আগুনের কড়াইতে পুড়ে ছাই স্বদেশের জন্য প্রতিদিনের অশ্রু, দেশটিকে এভাবে রেখে আসা, কিচ্ছু করতে না পারার আত্মগ্লানি যে অসহনীয়!
উইঘুর কবিদের বেশ কিছু কবিতা কয়েক বছর আগে পড়েছিলাম। ২০১৭ সালের পর থেকে কত পলাতক মানুষের সাথে তাদের অধিকাংশ স্বজনেরই কোন যোগাযোগ নেই! দুর্ভোগে-দুর্যোগে এতটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে, তবু শান্তির দেখা মেলেনি। তারা জানেন না কিভাবে- কেমন আছেন তাদের স্বজনেরা। প্রায়ই ফিরে যেতে চান সেই দুর্দশাক্লিষ্ট ভূমিতে। মাতৃভূমির বিপদাপন্ন স্বজাতির জন্য কিছু করতে না পারার আক্ষেপ তাদের তীব্র হতাশায় ফেলে দেয়। যন্ত্রণা উপশমের জন্য তারা কবিতার আশ্রয় নেন দিনের পর দিন। বর্তমানে তুরস্কে বসবাসরত কবি আবদুল এহেদের কবিতায় পড়েছিলাম-
‘টিকেট কিনে ফেলবে যে গোঙানি, তাতে আমার অকুণ্ঠ ঘৃণা
লটবহর টেনে চলবে যে অবিরাম অশ্রু বিসর্জন, তাতেও আমার অকুণ্ঠ ঘৃণা
গোটা হৃদয়ের দখল নিয়ে নেবে সে শোক
শিরা-উপশিরাদের দেবে অব্যাহতি আর শিথিল করে দেবে সমূহ ভয়
আর আমার মাথার ওপর যখন ব্লক ব্যাগটা কেমন চিৎকার করে উঠবে ‘উরুমচি’ বলে!
এটা তো কেবল মায়ের কবরের কাছে ধেয়ে যাওয়া আমার কাফনটাই
এর চেয়ে প্রশান্তিময় প্রত্যাবর্তন আর কোথায় থাকে!
আমার সকল ইচ্ছের নির্মম অনুমোদন হয়ে যাবে
চূড়ান্ত মৃত্যুর আগে।’
কবিতার লাইনগুলো পড়ে বাস্তুচ্যুত মানুষের যন্ত্রণা আরও উপলব্ধ হয়েছিল আমার।
আসেনার গল্পে ফিরি আবার। নামটা উইঘুরদের ভেতর বেশ প্রচলিত। এই নামের অর্থ- এক মেয়ে নেকড়ে, যে কিনা তুর্কিদের মা। যুক্তরাষ্ট্রে আসেনার ক্লাসের বন্ধুরা বলে, সে যথার্থই অশীতিপর বৃদ্ধদের মতন করে চিন্তা করে, কথা বলে। কারণটা আসেনা নিজেই বলে দিল। সে যা নিয়ে চিন্তা করে তার সিংহভাগ জুড়েই আছে উইঘুররা, গণহত্যা, আন্তর্জাতিক নীতি নিয়ে প্রশ্ন। প্রায় অসম্ভবকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে আসা জীবন নিয়ে ভাবনায় মগ্ন থাকার অভ্যাস তার।

আসেনার মত ১২ মিলিয়ন উইঘুর মুসলিম বছরের পর বছর ধরে চায়নিজ সরকারের চরম নজরদারির মধ্যে আছে। রাষ্ট্রীয় বয়ানে চীনদেশে উইঘুরদের তেমন অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। আসেনা জানালো যে, সে চায়নিজ ডাইনেস্টি নিয়ে পড়তে, ছবি দেখতে পছন্দ করে অথচ চায়নিজরা উইঘুরদেরকে নিজ সংস্কৃতির কিছুই শেখায় না। উরুমচির ক্লাসরুমে মাত্র কয়েকটি প্যারাগ্রাফে উইঘুর ইতিহাস পড়ানো হতো। চায়নিজ টেক্সটবুকে উইঘুর হচ্ছে এমন এক অঞ্চল যেখানে বেশ ফল-সবজি ফলে। সবাই সেখানে নাচতে জানে, গাইতে জানে। ব্যাস এতটুকুই। আসেনা আরও জানায়, ‘এগুলো নিছক তাদের কল্পনা। তারা উইঘুরদের কিছুই জানে না। আমরা আগুনকে ঘিরে নাচি না। কয়েক দশক আগে হয়ত এমন ছিল কিন্তু এখন আর তেমন না।’
কেবল উইঘুরদের ভেতর যতদিন আসেনার গণ্ডি ছিল, সে তেমন জটিলতা ধরতে পারত না। কিন্তু উরুমচি ছাড়ার পরই গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারল, বেইজিংয়ের মত জায়গাগুলোতে হান চাইনিজরা আসলে নিজেদের থেকে তাদের অনেক ভিন্ন মনে করে। বিদেশী মনে করে, এলিয়েনের মত মনে হয় তখন নিজেকে। চায়নিজ মিডিয়া উইঘুরদের পরিচয় করিয়ে দেয় উগ্র ধর্মবাদী গোষ্ঠী হিসেবে, নিষ্ঠুর হিসেবেও। যারা কোনদিন শিংজিয়ান যায়নি কিংবা এই ধরনের বাজে রাজনীতি নিয়ে গভীর ভাবনা ভাবে না তারা মিডিয়া বা টেক্সটবুক যা আওড়ায় তাইই বিশ্বাস করে। বিষয়টা খুব পীড়াদায়ক। মিডিয়ার বর্ণনায় উইঘুর শব্দটি কেবল ফলখাদক, আগুনকে ঘিরে বৃত্তাকারে নাচতে থাকা নর্তক-নর্তকী, গানওয়ালা, সেই সাথে নিষ্ঠুর নৃশংস, উগ্র ধার্মিক, জাতিগত সংখ্যালঘুর ভেতরেই সীমাবদ্ধ।
আসেনার মনে প্রশ্ন এবং ক্ষোভ দানা বাঁধে। ‘আমরা কি কিছুই করি না? কেন আমরা আর কিছুই করতে পারি না? এ ধরনের প্রচারণা এক ধরনের অস্বস্তি এবং অনিরাপত্তাবোধ থেকে আসে বলে আমার মনে হয়। এই ধরনের প্রচারণার উদ্দেশ্য আমাকে আমার দেশে অনাহূত মনে করানো। তাই আমি অবাক হই না। আমার বরং হাসি পায়। আক্ষরিক অর্থেই তারা এমনভাবে আমাদের নিয়ে কথা বলে যেন আমরা বহিরাগত। এইসব ছোটখাটো বৈষম্যে অভ্যস্ত আমরা। অভ্যস্ত বাঁধাধরা চিন্তায়। এগুলো সাধারণ বিষয় হিসেবে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু বিষয়টা যখন এথনিক ক্লিনজিং এর দিকে গড়ায় তখন তা ভয়াবহ এবং দুঃসহ।’
২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো আসেনা একটি ফ্যাক্টরিতে উইঘুরদের বিরুদ্ধে এক সাজানো অভিযোগের কারণে সৃষ্ট সংঘাত এবং তার ফলাফলের সাক্ষী হলো। ভিত্তিহীন সেই গুজবের প্রতিক্রিয়ায় হান কর্মীরা তাদের বেশ কয়েকজন উইঘুর সহকর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করে। ঘটনাটি আসেনার নিজ শহর উরুমচিতে বিক্ষোভের জন্ম দেয়। বিক্ষোভ শুরুতে শান্তিপূর্ণ ছিল, কিন্তু এরপরেই সহিংসতার সূত্রপাত ঘটে।

বিদ্বেষ একদম চূড়ান্ত রূপ নিলো ২০১৭-তে। আসেনার শহরেই একশ মিটার পর পর পুলিশ ফাঁড়ি নির্মিত হলো, দশ মিনিট দূরত্বের স্কুলে যেতে সাঁজোয়ায় দাঁড়িয়ে থাকা সেনাদের তীক্ষè নজরের প্রাত্যহিকতা ভীষণ বিব্রত করত তাকে। ক্যামেরা বসানো হলো প্রচুর। আসেনা জানায়, ‘আমাদের জীবনের প্রতিটি পর্যায়ের সাথে জড়িয়ে গেল ক্রমাগত আঙুলের ছাপ দেয়া, আমাদের ঘরগুলোতে- টেলিফোনে আড়িপাতা হতে লাগলো নিয়মিত, তাই বাড়ির ভেতর রাজনীতি নিয়ে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেল। আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লাম। যারা এসবের প্রতিবাদ করার মত ছিল সবাইকে বন্দী করা হল। উইঘুরেরা গুম হতে শুরু করল ২০১৭ সাল থেকেই। প্রথম টার্গেট ছিল ধর্মীয় ব্যক্তিরা। তাদেরকে রাষ্ট্র বিভাজনকারী সন্দেহ করা হতো। কেন্দ্রে ঢুকিয়ে প্রচারণা চালানো হতো যে তাদের শিক্ষিত করা হচ্ছে; চাইনিজ ভাষা-সংস্কৃতি-ধর্ম শিক্ষায় শিক্ষিত। শেখা শেষ হলে সমাজে আবার পাঠিয়ে দেয়া হবে। কিন্তু মাসের পর মাস যায়, কেউ আর ফেরে না।’
এমনকি আসেনার ক্লাসরুমেও ক্যামেরা লাগানো ছিল। ক্লাসমেটদের সবারই কোন না কোন নিকটজন বন্দী ছিল। তাদের চিৎকার করে কাঁদার জায়গাটুকুও ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছিল।

২.

উইঘুরদের ইতিহাসে কবিতার স্থান এর আগে এতটা ছিল না। কবিতা উইঘুরদের নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়ালো ঠিক তখন থেকে, যখন থেকে তারা নির্যাতিত তো বটেই; নিশ্চিহ্ন হতে লাগলো। দশজন জীবিত উইঘুর কবিদের যদি তালিকা করা হয় তবে তাদের ভেতর একজন হবেন কবি তাহির হামুত ইযগিল। কবি তাহিরের জন্ম কাশগরে। একসময় ম্যান্ডারিন ভাষা শেখাতেন উরুমচিতে। বেইজিংয়েও কাজ করেছেন। ১৯৯৬ সালে তুরস্কে পড়াশোনার জন্য যাবার প্রাক্কালে গ্রেফতার হন। তিন বছর জেল খাটেন। উরুমচি এবং তারপর কাশগরের কাছেই এক বাধ্যতামূলক শ্রমশিবিরে তাকে রাখা হয় রাষ্ট্রীয় গোপন বিষয় ফাঁস চেষ্টার অভিযোগে। সুতরাং রাষ্ট্রীয়ভাবে দণ্ডিত কবি তাহির। লক্ষ লক্ষ উইঘুরদের মত রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সন্ত্রাস এবং প্রযুক্তিগত নজরদারির শিকার কবি তাহির আর তার পরিবার।
উইঘুরদের ওপর গোপন নজরদারির মাধ্যমে তাদের স্বাভাবিক ধর্মপালনকে অস্বাভাবিক হিসেবে দেখানো হয়, এমনকি বাসায় মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থ কুরআন রাখা, পোশাক, দাড়ি এসবের কারণে নানা রকম অপবাদ দেয়া হয়। এই ধরনের প্রচারণার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হচ্ছে জুলুম বৈধতা পেয়ে যায়। কারো ওপর জুলুম করার আগে-পরে যখন প্রচার করা হয় ব্যক্তিটি উগ্র ধর্মবাদী, তখন সেই জুলুম জনসাধারণের কাছে বা রাষ্ট্রীয়-আন্তর্জাতিক নানান পর্যায়ে আর তেমন অন্যায্য মনে হয় না।
বছর কয়েক আগে কবি তাহির হামুত ইযগিল মার্কিন মুল্লুকে পালিয়ে আসতে পেরেছিলেন সপরিবারে। বর্তমানে পরিবর্তিত জীবন নিয়ে যুদ্ধ এবং মিলিয়নেরও বেশি উইঘুর গিলে খাওয়া ইন্টার্নমেন্ট ক্যাম্প সম্পর্কে পৃথিবীকে সচেতন করার জন্য, উইঘুরদের মুক্তির জন্য কলমযুদ্ধ করে যাচ্ছেন। কবি তাহিরের লেখা একটি কবিতা পডক্যাস্টে পড়া হয়েছিল। কবিতার নাম অংল্কহধ। বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের জন্য কবিতাটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি আমি।

আমার দেহের একটি অংশ
ছিঁড়লো যেন
হাড়ের একটি খণ্ড আমার
ভাঙলো যেন

আমার প্রাণের কণাটুকু যেন
নির্মিত হল আবার
ভাবনার আগল খুলে গেল আহা
রুগ্ন হাতে তার!

সময়ের রেখা বাড়লো কেবল
তারই কৃষ্ণ চোখে
প্রস্তরীভূত সত্য ভাসলো
সরু গ্রীবা সম্মুখে।

গাঢ় ত্বকে আলগোছে আছে
খুব সূক্ষ্ম কেশের দাগ
আঁকা হলো তাতে পুষ্প প্রসূন
ভূমিচিত্রের ভাগ।

আমার কপোলে বৃষ্টি ফোঁটা সে স্বচ্ছ
যতটা স্বচ্ছ অনাগত রাতদিন
বন্ধন চেনে অখণ্ডতা,
রক্ত দলিল আসমানে লেখা,
পূর্বাভাস তো ইতিহাসে দেখা,
চিরকাল অমলিন।

আমার কবর ফলকে আদর মাখে
আমার লাশটি মায়ায় জড়িয়ে রাখে
সওগাত সে তো, পরম ভাগ্যে পাওয়া

সে বিরাগদিনের দুর্ভাগা কোন মন্ত্র
তার মাঝে পাই আপন সৃষ্টিছন্দ
সৃষ্টির ধারা বইবে শিরায় রক্তে
কন্যা আমার, আমার কন্যা সে।

৩.

পডক্যাস্ট শেষ হল, হাতের কাজও ফুরিয়ে এলো। নিঃশ্বাস ছেড়ে খোলা বাতাসে বসতে গেলাম, লক্ষ্য করলাম শ্বাস একটু ভারী। কিছু একটা কোথাও দলা পাকিয়ে আছে। এক ধরনের আক্ষেপ এবং দুঃখবোধ থেকে পালাতে পারছি না। আমার মনে হলো, নিরাপদে বেঁচে থাকা এবং নিজেদের সভ্য হিসেবে দাবি করা অগণিত মানুষ আজও শরণার্থী- অভিবাসন এসব শব্দের অর্থ যেমন বোঝে না, বাস্তবতাও বোঝে না। স্বাভাবিক জীবন-যাপন করা এই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষেরা অবিবেচকের মতন রিফিউজি রিফিউজি তামাশা করে যায়। কারো ওপর রাগ হলে গালি দেয় রিফিউজি, কারো সাথে মজা নিতে ইচ্ছে হলে বলে রিফিউজি। শবাগার থেকে ফেরা, ঘরভাঙা, স্বপ্নভাঙা এইসব জীবনের ভার তাদের কাছে গৌণ ভীষণ।
আমি ক’বছর আগে বাংলাদেশে গিয়ে শুনতে পাচ্ছিলাম যে মানুষ গালি দেয়ার জন্য রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করছে। রোহিঙ্গা গালি (?) আস্তে আস্তে ভাইরাল হচ্ছে তখন। রোহিঙ্গা কারা? রোহিঙ্গারা এথনিক ক্লিঞ্জিংয়ের শিকার বিপদাপন্ন মানুষের দল, বিশ্বের অন্যতম নির্যাতিত সংখ্যালঘু। নিজের জন্মভূমি থেকে পালিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে ঠাঁই না মেলা- বারবার পুশ ইনের শিকার নৃতাত্ত্বিক মানবগোষ্ঠী। যাদেরকে, যাদের অবুঝ শিশুদেরকে আগুনে ছুঁড়ে ফেলেছে উগ্র বার্মিজ সামরিক জান্তা অথবা থেরাভেদাপন্থীরা। উগ্র জাতীয়তাবাদ আর ধর্মভিত্তিক রোষে যাদের ছোট্ট শিশু নাফ নদীতে ভাসতে থাকে।
রোহিঙ্গাদের একটা অংশ ড্রাগ ডিলিংয়ে জড়িত, তারা কেউ কেউ মারকুটে, তারা কেউ কেউ বঞ্চিত বিধায় অপরাধপ্রবণ এগুলো সত্যি কথা। এসব তো সব জাতির ক্ষেত্রে ঘটে। অভিবাসী নয়- নিজ দেশে বসবাস করছে এমন মানুষেরা অপরাধে জড়ালে আমাদের অভিব্যক্তি কি এমনই হয়? বরং বাস্তচ্যুত ক্লিষ্ট চেহারা, অপুষ্টিতে ঝাঁজরা, দেখতে এস্থেটিক না- কেমন যেন আধমরা; এসব কারণে কাউকে পছন্দ না হলে গালি দেয়া হয় ‘রাহিঙ্গা’।
ঘিঞ্জি নর্দমাপুষ্ট বৈরি গলিতে বেড়ে উঠতে থাকা শিশুটিকে ‘বিহারি-বিহারি’ খিস্তি করা হয়। যাদের মালাউন আর গোখোর গালি দেয়া হয়, এনাদেরই কাউকে হয়ত পরিবারশুদ্ধ পুড়িয়ে মারা হয়েছে, রাইফেল তাক করে গুলিতে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে আবার কাউকে ট্রেন থেকে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে।
স্নাইপারের বিপরীতে পাথর হাতের ফিলিস্তিনিদের সন্ত্রাসী ডাকা হয়, ছররা কার্তুজের লক্ষ্যবস্তু সমুদয় কাশ্মিরিদের ডাকা হয় বিচ্ছিন্নতাবাদী, কাউন্টার এক্সট্রিমিজম (?) সেন্টারে আটকে থাকা দশ লাখেরও বেশি উইঘুরদের জীবনের মূল্য নিয়ে খুব বেশি মানুষ কি আসলে ভাবছে?
কিছুদিন আগে শীতকালীন অলিম্পিক বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয়েই গেল। অথচ এই অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই স্থাপিত আছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। বিশ্বযুদ্ধের ভয়াল ইতিহাস যারা কিছুটা হলেও জানি, তারা এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্প কতটা নির্মম নিশ্চয়ই বুঝতে পারি। পৃথিবীর সকল সভ্য মানুষ কি আঙুল তাক করেছিল সেদিকে? এই যে এখন সোশ্যাল মিডিয়ায়, ইলেকট্রনিক প্রিন্ট মিডিয়ায়- রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ দেখতে পাচ্ছে পৃথিবী। ইতোমধ্যে যুদ্ধের প্রভাব ইউরোপসহ বিশ্বের এখানে-সেখানে পড়ে গিয়েছে। প্রতিদিন কোলেটারাল ড্যামেজের নামে কত মানুষ মরছে, গৃহহীন হচ্ছে, সীমান্ত পাড়ি দিতে বাধ্য হচ্ছে এসবের সাক্ষী তো আমরাই। আচ্ছা, উদ্বাস্তুদের জীবন নিয়ে তামাশা রসিকতা আসলেই কি করা যায়?

Share.

মন্তব্য করুন